কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / তৃতীয় সংখ্যা / ১২৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / তৃতীয় সংখ্যা / ১২৩

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

শিবাংশু দে

 

শ্যামলবাবুকে যা বলা হয়নি

 


তেইশ বছর আগে সেপ্টেম্বরের চব্বিশে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গিয়েছিলেন। নেহাত অকালেই। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো একানব্বই। এতো আগে চলে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। তবে সব কিছুর 'মানে' কে’ই বা আর বুঝতে পারে?

কিশোরকালে দেশভাগের পর ওপার বাংলা থেকে যখন তিনি এদেশে এসে পৌঁছোন, ভায়া শেয়ালদা রেলস্টেশন, তার আগে যুদ্ধ দেখে এসেছেন। এদেশে ইশকুল, কলেজ, ছাত্র রাজনীতি, মিছিল, গুলি, কলেজ থেকে মাঝপথে বিতাড়ন, লোহাকলে ফার্নেস হেল্পার হিসেবে গলন্ত ইস্পাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে 'লিখিবার হল তাঁর সাধ'। 'সাধ'টি ছিলো আগে থেকেই, কলকাতায় এসে তা ঘনত্ব পেলো। সেকালের কলকাতার সাহিত্য জগৎকে তিনি দেখেছিলেন এভাবে,

'এই সময় সেনেট হলে একটি কবি সম্মেলন হয়। তাতে আমাদের বয়সী অনেকে কবিতা পড়ল। তারা ধুতি-পাঞ্জাবি বা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে। একে অন্যকে আপনি-বাবু বলে ডাকে। একসঙ্গে কথা বলতে হলে চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। সিগারেট ধরায়। পকেট থেকে কবিতা বের করে।

এদের দেখা পাবার জন্যে মর্নিং শিফটের পর হাওড়া লাইনের সেই কারখানা থেকে কলেজ স্ট্রিটে যেতাম।  ওদের সঙ্গে বসে আত্মীয়তা বোধ করতাম। যদিও এখন জানি, কোন কারণেই আত্মীয়তা বোধ করে পুলকিত হওয়ার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু তবু হতাম।'

প্রথম দর্শনে কলকাতাকে তাঁর খুব 'নিষ্ঠুর' মনে হয়েছিলো। এখনও এ শহরে যেসব নবীন যশোপ্রার্থী 'লেখালেখি' করার বাসনা নিয়ে আসেন, তাঁদেরও সে রকমই লাগে। প্রথম লেখাটি ছাপা হবার পর তাঁর অবাক লেগেছিলো। মনে হয়েছিলো, 'ও, তাহলে এই ভাবে লেখে!

তবে পরবর্তীকালে বারবার বলেছিলেন, 'সব দিক থেকে 'অপমানের ঝাপটা' আর 'ব্যর্থতার বাতাস' তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে এসেছে সেকালে। বন্ধু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, 'তুই একদম বানাতে জানিস না। তোর কোন ইমাজিনেশন নেই।'

কিছুদিন আগে শ্রদ্ধেয় গল্পকার অমর মিত্র একটি আসরে বললেন, এখন যাঁরা বাংলা গল্প লিখছেন, তাঁরা কি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প পড়েন? পরবর্তী প্রজন্মের কেউ কেউ বললেন কিছু পড়েছেন। তবে মনে হলো সে পর্যায়ের তন্নিষ্ঠ শ্যামল-পাঠ কম গল্পকারই করেন এখন। পিছিয়ে যেতে হলো  আধ শতক আগে। ইশকুল পেরিয়ে তখন প্রথম কলেজে গেছি। তিন নবাগত 'ব্রাহ্মণ', সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পাঠক জয়ের যুদ্ধ চালাচ্ছেন। 'একা এবং কয়েকজন', 'যাও পাখি' আর 'কুবেরের বিষয়আশয়' নিয়ে আসরে নেমে এসেছেন তাঁরা। লোকে নতুন গদ্যের স্বাদ পাচ্ছে। বাংলা ফিকশনে তিন 'বাঁড়ুজ্যে'র পর তৈরি হওয়া এক নতুন ত্রিভুজ। গদ্য ও আখ্যান শৈলীর অন্য প্রসঙ্গগুলি ছেড়ে দিলেও বলা যায় এই তিনজন তিন ধরনের নতুন বাংলা গদ্যভাষা তৈরি করেছিলেন। পাঠকের বিচারে ভালো বা ততো ভালো নয় এমন পক্ষপাত থাকতেই পারে। কিন্তু ঘটনা হলো পরবর্তীকালে যাঁরা মূল স্রোতের বাংলা ফিকশন লিখতে ব্রতী হয়েছেন, এঁদের গদ্যশৈলী এড়িয়ে যেতে পারেন না। এঁরা কমলকুমার, অমিয়ভূষণ বা নবারুণের থেকে আলাদা। একেবারে আলাদা। কিন্তু তাঁদের বিক্রমকে অস্বীকার করতে চাওয়া এক ধরনের ছেলেমানুষি। গা-জোয়ারি বলা যায়।

কিশোর বয়স থেকেই শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এমনিতেই পড়ি। সময় পেলেই। একেবারে বাল্যকালে 'দেশ' পত্রিকায় একটি উপন্যাসের হেডপিস দেখতুম। একটি উল্টো হাতের পাঞ্জার স্কেচ। নাম, 'কুবেরের বিষয় আশয়'। লেখক, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। তখনও পড়ার বয়স হয়নি। পড়তুমও না। তবে চমকপ্রদ নামটা স্মৃতিতে থেকে গিয়েছিলো। তাঁকে আমার প্রথম পড়া একটি গল্পসংগ্রহের মাধ্যমে। তখন আমি বোধহয় দশ ক্লাসে। শুরু থেকেই আমি তাঁর নিবিষ্ট পাঠক।

কলকাতার ঘিঞ্জি এজমালি পারিবারিক আবাসে তাঁর লেখালেখির ন্যূনতম জায়াগা ছিলো না। প্রেসে বসে লিখতেন। নয়তো অন্য কোথাও। ষাট সালে বিবাহ, একষট্টিতে বাবা হওয়া। আনন্দবাজারের চাকরি। শ্যামল-পত্নী ইতি গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন,

'ক্ষুধার্তের মতো শ্যামল লেখার জায়গা খুঁজছিল একটা। তার সঙ্গে হয়তো খুঁজছিল লেখার নতুন বিষয়ও। কারণ, এই সময় থেকেই তো ওর মধ্যে একটু একটু করে চাড়িয়ে উঠছিল জমির নেশা।'

(আমার শ্যামল - ইতি গঙ্গোপাধ্যায়)

পঁয়ষট্টি সাল থেকে তিনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গ্রামীণ প্রান্ত চম্পাহাটিতে জমিজমা কেনা এবং বাড়ি বানানো শুরু করেন। সাতষট্টিতে কলকাতা ছেড়ে সেখানে নিজের বাড়িতে থাকা। তাঁর সঙ্গে সেখানে জমি কিনতে শুরু করলেন অন্য লেখক বন্ধুরাও। মতি নন্দী, কবিতা সিংহ, সন্তোষকুমার ঘোষ, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, আরও অনেকে। এরকম সময়ে  তিনি একটি উপন্যাস লেখা শুরু করলেন। এক বন্ধুর পত্রিকায়। নাম, 'গণেশের বিষয় আশয়'। উপন্যাস তিন কিস্তি প্রকাশিত হবার পর পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলো। সাগরময় ঘোষ তাঁর কাছে 'দেশ' পত্রিকার জন্য ধারাবাহিক উপন্যাস চাইলেন যখন, শ্যামল অসমাপ্ত উপন্যাসটিই ঈষৎ নাম বদলে লেখা শুরু করে দিলেন। রচনাটি সে সময়  বিশেষভাবে জনআদৃত হয়। 'কুবের বিষয় আশয়' এভাবেই এসেছিলো। কিছুদিন পরে হঠাৎ আদেশ আসে চার কিস্তির মধ্যে লেখাটি শেষ করে দেবার জন্য। শ্যামল খুব আঘাত পেয়েছিলেন। পরে একটি স্মৃতিচারণে পাই,

'সাপ্তাহিকে বেরোবার সময় সম্পাদক ওটাকে উপন্যাস বলেই গণ্য করেননি। ক্ষমা-ঘেন্না করে বিজ্ঞাপন করতেন: ধারাবাহিক রচনা। আচমকা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, আর চার কিস্তির ভেতর শেষ করে দাও।

তাই শেষ করেছিলাম। সেই সম্পাদক বারো বছর পরে সেদিন বললেন, কী বই লিখেছিলে। ক্লাসিক। আমি ধন্য হয়ে কৃতার্থের হাসি হেসেছিলাম।'

'শাহজাদা দারাশুকোহ'-কে যদি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যতিক্রমী সৃষ্টি হিসেবে গণ্য করি তবে তাঁর বাকি রচনাগুলির মধ্যে স্পষ্ট আত্মজৈবনিক ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাঁর বিশ্রুত ত্রয়ীর মধ্যে দুটি, 'কুবেরের বিষয় আশয়' এবং 'ঈশ্বরীতলার রূপোকথা'র পটভূমি তাঁর গ্রামীণ বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে। তৃতীয় উপন্যাসটি 'হাওয়াগাড়ি', যার পটভূমি মহানাগরিক। এছাড়া তাঁর অধিকাংশ গল্প ও উপন্যাসের আধার গ্রামীণ, কৃষিভিত্তিক চালচিত্রের অংশ। এ বিষয়ে তাঁর অবস্থান এই রকম,

'৩২-৩৩ বছর বয়সে এমন একটা গাঁয়ে গিয়ে বাসা বাঁধলাম, যেখানটায় বিদ্যাধরীর বন্দী জল প্রায় চল্লিশ বছর আটক থেকে সব রকম গতি রুদ্ধ করে রেখেছিল। জল নিকাশের পর সেখানে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হচ্ছিল।

এমন জায়গায় একদিন শীতের বিকেলে বোরো ধানের বীজতলা করা হচ্ছিল। চাষী ফকিরচাঁদ ডুবন্ত সূর্যের দিকে মুখ করে তিন দিনের অঙ্কুরিত ধানবীজ হাতের বিশেষ প্রক্রিয়াতে পাঁক মাটিতে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। সেগুলিই পরে ধানচারা হয়ে দাঁড়াবে।

বললাম, এ-রকম শিখলি কোথ্থেকে ফকিরদা?

ছোট ঠাকুদ্দার কাছ থেকে।

আমি সেই বিকেলে পরিষ্কার দেখতে পেলাম, আমাদের বীজতলায় খানিক দূরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফকিরচাঁদের ছোট ঠাকুদ্দা, তস্য ছোট ঠাকুদ্দা, তস্য ছোট ঠাকুদ্দা-। এরই নাম বোধ হয় সভ্যতা। এসব জিনিস বোঝা এক জিনিস। আর ফুটিয়ে তোলা আরেক জিনিস। বিশেষ করে পাঠকের মনে সঞ্চারিত করা’।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের যাবতীয় সৃষ্টির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত যাপন ও অভিজ্ঞতা ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকে। তিনি শুধু মনোজগতের কথাকল্প নিয়ে আখ্যানরচনা করতেন না। তাঁর সমস্ত কথানির্মাণের সঙ্গে তিনি শারীরিক অর্থেও তুমুলভাবে জড়িয়ে থাকতেন। অনেক বিদেশী সর্বকালের সেরা শব্দশিল্পীদের সম্বন্ধে যেমন শুনেছি, যথা, জ্যাক লণ্ডন, ম্যাক্সিম গর্কি, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ইত্যাদি বহু গরিমাময় নাম। সেই তালিকায় রয়েছেন আমাদের নিজস্ব সমরেশ বসুও। এঁরা সবাই তাঁদের লেখার বিষয়ের সঙ্গে একান্ত যাপন সমীকৃত না হলে লিখতে বসতেন না। যদিও অনেক খ্যাতনাম লেখক এই জাতীয় তত্ত্বে বিশ্বাস রাখেন না। তাঁরা মনে করেন আধেয়র সঙ্গে অতো লুটোপুটি না করেও বিশ্বাসযোগ্য সৃষ্টি করা যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে শ্যামল একবার বলেছিলেন,

'...কবি লিখছেন ধান করো। ধান করো। ধান একদা গণনাট্যের গান হয়েছিল। ট্রেনের জানালায় বসলে এই দৃশ্যই দেখা যায়। ধান, গরু, জল, মানুষ - এসব তো একই সুতোয় গাঁথা। একজন লেখক এ ব্যাপারটি কি এড়িয়ে চলতে পারেন? তাঁর শিক্ষায় এটা কি অবশ্য পাঠ্য নয়? এই তো তাঁর টেক্স্ট বুক। এ কথা কোন এক আড্ডায় বলাতে আমার খুবই প্রিয় একজন সমসাময়িক লেখক বলেছিলেন, না। ও সম্পর্কে লেখকের একটা রিমোট ধারণা থাকাই যথেষ্ট। আমি জানি, এই টেক্স্ট বইখানা পড়া থাকলে ওই লেখকের বিষয়বস্তু ও কলমের জাদু অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়াত। আমরা কেউ তাঁর সামনে এগোতে পারতাম না।'

তাঁর এই অবস্থানের বিপরীতে 'একদা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, হোয়াট ইজ লফটি ইন ইওর স্টেয়িং ইন এ ভিলেজ?' সন্তোষকুমার ঘোষ বলেছিলেন 'শ্যামল ধানের খেতে হারিয়ে গেছে।'

ফিকশন পড়া খুব কমে গেছে ব্যক্তি আমার। লেখালেখির জন্য যা কিছু পড়তে হয় তাই বেশ ভারি হয়ে যায়।  তবু মাঝে মাঝে বাংলা ছোটোগল্প পড়ে অক্সিজেন পাই। যাঁদের লেখা পড়ি, তাঁদের মধ্যে মধ্যে শ্যামল আছেন। যদি প্রশ্ন ওঠে, কেন? তবে বলবো সেই রিকশাওয়ালার প্রতি টান আছে আমার। যে বলে,

'ভগবানের কথা ভাবি। মাঝে মাঝে রিকশা চালিয়ে ভগবান দেখতে বেরোই।'

সেই লোকটিকে শ্যামল ধরে আনেন আমার কাছে,

'...ভাবতে অবাক লাগল। একটা লোক ভগবান দেখতে প্যাডেল করে রিকশা নিয়ে উত্তরে যায়, দক্ষিণে যায়। গল্প লিখলাম - চন্দনেশ্বরের মাচানতলায়।'

তাঁকে নিয়ে একটা কিছু লিখবো সে রকম কিছু ভাবিনি।  সত্যি কথা বলতে ভাবতুম একটু সময় লাগবে। মনের মধ্যে  ইচ্ছে হয়ে থাকা লেখাটি পাতায় নামাতে সময় লাগবে। মনে পড়ে  বাংলা আখ্যানের যে ভঙ্গিটি  সিনেমার ন্যারেটিভ হয়ে উঠতে চায়, অনেক গদ্যকার সেকালে লড়ে যেতেন তাকে আয়ত্ব করার জন্য। মানে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে। বহু বাঙালি রসিক রহস্য ভরে বলতেন, লেখাটি পড়িনি। তবে  সিনেমা হলে দেখে নেবো।' সিনেমায় দেখতে পেলে বাংলা আখ্যান জাতে উঠে যায়।  যে সব ব্যাপারস্যাপার দেখতে বাঙালি  এখন 'রানি রাসমণি'র সামনে হাত জোড় করে বসেন। সাহিত্যপাঠের নিমগ্নতা হাইজ্যাক হয়ে যায় অনৃত ভাবালুতার কাছে।  শ্যামল সেটা করেননি। সজ্ঞানে না অবচেতনে, বলা মুশকিল। শব্দমালার  আকুল ফ্রেমে বাঁধা ন্যারেটিভে নিজেকে উদ্ধার করে আনার স্পৃহা ছাড়া শ্যামল ধরা দিতে চান না। কোনও চতুরতার স্পর্শে  মলিন হতে দেখিনি তাঁকে। তাঁর লেখা নিয়ে 'সিনেমা' হয় না। শেয়ালদা থেকে আঁধার রাতে ক্যানিং লাইনের শেষ ট্রেন ধরে শ্যামল টুক করে চম্পাহাটি নেমে যান যখন, মনে হয় এইতো 'যাওয়া'। এর সিনেমা হয় না।

পঞ্চাশ-ষাট দশকে বাংলা আখ্যান গদ্যের বাজার ছিলো 'কথক'দের দখলে। অনেকদিন ধরে গোছানো গল্পের স্রোতে ডুবে থাকা পাঠক তার বাইরে ভাবতে পারতেন না। মূলস্রোতের বাঙালি পাঠকের সাইকিটিই ছিলো  কথকতার। বাংলায় সেকালের সফল লিখিয়েরা সবাই যেন কথকঠাকুর। যেমন ধরা যাক, বিমল মিত্র। নাক উঁচু পণ্ডিতরা তাঁকে খুব হ্যাটা করতো। এখনও করে। অথচ ভাষার উপর তাঁর দারুণ দখল। প্লটের পর প্লট নিপুণভাবে গেঁথে যান। চরিত্রদের খেলাতে পারেন। অতো অতো লিখতে পারেন। আর রয়েছে সহজাত গল্প বাঁধার কৌশল। কিন্তু বাংলায় 'উপন্যাস' নামক নির্মাণটি, যেটা সম্ভবত বিলিতি নভেল থেকে ধার করা, চারিত্র্যে একেবারেই আলাদা। তা বলে কি তিনি 'লেখক' ন'ন? তিনি তো একজন অখিল ভারতীয়  'ট্রেন্ডসেটার' ছিলেন। শরৎচন্দ্রের পর তাঁর লেখাই সব থেকে বেশি অনূদিত হয়েছিলো। তাঁর লোকপ্রিয়তা অসাধারণ। কারণ, বাঙালির একটাই চাহিদা, 'গল্প ভালো, আবার বলো'। বিমল মিত্র যেন সেই সুবাদেই ছবি-করিয়ে-দের লেখক। কিন্তু কয়েকজন বাংলা কথাকার কথকতা করেন না। তাঁদের আখ্যান, সৃষ্ট চরিত্রগুলিকে এমনভাবে তৈরি করেন, অন্য কোনও শিল্পী তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। কেউ কখনও 'ঢোঁড়াই'য়ের সিনেমা বানাতে পারবেন কি? চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু কোনও বড়ো ছবিকর হলে সতীনাথ নয়, তাঁর নিজের 'ঢোঁড়াই'কে তৈরি করবেন। সেটা কোনও অবস্থাতেই 'সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ণ' হবে না। হবে না 'কুবেরের বিষয়আশয়' বা 'ঈশ্বরীতলার রূপোকথা' বা 'হাওয়াগাড়ি'। শ্যামল কথক ছিলেন না। তিনি মূলত কবি। আদি কবি।

একজন কথাশিল্পীর রাজনৈতিক বিশ্বাস শুধু ব্যক্তি নয়, তাঁর শিল্পকেও বুঝতে সাহায্য করে। একজন সিরিয়স পাঠক তা বিশ্বাস করেন। আগেও করতেন। কিন্তু শ্যামল ঘোষণা করেছিলেন,

'…আরও মুশকিলের কথা- আমার কোন রাজনৈতিক বিশ্বাস নেই। কোনদিন মনে হয়নি- অমুকে ক্ষমতাচ্যুত হলে এবং সে জায়গায় অমুক এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সর্বদাই জানি- রাষ্ট্র ও প্রশাসন মানে একটি অন্ধ, কবন্ধ দানব। সেজন্যে কেউ ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নয়। এটা একটা ব্যবস্থা বা প্রথা। এক সময় ছিল, যখন আমেরিকা পরমাণু বোমা ফাটালেই খবরের কাগজের প্রতিবাদ পত্রে আমরা সই দিতাম। রাশিয়াও যখন ফাটালো তখন কোন কোন রাজনৈতিক-বিশ্বাসী সমসাময়িক সই দিলেন না। তারপর সময় যেতে বুঝলাম- লিখতে হলে এই সইসাবুদ সর্বৈব বাজে ব্যাপার।'

এই স্বীকারোক্তি বিশ্লেষণ করলে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক অবস্থানটুকু অনায়াসেই বোঝা যায়। একজন বাংলা সাহিত্যপাঠক হিসেবে তার মধ্যে কোনও আপত্তিজনক, অস্বীকার্য তত্ত্ব পাইনি কখনও। ভিন্নমত হওয়া যায় হয়তো, কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। কারণ তাঁর সৃজন সত্ত্বায় মাটির থেকে রস আহরণের লক্ষণ অতি প্রত্যক্ষ। পাঠক আমার কাছে তিনি অপরিহার্য এক কথাকার হয়ে উঠতে পারেন।



ঠিক চার দশক আগে জামশেদপুরে একটি সাহিত্য সম্মেলনে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখোমুখি হয়েছিলুম। তখন আমি শহরের 'তরুণ তুর্কি'। নানা জায়গায় সুযোগ পেলেই (না পেলেও) রালফ ফক্স, কডওয়েল, কর্নফোর্ড, নেরুদা, এঙ্গেলস, লেনিন, গতিয়ে আউড়ে যাই। ভাবতুম, ‘The Novel and the People'-এর মানচিত্রের বাইরে আর কোনও দেশ নেই। এই সব ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ  লোকে শুনতে ভালোবাসতেন আমাদের শহরে। সেই সুবাদে সভার উদ্যোক্তারা আমার উপর একটা দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন। সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্যের পাঠক হিসেবে তার মধ্যে কী কী অসম্পূর্ণতা চোখে পড়ে সেই প্রসঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত করতে আমি আদিষ্ট হয়েছিলুম। কথা ছিলো সেই সভায় উপস্থিত দুই সাহিত্যরথী প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত এবং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় আলোচনাটি পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাবেন। সেকালে জামশেদপুরে প্রবুদ্ধ বাংলা সাহিত্য অনুরাগীর অভাব ছিলো না। অনেকে এসেছিলেন আলোচনার অংশভাগী হতে।

পাঠক হিসেবে তখন যেমন ভাবতুম সেই পরিপ্রেক্ষিতে মূল স্রোতের জনপ্রিয় বাংলা গদ্যসাহিত্য বিষয়ে (যাকে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'বাজার সাহিত্য' বলতেন) একটা পেপার পড়েছিলুম সেই  সভায়।  প্রতুলবাবু আমার বক্তব্য নিয়ে মোটামুটি একমত হলেন। সঙ্গে নিজের বক্তব্যও জানিয়েছিলেন পেশাদারি দক্ষতায়। গুছিয়ে। তারপর বলতে গিয়ে শ্যামলবাবু হঠাৎ রীতিমতো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। আমরা জানতুম তিনি বেশ খানিকটা প্রমত্ত অবস্থায় ছিলেন। তার উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণহীন 'বাঙালে' ক্রোধী স্বভাবটি পরিচিত জনের জানা থাকলেও সবাই তো জানতেন না। সব মিলিয়ে তাঁর বক্তব্যের মধ্যে সমকালীন বাংলা 'কথাসাহিত্য'-এর প্রসঙ্গ অবহেলিত হয়ে অসহিষ্ণু দোষারোপের পালাই প্রধান হয়ে উঠলো। 'খালাসিটোলা' সম্পৃক্ত মেধার অপচয় হেন। অহৈতুকী বক্তব্যের প্রতিবাদে বেশ কিছু সমাগত ভদ্রজনও বিরক্ত হয়ে তাঁর কাছে 'জবাব' চাইতে লাগলেন। ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া শুরু হতে আমার পিতৃদেব, যিনি সভা পরিচালনা করছিলেন, এ বিষয়ে আলোচনায় বিরতি টেনে দিলেন। শ্যামলবাবু রুষ্ট হয়ে তৎক্ষণাৎ সভা ত্যাগ করলেন।

তাঁর প্রতি ব্যক্তি আমার প্রত্যাশা ছিলো। প্রতীক্ষাও ছিলো। তাঁকে আমার অনেক কথা বলার ছিলো। তাঁর শিল্পের প্রতি আমার মুগ্ধতা জানানোর ছিলো। কিছুই হলো না শেষ পর্যন্ত। আর সুযোগও পাইনি। চাইবাসা বা গালুডি তাঁকে কেউ নিয়ে যায়নি কখনও। তাঁর আক্ষেপ ছিলো। লিখেও ছিলেন সেকথা। ভেবেছিলুম আমি নিয়ে যাবো। আমি সময় পেলুম না। তাঁরও সময় হলো না।

অন্যান্য সব শিল্পধারার মতো জনপ্রিয় বাংলা আখ্যানের ভঙ্গি বা শৈলীর মধ্যেও অনেক পরিবর্তন এসেছে গত চার দশকে। 'জীবনমুখী' গানের মতো 'সিনেমামুখী' সাহিত্যেরও  দিনাবসান ঘটেছে হয়তো। যাপনের গরমিল থেকে উঠে আসা দুঃখযন্ত্রণার রূপকথা এখন ক্যানভাস পাল্টেছে। সময় ও মূল্যবোধের প্রাসঙ্গিক মাত্রাগুলি বেশ পাল্টে গেছে গত চার দশকে। 'বই' থেকে আর 'বই' তৈরি হয় না। শুধু গল্পের টানে লেখার গুণ আর টানা যায় না। এখনই সময়। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়দের এখন জেগে ওঠার সময় হয়েছে আবার। এই কথাটি বলার সুযোগ আর হয়নি আমার। এখানেই বলে রাখি বাংলা সাহিত্য অনুরাগীদের জন্য।

(এই ছবিতে মঞ্চাসীন, ডানদিক থেকে আমার পরে পিতৃদেব ড. সত্যেন্দ্র দে, ডা.অজিতকুমার বাগচি, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, ড. প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত)

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন