কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / তৃতীয় সংখ্যা / ১২৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / তৃতীয় সংখ্যা / ১২৩

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী




(৩৬)

হৃদয় কথায় কথায় নির্মাল্যকে বলে, বাগানটা চালাতে আমাদের খুবই কষ্ট হচ্ছে। তুই যদি মাসে মাসে কিছু আর্থিক সাহায্য করিস খুবই উপকার হয়। নির্মাল্যর এখন টাকার অভাব নেই। চাইলেই ওর উদ্যোগে আবার ফুলের বাগানটা জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে। এখন সেটা ধুঁকছে। নির্মাল্য ভুরি-ভুরি প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যায়। একটা প্রতিশ্রুতিও রাখে না। কিছুই দেয় না সে। কিন্তু একটা জিনিস নিয়ে যায়। উপমাকে। শৈশব থেকে অভাব ছাড়া কিছুই দেখেনি উপমা। নির্মাল্য ওকে তাক লাগিয়ে দেয়। হৃদয়কে ভুলে যেতে ওর খুব একটা অসুবিধা হয় না।

কয়েকটা দিন খুবই মনের কষ্টে কাটে হৃদয়ের। সেই সময় একদিন একটা ঘটনা ঘটে। খুব ক্লান্ত হয়ে সমিধা একদিন হৃদয়ের বাড়ি আসে। হৃদয়ের মা ওকে হৃদয়ের ঘরে শুতে দেন। নিজের হাতে জানালাটা বন্ধ করে দেন। দরজাটা খোলাই থাকে। অন্ধকার ঘরে চোখ বুজে শুয়ে থাকে সমিধা। দুপুরবেলা ফেরে হৃদয়। নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়েই থমকে যায়। একটি মেয়ে শুয়ে আছে ওর খাটে। উপমা কি ফিরে এসেছে? কেমন একটা বিভ্রমের মতো হয় ওর। অনেকদিন উপমাকে ও স্পর্শ করেনি। ওর ভেতরে যেন ঝড় ওঠে। ছুটে যায় বিছানার দিকে। তারপর জড়িয়ে ধরে মেয়েটিকে। সমিধা চোখ খোলে। হৃদয়কে ঐ অবস্থায় দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। ছাড় ছাড় আমাকে, তুই ভুল করছিস। আমি সমিধা---

ভুল ভাঙে হৃদয়ের। কিন্তু সেই মুহূর্তে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেনা সে। একটা নারী শরীর কতদিন পরে। ওর যেন কিছুই করার থাকে না। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওইভাবেই আরও কয়েক সেকেণ্ড থেকে যায়। আর তখনই হাত বাড়িয়ে ঘরের টিউব লাইটের সুইচ পেয়ে যায় সমিধা। সেটা জ্বালায়। হৃদয় মাথা তুলে সমিধাকে দেখে। ভেবেছিল এবার অন্তত পেরে যাবে। সহ্য করা যাবে। কিন্তু আবার ওর সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে। সেই মুখ যা দেখলে ওর মধ্যে শুধু বিতৃষ্ণাই জাগে। ছিটকে সরে আসে সে।

সমিধা উঠে বসে এবার। তারপর বলে, কী করছিলি তুই?

আমি বুঝতে পারিনি। হৃদয় একরাশ সঙ্কোচ নিয়ে বলে।

আমার গলা তো শুনতে পেয়েছিলি। তার পরেও?

স্যরি। ক্ষমা চাইছি।

সমিধা কথা বাড়ায় না। পরে আগ্নেয়কে বলে, এই অবস্থা ওর। আমার গলা তো পেয়েছিল। তবু সরল না।

তখন বোধহয় ও হুঁশে ছিল না। আগ্নেয় বলেছিল।

তাই কী? সমিধা সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। নাস্কি ও ভাবে, আমার সঙ্গে যা ইচ্ছে করার অধিকার ওর আছে?

এমনকী চাইলে ও আমার শরীরটা...

যে ওর প্রতি আনুগত্য দেখাবে তার প্রতিই ও এরকম দুর্দান্ত হয়ে ওঠে। অধিকার ফলায়। অনধিকার বলাই ভালো। ওর অত্যাচার এরকমই। বিহান যেন রাগে ফেটে পড়ে।

সমিধা চুপচাপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে বলে, ও কিছুতেই বুঝতে পারেনা, আমি ওকে ভালো বেসেছিলাম। ভালোবাসা কোনও দুর্বলতা নয়, আমি যে দুর্বল নই, সেটাই ওকে এবার বোঝানো দরকার।

ছোটোবেলা থেকে খুব অর্থকষ্টে ভুগেছে বিহান। যখন ওর বয়স মাত্র পাঁচ বছর, ওর বাবার কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ওর বাবার আর কাজ জোটেনি। মাথার ওপর একটা ছাদ ছিল, তাই না খেয়ে মরতে হয়নি। কোনওরকমে বাড়ির সিংহভাগ ভাড়া দিয়ে আর নানা খুচরো কাজ করে সংসার চালিয়ে এসেছেন ওর বাবা। অল্পবয়সেই বাবার সমস্ত চুল সাদা হয়ে যেতে দেখেছে সে। আর তারই পাশাপাশি দেখেছে ওর জ্যাঠাদের স্বচ্ছলতা। ভালো চাকরি করতেন ওর জ্যাঠা। কিন্তু কোনওদিন ওদের দিকে ফিরেও তাকান নি। নিজেদের এই প্রচণ্ড অভাবের পাশাপাশি জ্যাঠাদের ওই বিপুল স্বচ্ছলতা বিহানের মনকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। দারিদ্র, অভাব, অর্থকষ্ট ইত্যাদির হাত থেকে বাঁচতেই সে ফুলের বাগানে আসে। বিশ্রুতকে ধরে, ফুলের প্রতি বিশ্রুতর দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে। ছোটোবেলা থেকেই ফুলের প্রতি ওর একটা ঝোঁক ছিল। ওদের বাগানটা পরিচর্যার অভাবে নষ্ট হয়ে গেছিল অনেক আগেই। জ্যাঠদের বাগানের ফুলগুলোর দিকে ও তাকিয়ে থাকত। কিন্তু সেখানে পা রাখার কোনও অধিকার ওর ছিল না। অভাব ও দারিদ্র্যের মধ্যে বড়ো হয়েছে বলেই বোধহয় বিহানের ছিল প্রখর পর্যবেক্ষণক্ষমতা আর তীক্ষণ বাস্তব্বুদ্ধি। ফুলের বাগানে এসেই ও বুঝতে পেরেছিল, আগ্নেয় যে সমিধার ঘনিষ্ঠ হতে চায়, তার পিছন টাকাপয়সাও একটা কারণ। আগ্নেয়র অর্থকষ্ট রয়েছে, আর দরকার হলেই সমিধা ওকে টাকা দেয়। হৃদয় যে সমিধাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, সেটাও সে জানতে পারে, কারণটাও বোঝে। হৃদয়ের অভাব নেই। সমধার টাকার দিকে কোনওদিন সে তাকায় নি। হৃদয় খোঁজে সৌন্দর্য। আগ্নেয়র অভাব আছে, কিন্তু সৌন্দর্য নিয়ে হ্যাংলামি ওর মধ্যেও আছে। সমিধাকে ও অর্থের প্রয়োজনে তোষামোদ করতে পারে, কিন্তু তার বেশী কিছু ভাবতে ও নারাজ। তাছাড়া সমিধার প্রতি আগ্নেয়র মনে একটা সূক্ষ্ম তাচ্ছিল্য আছে। হৃদয় বা অতলান্তকে সে মেধার দিক থেকে নিজের সমকক্ষ মনে করে কিন্তু সমিধাকে নয়। বিহান বুঝতে পারে তার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সমিধাকে পাওয়ার ব্যাপারে তার কোনও প্রতিপক্ষ নেই। সমিধা ভালোবাসা চায়, আর সে চায় আর্থিক স্বাচ্ছল্য। সৌন্দর্য নিয়েও তার কোনও মাথাব্যথা নেই।

সমিধাকে নিজের মনের কথা জানায় বিহান। সমধা কিন্তু সহজে ধরা দেয় না। বিহানকে ওর ভালো লাগে। সুন্দর করে কথা বলতে পারে বিহান। মানসিকভাবেও ও যথেষ্ট পরিপক্ব। সেই তুলনায় হৃদয়, বিশ্রুত বা আগ্নেয় অনেক বেশী শিশুসুলভ আচরণ করে। কিন্তু বিহান সব সময়েই সংযত এবং মার্জিত। কখনও বা অতিরিক্ত বিনয়ী। যেন সমিধা চাইলে অনায়াসে মাটিতে মিশে যেতে পারে। স্পমিধা কিন্তু বিহানকে বাজিয়ে দেখতে চায়। দুবার সে সহজে ধরা দিতে গেছিল। প্রথমবার বাবার কাছে, স্নেহের দাবিতে। দ্বিতীয়বার হৃদয়ের কাছে, প্রেমের দাবিতে। দুজনেই তাকে দুর্বল ভেবেছে। সমিধা আর কোনও পুরুষের কাছে দুর্বল হয়ে থাকতে চায়না। বরং পুরুষের দুর্বলতা দেখলে এখন ওর মজা লাগে। বিহান বুঝতে পারে ওকে কী করতে হবে। সমিধার চোখ সব সময়েই ও তাই, বিনীত, নম্র ও দুর্বল হয়েই থাকতে চায়। আর মনে মনে অপেক্ষা করে উপযুক্ত সুযোগ ও সময়ের।

বিশ্রুত নাচের ওপর একটা সেমিনারে যোগ দিতে দূরের একটা দ্বীপে যাবে। সমিধা বলে, আমিও তোর সঙ্গে যাবো। হৃদয়পুরে বোর হচ্ছি আমি।

বিশ্রুত একটু ভেবে রাজি হয়ে যায়।

বিহানকে কিন্তু কথাটা ফলাও করে জানায় সমিধা। বিহান জানে ওর মতামতে কিছু এসে যায় না। ওকে বাজিয়ে দেখতেই সমধার এত হৈচৈ। সে একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, আমাকে ফোন করবি তো?

রোজ। সমিধা প্রতিশ্রুতি দেয়।

সমিধা কথা রাখে। বিহান জানতে পারে, ওখানে গিয়েও একটি ছেলের প্রেমে পড়েছে সমিধা। ছেলেটির নাম শ্রমণ। আশ্চর্য সুন্দর ছেলে। অত্যন্ত রূপবান। মার্জিত ও রুচিশীল। সমিধা ওকে দেকে পাগল হয়ে গেছে। সারাদিন ওকে দেখার জন্য ছটপট করে। ও না আসা পর্যন্ত অস্থির হয়ে থাকে। বিশ্রুত সেমিনার নিয়ে ব্যস্ত। শ্রমণের সঙ্গে রোজই বেড়াতে যায় সমিধা।

ফোনে সমিধার গলার স্বর খুবই উত্তেজিত শোনায়। সে বলে এখানে একটা নদী আছে, জল বেশী নেই। কিন্তু চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব। আমি আর শ্রমণ বালির চরে গিয়ে বসেছিলাম। শ্রমণ ভোদকা নিয়ে এসেছিল। দুজনে বসে তাই খেলাম। শ্রমণকে আজ খুব সুন্দর লাগছিল। আমার খুব ইচ্ছা করছিল, ওকে জড়িয়ে ধরি। চুমু খাই। কিন্তু পারলাম না। মনে হল এখনই অত দূর এগোনো ঠিক হবে না। ও ঠিক প্রস্তুত নয়। এখনও ও আমাকে একটু একটু লজ্জা পায়। লজ্জা ভাঙার আগেই হয়ত আমাকে ফিরে যেতে হবে।

বিহান চুপ করে শোনে। তারপর বলে, শ্রমণের একটা ছবি নিয়ে আসিস। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

সমধা বিহানের ধৈর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। শ্রমণের ছবি সে আনে না অবশ্য। অন্য অনেক কাগজ আনে। সেগুলো বেশীরভাগই রাজনীতিক ইস্তেহার। শ্রমণ রাজনীতি করে। বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে। গেরিলা যুদ্ধের কথা বলে। সে যেন এক রোম্যান্টিক প্রতিবাদী। শ্রমণের ডাকে কিছুদিন পরই আবার সেই দ্বীপে যায় সমিধা। সেই দ্বীপে এক পাহাড় আছে। অতি দুর্গম সেই এলাক্কা। সেখানেই সমিধাকে ডেকেছে শ্রমণ। অনেক রাজনীতিক আলোচনা হবে। সেখানে নাকি সমিধার থাকাটা একান্তই জরুরি। সমিধা তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যায়। বিহানকে সে ফোনে বলে, শ্রমণ আজ আমাকে ঘুরে ঘুরে গ্রাম দেখিয়েছে। জীবনে কখনও গ্রাম দেখিনি। আজ খুব মন দিয়ে দেখলাম। আলপথ দিয়ে হাঁটছিলাম প্রথমে। তারপর সবুজ ক্ষেতে নামলাম। অনেকক্ষণ জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ছাষীদের সঙ্গেই আজ ভাত খেলাম। ক্ষেতের ধারে বসে। তাদের মাটির বাড়িতেও গেছি। এরকমই একটা মাটির বাড়িতে আজ থাকবো। কুপির আলোয় রাতে খাবো। কী গরীব এরা। কী প্রচণ্ড অভাব এদের। অথচ মনে কত আনন্দ। মানুষকে খাতির যত্ন করতে জানে। শ্রমণ বলেছে, আজ রাতে আর আমরা ঘুমোবো না। গল্প করেই কাটাবো। আমিও রাজি হয়ে গেছি। ঘুমের সময় অনেক পড়ে আছে। আজ সারা রাত ধরে এই গ্রাম, এই পাহাড়, এই জঙ্গল, আমি দেখতে চাই---

সমিধা ফিরে আসে। কিন্তু ওর যেন ঘোর কাটে না। সবসময় মুখে শ্রমণের কথা। রাজনীতির কথা, বিপ্লবের কথা। মানুষের মুক্তির কথা। কিন্তু বিহানের বাস্তববুদ্ধি অতি প্রখর। সে ঠিকই বোঝে সমিধা একটা ঘোরের মধ্যে আছে। এসব কথা ও মন থেকে বলছে না। শেখানো বুলিগুলোই আওড়ে যাচ্ছে শুধু। ওপর ওপর কিছু ফাঁকা বুলি। ও এক ধনী ব্যবসায়ীর মেয়ে। আরাম-আয়েসে অভ্যস্ত। রাজনীতি নয়, আসলে ওর ভালো লেগেছে শ্রমণকে। মানুষের সঙ্গে তার আদর্শকে সে গুলিয়ে ফেলেছে। ওর সবটাই শখের। নেশাগ্রস্তের মতো আচরণ করছে। কোনও দায়বদ্ধতা থেকে ওসব বলছে না।

(ক্রমশঃ)



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন