কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

মধুবন চক্রবর্তী

 

গান ও কবিতা  ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের শক্তির উৎস



 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান নিয়ে বলছেন "গান নিজের ঐশ্বর্যই বড়...বাক্যের দাসত্ব সে কেন করিতে যাইবে? বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে, সেইখানেই গানের আরম্ভ। বাক্য যাহা বলিতে পারে না গান তাহাই বলে"...।

ঠিক একইরকমভাবে দেশ যদি একটা সংগীত হয় সেই দেশকেও অনুশাসনের বেড়াজাল থেকে বেরোতেই হয়, পরাধীনতার নাগপাশে বাঁধা যায় না তাকে। মানুষ সেখান থেকে মুক্তির পথ খুঁজবেই। তাই আমার কাছে  স্বাধীনতা শব্দটি শ্রেষ্ঠ শব্দ। বিকাশের ক্ষেত্র হিসেবে মাধ্যম থাকে মঞ্চ। স্বাধীনতা চায় অধিকার। অধিকার অর্জন করতে হয়। নিজের আবেগ দেশের আবেগ ছিনিয়ে নিলে সেই দেশ আত্মগ্লানিতে জর্জরিত হয়। কখনও রক্তের বিনিময়ে যুদ্ধ করে অর্জন করা। পরাধীনতার  নাগপাশ থেকে দেশকে দশকে মুক্ত করার এক অনাবিল আনন্দ বিরাজ করে স্বাধীনতায়। সঙ্গীতেও সেই মুক্তির স্বাদ আছে, ভিন্নভাবে। যেমন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংগীতে মুক্তির কথা বলেছেন বারবার। বলেছেন, 'এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়'। যে কবি শিশু বয়সে ভৃত্যরাজতন্ত্রে বন্দি ছিলেন। জানালার মধ্যে দিয়ে যিনি বিশ্বকে দেখতেন, সেই কবিই পরে লিখলেন, 'আমি চঞ্চল হে আমি সুদূরের পিয়াসি', 'আমারে বাঁধবি তোরা সেই বাঁধন কি তোদের আছে' ইত্যাদি গান।

কবিতা চিরকালই যে কোনওরকম বাঁধনকে মানেনি কিংবা বন্দিদশা থেকে উত্তীর্ণ হতে চেয়েছে। শুধু কবিতা বা কবিরা কেন, আমরা সকলেই তাই চাই। বিপ্লবী যতীনদাস অনশনে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। কবির মনে তখন চেপে বসল এক ভীষণ যন্ত্রণা, বেদনা। তিনি রচনা করলেন, 'সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ'। বিপ্লবী যতীন দাসের আন্দোলনের মূল কথা পরাধীন ভারতের ব্রিটিশের অত্যাচারের কথা এবং এই গানটির অন্তর্নিহিত আত্মশক্তির যে মোহ মুক্তজাগরণের কথা সবই মিলে যাচ্ছে।  স্বাধীনতা অর্জনের পথটি ছিল কণ্টাকাকীর্ণ। সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে অবশেষে সেই বহু প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করেছি আমরা।

যদিও এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে অনেক সময় পদদলিত করছি। যে কষ্টার্জিত পথে বিপ্লবীরা স্বাধীনতা অর্জন করেছেন, সেই পথ কি আদৌ প্রশস্ত করছেন পরবর্তী প্রজন্ম বা করবে তার পরের প্রজন্ম? স্বাধীনতার অপব্যবহার হচ্ছে বলেই কি বাড়ছে বিষণ্ণতা? আত্মহত্যার প্রবণতা? প্রশ্নের উত্তর আছে। তবে এই প্রবন্ধটি  স্বাধীনতা কতটা স্বাধীন হয়েছে নাকি আজও স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করতে পারলাম না এই নিয়ে নয়। এটি তো একটা প্রশ্ন মাত্র। তার উত্তর আপনারা বলবেন। কিন্তু আমি পিছনের পানে চাইছি। গভীরে যেতে চাইছি ফিরে যেতে চাইছি সেই সময়ের গর্ভগৃহে যেখান থেকে তৈরি হয়েছিল দেশমাতৃকার প্রতি আত্মনিবেদনের অঙ্গীকার। গড়ে উঠেছিল আত্মশক্তি আত্মবিশ্বাস। তার নেপথ্যে ছিল অনেক সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলন। যার প্রেক্ষাপটে একের পর এক নির্মিত হয়েছিল দেশাত্মবোধক গান। কবিতা। পঞ্চকবির গান সেই সময় দেশাত্ববোধকে আরও জাগ্রত করেছিল। উদ্বুদ্ধ করেছিল সেই সময়ের তরুণ প্রজন্মকে। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছিলেন মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হাত ধরে। কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।

পরাধীনতার নাগপাশে দীর্ঘদিন আবদ্ধ ছিল যে দেশের মানুষ, তারা তো জানে অতীতের করুণ কাহিনি। বন্দি অবস্থায় তাদের উপর নেমে এসেছিল ইংরেজের উপেক্ষা, অত্যাচার। যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিপ্লবীরা। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তাঁরা তাঁদের প্রতিবাদকে সোচ্চার করে তুলেছিলেন। জাতীয় আন্দোলনের মূল সুর তৈরি হয়েছিল ভারতবর্ষে। প্রথমে আসি, ঠাকুর পরিবারের কথায়। ভারতের স্বতন্ত্রতা আন্দোলনে নিজেদের আবেগ কার্যপদ্ধতি ও চিন্তার বিস্তার ঘটিয়েছিল এই পরিবার। 'বহুবল ধারিনিং নামামি তারিনিং রিপুদলবারিনিং  মাতরাম'। ভারতবাসীর কাছে মাতৃভূমির এই আহ্বান ছিল সেদিন সবথেকে বড়।  জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানেও সেই আহ্বান। চল রে চল সবে ভারত 'সন্তান মাতৃভূমি করে আহ্বান বিরোদর্পে পৌরুষ গানে, সাধরে সাধ সবে দেশের কল্যাণ'। তাঁর কাছ থেকে আমরা পেলাম অসংখ্য গান কবিতা। সেই সব দেশাত্মবোধক গানের মধ্যেই অন্তর্নিহিত ছিল অগ্নিমন্ত্র জেগে ওঠার বাণী।

জেগে ওঠার কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বাধীনতাকে ফিরে পেতে ছন্দ ও সুরে দেশমাতৃকার বন্দনা শুরুর জাতীয় মেলা থেকে। পরে এই মেলার নাম হয় হিন্দু মেলা। ১৮৬৮ সালে মেলার উদ্বোধনী সঙ্গীত লিখলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম ভারতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করে এই সংগীত, 'মিলে সবে ভারত সন্তান, গাও ভারতের যশো গান'। বঙ্কিমচন্দ্র লিখলেন, 'এই মহাগীত ভারতের সর্বত্র গীত হউক হিমালয়ের কন্দরে প্রতিধ্বনিত হউক গঙ্গা-যমুনা সিন্ধু নর্মদা গোদাবরী তটে বৃক্ষে মর্মরিত হোক'। তিনি বলছেন, 'জগন্মতাই  দেশমাতা বিশ্বশক্তিই মা'...

১৮৬৭-র ১১ এপ্রিল নবগোপাল মিত্র হিন্দুমেলা নামে যে জাতীয় সম্মেলনের প্রবর্তন করেছিলেন, সেই মেলার উদ্দেশ্য ছিল রাজনীতি অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয় জনগণকে বেশি করে উদ্বুদ্ধ করা এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা। সেইসময় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বালক। মাত্র ছ'বছর বয়স। পরবর্তী সময়ে ১৮৭৫-এর ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার পার্শি বাগানে হিন্দু মেলার অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করেছিলেন তাঁর কবিতা 'হিন্দু মেলার উপহার'। এই কবিতাটিতে ছিল পরাধীন ভারতের নিদারুণ দুরবস্থার কথা। ভারতীয় যুবকদের জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করার জন্য রাজনারায়ণ বসু সঞ্জীবনী সভা নামে যে গুপ্ত রাজনৈতিক সমিতি গড়েছিলেন, সেই সভাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন অগ্রজদের সঙ্গে। এই সভাকে উপলক্ষ করে কবিগুরু লিখলেন, 'একই সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন একই কর্যে সহস্র জীবন বন্দেমাতারাম আসুক সহস্র বাধা বাধুক প্রলয় আমরা সহস্র প্রাণ রহিবনের ভয়েবান্দে মাতারাম'। লিখলেন, ইংরেজ সরকার কর্তৃক রাজত্ব নিরোধক আইন বিলের বিরুদ্ধে তার প্রবন্ধ কণ্ঠরোধ এই প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ বললেন "আজ সহসা জাগ্রত হইয়া দেখিতেছে দুর্বলের কোন অধিকার নাই।" পাশাপাশি এই সঞ্জীবনী সভা উপলক্ষে লিখেছিলেন অসংখ্য গান যেমন, 'তোমারি তরে মা সপিনু এ দেহ', 'অয়ি বিষাদিনী বিনা', 'একবার তোরা মা বলিয়া ডাক'। এরপর এলো বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের যুগ, লিখলেন অসংখ্য গান। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'। ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট  কলকাতার টাউন হলের এক প্রতিবাদ সভায় এই গান গাওয়া হয়েছিল। এই দেশকে সমাজকে আলোড়িত করেছিল এই গান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করে। যা আজও গর্বিত করে l পাশাপাশি এই সময় থেকেই তাঁর গানে মূলগত কিছু পরিবর্তন দেখা দিল। দেশাত্মোধক গানের সঙ্গে মিশিয়েছেন বাংলার প্রচলিত বাউল সারি ভাটিয়ালি সুরের অনেক গান। রচনা করলেন স্বদেশী গান। রচনা করলেন, যেমন-- 'আমরা সবাই রাজা', 'এবার তোর মরা গাঙে বাণ এসেছে', 'ও আমার দেশের মাটি, 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, 'সার্থক জনম আমার'

রবীন্দ্রনাথ যে-ভারতবর্ষের কথা বলেছেন, যে-ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সেই স্বপ্নের বীজ বুনেছিলেন। বাংলা গানের বিশাল ভাণ্ডারের মধ্যে একটি অন্যতম ধারা হচ্ছে স্বদেশী গান। দেশাত্মবোধক বহু গান রচিত হয়েছে সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে। এই গানই হয়ে উঠেছে সেই সময়ের একমাত্র হাতিয়ার।

রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি আর একজন বাঙালি কোভিদ সাহিত্যিক সাংবাদিকের কথা বলতেই হবে তিনি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত উনিশ শতকের কোভিদ সাহিত্যিক তাঁর হাত ধরে বাংলা কবিতা মধ্যযুগীয় সীমানা অতিক্রম করে আধুনিকতার পথে পা বাড়িয়েছিলেন। তিনি গুপ্ত কবি নামেও পরিচিত ছিলেন। বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য তিনি যে আন্দোলন করেছিলেন তা আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ইংরেজি প্রভাব বর্জিত খাঁটি বাংলা শব্দ তিনি ব্যবহার করতেন। যদিও এক সময় সিপাহী বিদ্রোহের প্রতি বিরূপ মনোভাব নিয়ে লিখেছিলেন একাধিক কবিতা। ব্রিটিশ শাসন আর অত্যাচার থেকে ভারতবাসীকে মুক্তি দিতে রানি ভিক্টোরিয়ার প্রতি প্রার্থনা জানাতে ব্রিটিশদের প্রতি ব্যঙ্গাত্মক রচনা লিখেছেন একাধিকবার। তাঁর যুদ্ধবিষয়ক কবিতার মধ্যে যা স্পষ্ট। তিনি লিখেছেন 'ওগো মা ভিক্টোরিয়া করো গো মানা করো গো মানা, যত তোর রাঙ্গা ছেলে আর যেন মা চোখ রঙে না চোখ রাঙে না, প্রজা লোকের জাতি ধর্মে কেহ যেন জোর করে না'...। তাঁর কবিতার স্বাদেশিকতার যে স্পন্দন তাতে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত নবীনচন্দ্র সেনের কাব্যের গভীর জাতীয়তাবাদ আরও বাড়িয়ে তুলেছিল।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দেশপ্রেমী কবি নবীনচন্দ্র সেন যিনি পলাশীর যুদ্ধ কাব্যগ্রন্থের স্রষ্টা। ১৮৭৫-এ  প্রকাশিত হয়েছিল। এবং বাংলার ইতিহাসে যা আজও ভীষণভাবে সমাদৃত। পলাশীর যুদ্ধ কাব্যের জন্য অবিস্মরণীয় কবির অধিকারী হন তিনি। এই কাব্যকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তেজস্বিনী জ্বালাময়ী এবং অগ্নি তুল্য আখ্যা দিয়েছেন। ইংরেজ শাসকদের রোষানলে পড়েছিলেন নবীনচন্দ্র সেন। স্বদেশ প্রেমের বিহ্বল ছিলেন আর এক কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।  মাইকেল মধুসূদন এর পরেই এক মর্যাদাপূর্ণ আসনের আধিকারী এই কবি মধুসূদনের মৃত্যুর পর বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, 'বঙ্গ কোভিদ সিংহাসনে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি অনন্ত ধামে যাত্রা করিয়াছেন কিন্তু বঙ্গমাতার বলিয়া আমরা কখনো রোদন করিব না'। তাঁর রচিত কাব্যের কিছু কিছু কবিতায় রাজনৈতিক বা সমকালের সামাজিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যঙ্গের রস উদ্ভূত হয়। যেমন  মুখে ইংরেজি বিদ্রোহ অথচ ভেতরে ইংরেজ দর্শনের ধ্বজাধারীদের প্রতি ব্যঙ্গ করেছেন। যেমন এই কবিতাটি 'পরের অধীন দাসের জাতি নেশান আবার তারা। তাদের আবার এজিটেশন নরুন উচুঁ করা'...। এই ব্যঙ্গের আড়ালে স্বদেশ প্রীতির ভাব উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রকাশ পায়।

আর এক স্বদেশপ্রেমী কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক সাংবাদিক রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। যিনি তাঁর দেশাত্মবোধক কবিতার জন্য বাংলা সাহিত্যের আজও চিরস্থায়ী আসন তৈরি করে নিয়েছেন। তার সেই বিখ্যাত কবিতা পদ্মিনী উপাখ্যান থেকে কিছু অংশ-- 'স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে কে বাঁচিতে চায়। দাসত্ব শৃংখল বলো কে পরিবে পায়'।... ঐতিহাসিক কাহিনির মধ্যে দিয়ে তিনি স্বদেশপ্রেমের আবেগকে সঞ্চারিত করেন তার কবিতায়। তাই বলা যায়, শুধু গান নয়, সেইসঙ্গে কবিতাও হয়ে উঠেছিল মস্ত বড় শক্তি। গান কবিতা শুধু রোমান্টিসিজম বাড়াতেই নয়, যে-কোনও আন্দোলনের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে বরাবরই গোটা বিশ্বজুড়ে। সেই সময়ের কবি সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক সাংবাদিক গীতিকার  দেশমাতৃকার বন্দনায় নিজেদের নিমজ্জিত করেছিলেন। যাঁদের লেখা কাব্য, কবিতা স্বদেশ প্রেমের জোয়ার তৈরি করেছিল। তেমনই পরবর্তী ক্ষেত্রেও এমন অনেক সাহিত্যিক প্রবন্ধকার দেখতে পাই যাঁদের লেখায় দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এর বড় উদাহরণ আমরা পাই পরবর্তীকালে বিশ্বসঙ্গীত এবং সংস্কৃতি জগতের এক মহাবিস্ময় সেই বব ডিলানকে। যিনি সঙ্গীতকে আশ্রয় করে খুঁজেছিলেন মানবতার পথ। গেয়েছেন সাম্যের জয়গান। আমেরিকা থেকে ভিয়েতনাম পৃথিবীর যে প্রান্তে অন্যায় দেখেছেন, শোষণ দেখেছেন তার জন্য প্রতিবাদ করেছেন তাঁর গানে, তাঁর লেখায়। তাঁর কলম গর্জে উঠেছে বারেবারে। তিনি বলেছেন, "আমার বন্দুক নেই কিন্তু কলম আছে।" বব ডিলানের গানে উঠে এসেছে মার্কিন ইতিহাস, যুদ্ধ, বর্ণবাদ এবং সামাজিক অসঙ্গতির কথা।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় স্বদেশী যাত্রা এবং সংগীতে আলোড়ন তুলেছিলেন অনেক কবি, গীতিকার। তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন চারণকবি মুকুন্দ দাস। উচ্চকিত কণ্ঠে সুরের মাতনে মাতিয়ে দিয়ে তিনি গাইলেন, 'আমি দশ হাজার প্রাণ যদি পেতাম, তবে ফিরিঙ্গি বণিকের গৌরব রবি অতল জলে ডুবিয়ে দিতাম'... অথবা 'ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে, মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে' কিংবা 'ছেড়ে দাও রেশমি চুড়ি বঙ্গনারী, কভু হাতে আর পোরো না'...

১৯০৮, ৩০ এপ্রিল। দুই তরুণ কুড়ি বছরের প্রফুল্ল চাকী এবং সতেরো বছরের ক্ষুদিরাম বসু বোমা ছুড়লেন কিংসফোর্ডের গাড়ি লক্ষ্য করে। মারা গেলেন মিসেস কেনেডি এবং তাঁর মেয়ে। ধরা পড়লেন দুই বিপ্লবী। নিজেকে নিজেই গুলি করে মারলেন, প্রফুল্ল চাকী। আর ক্ষুদিরামের হল ফাঁসির আদেশ। ১৯০৮-রর ১১ অগাস্ট। ভোর ছ'টায়ফাঁসি হল ক্ষুদিরামের। সারাদেশব্যাপী শুরু হয়েছিল আত্মবলিদান এর পালা। বাঁকুড়া অখ্যাত কবি পীতাম্বর দাস লিখলেন মর্মস্পর্শী সেই গান। যে-গান মানুষের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। যে-গান শুনে প্রায় সকলেরই ছেলেবেলা অতিবাহিত হয়েছে। স্কুলে স্বাধীনতা দিবস পালন মানেই এই গান কোরাসে গাইতেই হবে। 'একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি (আমি) হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে ভারতবাসী, কলের বোমা তৈরি করে দাঁড়িয়ে ছিলাম রাস্তার ধারে মাগো, বড় লাটকে মারতে গিয়ে মারলাম আর এক ইংল্যান্ডবাসী। একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি'...

এই পরাধীন ভারতবর্ষের দুর্দশা দেখে কলম থেকে গর্জে উঠেছিল বহু কবিতা আর গান। কাজি নজরুল ইসলাম লিখলেন অসংখ্য গান। বিপ্লবীদের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ রেখে চলতেন কাজী নজরুল ইসলাম তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অগ্নিবীণা' উৎসর্গ করলেন বিপ্লবী বারীন ঘোষকে। 'অগ্নি ঋষি অগ্নিবীণা তোমায় শুধু সাজে। তাইতো তোমার বহ্নি রাগেও বেদন বেহাগ বাজে'।... 'কাজি নজরুল স্বদেশী গানের ক্ষেত্রে আনলেন এক নতুন ধারা। তৈরি করলেন মার্চ সংগীত। তিনি এই সংগীতের অন্যতম পুরোধা ছিলেন। দেশাত্মবোধক সংগীত হিসেবে আমরা বলতে পারি সেই গানের কথা, 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার'...। এই গান সম্পর্কে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন, "আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে সর্বদাই ঘুরে বেড়াই। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয় সংগীত শোনবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু নজরুলের দুর্গম গিরি কান্তার মরুর মত প্রাণ মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।"

বাংলা গানের বিশাল ভাণ্ডারের মধ্যে স্বদেশী গান একটি বিশেষ ধারা। যা শুধুমাত্র বিদেশি শাসনের নাগপাশ থেকেই যে মুক্তির কথা বলেছে তা নয়দেশের দুঃখ-দৈন্য থেকে মানুষকে মুক্তির কথা বলেছে, আর তারই প্রতিফলন ঘটেছে সাহিত্যে শিল্পে সংস্কৃতিতে। একদিকে যেমন পরাধীনতার গ্লানির কথা বলা হয়েছে।  অন্যদিকে আছে দেশের ঐতিহ্যের কথা আত্মশক্তি বিকাশের কথা আত্মনির্ভরতার কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের  কথা তো আগেই বলেছি, আর একজন বাঙালি কবি সাহিত্যিক সাংবাদিকের কথা না বললেই নয় তিনি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত উনিশ শতকের  কবি সাহিত্যিক তার হাত ধরে বাংলা কবিতা মধ্যযুগীয় সীমানা অতিক্রম করে আধুনিকতার পথে পা বাড়িয়েছিল। তিনি গুপ্ত কবি নামেও পরিচিত ছিলেন স্বদেশ ও সমাজের প্রতি ঈশ্বরচন্দ্রের অনুরাগ ছিল তীব্র। বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য যে আন্দোলন তিনি করেছিলেন, তা আজ স্মরণীয়। ইংরেজি প্রভাব বর্জিত খাঁটি বাংলা শব্দ তিনি ব্যবহার করতেন। তার কবিতার স্বাদশিকতায় যে স্পন্দন তাকে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, নবীনচন্দ্র সেনের কাব্যের গভীর জাতীয়তাবাদ আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। স্বাধীনতা কবিতায় রঙ্গলাল লিখেছিলেন, 'স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে

কে বাঁচিতে চায়

দাসত্ব শৃঙ্খল বলো কে

পরিবে পায় হে কে পরিবে পায়'

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একবার বলেছিলেন "যতদিন না দুখিনী মাতৃভূমির দুঃখ দৈন্য দীনতা সম্পূর্ণ বিতাড়িত হয় ততদিন ভারতবর্ষের মুখে প্রেম সংগীত ভালো দেখায় না"...। তাঁর স্বদেশী গান তাই এত বলিষ্ঠ এত নির্ভীক।

পরাধীন ভারতে বাঙালির মুখে মুখে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের দেশাত্মবোধক গান যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জাগিয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনি। জন্ম দিয়েছিলেন একের পর এক দেশাত্মবোধক নাটকের। অনেক দেশাত্মবোধক গান এই নাটকগুলিকে প্রাণবন্ত করতে সাহায্য করেছিল। আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস 'মেবারপতন' নাটকের 'মেবার পাহাড়' গানটি কবির মুখ থেকে শুনে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন "আপনার এই গানে আমরা কবিত্ব উপভোগ করতে পারি.. কিন্তু যদি আমি মেবারের লোক হতেম, তাহলে আমার প্রাণ দিয়ে আগুন ছুটতো...।"

পঞ্চকবির অন্যতম ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন। যাঁর গানের মধ্যে অপার স্নিগ্ধতা। শান্ত স্নিগ্ধ সমুদ্র বিরাজ করে। যাঁর গানের অন্তরে পরাধীনতার জ্বালা তাঁকে বিদ্রোহী হতে বাধ্য করলেও, তার লেখা গানগুলিতে  দুঃখ লজ্জা ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্থান পায়নি ঘৃণা বা অশালীনতা বা তীব্রতা। নজরুল ইসলামের বিদ্রোহের তুলনায় অতুলপ্রসাদ সেনের গানের মধ্যে যে বিদ্রোহ, তা তুলনামূলকভাবে বেশি মাত্রাতিরিক্ত নয়। দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ করতে দেশের ঐতিহ্যের কথা বারবার তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তার রচনায়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনেও প্রতিবাদ করেছেন তার গানের মধ্যে দিয়ে তবে নমনীয়ভাবে।

তার রচিত দেশাত্মবোধক গানগুলি পরাধীন মানব মনের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছিল। আজও কণ্ঠে ধ্বনিত হয় সেই গানগুলি। যেমন

'উঠো গো ভারত লক্ষ্মী

উঠো আজি জগত জন শয্যা

দুঃখ দৈন্য সর্বনাশে করো দূরিত ভারতে লজ্জা'

কিংবা 'হও ধরমেতে ধীর হও করমেতে বীর হও উন্নত শির নাহি ভয়'। আবার লিখলেন, 'বল বল বল সবে শত বিনা বেনু রবে, ভারতও আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে'। কান্ত কবি রজনীকান্ত সেনের কথায়  আসি তাঁর গানগুলিকে মূলত বেশ কয়েকটি ভাগে আমরা ভাগ করতে পারি যা ভক্তিমূলক বা সমর্পণের গান। রজনীকান্তের ভক্তিমূলক গানগুলি সর্বোচ্চ সৃষ্টি বলে মনে করা হয় তবে। তবে তাঁর রচিত দেশাত্মবোধক গানগুলি সাধারণ মানুষের মনে আলোড়ন তৈরি করেছিল। বিশেষ করে, 'মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই,

দিন-দুখিনী মা যে তোদের তার বেশি আর সাধ্য নাই'

যা আজও সর্বজনবিদিত। আর একটি গানের কথা মনে পড়ে। 'নমো নমো নমো জননী বঙ্গ'... ইত্যাদি।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম আত্মোৎসর্গকারী মহিলা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি বলেছিলেন, আমাদের দেশে অধর্মের শুরু পলাশীর প্রান্তর থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলার হত্যা, মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসি, ঝাঁসির রানিকে হত্যা, বাহাদুর সাহেবের নির্বাসন। স্বাধীনতা সংগ্রামী সূর্য সেনের নেতৃত্বে একসময় গড়ে উঠেছিল গুপ্ত সংগঠন। ওই দলে যোগ দিয়েছিলেন সেইসময় প্রীতিলতা। এই গুপ্ত সংগঠনে তখন ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। আর সেটাই ছিল সঠিক সময়। মাস্টারদার নির্দেশেই ইউরোপিয়ান ক্লাবে বোমা ছোড়েন তিনি। একটা গুলি এসে লাগে তাঁর বুকে। পকেট থেকে পটাশিয়াম সায়ানাইড বের করে মুখে পুরে দেন। দেশমাতৃকার চরণে নিজেকে উৎসর্গ করলেন  প্রীতিলতা। ধরা পড়লেই পুলিশের নারকীয় অত্যাচার। তার থেকে এই ভালো নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়ে এক প্রীতিলতার প্রদীপের আলোয় জ্বলে উঠবে অনেক প্রীতিলতার প্রদীপের শিখা। অবশ্য এভাবেই তখন ভাবতেন ভারতের বিপ্লবীরা। সেই ভাবনা থেকেই গীতিকার মোহিনী চৌধুরী লিখেছিলেন। 'মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হলো বলিদান, লেখা আছে অশ্রু জলে, কত বিপ্লবী বন্ধুর রক্তে রাঙা, বন্দিশালার ওই শিকল ভাঙা, তারা কি ফিরিবে আর এই সুপ্রভাতে, কত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে'...

দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তুলেছিলেন আর এক তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কৈশোর থেকেই যিনি যুক্ত হয়েছিলেন সাম্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে। পরাধীন দেশের দুঃখ দুর্দশাজনিত যন্ত্রণা বেদনা শোষণমুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন,  শোষিত মানুষের কর্মজীবন,  পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম এই ছিল তার কবিতার মূল প্রেরণা। তিনি লিখলেন, 'এ আকাশ, এ দিগন্ত, এই মাঠ, স্বপ্নের সবুজ ছোঁয়া মাটি, সহস্র বছর ধরে একে আমি জানি পরিপাটি'...'জানি  এ আমার দেশ অজস্র ঐতিহ্য দিয়ে ঘেরা, এখানে আমার রক্তে বেঁচে আছে পূর্বপুরুষেরা'...। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও এই তীব্র যন্ত্রণার কথা সংগ্রামের কথা মানুষ ভোলেনি। তাই বিবিধ গান রচনার পাশাপাশি দেশমাতৃকার বন্দনা করেছেন অনেক গীতিকার সুরকার। সলিল চৌধুরীর তাঁর গানে লিখেছিলেন, 'ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধুলিতে আমার জীবনে মরণে তোমায় চাই না ভুলিতে'...'স্বাধীনতা' শব্দটা বড় হৃদয়স্পর্শী। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মানুষ যখন তার কাঙ্ক্ষিত কিছু পায়, তখন তার ভেতরে যে অনুভূতির সঞ্চার হয়। সেই অনুভূতিকে আঁকড়ে রাখার চেষ্টা করে মানুষ। দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের পর বহু যন্ত্রণার পথ পেরিয়ে আমরা যেন কবিতা, গানের মধ্যে শুধু নিজের প্রচার প্রসার নয়, স্বাধীনতাকে ভুলে না যাই।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন