কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

এ্যান্ড্রু করিবকো (ভাষান্তর: অদিতি ফাল্গুনী)

 

বাংলাদেশের বিদ্যমান অস্থিতিশীলতা কোন ’কালার রেভল্যুশন’ নয় তবে সহজেই তেমনটা হতে পারতো:

(ভাষান্তর: অদিতি ফাল্গুনী)



(এ্যান্ড্রু করিবকো একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক এবং বেশ কয়েকটি অনলাইন পত্রিকার নিয়মিত সাংবাদিক এবং একইসাথে রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশীপ ইউনিভার্সিটি অফ রাশিয়ার ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এ্যান্ড প্রেডিকশন্স বিভাগের সদস্য)।

গত বুধবার ’দ্য এ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ (এপি) এই শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে ’প্রায় ২০০ মানুষের প্রাণ হরণকারী সহিংস সঙ্ঘর্ষের পর বাংলাদেশ হামাগুড়ি দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে।’ মূলত: ছাত্রদের নেতৃত্বে সঙ্ঘটিত এই বিক্ষোভ বা সঙ্ঘর্ষ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের পরিবার-পরিজনের জন্য সরকারী চাকরির ৩০% শতাংশ কোটা বাতিল করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। সুপ্রীম কোর্ট সাথে সাথে এই চাকরির কোটার হার মাত্র পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনে যা সেনাবাহিনী কর্তৃক আরোপিত কার্ফ্যুর সমান্তরালে আইন-শৃঙ্খলার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। বর্তমানে এই কার্ফ্যু ধীরে ধীরে শিথিল করা হচ্ছে।

সংক্ষেপে বললে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রতি ক্রমাগত তিক্ত বা বিরূপ হয়ে উঠছে এবং দিল্লির স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতিকে শাস্তি দিতে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে পারাটা তাদের জন্য বেশ সুবিধাজনক হয়- বাংলাদেশ ভারতের নিকটবর্তী সেই নাজুক, স্পর্শকাতর বিন্দু। এছাড়া, বাংলাদেশ মস্কোকে পরিত্যাগ করতে রাজি না হওয়ায় ওয়াশিংটনও ঢাকার প্রতি ক্ষুব্ধ। এই বিষয়গুলোই ওয়াশিংটনকে বাংলাদেশে ২০২৪-এর জানুয়ারির আগে একটি ’কালার রেভল্যুশন’ আয়োজনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল যদিও মার্কিনীদের এই পরিকল্পনা তখনো পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। তবু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে আস্থার ক্ষেত্রে চিড় ধরেছে এবং সেজন্যই বাংলাদেশের নেত্রী সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে আমেরিকা তাঁর দেশকে একটি বশংবদ বা প্রতিনিধি রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়।

এমতাবস্থায় বাইরে থেকে যে কোন পর্যবেক্ষকের এমনটা মনে হতেই পারে যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম অস্থিতিশীলতা একটি বিলম্বিত ’কালার রেভল্যুশন’ থেকেও খানিকটা বেশি। তবে বাস্তবতা আরো অনেক বেশি জটিল। সেদেশের বিরোধী দল নিশ্চিত ভাবেই এই উত্তেজক ও প্রায় দাঙ্গা-ত‚ল্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে ইন্ধন যোগানোর কাজ করেছে। পাশাপাশি এই ভয়ানক সঙ্ঘর্ষ-পরায়ণ, দাঙ্গা-ত‚ল্য পরিস্থিতিকে চিরস্থায়ী করতেই যেন পুরো উত্তপ্ত অবস্থাটিই ছাত্রদের নেতৃত্বেই রইলো এবং সমাজের অন্য নানা অংশের সদস্যদেরও যুক্ত করতে চাইলো। কারণ ছাত্ররা সহ বাংলাদেশের সমাজের বহু মানুষেরই কাছে সরকারী চাকরি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। যদিও এতে করে ছাত্রদের গৃহীত আন্দোলনের সহিংস পন্থাকে উপেক্ষা করা যায় না, তবে এটা থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে কেন এই ছাত্রদের আন্দোলনের ইস্যুটি এত জনপ্রিয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের অর্থনীতি পাকিস্থানের অর্থনীতির চেয়েও আয়তনে আরো বৃহদাকার হয়ে উঠেছে। ব্যপারটি সত্যিই আগ্রহোদ্দীপক যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশ ছিল পাকিস্থানের একটি অংশ। তবু বাংলাদেশের সমাজের কিছু কিছু অংশ দেশটিতে সম্পদের বন্টণ এবং শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে উদ্বিগ্ন। দেশটিতে বাড়তে থাকা ভিন্ন মতের সাথে ক্রমবর্দ্ধমান বেকারত্বের হার মিলে ইতোমধ্যেই বিরোধী দলের রাজনীতির প্রতি অনুরাগী তরুণদের একটি বিপুল অংশকে সরকারী চাকরির কোটা নীতি বিষয়ে সংগঠিত হবার পেছনের মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে।

যদিও এই খাতে প্রাপ্তব্য নতুন চাকরিগুলো দেশের সামগ্রিক চাহিদার তুলনায় প্রতি বছরই যেন আরো বেশি অপ্রত‚ল বলে মনে হয়, তবু যারা সরকারী কাজ পায়, তারা যেন সারা জীবনের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এজন্যই গোটা দেশ জুড়ে এই দাবি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে পারিবারিক যোগাযোগের বদলে মেধার ভিত্তিতেই চাকরিগুলো প্রাপ্য হওয়া উচিত। বাংলাদেশের সরকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো এই অনুভূতিকেই কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাসীণ দলের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা এবং কিছু বিক্ষোভকারীকে সহিংস কর্মকান্ডে অংশ নিতে প্ররোচিত করেছে।

বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু না জানা কোন অপ্রশিক্ষিত নিরীক্ষক বা পর্যবেক্ষকের কাছে বর্তমানের সহিংস পরিস্থিতিকে বা ’কালার রেভল্যুশন’ বলে মনে হলেও বাস্তবে বহু যুগের পুরণো নীতির প্রতি দীর্ঘদিন ধরে জমতে থাকা অসন্তোষের ফলাফল হলো এই গৃহযুদ্ধ ত‚ল্য দাঙ্গা-পরিস্থিতি। আর বাংলাদেশের বাইরের শক্তিগুলোর পক্ষে এই সার্বিক পরিস্থিতি তাদের নিজেদের কাজে লাগনোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

গত জানুয়ারির নির্বাচনের সময়েই বিরোধী দলগুলোর প্রতি আনুগত্যপূর্ণ ও বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কর্তৃক সুবিধাপ্রাপ্ত এনজিওগুলো কোটা-বিরোধী ছাত্রদের একটি বিপুল অংশকে সংগঠিত করে তুলেছিল যা পরবর্তী সময়ে এই দ্বিতীয় দফা সহিংসতার মঞ্চ প্রস্তÍত করেছে।

ক্ষমতাসীন দলকে তাই এই মূহূর্তে বিশেষ সঙ্কট মোকাবেলা করতে হচ্ছে যেহেতু সে দেশের প্রাপ্ত-বয়ষ্ক তরুণেরা সাম্প্রতিক নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সাথেই নতুন মৈত্রী-বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা অনেকেই নিরাপত্তা বাহিনীসমূহ কর্তৃক বলপ্রয়োগের অসম ব্যবহারে বিক্ষুব্ধ এবং তরুণ প্রজন্মের ভেতরে চিন্তার এই প্রবণতা সহজে আর বিপরীতমুখী করা যাবে না। ছাত্রসমাজ ও বিরোধী দলের ভেতর এই ঐক্য সূত্রেই দেশটিতে যাবতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক বিনাশযজ্ঞ চালানো সম্ভব। বিশেষত: যদি বাইরের দেশগুলো থেকে আর্থিক ও সাংগঠনিক সহায়তা এবং এই আন্দোলনের প্রতি সহানুভ‚তিশীল গণমাধ্যম প্রতিবেদন পাওয়া যায়। চলমান এই ধ্বংস বা বিনাশযজ্ঞের প্রক্রিয়া যে চলমান রয়েছে তা’ সরকারের গৃহীত পূর্বতন কোটা নীতির সংস্কার দাবি করা থেকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ক্ষমা চাওয়া, মন্ত্রীসভার অন্যান্য মন্ত্রীদের পদত্যাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কোন কোন সদস্যের গ্রেপ্তারের দাবিও ছাত্রদের উত্থাপিত দাবি-দাওয়াগুলোর অন্তুর্ভুক্ত হওয়া থেকে বোঝা যায়। এটা বোঝাও খুব দূরূহ নয় যে কিভাবে এই আন্দোলন খুব দ্রæতই একটি শাসন বা সরকার পরিবর্তনের প্রকাশ্য আহŸানে পরিণত হতে পারে, সেই লক্ষ্যে আরো বেশি বেশি প্রতিবাদ সমাবেশ হতে পারে এবং এই অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় আরো ফাটল ধরলে সরকার-বিরোধী উগ্রতম শক্তিগুলো কর্তৃক একটি বিদ্রোহী ও সন্ত্রাসী অভিযান চালানো যায়।

ভবিষ্যতে তাই বাংলাদেশ নিজেকে আরো চাপের ভেতরে আবিষ্কার করতে পারে যদিও এটি অস্বচ্ছ যে এই অস্থিতিশীলতার পরবর্তী পালা কখন শুরু হবে, ঠিক কতটা স্তর পর্যন্ত দেশের বাইরের বা বহি:স্থ শক্তিগুলো নিজেদের এসবে জড়াবেন এবং একবার চ‚ড়ান্ত ঘটনাটি ঘটে গেলে সবকিছু কি ভয়ানক রূপ নেবে। যাহোক, অনিবার্য যা সামনে আসবে তার জন্য কর্তৃপক্ষকে প্রস্তÍত হতে হবে এবং সরকার-বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে শান্তিপূর্ণ ভাবে পাল্টা লড়াই লড়তে হলে সরকারের অনুক‚ল নাগরিক সমাজের শক্তিসমূহের বিকাশের পথ প্রশস্ত করতে হবে। ’গণতান্ত্রিক নিরাপত্তা’র শিক্ষা অনুযায়ীই সেটা বাংলাধেম সরকারের সেটা করতে পারলে ভাল।

ভারত মহাসাগরের উত্তরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগবিন্দুতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই ’নতুন শীতল যুদ্ধ’-এর সময়কালীন পরাশক্তিগুলোর ভারসাম্যের প্রশ্নে দেশটির ভ‚-কৌশলগত গু রুত্ব রয়েছে। এর অর্থ হলো দেশটিকে সারা জীবনই বিদেশী শক্তিগুলোর চক্রান্তের বিষয়বস্তু হয়ে থাকতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলটির একইসাথে চীণ, ভারত, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মৈত্রী-জোট বাঁধা আপাত:দৃষ্টে বাস্তববাদী বুদ্ধিমত্তার স্বাক্ষর মনে হলেও বস্তÍত: এই কারণেই ওয়াশিংটন দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। যেহেতু দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ’কনিষ্ঠ অংশীদার’ হতে রাজি হয়নি।

টীকা: একবিংশ শতকের শুরুতে সোভিয়েত যুগের অবসানের পর আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন, কিরঘিজিস্থান এবং ফেডারেল রিপাবিক অফ যুগোশ্লাভিয়ায় পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অ-হিংস প্রতিবাদেও প্রেক্ষিতে বিদ্যমান সরকারগুলোর পতনকে ’কালার রেভল্যুশন’ বলা হয়। মূলত: ঐ দেশগুলোয় নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিপুল জন-অসন্তোষের প্রেক্ষিতে এই ’বিপ্লবগুলো’ সঙ্ঘটিত হয় যেখানে অন্তর্জাল যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেশ কাজ করে এবং প্রতিবাদগুলোয় এনজিওগুলোও একটি শক্তিশালী ভ‚মিকা পালন করে। এমন কয়েকটি সরকার পতনের আন্দোলনের ভেতর সফল আন্দোলন হিসেবে রয়েছে যুগোশ্লাভিয়ার ’বুলডোজার বিপ্লব (২০০০),’ জর্জিয়ার ’গোলাপ বিপ্লব (২০০৩),’ ইউক্রেনের ’কমলা বিপ্লব (২০০৪),’ কিরঘিজিস্থানের ’টিউলিপ বিপ্লব (২০০৫)’ এবং আর্মেনীয়ার ’মখমল বিপ্লব (২০১৮)।’

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন