কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / তৃতীয় সংখ্যা / ১২৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / তৃতীয় সংখ্যা / ১২৩

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

অচিন্ত্য দাস

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২৮


একলা সৈনিক

জানালা দিয়ে যে দুটো ফ্ল্যাটবাড়ি দেখা যায় তার একটাতে রং হচ্ছে। কদিন দেখছি গোটা সাত-আট লোক মিস্ত্রির সঙ্গে সারাদিন লেগে আছে। বাড়িটা পুরনো, দেয়ালে বসে যাওয়া কালোছোপ ঘষে তুলতে বেশ কসরতের দরকার। এখন ছাদে জলের ট্যাঙ্ক, চিলেকোঠার দেয়াল পরিষ্কার হচ্ছে। কুতুব মিনারের চূড়ার মতো এ বাড়ির ‘উচ্চতম’ বিন্দু জলের ট্যাঙ্ক। শিরীষ কাগজ নিয়ে উঠেছে ছেলেটা, অনেকটা ঘষতে হবে। কিন্তু কাজটা শুরু করতে গিয়েই বাধা। একটা অশত্থতগাছ গজিয়েছে সিমেন্টের ট্যাঙ্কের ফাটল আশ্রয় করে। উপড়ে ফেলে না দিলে তো কাজ হবে না।

এক হাতে গাছের কচি ডাল ধরে টান মারল ছেলেটা। কিচ্ছু হলো না। গাছ বরং যেন দুলে উঠে মাথা নাড়ল, “যা পালা! বিরক্ত করিস না।”

এবারে দেখলাম ছেলেটা দুহাতে শক্ত করে মূল ডালটা মুচড়ে নিয়ে বেশ একখান রামটান মারতে গেল। বাপ রে, আর একটু হলে হাত পিছলে ছেলেটা পড়ে যাচ্ছিল, কোনো রকমে সামলেছে। গাছের গোটা চারেক পাতা ছিঁড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো ক্ষতি হলো না। এবারে মাথা নাড়িয়ে গাছ যেন বলল, “যা ভাগ এখান থেকে!”

আমি ব্রেকফাস্ট নিয়ে বসে অভ্যাস মত টিভি চালালাম। দেখলাম কোন একটা পল্লীগ্রামের ইস্কুলে সমবেত গলায় গান হচ্ছে ‘মরুবিজয়ের কেতন উড়াও হে শূন্যে”, মানে বৃক্ষরোপণ উৎসব। বড়সড় অফিসার গোছের কারা যেন গাছের চারা লাগাচ্ছেন। তবে এঁদের পেটের যা সাইজ তাতে ঝুঁকতে বড় কষ্ট হচ্ছে। টিভি বন্ধ করে আবার গেলাম জানালার ধারে।

ওরে বাবা, এদিকের যুদ্ধ তো জমে উঠেছে। নিজে না পেরে ছেলেটা আরও দুটো লোককে নিয়ে এসেছে, তাদের একজনের হাতে একটা রামদা। রোদ্দুর পড়ে রামদার ধারালো ফলাটা চকচক করে উঠল। আমি যেন যুদ্ধক্ষেত্রের সাংবাদিক, অবশ্য আমার এ বিবরণ কে আর পড়বে! পাশের চারতলা ফ্ল্যাটের চিলেকোঠায় একটা গোলপানা চাকতি, ওটা বেয়ে আকাশ থেকে নেমে আসে টিভির ছবি। তার ওপর এখন একটা বড় চিল বসে আছে। প্রায়ই বসে কিন্তু আজ এর ‘শ্যেনচক্ষু’ যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ফোকাস করা।

ছেলেটা রামদা নিয়ে গাছের দিকে এগোচ্ছে … আমার গা শিরশির করে উঠল। অশথ্থ গাছটা যেন এক একলা সৈনিক। সে বলছে, “মাটি পাইনি তাই অনেক কষ্টে এই শক্ত বিচ্ছিরি সিমেন্টের গাঁথনির ফাটলে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কী পরিশ্রম করে যে তা ফুঁড়ে শেকড় বেছাতে হয়েছে তা তোরা জানিস না। তোদের কি সব চাই? এইটুকু সহ্য হলো না? কেটে ফেল আমাকে তবু জেনে রাখ আমি মরব না। ভেতরে ভেতরে শেকড় গজিয়ে তোদের দেয়াল বাড়ি সব ফাটিয়ে দেব। অভিশাপ দিচ্ছি তোরা সব মরবি!”

ছেলেটা যেই তার অস্ত্র তুলেছে, আমি চোখ বুজলাম।

তবে কান তো খোলাই ছিল। শুনলাম চিলটা ডেকে উঠল তীব্রস্বরে হইসিলের মতো। অশথ্থের ভাষা চিল বোধহয় জানে, তাই একলা সৈনিকের চীৎকার সে আমাদের সকলকে শুনিয়ে উড়ে গেল।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন