কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / তৃতীয় সংখ্যা / ১২৩

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / তৃতীয় সংখ্যা / ১২৩

শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১২৩ / দ্বাদশ বর্ষ : তৃতীয় সংখ্যা

 

সময় কখনও সরল নয়, বরং জটিল। কখনও কখনও সেই জটিলতা জটিলতর হয়ে ওঠে। সেই জটিলতর সময়ের মুখোমুখি হব কীভাবে, কীভাবেই বা সেই জটিলতার মোকাবিলা করব, অনেক ক্ষেত্রেই দিশা খুঁজে পাওয়া যায় না, বিভ্রান্তি জাগে। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারা যায় না, সেই জটিলতর পরিস্থিতির কারণে যেসব  দুর্ঘটনা ঘটছে, প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, তা কীভাবে অতিক্রম করব! কিছুটা দ্বিধা, কিছুটা দ্বন্দ্ব, তারপর একটা পথ খুঁজে নিতেই হয়। পথটা লড়াইয়ের, পথটা সংগ্রামের, জান বাজি রেখেই তখন পথে নেমে পড়তে হয়। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হয়। সলিল চৌধুরীর লেখা সেই অবিস্মরণীয় গানের কথা মনে পড়ে যায়, ‘পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে পথ চেনা’। ব্যক্তিগত জীবনে বেশ কিছু আন্দোলনের সাক্ষী থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার। তারমধ্যে আলাদা করে উল্লেখ ও স্মরণ করতে হয়, সত্তর দশকে  সংঘটিত নকশালবাড়ি আন্দোলনের কথা। এই মহান আন্দোলন সেই সময় রীতিমতো নাড়া দিয়েছিল পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠির কায়েমী স্বার্থের ভিতকে। যদি সেই আন্দোলন কার্যকরী হতো, তাহলে একটা অন্য সমাজব্যবস্থার হয়তো পত্তন হতো। বিশেষত আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম মুক্তির দশকের। তারপর কেটে গেছে আরও বেশ কয়েকটি দশক। মুক্তির ভাবনা স্বপ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। বরং আরও কঠোর ও কঠিন হয়েছে শাসকশ্রেণীর দমন ও পীড়ন নীতির। দাসত্বের আরও সুচতুর ও নির্মম আবহে আমরা ক্রমাগত বন্দী হয়ে পড়েছি।

তবু আমরা যে পরাজয় মেনে নিতে রাজী নই, মনের মধ্যে রয়ে গেছে লড়াইয়ের সুতীব্র জেদ ও বাসনা, তাই চারিদিকের এত অবিচার ও অনাচারের মধ্যে বাস করেও সম্প্রতি সংঘটিত একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে এসে দাঁড়িয়েছি উন্মুক্ত পথে, আমাদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই, কন্ঠস্বরেই উদ্গারিত হচ্ছে আমাদের যাবতীয় ক্ষোভ ও ক্রোধ। বিশেষত এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের জনজোয়ারে নেতৃত্ব  নেই কোনো তথাকথিত রাজনৈতিক দলের, ছড়ি ঘোরাচ্ছে না কোনো জাতি, প্রদেশ বা ধর্মের কোনো ভাবাবেগ, বরং শুধুমাত্র অন্যায় ও অপরাধের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে সাধারণ মানুষের এই আপোষহীন  প্রতিবাদের বিস্ফোরণ। আমাদের এই প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় আমরা যে কেউই সুরক্ষিত নই, বিশেষত মহিলারা যে কোনোভাবেই সুরক্ষিত নয় ঘরে এবং বাইরে, পথে-ঘাটে-বাজারে-ময়দানে-কর্মস্থানে সর্বত্রই তাদের আক্রান্ত হতে হয়, সম্ভ্রম ভূলুন্ঠিত হয়, প্রাণনাশ হয়, এ তো আমরা জানি। প্রতিদিন বিভিন্ন ঘৃণ্য  ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকছি। অথচ কোনো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে পারছি না, এটা তো আমাদেরই  ভীরুতা, দুর্বলতা। আর সেই ভীরুতা ও দুর্বলতাকে কাটিয়ে ঊঠতে পারলে যে অনেক সমস্যা সমাধানের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়, বিগত মাসের কলকাতার আর জি কর হাসপাতালের অত্যন্ত নক্করজনক ঘটনার বিরুদ্ধে তথাকথিত রাজনীতিহীন সাধারণ মানুষের আন্দোলন তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। না, এই সম্পাদকীয় প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত আমাদের তিলোত্তমার ওপর সংঘটিত পাষন্ডদের অত্যাচারের বিচার এখনও হয়নি, এখনও খোলসা করা হয়নি এই সরকারী হাসপাতালের মধ্যে দুষ্টচক্রের বিভিন্ন দুষ্কর্মের ফিরিস্তি, পরিষ্কার করে এখনও ঘোষিত হয়নি সেই দুষ্টচক্রে জড়িয়ে থাকা শাসকশ্রেণীর ভূমিকা। তবে পথে যখন  আমরা নেমেছি, আমরা নিশ্চিত, আমাদের পথেই হবে পথ চেনা। এক্ষেত্রে কোনো আপোষ হতে পারে না। কেননা আমরা আপোষহীন।   

 ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের পক্ষ থেকে সবাইকে জানাই শারদ শুভেচ্ছা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

 দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

এ্যান্ড্রু করিবকো (ভাষান্তর: অদিতি ফাল্গুনী)

 

বাংলাদেশের বিদ্যমান অস্থিতিশীলতা কোন ’কালার রেভল্যুশন’ নয় তবে সহজেই তেমনটা হতে পারতো:

(ভাষান্তর: অদিতি ফাল্গুনী)



(এ্যান্ড্রু করিবকো একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক এবং বেশ কয়েকটি অনলাইন পত্রিকার নিয়মিত সাংবাদিক এবং একইসাথে রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশীপ ইউনিভার্সিটি অফ রাশিয়ার ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এ্যান্ড প্রেডিকশন্স বিভাগের সদস্য)।

গত বুধবার ’দ্য এ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’ (এপি) এই শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে ’প্রায় ২০০ মানুষের প্রাণ হরণকারী সহিংস সঙ্ঘর্ষের পর বাংলাদেশ হামাগুড়ি দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে।’ মূলত: ছাত্রদের নেতৃত্বে সঙ্ঘটিত এই বিক্ষোভ বা সঙ্ঘর্ষ  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যদের পরিবার-পরিজনের জন্য সরকারী চাকরির ৩০% শতাংশ কোটা বাতিল করার লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। সুপ্রীম কোর্ট সাথে সাথে এই চাকরির কোটার হার মাত্র পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনে যা সেনাবাহিনী কর্তৃক আরোপিত কার্ফ্যুর সমান্তরালে আইন-শৃঙ্খলার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। বর্তমানে এই কার্ফ্যু ধীরে ধীরে শিথিল করা হচ্ছে।

সংক্ষেপে বললে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রতি ক্রমাগত তিক্ত বা বিরূপ হয়ে উঠছে এবং দিল্লির স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতিকে শাস্তি দিতে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে পারাটা তাদের জন্য বেশ সুবিধাজনক হয়- বাংলাদেশ ভারতের নিকটবর্তী সেই নাজুক, স্পর্শকাতর বিন্দু। এছাড়া, বাংলাদেশ মস্কোকে পরিত্যাগ করতে রাজি না হওয়ায় ওয়াশিংটনও ঢাকার প্রতি ক্ষুব্ধ। এই বিষয়গুলোই ওয়াশিংটনকে বাংলাদেশে ২০২৪-এর জানুয়ারির আগে একটি ’কালার রেভল্যুশন’ আয়োজনের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল যদিও মার্কিনীদের এই পরিকল্পনা তখনো পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। তবু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে আস্থার ক্ষেত্রে চিড় ধরেছে এবং সেজন্যই বাংলাদেশের নেত্রী সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে আমেরিকা তাঁর দেশকে একটি বশংবদ বা প্রতিনিধি রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়।

এমতাবস্থায় বাইরে থেকে যে কোন পর্যবেক্ষকের এমনটা মনে হতেই পারে যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম অস্থিতিশীলতা একটি বিলম্বিত ’কালার রেভল্যুশন’ থেকেও খানিকটা বেশি। তবে বাস্তবতা আরো অনেক বেশি জটিল। সেদেশের বিরোধী দল নিশ্চিত ভাবেই এই উত্তেজক ও প্রায় দাঙ্গা-ত‚ল্য পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে ইন্ধন যোগানোর কাজ করেছে। পাশাপাশি এই ভয়ানক সঙ্ঘর্ষ-পরায়ণ, দাঙ্গা-ত‚ল্য পরিস্থিতিকে চিরস্থায়ী করতেই যেন পুরো উত্তপ্ত অবস্থাটিই ছাত্রদের নেতৃত্বেই রইলো এবং সমাজের অন্য নানা অংশের সদস্যদেরও যুক্ত করতে চাইলো। কারণ ছাত্ররা সহ বাংলাদেশের সমাজের বহু মানুষেরই কাছে সরকারী চাকরি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। যদিও এতে করে ছাত্রদের গৃহীত আন্দোলনের সহিংস পন্থাকে উপেক্ষা করা যায় না, তবে এটা থেকে বোঝা সম্ভব হয় যে কেন এই ছাত্রদের আন্দোলনের ইস্যুটি এত জনপ্রিয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের অর্থনীতি পাকিস্থানের অর্থনীতির চেয়েও আয়তনে আরো বৃহদাকার হয়ে উঠেছে। ব্যপারটি সত্যিই আগ্রহোদ্দীপক যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশ ছিল পাকিস্থানের একটি অংশ। তবু বাংলাদেশের সমাজের কিছু কিছু অংশ দেশটিতে সম্পদের বন্টণ এবং শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে উদ্বিগ্ন। দেশটিতে বাড়তে থাকা ভিন্ন মতের সাথে ক্রমবর্দ্ধমান বেকারত্বের হার মিলে ইতোমধ্যেই বিরোধী দলের রাজনীতির প্রতি অনুরাগী তরুণদের একটি বিপুল অংশকে সরকারী চাকরির কোটা নীতি বিষয়ে সংগঠিত হবার পেছনের মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে।

যদিও এই খাতে প্রাপ্তব্য নতুন চাকরিগুলো দেশের সামগ্রিক চাহিদার তুলনায় প্রতি বছরই যেন আরো বেশি অপ্রত‚ল বলে মনে হয়, তবু যারা সরকারী কাজ পায়, তারা যেন সারা জীবনের মতো প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এজন্যই গোটা দেশ জুড়ে এই দাবি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে পারিবারিক যোগাযোগের বদলে মেধার ভিত্তিতেই চাকরিগুলো প্রাপ্য হওয়া উচিত। বাংলাদেশের সরকার বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো এই অনুভূতিকেই কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাসীণ দলের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা এবং কিছু বিক্ষোভকারীকে সহিংস কর্মকান্ডে অংশ নিতে প্ররোচিত করেছে।

বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু না জানা কোন অপ্রশিক্ষিত নিরীক্ষক বা পর্যবেক্ষকের কাছে বর্তমানের সহিংস পরিস্থিতিকে বা ’কালার রেভল্যুশন’ বলে মনে হলেও বাস্তবে বহু যুগের পুরণো নীতির প্রতি দীর্ঘদিন ধরে জমতে থাকা অসন্তোষের ফলাফল হলো এই গৃহযুদ্ধ ত‚ল্য দাঙ্গা-পরিস্থিতি। আর বাংলাদেশের বাইরের শক্তিগুলোর পক্ষে এই সার্বিক পরিস্থিতি তাদের নিজেদের কাজে লাগনোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

গত জানুয়ারির নির্বাচনের সময়েই বিরোধী দলগুলোর প্রতি আনুগত্যপূর্ণ ও বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কর্তৃক সুবিধাপ্রাপ্ত এনজিওগুলো কোটা-বিরোধী ছাত্রদের একটি বিপুল অংশকে সংগঠিত করে তুলেছিল যা পরবর্তী সময়ে এই দ্বিতীয় দফা সহিংসতার মঞ্চ প্রস্তÍত করেছে।

ক্ষমতাসীন দলকে তাই এই মূহূর্তে বিশেষ সঙ্কট মোকাবেলা করতে হচ্ছে যেহেতু সে দেশের প্রাপ্ত-বয়ষ্ক তরুণেরা সাম্প্রতিক নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সাথেই নতুন মৈত্রী-বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা অনেকেই নিরাপত্তা বাহিনীসমূহ কর্তৃক বলপ্রয়োগের অসম ব্যবহারে বিক্ষুব্ধ এবং তরুণ প্রজন্মের ভেতরে চিন্তার এই প্রবণতা সহজে আর বিপরীতমুখী করা যাবে না। ছাত্রসমাজ ও বিরোধী দলের ভেতর এই ঐক্য সূত্রেই দেশটিতে যাবতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক বিনাশযজ্ঞ চালানো সম্ভব। বিশেষত: যদি বাইরের দেশগুলো থেকে আর্থিক ও সাংগঠনিক সহায়তা এবং এই আন্দোলনের প্রতি সহানুভ‚তিশীল গণমাধ্যম প্রতিবেদন পাওয়া যায়। চলমান এই ধ্বংস বা বিনাশযজ্ঞের প্রক্রিয়া যে চলমান রয়েছে তা’ সরকারের গৃহীত পূর্বতন কোটা নীতির সংস্কার দাবি করা থেকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ক্ষমা চাওয়া, মন্ত্রীসভার অন্যান্য মন্ত্রীদের পদত্যাগ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর কোন কোন সদস্যের গ্রেপ্তারের দাবিও ছাত্রদের উত্থাপিত দাবি-দাওয়াগুলোর অন্তুর্ভুক্ত হওয়া থেকে বোঝা যায়। এটা বোঝাও খুব দূরূহ নয় যে কিভাবে এই আন্দোলন খুব দ্রæতই একটি শাসন বা সরকার পরিবর্তনের প্রকাশ্য আহŸানে পরিণত হতে পারে, সেই লক্ষ্যে আরো বেশি বেশি প্রতিবাদ সমাবেশ হতে পারে এবং এই অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র পরিচালনায় আরো ফাটল ধরলে সরকার-বিরোধী উগ্রতম শক্তিগুলো কর্তৃক একটি বিদ্রোহী ও সন্ত্রাসী অভিযান চালানো যায়।

ভবিষ্যতে তাই বাংলাদেশ নিজেকে আরো চাপের ভেতরে আবিষ্কার করতে পারে যদিও এটি অস্বচ্ছ যে এই অস্থিতিশীলতার পরবর্তী পালা কখন শুরু হবে, ঠিক কতটা স্তর পর্যন্ত দেশের বাইরের বা বহি:স্থ শক্তিগুলো নিজেদের এসবে জড়াবেন এবং একবার চ‚ড়ান্ত ঘটনাটি ঘটে গেলে সবকিছু কি ভয়ানক রূপ নেবে। যাহোক, অনিবার্য যা সামনে আসবে তার জন্য কর্তৃপক্ষকে প্রস্তÍত হতে হবে এবং সরকার-বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে শান্তিপূর্ণ ভাবে পাল্টা লড়াই লড়তে হলে সরকারের অনুক‚ল নাগরিক সমাজের শক্তিসমূহের বিকাশের পথ প্রশস্ত করতে হবে। ’গণতান্ত্রিক নিরাপত্তা’র শিক্ষা অনুযায়ীই সেটা বাংলাধেম সরকারের সেটা করতে পারলে ভাল।

ভারত মহাসাগরের উত্তরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগবিন্দুতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই ’নতুন শীতল যুদ্ধ’-এর সময়কালীন পরাশক্তিগুলোর ভারসাম্যের প্রশ্নে দেশটির ভ‚-কৌশলগত গু রুত্ব রয়েছে। এর অর্থ হলো দেশটিকে সারা জীবনই বিদেশী শক্তিগুলোর চক্রান্তের বিষয়বস্তু হয়ে থাকতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলটির একইসাথে চীণ, ভারত, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মৈত্রী-জোট বাঁধা আপাত:দৃষ্টে বাস্তববাদী বুদ্ধিমত্তার স্বাক্ষর মনে হলেও বস্তÍত: এই কারণেই ওয়াশিংটন দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। যেহেতু দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ’কনিষ্ঠ অংশীদার’ হতে রাজি হয়নি।

টীকা: একবিংশ শতকের শুরুতে সোভিয়েত যুগের অবসানের পর আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, ইউক্রেন, কিরঘিজিস্থান এবং ফেডারেল রিপাবিক অফ যুগোশ্লাভিয়ায় পশ্চিমা উদারনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অ-হিংস প্রতিবাদেও প্রেক্ষিতে বিদ্যমান সরকারগুলোর পতনকে ’কালার রেভল্যুশন’ বলা হয়। মূলত: ঐ দেশগুলোয় নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিপুল জন-অসন্তোষের প্রেক্ষিতে এই ’বিপ্লবগুলো’ সঙ্ঘটিত হয় যেখানে অন্তর্জাল যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বেশ কাজ করে এবং প্রতিবাদগুলোয় এনজিওগুলোও একটি শক্তিশালী ভ‚মিকা পালন করে। এমন কয়েকটি সরকার পতনের আন্দোলনের ভেতর সফল আন্দোলন হিসেবে রয়েছে যুগোশ্লাভিয়ার ’বুলডোজার বিপ্লব (২০০০),’ জর্জিয়ার ’গোলাপ বিপ্লব (২০০৩),’ ইউক্রেনের ’কমলা বিপ্লব (২০০৪),’ কিরঘিজিস্থানের ’টিউলিপ বিপ্লব (২০০৫)’ এবং আর্মেনীয়ার ’মখমল বিপ্লব (২০১৮)।’

 


শিবাংশু দে

 

শ্যামলবাবুকে যা বলা হয়নি

 


তেইশ বছর আগে সেপ্টেম্বরের চব্বিশে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গিয়েছিলেন। নেহাত অকালেই। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হতো একানব্বই। এতো আগে চলে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। তবে সব কিছুর 'মানে' কে’ই বা আর বুঝতে পারে?

কিশোরকালে দেশভাগের পর ওপার বাংলা থেকে যখন তিনি এদেশে এসে পৌঁছোন, ভায়া শেয়ালদা রেলস্টেশন, তার আগে যুদ্ধ দেখে এসেছেন। এদেশে ইশকুল, কলেজ, ছাত্র রাজনীতি, মিছিল, গুলি, কলেজ থেকে মাঝপথে বিতাড়ন, লোহাকলে ফার্নেস হেল্পার হিসেবে গলন্ত ইস্পাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে 'লিখিবার হল তাঁর সাধ'। 'সাধ'টি ছিলো আগে থেকেই, কলকাতায় এসে তা ঘনত্ব পেলো। সেকালের কলকাতার সাহিত্য জগৎকে তিনি দেখেছিলেন এভাবে,

'এই সময় সেনেট হলে একটি কবি সম্মেলন হয়। তাতে আমাদের বয়সী অনেকে কবিতা পড়ল। তারা ধুতি-পাঞ্জাবি বা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে। একে অন্যকে আপনি-বাবু বলে ডাকে। একসঙ্গে কথা বলতে হলে চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। সিগারেট ধরায়। পকেট থেকে কবিতা বের করে।

এদের দেখা পাবার জন্যে মর্নিং শিফটের পর হাওড়া লাইনের সেই কারখানা থেকে কলেজ স্ট্রিটে যেতাম।  ওদের সঙ্গে বসে আত্মীয়তা বোধ করতাম। যদিও এখন জানি, কোন কারণেই আত্মীয়তা বোধ করে পুলকিত হওয়ার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু তবু হতাম।'

প্রথম দর্শনে কলকাতাকে তাঁর খুব 'নিষ্ঠুর' মনে হয়েছিলো। এখনও এ শহরে যেসব নবীন যশোপ্রার্থী 'লেখালেখি' করার বাসনা নিয়ে আসেন, তাঁদেরও সে রকমই লাগে। প্রথম লেখাটি ছাপা হবার পর তাঁর অবাক লেগেছিলো। মনে হয়েছিলো, 'ও, তাহলে এই ভাবে লেখে!

তবে পরবর্তীকালে বারবার বলেছিলেন, 'সব দিক থেকে 'অপমানের ঝাপটা' আর 'ব্যর্থতার বাতাস' তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে এসেছে সেকালে। বন্ধু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, 'তুই একদম বানাতে জানিস না। তোর কোন ইমাজিনেশন নেই।'

কিছুদিন আগে শ্রদ্ধেয় গল্পকার অমর মিত্র একটি আসরে বললেন, এখন যাঁরা বাংলা গল্প লিখছেন, তাঁরা কি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প পড়েন? পরবর্তী প্রজন্মের কেউ কেউ বললেন কিছু পড়েছেন। তবে মনে হলো সে পর্যায়ের তন্নিষ্ঠ শ্যামল-পাঠ কম গল্পকারই করেন এখন। পিছিয়ে যেতে হলো  আধ শতক আগে। ইশকুল পেরিয়ে তখন প্রথম কলেজে গেছি। তিন নবাগত 'ব্রাহ্মণ', সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পাঠক জয়ের যুদ্ধ চালাচ্ছেন। 'একা এবং কয়েকজন', 'যাও পাখি' আর 'কুবেরের বিষয়আশয়' নিয়ে আসরে নেমে এসেছেন তাঁরা। লোকে নতুন গদ্যের স্বাদ পাচ্ছে। বাংলা ফিকশনে তিন 'বাঁড়ুজ্যে'র পর তৈরি হওয়া এক নতুন ত্রিভুজ। গদ্য ও আখ্যান শৈলীর অন্য প্রসঙ্গগুলি ছেড়ে দিলেও বলা যায় এই তিনজন তিন ধরনের নতুন বাংলা গদ্যভাষা তৈরি করেছিলেন। পাঠকের বিচারে ভালো বা ততো ভালো নয় এমন পক্ষপাত থাকতেই পারে। কিন্তু ঘটনা হলো পরবর্তীকালে যাঁরা মূল স্রোতের বাংলা ফিকশন লিখতে ব্রতী হয়েছেন, এঁদের গদ্যশৈলী এড়িয়ে যেতে পারেন না। এঁরা কমলকুমার, অমিয়ভূষণ বা নবারুণের থেকে আলাদা। একেবারে আলাদা। কিন্তু তাঁদের বিক্রমকে অস্বীকার করতে চাওয়া এক ধরনের ছেলেমানুষি। গা-জোয়ারি বলা যায়।

কিশোর বয়স থেকেই শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এমনিতেই পড়ি। সময় পেলেই। একেবারে বাল্যকালে 'দেশ' পত্রিকায় একটি উপন্যাসের হেডপিস দেখতুম। একটি উল্টো হাতের পাঞ্জার স্কেচ। নাম, 'কুবেরের বিষয় আশয়'। লেখক, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। তখনও পড়ার বয়স হয়নি। পড়তুমও না। তবে চমকপ্রদ নামটা স্মৃতিতে থেকে গিয়েছিলো। তাঁকে আমার প্রথম পড়া একটি গল্পসংগ্রহের মাধ্যমে। তখন আমি বোধহয় দশ ক্লাসে। শুরু থেকেই আমি তাঁর নিবিষ্ট পাঠক।

কলকাতার ঘিঞ্জি এজমালি পারিবারিক আবাসে তাঁর লেখালেখির ন্যূনতম জায়াগা ছিলো না। প্রেসে বসে লিখতেন। নয়তো অন্য কোথাও। ষাট সালে বিবাহ, একষট্টিতে বাবা হওয়া। আনন্দবাজারের চাকরি। শ্যামল-পত্নী ইতি গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন,

'ক্ষুধার্তের মতো শ্যামল লেখার জায়গা খুঁজছিল একটা। তার সঙ্গে হয়তো খুঁজছিল লেখার নতুন বিষয়ও। কারণ, এই সময় থেকেই তো ওর মধ্যে একটু একটু করে চাড়িয়ে উঠছিল জমির নেশা।'

(আমার শ্যামল - ইতি গঙ্গোপাধ্যায়)

পঁয়ষট্টি সাল থেকে তিনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গ্রামীণ প্রান্ত চম্পাহাটিতে জমিজমা কেনা এবং বাড়ি বানানো শুরু করেন। সাতষট্টিতে কলকাতা ছেড়ে সেখানে নিজের বাড়িতে থাকা। তাঁর সঙ্গে সেখানে জমি কিনতে শুরু করলেন অন্য লেখক বন্ধুরাও। মতি নন্দী, কবিতা সিংহ, সন্তোষকুমার ঘোষ, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, আরও অনেকে। এরকম সময়ে  তিনি একটি উপন্যাস লেখা শুরু করলেন। এক বন্ধুর পত্রিকায়। নাম, 'গণেশের বিষয় আশয়'। উপন্যাস তিন কিস্তি প্রকাশিত হবার পর পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলো। সাগরময় ঘোষ তাঁর কাছে 'দেশ' পত্রিকার জন্য ধারাবাহিক উপন্যাস চাইলেন যখন, শ্যামল অসমাপ্ত উপন্যাসটিই ঈষৎ নাম বদলে লেখা শুরু করে দিলেন। রচনাটি সে সময়  বিশেষভাবে জনআদৃত হয়। 'কুবের বিষয় আশয়' এভাবেই এসেছিলো। কিছুদিন পরে হঠাৎ আদেশ আসে চার কিস্তির মধ্যে লেখাটি শেষ করে দেবার জন্য। শ্যামল খুব আঘাত পেয়েছিলেন। পরে একটি স্মৃতিচারণে পাই,

'সাপ্তাহিকে বেরোবার সময় সম্পাদক ওটাকে উপন্যাস বলেই গণ্য করেননি। ক্ষমা-ঘেন্না করে বিজ্ঞাপন করতেন: ধারাবাহিক রচনা। আচমকা চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, আর চার কিস্তির ভেতর শেষ করে দাও।

তাই শেষ করেছিলাম। সেই সম্পাদক বারো বছর পরে সেদিন বললেন, কী বই লিখেছিলে। ক্লাসিক। আমি ধন্য হয়ে কৃতার্থের হাসি হেসেছিলাম।'

'শাহজাদা দারাশুকোহ'-কে যদি শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যতিক্রমী সৃষ্টি হিসেবে গণ্য করি তবে তাঁর বাকি রচনাগুলির মধ্যে স্পষ্ট আত্মজৈবনিক ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাঁর বিশ্রুত ত্রয়ীর মধ্যে দুটি, 'কুবেরের বিষয় আশয়' এবং 'ঈশ্বরীতলার রূপোকথা'র পটভূমি তাঁর গ্রামীণ বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে। তৃতীয় উপন্যাসটি 'হাওয়াগাড়ি', যার পটভূমি মহানাগরিক। এছাড়া তাঁর অধিকাংশ গল্প ও উপন্যাসের আধার গ্রামীণ, কৃষিভিত্তিক চালচিত্রের অংশ। এ বিষয়ে তাঁর অবস্থান এই রকম,

'৩২-৩৩ বছর বয়সে এমন একটা গাঁয়ে গিয়ে বাসা বাঁধলাম, যেখানটায় বিদ্যাধরীর বন্দী জল প্রায় চল্লিশ বছর আটক থেকে সব রকম গতি রুদ্ধ করে রেখেছিল। জল নিকাশের পর সেখানে নতুন প্রাণ সঞ্চারিত হচ্ছিল।

এমন জায়গায় একদিন শীতের বিকেলে বোরো ধানের বীজতলা করা হচ্ছিল। চাষী ফকিরচাঁদ ডুবন্ত সূর্যের দিকে মুখ করে তিন দিনের অঙ্কুরিত ধানবীজ হাতের বিশেষ প্রক্রিয়াতে পাঁক মাটিতে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। সেগুলিই পরে ধানচারা হয়ে দাঁড়াবে।

বললাম, এ-রকম শিখলি কোথ্থেকে ফকিরদা?

ছোট ঠাকুদ্দার কাছ থেকে।

আমি সেই বিকেলে পরিষ্কার দেখতে পেলাম, আমাদের বীজতলায় খানিক দূরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফকিরচাঁদের ছোট ঠাকুদ্দা, তস্য ছোট ঠাকুদ্দা, তস্য ছোট ঠাকুদ্দা-। এরই নাম বোধ হয় সভ্যতা। এসব জিনিস বোঝা এক জিনিস। আর ফুটিয়ে তোলা আরেক জিনিস। বিশেষ করে পাঠকের মনে সঞ্চারিত করা’।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের যাবতীয় সৃষ্টির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত যাপন ও অভিজ্ঞতা ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকে। তিনি শুধু মনোজগতের কথাকল্প নিয়ে আখ্যানরচনা করতেন না। তাঁর সমস্ত কথানির্মাণের সঙ্গে তিনি শারীরিক অর্থেও তুমুলভাবে জড়িয়ে থাকতেন। অনেক বিদেশী সর্বকালের সেরা শব্দশিল্পীদের সম্বন্ধে যেমন শুনেছি, যথা, জ্যাক লণ্ডন, ম্যাক্সিম গর্কি, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ইত্যাদি বহু গরিমাময় নাম। সেই তালিকায় রয়েছেন আমাদের নিজস্ব সমরেশ বসুও। এঁরা সবাই তাঁদের লেখার বিষয়ের সঙ্গে একান্ত যাপন সমীকৃত না হলে লিখতে বসতেন না। যদিও অনেক খ্যাতনাম লেখক এই জাতীয় তত্ত্বে বিশ্বাস রাখেন না। তাঁরা মনে করেন আধেয়র সঙ্গে অতো লুটোপুটি না করেও বিশ্বাসযোগ্য সৃষ্টি করা যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে শ্যামল একবার বলেছিলেন,

'...কবি লিখছেন ধান করো। ধান করো। ধান একদা গণনাট্যের গান হয়েছিল। ট্রেনের জানালায় বসলে এই দৃশ্যই দেখা যায়। ধান, গরু, জল, মানুষ - এসব তো একই সুতোয় গাঁথা। একজন লেখক এ ব্যাপারটি কি এড়িয়ে চলতে পারেন? তাঁর শিক্ষায় এটা কি অবশ্য পাঠ্য নয়? এই তো তাঁর টেক্স্ট বুক। এ কথা কোন এক আড্ডায় বলাতে আমার খুবই প্রিয় একজন সমসাময়িক লেখক বলেছিলেন, না। ও সম্পর্কে লেখকের একটা রিমোট ধারণা থাকাই যথেষ্ট। আমি জানি, এই টেক্স্ট বইখানা পড়া থাকলে ওই লেখকের বিষয়বস্তু ও কলমের জাদু অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়াত। আমরা কেউ তাঁর সামনে এগোতে পারতাম না।'

তাঁর এই অবস্থানের বিপরীতে 'একদা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, হোয়াট ইজ লফটি ইন ইওর স্টেয়িং ইন এ ভিলেজ?' সন্তোষকুমার ঘোষ বলেছিলেন 'শ্যামল ধানের খেতে হারিয়ে গেছে।'

ফিকশন পড়া খুব কমে গেছে ব্যক্তি আমার। লেখালেখির জন্য যা কিছু পড়তে হয় তাই বেশ ভারি হয়ে যায়।  তবু মাঝে মাঝে বাংলা ছোটোগল্প পড়ে অক্সিজেন পাই। যাঁদের লেখা পড়ি, তাঁদের মধ্যে মধ্যে শ্যামল আছেন। যদি প্রশ্ন ওঠে, কেন? তবে বলবো সেই রিকশাওয়ালার প্রতি টান আছে আমার। যে বলে,

'ভগবানের কথা ভাবি। মাঝে মাঝে রিকশা চালিয়ে ভগবান দেখতে বেরোই।'

সেই লোকটিকে শ্যামল ধরে আনেন আমার কাছে,

'...ভাবতে অবাক লাগল। একটা লোক ভগবান দেখতে প্যাডেল করে রিকশা নিয়ে উত্তরে যায়, দক্ষিণে যায়। গল্প লিখলাম - চন্দনেশ্বরের মাচানতলায়।'

তাঁকে নিয়ে একটা কিছু লিখবো সে রকম কিছু ভাবিনি।  সত্যি কথা বলতে ভাবতুম একটু সময় লাগবে। মনের মধ্যে  ইচ্ছে হয়ে থাকা লেখাটি পাতায় নামাতে সময় লাগবে। মনে পড়ে  বাংলা আখ্যানের যে ভঙ্গিটি  সিনেমার ন্যারেটিভ হয়ে উঠতে চায়, অনেক গদ্যকার সেকালে লড়ে যেতেন তাকে আয়ত্ব করার জন্য। মানে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে। বহু বাঙালি রসিক রহস্য ভরে বলতেন, লেখাটি পড়িনি। তবে  সিনেমা হলে দেখে নেবো।' সিনেমায় দেখতে পেলে বাংলা আখ্যান জাতে উঠে যায়।  যে সব ব্যাপারস্যাপার দেখতে বাঙালি  এখন 'রানি রাসমণি'র সামনে হাত জোড় করে বসেন। সাহিত্যপাঠের নিমগ্নতা হাইজ্যাক হয়ে যায় অনৃত ভাবালুতার কাছে।  শ্যামল সেটা করেননি। সজ্ঞানে না অবচেতনে, বলা মুশকিল। শব্দমালার  আকুল ফ্রেমে বাঁধা ন্যারেটিভে নিজেকে উদ্ধার করে আনার স্পৃহা ছাড়া শ্যামল ধরা দিতে চান না। কোনও চতুরতার স্পর্শে  মলিন হতে দেখিনি তাঁকে। তাঁর লেখা নিয়ে 'সিনেমা' হয় না। শেয়ালদা থেকে আঁধার রাতে ক্যানিং লাইনের শেষ ট্রেন ধরে শ্যামল টুক করে চম্পাহাটি নেমে যান যখন, মনে হয় এইতো 'যাওয়া'। এর সিনেমা হয় না।

পঞ্চাশ-ষাট দশকে বাংলা আখ্যান গদ্যের বাজার ছিলো 'কথক'দের দখলে। অনেকদিন ধরে গোছানো গল্পের স্রোতে ডুবে থাকা পাঠক তার বাইরে ভাবতে পারতেন না। মূলস্রোতের বাঙালি পাঠকের সাইকিটিই ছিলো  কথকতার। বাংলায় সেকালের সফল লিখিয়েরা সবাই যেন কথকঠাকুর। যেমন ধরা যাক, বিমল মিত্র। নাক উঁচু পণ্ডিতরা তাঁকে খুব হ্যাটা করতো। এখনও করে। অথচ ভাষার উপর তাঁর দারুণ দখল। প্লটের পর প্লট নিপুণভাবে গেঁথে যান। চরিত্রদের খেলাতে পারেন। অতো অতো লিখতে পারেন। আর রয়েছে সহজাত গল্প বাঁধার কৌশল। কিন্তু বাংলায় 'উপন্যাস' নামক নির্মাণটি, যেটা সম্ভবত বিলিতি নভেল থেকে ধার করা, চারিত্র্যে একেবারেই আলাদা। তা বলে কি তিনি 'লেখক' ন'ন? তিনি তো একজন অখিল ভারতীয়  'ট্রেন্ডসেটার' ছিলেন। শরৎচন্দ্রের পর তাঁর লেখাই সব থেকে বেশি অনূদিত হয়েছিলো। তাঁর লোকপ্রিয়তা অসাধারণ। কারণ, বাঙালির একটাই চাহিদা, 'গল্প ভালো, আবার বলো'। বিমল মিত্র যেন সেই সুবাদেই ছবি-করিয়ে-দের লেখক। কিন্তু কয়েকজন বাংলা কথাকার কথকতা করেন না। তাঁদের আখ্যান, সৃষ্ট চরিত্রগুলিকে এমনভাবে তৈরি করেন, অন্য কোনও শিল্পী তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। কেউ কখনও 'ঢোঁড়াই'য়ের সিনেমা বানাতে পারবেন কি? চেষ্টা করতে পারেন। কিন্তু কোনও বড়ো ছবিকর হলে সতীনাথ নয়, তাঁর নিজের 'ঢোঁড়াই'কে তৈরি করবেন। সেটা কোনও অবস্থাতেই 'সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ণ' হবে না। হবে না 'কুবেরের বিষয়আশয়' বা 'ঈশ্বরীতলার রূপোকথা' বা 'হাওয়াগাড়ি'। শ্যামল কথক ছিলেন না। তিনি মূলত কবি। আদি কবি।

একজন কথাশিল্পীর রাজনৈতিক বিশ্বাস শুধু ব্যক্তি নয়, তাঁর শিল্পকেও বুঝতে সাহায্য করে। একজন সিরিয়স পাঠক তা বিশ্বাস করেন। আগেও করতেন। কিন্তু শ্যামল ঘোষণা করেছিলেন,

'…আরও মুশকিলের কথা- আমার কোন রাজনৈতিক বিশ্বাস নেই। কোনদিন মনে হয়নি- অমুকে ক্ষমতাচ্যুত হলে এবং সে জায়গায় অমুক এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি সর্বদাই জানি- রাষ্ট্র ও প্রশাসন মানে একটি অন্ধ, কবন্ধ দানব। সেজন্যে কেউ ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নয়। এটা একটা ব্যবস্থা বা প্রথা। এক সময় ছিল, যখন আমেরিকা পরমাণু বোমা ফাটালেই খবরের কাগজের প্রতিবাদ পত্রে আমরা সই দিতাম। রাশিয়াও যখন ফাটালো তখন কোন কোন রাজনৈতিক-বিশ্বাসী সমসাময়িক সই দিলেন না। তারপর সময় যেতে বুঝলাম- লিখতে হলে এই সইসাবুদ সর্বৈব বাজে ব্যাপার।'

এই স্বীকারোক্তি বিশ্লেষণ করলে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক অবস্থানটুকু অনায়াসেই বোঝা যায়। একজন বাংলা সাহিত্যপাঠক হিসেবে তার মধ্যে কোনও আপত্তিজনক, অস্বীকার্য তত্ত্ব পাইনি কখনও। ভিন্নমত হওয়া যায় হয়তো, কিন্তু অস্বীকার করা যায় না। কারণ তাঁর সৃজন সত্ত্বায় মাটির থেকে রস আহরণের লক্ষণ অতি প্রত্যক্ষ। পাঠক আমার কাছে তিনি অপরিহার্য এক কথাকার হয়ে উঠতে পারেন।



ঠিক চার দশক আগে জামশেদপুরে একটি সাহিত্য সম্মেলনে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখোমুখি হয়েছিলুম। তখন আমি শহরের 'তরুণ তুর্কি'। নানা জায়গায় সুযোগ পেলেই (না পেলেও) রালফ ফক্স, কডওয়েল, কর্নফোর্ড, নেরুদা, এঙ্গেলস, লেনিন, গতিয়ে আউড়ে যাই। ভাবতুম, ‘The Novel and the People'-এর মানচিত্রের বাইরে আর কোনও দেশ নেই। এই সব ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ  লোকে শুনতে ভালোবাসতেন আমাদের শহরে। সেই সুবাদে সভার উদ্যোক্তারা আমার উপর একটা দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিলেন। সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্যের পাঠক হিসেবে তার মধ্যে কী কী অসম্পূর্ণতা চোখে পড়ে সেই প্রসঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত করতে আমি আদিষ্ট হয়েছিলুম। কথা ছিলো সেই সভায় উপস্থিত দুই সাহিত্যরথী প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত এবং শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় আলোচনাটি পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যাবেন। সেকালে জামশেদপুরে প্রবুদ্ধ বাংলা সাহিত্য অনুরাগীর অভাব ছিলো না। অনেকে এসেছিলেন আলোচনার অংশভাগী হতে।

পাঠক হিসেবে তখন যেমন ভাবতুম সেই পরিপ্রেক্ষিতে মূল স্রোতের জনপ্রিয় বাংলা গদ্যসাহিত্য বিষয়ে (যাকে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 'বাজার সাহিত্য' বলতেন) একটা পেপার পড়েছিলুম সেই  সভায়।  প্রতুলবাবু আমার বক্তব্য নিয়ে মোটামুটি একমত হলেন। সঙ্গে নিজের বক্তব্যও জানিয়েছিলেন পেশাদারি দক্ষতায়। গুছিয়ে। তারপর বলতে গিয়ে শ্যামলবাবু হঠাৎ রীতিমতো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। আমরা জানতুম তিনি বেশ খানিকটা প্রমত্ত অবস্থায় ছিলেন। তার উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণহীন 'বাঙালে' ক্রোধী স্বভাবটি পরিচিত জনের জানা থাকলেও সবাই তো জানতেন না। সব মিলিয়ে তাঁর বক্তব্যের মধ্যে সমকালীন বাংলা 'কথাসাহিত্য'-এর প্রসঙ্গ অবহেলিত হয়ে অসহিষ্ণু দোষারোপের পালাই প্রধান হয়ে উঠলো। 'খালাসিটোলা' সম্পৃক্ত মেধার অপচয় হেন। অহৈতুকী বক্তব্যের প্রতিবাদে বেশ কিছু সমাগত ভদ্রজনও বিরক্ত হয়ে তাঁর কাছে 'জবাব' চাইতে লাগলেন। ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া শুরু হতে আমার পিতৃদেব, যিনি সভা পরিচালনা করছিলেন, এ বিষয়ে আলোচনায় বিরতি টেনে দিলেন। শ্যামলবাবু রুষ্ট হয়ে তৎক্ষণাৎ সভা ত্যাগ করলেন।

তাঁর প্রতি ব্যক্তি আমার প্রত্যাশা ছিলো। প্রতীক্ষাও ছিলো। তাঁকে আমার অনেক কথা বলার ছিলো। তাঁর শিল্পের প্রতি আমার মুগ্ধতা জানানোর ছিলো। কিছুই হলো না শেষ পর্যন্ত। আর সুযোগও পাইনি। চাইবাসা বা গালুডি তাঁকে কেউ নিয়ে যায়নি কখনও। তাঁর আক্ষেপ ছিলো। লিখেও ছিলেন সেকথা। ভেবেছিলুম আমি নিয়ে যাবো। আমি সময় পেলুম না। তাঁরও সময় হলো না।

অন্যান্য সব শিল্পধারার মতো জনপ্রিয় বাংলা আখ্যানের ভঙ্গি বা শৈলীর মধ্যেও অনেক পরিবর্তন এসেছে গত চার দশকে। 'জীবনমুখী' গানের মতো 'সিনেমামুখী' সাহিত্যেরও  দিনাবসান ঘটেছে হয়তো। যাপনের গরমিল থেকে উঠে আসা দুঃখযন্ত্রণার রূপকথা এখন ক্যানভাস পাল্টেছে। সময় ও মূল্যবোধের প্রাসঙ্গিক মাত্রাগুলি বেশ পাল্টে গেছে গত চার দশকে। 'বই' থেকে আর 'বই' তৈরি হয় না। শুধু গল্পের টানে লেখার গুণ আর টানা যায় না। এখনই সময়। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়দের এখন জেগে ওঠার সময় হয়েছে আবার। এই কথাটি বলার সুযোগ আর হয়নি আমার। এখানেই বলে রাখি বাংলা সাহিত্য অনুরাগীদের জন্য।

(এই ছবিতে মঞ্চাসীন, ডানদিক থেকে আমার পরে পিতৃদেব ড. সত্যেন্দ্র দে, ডা.অজিতকুমার বাগচি, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, ড. প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত)

 

 


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

বড় পর্দায়  ইংরেজী  ছবি



 

ষষ্ঠ পর্বঃ  গ্লোব

সম্ভবত ১৯৬৬ সালে নিজেকে নতুন করে সাজিয়ে মধ্য কলকাতায়, নিউ মার্কেটের উল্টো দিকে, পুনর্বার আত্মপ্রকাশ করে মেট্রো-লাইটহাউসকে টক্কর দেবার উপযুক্ত গ্লোব। বাইরে আলোকিত অক্ষরে জ্বলতঃ Home of 20th Century Fox, United Artistsআর ছবি প্রক্ষেপণের জন্য, সম্ভবত কলকাতায় এই প্রথম, দেখা গেল, পর্দা নয়, plastic paint করা সাদা দেওয়াল, যা ঢাকতে ওপর থেকে নেমে আসত বিচিত্র আকারের ধূসর পর্দা, অন্যান্য প্রেক্ষাগৃহের মতো চৌকো নয়।

এই পুনঃসংস্কৃত হলে প্রথম মুক্তি পেল এলিজাবেথ টেলর, রিচার্ড বার্টন ও রেক্স হ্যারিসন অভিনীত ১৯৬৩ সালের ছবি Cleopatra, যাকে প্রযোজনা করার বিপুল খরচ টানতে গিয়ে 20th Century Fox নাকি দেনার দায়ে ডুবতে বসেছিল! ছবিটি আজ অবধি দেখা হয় নি, আর ১৯৬৬-তে তো দেখার প্রশ্নই ছিল না! সেন্সর ছবিটিকে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্ধারণ করেছিল।

দাদা প্রথম গ্লোবে, সম্ভবত ১৯৬৬-তে, নিয়ে গেলেন দেখতে ১৯৬৫ সালের Those Magnificent Men in Their Flying Machines১৯১০ সালে, এরোপ্লেন যখন শৈশব অবস্থা কাটিয়ে ওঠে নি, সেই সময়, সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে অতি প্রভাবশালী লর্ড রন্সলি (অভিনয়ে রবার্ট মর্লি) তাঁর জামাই-হবার-অভিলাষী সেনাধিকারিক রিচার্ড মেসের (জেমস ফক্স) পরামর্শে লন্ডন থেকে প্যারিস অবধি এক বায়ু-দৌড়ের ব্যবস্থা করেন। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় এখন লুপ্ত প্রাশিয়া, ফ্রান্স, ইটালি, আমেরিকা, এবং জাপানের প্রতিযোগীরা। দারুণ মজার এবং উত্তেজক ছবি, বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীরা তাদের জাতীয় চরিত্রের প্রতিভূ হয়ে ওঠায় তাদের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়া ছবিটিকে আরও উপভোগ্য করে তুলেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নীতিজ্ঞান-বর্জিত স্যার পার্সির (টেরি টমাস) মজার-মজার কূটকৌশল আর রিচার্ড, লর্ড রন্সলি-কন্যা প্যাট্রিশিয়া (সারা মাইলস), আর আমেরিকার প্রতিযোগী অর্ভিল নিউটনের স্টুয়ার্ট ওইটম্যান) ত্রিকোণ প্রেম। ৭০ মিমি প্রক্ষেপণের প্রকাণ্ড পর্দায় পুরো ব্যাপারটি আরও জমিয়ে তুলেছিল।

এরপর, ১৯৬৬-তে গ্লোবে মুক্তি পেল ইংরেজী-বাংলা-হিন্দীতে দেখা যাবতীয় ছবির মধ্যে আমার দ্বিতীয় সবচেয়ে প্রিয় ছবি, কিন্তু তার প্রসঙ্গে আসব এই ধারাবাহিক লেখার সবশেষে, আমার প্রথম সবচেয়ে প্রিয় ছবির সঙ্গে, যার উল্লেখ দ্বিতীয় কিস্তিতেই করেছি।

গ্লোবে এরপর, ১৯৬৭-তে, দাদা দেখতে নিয়ে গেলেন বহু তারকা-খচিত মজার ছবি, ১৯৬৩ সালের It’s a Mad, Mad, Mad, Mad Worldদেখুন, বিদেশী ছবি কিরকম আগে-পরে এদেশে মুক্তি পেতঃ ১৯৬৫-র ছবি এলো আগে, ১৯৬৩-র ছবি পরে। একদল মানুষ এক মৃতপ্রায় ব্যক্তির মুখ থেকে কোন এক W-এর তলায় অনেক ডলার পোঁতা আছে শুনে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে ছুটে চলে সেই W-এর খোঁজে, কেউ গাড়ীতে, কেউবা চালাকি খাটিয়ে প্লেন ভাড়া ক’রে, যদিও সে এমন আদ্যিকালের প্লেন যে তাতে চড়ে স্বামী-স্ত্রী দেখে যে নীচে হাইওয়ে দিয়ে গাড়ীগুলো তাদের ভাড়া-করা প্লেনকে পেছনে ফেলে ছুটছে! অবশেষে, অকূস্থলে পৌঁছে সবাই দেখে যে চারটে নারকেল (নাকি তাল?) গাছ পাশাপাশি, মাঝের দুটো এমনভাবে একে অপরের ওপর হেলে রয়েছে যে সব মিলে তৈরি হয়েছে একটা ঢ্যাঙা W! তার তলা থেকে টাকা উদ্ধারের পরেও চলে প্রতিযোগিতা, কে সবটা নিয়ে পালাবে! যিনি সবার মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ, অভিনয়ে স্পেন্সার ট্রেসি, তিনিই শেষ অবধি প্রায় সফল হ’ন, কিন্তু সবাই তাঁর পেছনে ধাওয়া করে। যতদূর মনে পড়ে, টাকা কারুরই ভোগে লাগে নি।

গ্লোবে ষাট আর সত্তরের দশকে এত ছবি দেখেছি যে ঠিক বলতে পারব না সবচেয়ে বেশী ইংরেজী ছবি দেখেছি এখানে না মেট্রোয়! তার মধ্যে পরের দিকে অনেকগুলোই ৭০ মিমি প্রোজেকশানে ছিল না, যেমন এলিটের ক্ষেত্রে হয়েছিলো। আপাতত ৭০ মিমি ছবির কথাই বলি।

ভাল লেগেছিল ১৯৬৭ সালে তৈরি, এখানে পরে মুক্তিপ্রাপ্ত, Hugh Lofting-সৃষ্ট চরিত্র অবলম্বনে Doctor Dolittleযাঁর নামে গল্প, সেই ভেটেরিনারি ডাক্তার জন্তুজানোয়ারদের চিকিৎসাই শুধু করেন না, তাদের সঙ্গে কথাও বলতে জানেন! সার্কাসে নাকি চিড়িয়াখানায় বন্দী, নিজের স্বাভাবিক আবাসের জন্য কাতর এক সীলমাছকে ডাক্তার ঘোমটা পরিয়ে মানুষ সাজিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেন, ফলে তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হয় মানুষ খুনের দায়ে। আদালতে ওটি যে সীলই ছিল, মানুষ নয় সাব্যস্ত হবার ফলে ডাক্তারকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়ে বিচারক শেষ মুহূর্তে ডাক্তারকে মানসিকভাবে অস্থিতিশীল আখ্যা দিয়ে পাগলা গারদে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেন! যে ঢাকা ঘোড়ার গাড়ী করে তাঁকে গারদে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তা থেকে তাঁকে নাটকীয়ভাবে উদ্ধার করে তাঁরই পোষা পশুপাখীরা! এরপর – বা আগে – আছে ডাক্তারের এক সার্কাস মালিকের সঙ্গে মিলে তাঁর দুই-মাথাওয়ালা Pushmepullyu-র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা, আর শেষে ডাক্তারের সমুদ্র-যাত্রা, এমন এক অদ্ভূত দ্বীপে যেখানে রাজত্ব করেন কৃষ্ণাঙ্গ দশম উইলিয়ম শেক্সপীয়র! একেবারে শেষে ডাক্তার চাঁদেও যাবেন, এবং ছবির শেষ দৃশ্যে ডাক্তার পৃথিবীর বুকে নামবেন চাঁদের মথের পিঠে চেপে! ডাক্তারের ভূমিকায় ছিলেন My Fair Lady-খ্যাত রেক্স হ্যারিসন, মুখ্য নারী চরিত্রে সামান্থা এগার, আর সার্কাস মালিক হয়েছিলেন পরে ৮০-র দশকে ‘গান্ধী’ পরিচালনা করে খ্যাত রিচার্ড অ্যাটেনবরো। ১৯৯৮ সালে ডাক্তার ডুলিটল-কে নতুন করে পর্দায় রূপায়িত করেন এডি মার্ফি।

১৯৭০-এ গ্লোবে মুক্তি পায় যিশুখ্রিস্ট-কে কেন্দ্র করে ছবি, ১৯৬৫ সালের The Greatest Story Ever Toldযিশুর ভূমিকায় ছিলেন ম্যাক্স ভন সাইডো, ১৯৫৬ সালে The Ten Commandments-এ মোজেস করে বিখ্যাত চার্ল্টন হেস্টন করেছিলেন দীক্ষাগুরু জন, আর যা এই ছবির সম্বন্ধে অনেকেই বলেন, শেষাংশে উপস্থিত হ’ন প্রায় সমস্ত হলিঊডঃ এমন কি সাধারণত যিনি ওয়েস্টার্ন এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি ছবিতে অভিনয় করে বিখ্যাত, সেই জন ওয়েনকেও দেখা গেল রোমান শতানীক-অধিনায়কের বেশে! আমার মনে সবচেয়ে দাগ কেটেছিল শয়তানের ভূমিকায় ডোনাল্ড প্লেজেন্সের সংযত অভিনয়, বিশেষ করে যিশু বন্দী হবার পর যেভাবে শয়তান পীটারকে, যিশুর ভবিষ্যদ্বাণী-অনুযায়ী, যিশুকে অস্বীকার করার প্ররোচনা দিচ্ছে।

এই ১৯৭০-এর বড়দিনের ছুটিতে গ্লোবে আসে জেমস বন্ড-স্রস্টা ইয়ান ফ্লেমিং-এর ছোটদের জন্য লেখা গল্প Chitty Chitty Bang Bang-এর ১৯৬৮ সালে করা চলচ্চিত্রায়ন। মূল গল্পের সঙ্গে কয়েকটি চরিত্রের নাম ছাড়া ছবির গল্প ফ্লেমিং-এর আখ্যান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। চিত্রনাট্য লিখেছিলেন ছোটদের জন্য ভিন্ন স্বাদের গল্পের লেখক রোয়াল্ড ডাহল। বাস্তবের সঙ্গে রূপকথার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি হয়েছিলো এক মুগ্ধ-করা ছবি যা গ্লোবে চলাকালীন তিন হপ্তায় দেখি তিনবার! মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন সেই ১৯৬৮-তে দেখা Mary Poppins থেকে পরিচিত ডিক ভ্যান ডাইক, নায়িকা চরিত্রে স্যালি অ্যান হোস (বেশ মিষ্টি দেখতে, কিন্তু গানের গলা – যদি তাঁর নিজের হয় – মেরী পপিন্স-সাউন্ড অব মিউজিক খ্যাত জুলি অ্যান্ড্রুজের ধারেকাছে নয়। শিশু-অভিনেতা দু’জন ভালই, তাদের ঠাকুরদাদার ভূমিকায় লায়োনেল জেফ্রীস দারুণ, আর মূল প্রতিপক্ষ – বাস্তব অংশে নয়, ভ্যান ডাইক অভিনীত মিঃ পটসের বলা রূপকথায় – যার মধ্যে পটস রেখেছেন নিজেকে, বড়লোকের মেয়ে আর পটসের দুই ছেলেমেয়ের বন্ধু ট্রুলি (স্যালি অ্যান হোস), ঠাকুরদাদা, সবাইকে – ভালগেরিয়ার ব্যারন বম্বি-রূপে জেমস বন্ডের এক ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ গোল্ডফিংগারের ভূমিকায় অভিনয় করা গার্ট ফ্রোব এবং ব্যারনেস-রূপিণী অ্যানা কোয়েল; দুজনেই খুব ভাল। আর সমস্ত ছবি জুড়ে এককালে মোটর গাড়ীর দৌড়ে দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়ে আবর্জনার মাঝে পড়ে থাকা একটা গাড়ী, যাতে ব’সে পটসের ছেলেমেয়ে দুটি খেলত, এবং যেটা বিক্রী হয়ে যেতে উপক্রম হয়েছিলো। ছেলেমেয়ের গাড়িটির প্রতি ভালবাসা দেখে পটস এক অপ্রত্যাশিত উপায়ে অভাবের সংসারে টাকার ব্যবস্থা করে সেটিকে কিনে মেরামত করে ঝকঝকে করে তোলেন। এবার ট্রুলিকে নিয়ে পটস এবং তাঁর দুই সন্তান বেড়াতে যান সমুদ্রের ধারে। এখানে বসে পটস বলতে শুরু করেন তাঁর গল্প। ব্যারন বম্বি জাহাজে করে এসেছেন ‘চিটি চিটি ব্যাং ব্যাং’ (গাড়ীর নামকরণ পটসের) চুরি করতে, কারণ সে এক প্রায়-অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ী – প্রয়োজনে সে জলে জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে, আবার অবস্থামতো আকাশেও উড়তে পারে! বম্বির চরেরা ঠাকুরদাদাকে ভুল করে অপহরণ করায় চিটি বাকীদের উড়িয়ে নিয়ে যায় ভালগেরিয়ায় (সে নিজের স্টিয়রিং নিজেই ঘোরায়; পটস বলেন, “চিটি জানে কোথায় যেতে হবে, আমি জানি না!”) ভালগেরিয়ার ব্যারনেস শিশুদের সহ্য করতে পারেন না, তাঁর এক অশিব ছেলেধরা আছে, যে বাচ্চা দেখলেই তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে প্রাসাদে বন্দী করে। পটসের দুই সন্তান তার দ্বারা অপহৃত হয়। কিভাবে পটস-ট্রুলি এবং ঐ রাজ্যের অসংখ্য সুড়ঙ্গে-লুকিয়ে-থাকা শিশুর দল তাদের উদ্ধার করে, তাই হল রূপকথার শীর্ষবিন্দু, যার পর কাহিনী ফেরত আসে বাস্তবের জগতে, কিন্তু সেখানেও অবশেষে ঘটে মোহিনী ইচ্ছাপূরণ, দুই মা’-হারা শিশু ট্রুলির মধ্যে পায় তাদের মা’কে!

বাস্তব আর কল্পনাকে পদেপদে সুন্দর ভাবে মিশিয়েছেন চিত্রনাট্যকার। শুরুতে আবিষ্কারক পটসের অভাবী সংসারে ঠাকুরদা-বাবা-ছেলেমেয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের, এবং প্রথমে দুই শিশুর বাবার জন্য স্বার্থত্যাগ, আর তার বিনিময়ে কৃতজ্ঞ বাবার তাদের সখ মেটানোর চেষ্টা মর্মস্পর্শী। আধ-পাগলা আবিষ্কারকের সঙ্গে প্রথমে মনোমালিন্য হলেও, পরে দুই শিশুর টানে তাদের একে-অপরের প্রতি বিরূপতা দূর হওয়া ট্রুলি, আর সবশেষে পটসেরই এক আপাত-ব্যর্থ আবিষ্কারের অপ্রত্যাশিত সাফল্যে সংসারে দারিদ্র্যের অবসান – সমস্ত কিছু বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। উইকিপিডিয়া পড়ে জানলাম যে ছবির নির্মাতারা ‘মেরী পপিন্সে’র সফল জুটি জুলি অ্যান্ড্রুজ আর ডিক ভ্যান ডাইককেই আবার আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত সঙ্গতভাবে জুলি বলেন যে ট্রুলির চরিত্রটি মেরী পপিন্সের (এবং, আমি যোগ করব, ‘সাউন্ড অব মিউজিকে’র মারিয়ার) পুনরাবৃত্তিই হয়েছে – সেই মায়ের (এবং ‘মেরী পপিন্সে’ বাবা-মা দুজনেরই) স্নেহ-বঞ্চিত শিশুদের মূল মহিলা-চরিত্রের মধ্যে তাদের মাকে খুঁজে পাওয়া! তাই জুলি এই ছবিতে থাকতে অসম্মত হন। আসেন মঞ্চে My Fair Lady এবং The Sound of Music-এ জুলি-অভিনীত এলাইজা ডুলিটল আর মারিয়া চরিত্রদুটিতে জুলির বদলি হিসেবে কাজ-করা স্যালি।

৭০ মিমি ছবি গ্লোবে এরপর দেখেছি প্রায় সবই যুদ্ধের ছবি। যেমন, ১৯৭১-এ পুনর্মুক্তিপ্রাপ্ত ১৯৬২ সালের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ সংক্রান্ত ছবি The Longest Dayঅভিনব ব্যাপার – ৭০ মিমি প্রোজেকশানে সাদা-কালো ছবি! যথারীতি, এই জাতীয় ছবিতে যা হয়, অভূতপূর্ব তারকা সমাবেশ ছিল। আমার দেখার কারণ ছিলেন আমার হলিউড ‘হিরো’ জন ওয়েন! এর পর দেখেছি ১৯৭০ সালে তৈরি দুটি ছবি, জর্জ সি স্কট অভিনীত Patton আর আমেরিকা-জাপানের যৌথ উদ্যোগে তোলা ১৯৪১-এ পার্ল বন্দরের ওপর জাপানী আক্রমণের উপাখ্যান Tora! Tora! Tora!

আরেকটি পুনর্মুক্তিপ্রাপ্ত যুদ্ধের ছবি গ্লোবে দেখেছি সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, তবে তা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নয়, ১৮৩৬ সালে ঘটা টেক্সাস বিদ্রোহের সময় মেক্সিকান সৈন্যের কাছে টেক্সিয়ানদের সাময়িক পরাজয় নিয়ে ১৯৬০ সালে তৈরি জন ওয়েন প্রযোজিত, পরিচালিত, এবং অভিনীত The Alamo

১৯৭৬-এ পার্ক স্ট্রীট অঞ্চল থেকে কলকাতার উত্তর-পূর্বে সল্ট লেকে নিজস্ব বাড়ীতে উঠে যাবার পর সেখান থেকে সকাল ৭ঃ৩০-এ ফরাসী ভাষা শিখতে আসতাম পার্ক স্ট্রীট-ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের সংযোগস্থলে পার্ক ম্যানশন্সে অবস্থিত আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। ক্লাস সেরে মধ্য কলকাতায় দুপুরের শোতে ছবি দেখা প্রায়ই হতো। গ্লোবে দু’-বার – একবার একা, দ্বিতীয়বার ঐ আলিয়ঁসে পাঠরতা বেথুন কলেজের তিন বান্ধবীর সঙ্গে – দেখেছি ১৯৬০ সালে শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে ‘অস্কার’-প্রাপ্ত বিখ্যাত My Fair Ladyছোটবেলায় (ষাটের দশকে) ছবিটি এলিটে এসেছিল, তবে বাবা-মা আমাকে বাদ দিয়েই দেখে এসেছিলেন, এবং অন্তত মা’র ছবিটি খুব-একটা ভাল লাগেনি। ইতিমধ্যে ইস্কুলের একাদশ শ্রেণীতে ছবির উৎস যে নাটক, বার্নার্ড শ রচিত Pygmalion, সেটি কাউন্সিলের পরীক্ষায় পাঠ্যরূপে আসে। খুব জানা কাহিনী, আর ব্রিটিশ কাউন্সিলের  প্রেক্ষাগৃহে পরে ১৯৩৮ সালের সাদা-কালো চলচ্চিত্রায়নটিও দেখা ছিল, অভিনয়ে লেসলি হাওয়ার্ড ও ওয়েন্ডি হিলার। কিন্তু কি সেখানে আর কি অ্যালান জে লার্নারের করা এই সঙ্গীতবহুল নাট্যরূপে – যা পরে চিত্রায়িত হয়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পায় – নেই নাটকের ভাবালুতা-বর্জিত উপসংহার, যেখানে এলাইজা তার শিক্ষাগুরু হিগিনসের সংস্রব ত্যাগ করে বিয়ে করছে হাবাগোবা কিন্তু তার প্রেমে পাগল ফ্রেডিকে। দুটি ছবিতেই এলাইজা-হিগিনসের মিলনের দিকেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। তবে, My Fair Lady-তে, এক জেরেমি ব্রেট অভিনীত ফ্রেডিকে বাদ দিলে (যিনি পরে আশির দশকে শার্লক হোমস হয়ে ছোট পর্দা কাঁপাবেন!), প্রত্যেকের অভিনয় নিখুঁত, গানগুলো অতি সুখশ্রাব্য, এবং ছবিটি সামগ্রিকভাবে অতীব মনোরঞ্জনকারী। শুধু এলাইজার (অভিনয়ে অড্রি হেপবার্ন) মুখের গানে, যিনি মঞ্চে চরম সফলতার সঙ্গে চরিত্রটি রূপায়িত করেছিলেন, এবং যার গলার গানের ভক্ত আমি সেই ১০ বছর বয়স থেকে, সেই জুলি অ্যান্ড্রুজের অভাব পদে-পদে বোধ করেছি! মার্নি নিক্সন, যিনি ছিলে অড্রির নেপথ্য কণ্ঠ, গায়কী এবং স্বরক্ষেপে জুলিকেই মনে করান, এবং ১৯৬৪ সালে নিউইয়র্কে তিনি মঞ্চে এলাইজার ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন (ঠিক যেমনটি করেছিলেন ‘চিটি চিটি ব্যাং ব্যাং’-এর স্যালি অ্যান হোস; আপনাদের মনে থাকবে যে ঐ ছবিতে স্যালি ছিলে জুলির বদলি অভিনেত্রী)।

১৯৭৮-এ সকালের ফরাসী ক্লাস সেরে ছুটলাম নিউ মার্কেটে গ্লোবে লাইন দিতে। সেদিন সকাল থেকে সেখানে খুলছে আরেক যুগান্তকারী ছবির অগ্রিম বুকিংঃ ১৯৭৭-এর Star Warsএই কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক রূপকথার ট্রেলর দেখেছিলাম একাধিকবার, My Fair Lady এবং অন্যান্য ছবি দেখার সময়। গিয়ে দেখি কাউন্টার খোলার অনেক আগে থেকেই লাইন সিনেমার পাশের গলিতে দীর্ঘায়িত হয়েছে। দুরু-দুরু-বক্ষে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর গম্ভীর মুখ করে এসে দাঁড়ালেন এক পুলিশম্যান। লাইনের ওপর চোখ বুলিয়ে দু’জনের দিকে আঙুল তুলে তিনি উচ্চারণ করলেন একটাই শব্দ, “নিকলো!” বিনা বাক্যব্যয়ে বেরিয়ে গেল দুই ছোকরা, বোঝা গেল টিকিট কিনে তার কালোবাজারী করা তাদের পেশা! শোনা গেল মাথা পিছু চারটের বেশী টিকিট দেওয়া হবে না। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে যখন কাউন্টারে পৌছলাম, বললাম, “তিনটে ২ টাকা ৪৫।” (আজকের দিনে এই Star Wars saga-র কোন ছবি এলে কত টাকা খরচ করতে হয় একটা টিকিটের জন্য?) অমনি পেছন থেকে আকুতি, “ও দাদা, আমাদের হয়ে একটা নিয়ে নিন না, আপনাকে দাম দিয়ে দেব।” লাইনে দাঁড়িয়েই কালো বাজারী নিয়ে যা দেখেছিলাম, সেই দৃশ্য মনে কু গাইল। বললাম, “না দাদা, নিজের টিকিট নিজে কিনুন!”

বাবা-মাকে নিয়ে শো-এর দিন গ্লোবে উপস্থিত। বাড়ীতে তখন ‘স্টেটসম্যান’ নেওয়া হত, তার সমালোচক উচ্ছ্বসিত ছবির কাহিনী এবং চিত্রায়ন নিয়ে। কিন্তু এই অতিপ্রচারের ফলেই বোধহয় তেমন মন ভরল না, শেষে কি রকম যেন ভাবাবরোহের অনুভব হলো! অথচ, আশির দশকের গোড়ায় যখন এই গ্লোবেই মূল ছবির পরবর্তী কাহিনীর চিত্রায়ন দেখলাম, The Empire Strikes Back (১৯৮০), দারুণ লাগলো! এ তো সেই গুগাবাবা-র চেয়ে হীরক রাজার দেশে বা গুপী-বাঘা ফিরে এল বেশী ভালো লাগার মতো!

বিদেশ থেকে ১৯৮৮-তে ফেরার পর হবু-শ্যলিকা-শ্যালককে নিয়ে গ্লোবে দেখি স্পিলবার্গ-সৃষ্ট দুর্দান্ত চরিত্র ইন্ডিয়ানা জোনসের তৃতীয় অভিযান Indiana Jones and the Last Crusade (১৯৮৯) । এই অনবদ্য সৃষ্টির প্রথম কিস্তি, Raiders of the Lost Ark (১৯৮১) এই গ্লোবেই মুক্তি পেয়েছিল, তখন দেখা হয় নি। অক্সফোর্ডে কলেজে ভিডিওতে দেখে আমি মুগ্ধ! ওদেশে একটি টিকিটে দুটি বা তিনটি ছবি দেখানোর চল ছিল – বলা হত double বা triple billসেইভাবে ওখানকার ABC Cinema-য় একসঙ্গে দেখলাম Raiders আর ১৯৮৪-তে মুক্তিপ্রাপ্ত, ভারতের প্রেক্ষাপটে – এবং ভারতে নিষিদ্ধ – Indiana Jones and the Temple of Doom, যাতে পরাধীন ভারতে ঠগীদের সঙ্গে সংঘাতে নামছেন ইন্ডিয়ানা, তিনটি অমূল্য শিবলিঙ্গ উদ্ধার করতে। প্রধান দুই প্রতিপক্ষের চরিত্রে অমরীশ পুরী (কাপালিক) এবং অ্যাটেনবরোর গান্ধী ছবিতে পণ্ডিত নেহরু করে খ্যাত রোশন শেঠ (দুরাচারী মন্ত্রী)। ছবিটি নিয়ে আমার বিলিতী সহপাঠীদের সন্ত্রস্ত অপরাধবোধ দেখে সকৌতুকে বলেছিলাম, “একজন ভারতীয় – বিশেষ করে বাঙালী – হয়ে এই ছবি যতটা উপভোগ করেছি, তা’ তোমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তোমরা তো আর আমার মতো সেইসব ‘কাপালিকের কবলে’ জাতীয় গল্প পড়ে বড় হও নি!” দুর্ভাগ্যক্রমে ছবিটির পরিচালক স্পিলবার্গ স্বয়ং রাজনৈতিক শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে এই দ্বিতীয় ছবিটিকে তাঁর ত্যাজ্য সন্তানের পর্যায় রেখেছেন!

তৃতীয় অভিযানে ইন্ডিয়ানার বাবারূপে আমরা পাচ্ছি জেমস বন্ড-রূপে খ্যাত শন কনারিকে। যে পবিত্র পাত্র (Holy Grail) থেকে যিশুখ্রিস্ট তাঁর সর্বশেষ নৈশভোজের সময় পান করেছিলেন, এবং তিনি ক্রুশে বিদ্ধ হবার পর যে পাত্রে আরিমাথিয়ার জোসেফ যিশুর শোণিত রক্ষা করেছিলেন, সেই পাত্রের খোঁজে এই অভিযান, যে পবিত্র বস্তুর পেছনে ধাওয়া করেছে হিটলার এবং তার ঘৃণ্য নাৎসি সতীর্থরা। দুটি অবিস্মরণীয় দৃশ্যের কথা বলিঃ শত্রুদের প্লেন ধাওয়া করেছে ইন্ডিয়ানা ও তার বাবাকে। হঠাৎ জোনস সিনিয়র তাঁর ছাতাটি খুলে তেড়ে গেলেন সমুদ্রতীরে বসে থাকা পাখীর দলের দিকে। ভয় পেয়ে পাখীরা উড়ে গেল আকাশে, প্লেনের প্রপেলারের সঙ্গে একের পর এক পাখীর ধাক্কায় ভেঙে পড়ল প্লেন! দ্বিতীয় দৃশ্যঃ বার্লিনে চলছে নাৎসিদের পৌরোহিত্যে বই-পোড়ানোর উৎসব। তার মাঝখানে অতর্কিতে স্বয়ং হিটলারের মুখোমুখি ইন্ডিয়ানা (হ্যারিসন ফোর্ড) । হতভম্ব ইন্ডিয়ানা ঐ নরপিশাচের সামনে তুলে ধরে পবিত্র পাত্রের সন্ধান-সম্বলিত পুঁথিখানি! বিনা বাক্যব্যয়ে হিটলার বইটি নিয়ে তাতে স্বাক্ষর করে দেয় নিজের নাম!

গ্লোবে এই ছবিটি দেখতে গিয়ে একটি বাড়তি অভিজ্ঞতা হয়েছিল। হলের লবিতে রাখা ওজনের যন্ত্রে চড়েছিলাম আমরা তিনজনই। আমাদের পরেই এক হৃষ্টপুষ্ট ভদ্রলোক উঠলেন তাতে; পয়সা ফেললেন, হাতে পেলেন ওজন-ছাপা টিকিট। সেটি দেখে আমাদের কাতর স্বরে প্রশ্ন করলেন, “আপনাদের কত ঊঠল?” যে যার ওজন (কোনটাই খুব কম নয়!) বলতেই, তিনি আর্তনাদ ছাড়লেন, “আমার একশো কে জি!” তারপর ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান!

গ্লোবে সেই ষাটের দশক থেকে একাধিক ৩৫ মিমির ছবিও দেখেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ

·11১৯৬৮-তে ১৯৬৬ সালের কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক Fantastic Voyageএক বৈজ্ঞানিকের মস্তিস্কের ক্লট গলাতে একটি সাবমেরিন সহ একদল মানুষকে জীবাণুর আয়তনে ঠিক ৬০ মিনিতের জন্য ক্ষুদ্রায়িত করে বৈজ্ঞানিকের শরীরে প্রবিষ্ট করা! ৬০ মিনিটে কাজ শেষ না করলে জাহাজসহ সবাই স্বাভাবিক আয়তনে ফিরে গিয়ে রোগীর শরীর ভেদ করে বেরিয়ে আসবে! লবি থেকে জোর করে কিনেছিলাম ছবির কাহিনী-বলা বাংলা পত্রিকা (সম্ভবত আশ্চর্য), যার পেছন মলাটে ছিল বিধায়ক ভট্টাচার্যের অমরেশকে নিয়ে একমাত্র উপন্যাস অমরেশ চন্দ্রাহত হ’লো-র বিজ্ঞাপন! যথাসময়ে দাদার সঙ্গে কলেজ স্ট্রীটে গিয়ে অধুনালুপ্ত ‘বুক সার্ভিস’ থেকে আড়াই টাকা দিয়ে সংগ্রহ করেছিলাম সে বই। Fantastic Voyage-এ অভিনয় করেছিলেন বেন হুর-এ মেসেলা-চরিত্রে খ্যাত স্টীভেন বয়েড, খলচরিত্রে ডোনাল্ড প্লেজেন্স, এবং নার্সের চরিত্রে Raquel Welch (শরীর প্রদর্শনের সুযোগ ছিল না, অতএব, কেন যে এঁকে রাখা হয়েছিলো কে জানে!) প্রমুখ।

· ১৯৬৯-এ দেখেছি কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক (আমার কাছে) ডিস্টোপিয় স্যাটায়ার, ১৯৬৮ সালের Planet of the Apes, মূল চরিত্রে ‘টেন কমান্ডমেন্টস’, ‘বেন হুর’-খ্যাত চার্ল্টন হেস্টন। একদল নভোচারীর নেতা তিনি, তাঁদের মহাকাশযান বিকল হয়ে আছড়ে পরে এমন এক গ্রহে যেখানে বনমানুষেরা সভ্য আর মানুষ জংলী জানোয়ার, বনমানুষদের শিকারের লক্ষ্য! শেষে নভোচারীদের নেতা জানতে পারেন যে তিনি অন্য কোন গ্রহ নয়, এসে পড়েছেন ভবিষ্যতের পৃথিবীতেই, যেখানে মানুষ মারণযুদ্ধে নিজের সভ্যতা ধ্বংস করার পর,’যোগ্যতমের বেঁচে থাকা’-র নিয়মে বনমানুষেরা বিবর্তিত হয়েছে ক্ষমাতাবান সভ্য জীবের স্তরে!

·        ১৯৬৯-এ চন্দ্রাবতরণের পর গ্লোবে এসেছিল তা নিয়ে তথ্যচিত্র। তখন দেখা হয় নি, পরে রবিবার সকালের শোতে সেখানে দেখেছি ১৯৬৯-এর Footprints on the Moon

·        ১৯৭০-এ ১৯৬৭ সালের A Challenge for Robin Hoodবাবা-মার কাছে এরল ফ্লিন রূপায়িত রবিন হুডের ছবিসমূহের গল্প অনেক শুনেছি। এটি আমাদের যুগে তোলা রবিন-আখ্যান।

·        ১৯৭০-এই আবার, আমার প্রিয়তম হলিউড-স্টার জন ওয়েন এবং রক হাডসন অভিনীত আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ঠিক পরের সময়ের প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালের The Undefeatedএক সপ্তাহ চলাকালীন শেষদিন শেষ রাতের শোতে বাবার সঙ্গে দেখেছিলাম, কারণ সপ্তাহের প্রথম দিকে পেট খারাপ হয়েছিলো। বাবা বলেছিলেন, “তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো! জন ওয়েন কি মনে করবে? ‘আমার ভক্ত কিনা পেট হড়কে আমার ছবি miss করল!’





·         ·       মার সঙ্গে দেখেছি ১৯৮৩ সালের কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক রূপকথা Krullকলকাতার বনেদি প্রেক্ষাগৃহের কি অধঃপতন এতদিনে! একে তো সত্তরের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পর সব শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত হল পাখা লাগাতে বাধ্য হয়। এরপর ক্রমাগত লোকসানের বাজারে বিদ্যুৎ বিলের খরচ বাঁচাতে শোর আরম্ভে খানিক ক্ষণ এ সি চালিয়ে তারপর তা বন্ধ করে পাখা চালানো। Krull দেখার সময় তো পাখাও বন্ধ করে দেওয়া হলো!

·        মার সঙ্গেই গ্লোবে আরও দেখেছি এক বিচিত্র ধরণের ছবিঃ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য কার্টুন Heavy Metal (১৯৮১)!

গ্লোবে সর্বশেষ দেখা ছবি বোধহয় ১৯৯৭ সালের Titanic, যা দেখেছিলাম স্ত্রী, শ্যালিকা ও শ্যালককে নিয়ে। এটি ৭০ মিমি প্রোজেকশানেরই ছিল।

সবশেষে আবার বলি, এই গ্লোবেই মোট চারবার দেখা ছবিটির কথা বলব আলাদা ভাবে, কারণ সেটি আমার দেখা যাবতীয় ছবির মধ্যে (ইংরেজী-বাংলা-হিন্দী) দ্বিতীয় সবচেয়ে প্রিয়। ছবিগুলির সবার শেষে তার পোস্টারই শুধু রাখলাম!