কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

অপরাহ্ণ সুসমিতো

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৩


রোদের বাদলে আমরা


রোদ বাদল সবসময়ই আপনি আড়ংয়ের স্ট্রাইপ শার্ট। ফুল স্লিভ পরতেন শার্ট গুঁজে। ঢিলে ঢালা প্যান্ট। কাঁধে ঝোলানো বাদামি রঙের ব্যাগ। ব্যাগে কি এত ছাইভস্ম জিনিষপত্তর? ব্যথা করে না বুঝি ভারে?

ক্যাম্পাসে এত রোদ। রোদের একটা বিদ্যাসাগরীয় দাপট আছে। এরকম খরতাপ দেখলেই আমার মনে হতো রোদ বুঝি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ক্যাম্পাসের দামোদর নদী পার হচ্ছে মায়ের ডাকে। আপনাকে রোদের সৈনিক মনে হতো।


রোদ চশমা পরেন না কেন স্যার?

টিচার্স বাস দেরি করলে আপনি ছাতিম তলায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। ব্যাগ থেকে একটা ভারি বই বের করে পড়তেন। সারাক্ষণ পড়তে হয় কেন? ভাগ্যিস তখন মোবাইল ফোন ছিল না, না হলে আপনি ফোনটা বের করে বাটন টেপাটিপি করতেন। এই মোবাইল টেপাটিপি করে আমার এক বন্ধুর এখন হাতে কার্পাল টানেল সিনড্রোম।

সেদিন ফোনে বললেন: প্যানডেমিকের আগে একদিন মঞ্জু সস্ত্রীক ক্যাম্পাসে এসেছিল। সারাদিন ডিপার্টমেন্টে ছিল। মঞ্জু বেশ মুটিয়েছে। যে মঞ্জু একসময় ডিম পরোটা খেতে খুব পছন্দ করত, ওকে এত সাধাসাধি করেও ডিম-পরোটা খাওয়ানো গেল না।

বাংলাদেশে আমরা কখনো ফোনে কথা বলিনি। সেদিন আশ্চর্য এত এত বছর পর আমরা প্রথম ফোনে কথা বললাম। সেই উত্তাপ, সেই নীরদ কণ্ঠ। আপনি নাক টানছিলেন। বললাম; স্যার নাক টানছেন কেন? ঠাণ্ডা লেগেছে?

আমাদের শহরে তখন রাত নামছে সেকেন্ড কাপ কফি শপের পাশে কফির ঘ্রাণে, বাংলাদেশে তখন প্রভাত, শ্রাবণের নিমন্ত্রণ। কী অবাক কাণ্ড আমরা একসাথে সেই রিহার্সেলের দিনগুলোতে ফিরে গেলাম। ‘অভিব্যক্তি আবৃত্তি পর্ষদ’এর সেই সোনালি কাঁকন পরা দিন।

আপনি আমি একসাথে তখনই রবীন্দ্রনাথের ‘সন্ধ্যা ও প্রভাত’ স্মরণ করলাম।  বললেন যে বাংলাদেশে তখনও তেমন কেউ সন্ধ্যা ও প্রভাত আবৃত্তি করেনি।

আপনার মায়ের কথা জানতে চাইলাম। জানলাম তিনি আর নেই। আমি মুষড়ে উঠি। পৃথিবীর কোথাও মা হারানোর কথা শুনলে আমার বুক ভারী হয়ে ওঠে আর্দ্রতায়। সেই উত্তরার বাসা, বিকেলবেলা আপনার নরম মায়ের বাংলাদেশের মতো দাঁড়িয়ে থাকা, আপনাদের গৃহকর্মীর সাথে আপনার প্রমিত বাংলায় কথা বলা, বিকালের চা। সেই বিকেলে উত্তরায় নেমে এসেছিল বিষণ্ণ সন্ধ্যা। পড়ন্ত সাঁঝে আপনার মুখ ছিল জাহাঙ্গীরনগরীয় সুন্দর।  

আমরা বিকেলে হাঁটি পকেটে হাত ঢুকিয়ে।

মন্ট্রিয়লে তখন কুসুম রাত। আমার সঙ্গীদ্বয় তাড়া দিচ্ছিল কমলার রস খেতে যাবে দূর পাল্লায়। আমার ফোন ছাড়তে ইচ্ছা করছিল না স্যার। আপনি মনে করিয়ে দিলেন যে আমাদের শেষ দেখা হয়েছিল জাহাঙ্গীর নগরের বিলে শীতকালীন পাখি দেখার আসরে। আপনি মৃদু স্বরে বললেন,

: আমরা পাখি দেখছিলাম, একটা একটা পাখি ক্লান্ত ডানায় রোদ মেখে নামছিল আবার চলে যাবে বলে। প্রস্থানের জন্যই এই আগমন।

গাঢ় অন্ধকার জামরঙা কামিজ পরে তালেবানি দাপটে তখন আমাদের শহর।

সেকেন্ড কাপ কফি শপের হা হা হো হো ভিড়েও কেউ জানল না যে আপনি বা আমি বা আমরা সবাই একা।


2 কমেন্টস্: