কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

শ্রাবণী দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

লাল-নীল-পেন্সিল




 

(২২)

--অ্যাকোয়ারিয়াম আমার মিস্টিরিয়াস্‌ লাগে, জানিস?

--হুম্‌।

--জানি না কেন। মাসিমণির বাড়িতে দেখলাম ছোট্ট লাইট দিয়েছে, জলের ওপরে কুচি-কুচি ছড়িয়ে গেছে আলো, চোখ সরাতে ইচ্ছে করছিল না। জলটা টলটলে পরিষ্কার, মাছগুলোর নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছিলাম।

--তোর মাসিমণি শৌখিন কিন্তু!

--হুঁ-উ।

সংক্ষেপে বলে শ্রুতি হাঁটু ভাঁজ করে মুখ রেখে বসে, যেন মাছের বাক্সটা দেখতে পায়। কাচের ঘেরাটোপে জল, ভেতরে নড়াচড়া করছে প্রাণমায়ের গর্ভজল যেমন হয়। প্রকৃতির ছাঁকা আলো কাচের দেওয়াল ভেদ করে ভেতরের জলে পড়েছে, মাছেরা দেখতে পায় কিনা কে জানে! জলে দূষণ হলে বা বাক্স ফেটে গেলে আর আলো ঢোকে না, ঘোলা জলে মাছেরা মরে যায়। মানুষ ও পরিবেশ! আসলে বেঁচে থাকার জন্যে ঠিকঠাক আয়োজন রাখা দরকার। এসব নিয়ে সময়ে অসময়ে ভাবে, নিজের কথাও ভাবে। অর্জুন চাকরি পেয়ে উৎফুল্ল, শ্রুতির সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য সময় প্রায় তলানিতে। অর্জুনের চাকরির খবরে সে অখুশি হয়নি, কিন্তু নিজের জন্য মনখারাপ বেড়ে গেছে। চেষ্টা তো করছে সেও। অর্জুন আলগা উৎসাহ দেয়,

--একাদেমির একজিবিশনটা তোকে বড়ো ব্রেক দেবে, দেখিস!

--ধুস্‌, ছাড় তো! চারজনের কাজ একসঙ্গেআমি জুনিয়ার মোস্ট, আমার জন্য অ্যালটেড জায়গাও মিনিমাম...!

শ্রুতি মুখ বেজার করে রাখে। অর্জুন উদার গলায় বলে,

--এরকম পেসিমিস্টিক হয়ে জাস্ট পারবি না শ্রুতি!

--প্রচুর তেল পুড়িয়ে ফার্স্টটাইম একাদেমিতে, সনৎদা যদিও অনেক হেল্প করেছেন, এবারে কী চাইবেন জানি না। অ্যাকোয়ারিয়ামের ছবিটাই খালি ওনার ইউনিক লেগেছে, বাকিগুলো নিয়ে মন্তব্য করেন নি। আমি একটা কথা ভাবছি, জানিস?

--কী?

--পরে বলবো তোকে।

সন্ধেবেলা অল্পক্ষণের জন্য টুকিটাকি কিনতে বেরিয়েছিল লিপিকা, পথঘাট খালি। মোবাইল বেজে উঠল, খুলে দ্যাখে শ্রুতি। ড্রাইভ করতে করতে সে ফোন ধরে না, গাড়িটা ঘ্যাঁস করে দাঁড় করাল ফাঁকা দেখে, ভাগ্য ভালো বলে পাওয়া গেছে। লিপিকা খানিক অবহেলায় বলে,

--বল্‌ মামপি, ভালো তোরা সবাই?

--হ্যাঁ হ্যাঁ মাসিমণি। শোনো না, একটা কথা বলার ছিল!

--কী বল্‌?

--নেক্সট উইকে একাদেমিতে আমার ছবির একজিবিশন এই ফার্স্ট টাইম! তুমি আর মেশো এলে খুব ভালো হয়।

--বাঃ ভালো খবর! ও-রে বাবা না-রে, তোর মেশোকে নিয়ে কোথাও যাই না, আর একা রেখে যাওয়া আরো মুশকিল। সাকসেসফুল হ, তোর নামডাক হোক, আশীর্বাদ করি।

--এতে নামডাক হয়না মাসিমণি। ভাবে শ্রুতি, প্রায় মরিয়ার মতো বলে, মেশো খুশি হত তাই বলছিলাম, এনিওয়ে ঠিক আছে।

ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে শ্রুতি, কাছেই দু-টি ক্লাস ইলেভেনের ছেলেকে পড়াচ্ছে আজকাল, ইচ্ছে করছে না যেতে। পাড়ার গলিতে ঢুকতে আড্ডা মারা ছেড়ে উঠে আসে রিকি, তাদের ঠিক পেছনের বাড়ি। কাছে এসে বলে,

--বাড়ি ফিরছ মামপিদিদি?

--হ্যাঁ, কেন রে? কী হয়েছে রিকি?

--প্রায় ঘন্টাখানেক আগে তোমাদের বাড়িতে কারা এসেছে যেন।

--আমাদের বাড়িতে?

শ্রুতি বিরক্তমুখে পা চালায় বাড়ির দিকে, কে জানে কারা আবার এসে বসে আছে। পথটা খোয়া উঠে এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে, পুরভোট কাছে এলে আবার কাজ হবে এমনই দেখে এসেছে আজন্ম।

দরজা ঠেলে পা রাখামাত্র দেবিকার আহ্লাদিত স্বর কানে এলো,

--ওই আইসা পড়ছে, বললাম তো টাইম হয়ে গেছে, আসছি একটু, অ্যাঁ?

স্নিকার্সের লেস খুলতে সবে ঝুঁকেছে, থপথপ করে দৌড়ে দেবিকা প্রায় মামপির ঘাড়ে এসে পড়ে, স্বভাববিরুদ্ধ নীচুস্বরে বলে,

--সারাদিন টৈ টৈ করে আসলি, যা তাড়াতাড়ি মুখহাত ধুইয়া একটা সালয়ার-কামিজ পরে আয়।

ভ্রূ কুঁচকে অসম্ভব বিরক্তিতে প্রশ্ন নিয়ে তাকায় মামপি, মুখ খোলে না। দেবিকা বলে,

--যা কইতাছি কর, পরে কথা হবে।

--হয়েছেটা কী? সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে নিস্তার নেই? জ্বালিয়ে মারছো? শ্রুতি হিসহিস করে বলে।

কারা এসেছে অনুমান করতে পারে। কথায় অযথা উত্তেজনা বাড়ে, বাইরের লোকের সামনে লজ্জা করে, চট করে সে বাথরুমে ঢুকে পড়ে। আধো-অন্ধকারে নিজের মুখচোখে দেখে ঝাপসা আয়নাটায়। উড়োখুড়ো চুল মুখে এসে পড়েছে, চোখের ধেবড়ে-যাওয়া কাজলে মিশেছে রাস্তার ধুলো। ভালো করে মুখে-চোখে জল ছিটিয়ে মুছে নিয়ে বেরিয়ে আসে, মা-র সঙ্গে অশান্তি করতে আজকাল ক্লান্ত লাগে। বাড়িটায় কোনো আব্রু নেই, মা-র ঘরে অতিথিদের বসিয়েছে হয়ত। সে ধীরপায়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে, দিদিমার ফোটোর সামনে কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়ায়, আলনা থেকে চলনসই লংস্কার্ট নামিয়ে বাইরের কাপড় বদলে ফেলে।

নিঃশব্দে খেয়ে উঠে নিজের ঘরের আলো নিভিয়ে টান হয়ে শুয়ে থাকে মামপি, দেবিকা এসে কিচ্ছু না জিজ্ঞেস করে ফট্‌ করে টিউব জ্বালে। চোখে ঝটকা লাগে, সামলে নেয় মামপি, মুখ ভয়ানক গম্ভীর করে কনুই দিয়ে চোখ ঢেকে শুয়ে থাকে। দেবিকা কোণে-রাখা ভারী কাঠের চেয়ার ঘ্যাঁশ করে টেনে বসে,

--কীরে কইলাম পরেও একটু সাজলি না? এত অবাধ্য! তা অগরে কেমন লেগেছে?

মামপির অসহ্য লাগলেও জবাব দেয় না। কৌশিক দরজায় দাঁড়িয়েছিল, আমতা-আমতা করে বলে,

--হ্যাঁরে মা, ভালো লেগেছে ওদের?

আরো কী কী বলে যায় দেবিকা, গরম হয়ে উঠতে গিয়ে উলটে ঠাণ্ডা খরখরে গলায় মামপি বলে,

--দু-জনে প্ল্যান করে একসাথে অ্যাটাক করতে এসেছ? লাভ নেই, আমি উত্তর দেবো না। ঝামেলা বাড়িয়ো না, লাইট নিবিয়ে দরজাটা টেনে দিয়ে নিজেদের ঘরে যাও।

বার পাঁচ-ছয় বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে তার মা-বাবা, সে ক্রমাগত বাদ সেধেছে, দু-বার টের পেয়ে বাড়িতে ঢোকেনি, পালিয়ে গিয়ে বসে থেকেছে কোনো বন্ধুর বাড়ি। অপমানিত লেগেছে, কথা বলেনি কারো সঙ্গে দিনের পর দিন। আজ কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না। চারজন এসে তার সঙ্গে দু-একটা কথা বলেছে, কিছুই জানতে চায়নি, সে গুরুত্ব না দিয়ে হুঁ-হাঁ চালিয়ে গেছে। চেহারাগুলো মনে করছিল শ্রুতি, ভালোমানুষ চেহারার হালকারঙ শাড়ি-পরা বিধবা ছেলের মা, কোথায় যেন দিদার সঙ্গে মিল! মিষ্টিমুখের মোটাসোটা ফর্সা মেয়েটি ছেলের ছোটোবোন, অনেকটাই ছোটো বলল ওরা, হাসিখুশি ছোকরামতো ফর্সা লোকটি তার বর। শান্ত গম্ভীর রোগাটে চশমাপরা ভদ্রলোক পাত্র, ব্যাঙ্ককর্মী। যত ফালতু প্রহসনভাবতে ভাবতে চোখ বুজে আসে, চোখের সামনে নিজের আঁকা অ্যাকোয়ারিয়ামের ছবিটা ভেসে চলে। হঠাৎ হোয়াটস্‌-অ্যাপের মেসেজ টোন বাজে, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। মামপি বালিশের পাশ থেকে মোবাইল টেনে নেয়, অচেনা নম্বর থেকে শুদ্ধ বাংলায় মেসেজ,

--আপনি কি আমার সঙ্গে আলাদা করে দেখা করতে ইচ্ছুক? আমার মা ও বোন  দু-জনেই আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বলল। যদি অনিচ্ছুক হন বিব্রত করবো না, অনুরোধ করবো হ্যাঁ বা না জানিয়ে দিতে। রেগে যাবেন না, ফোন নম্বর আপনার মা নিজে থেকে আমার বোনকে দিয়েছেন। দেবার্ঘ্য ঘোষ।

মামপি হতভম্ব হয়ে গেল। কোনো জবাব না দিলেই চলত, কী মনে হল লিখে দিল, ‘ও-কে ফাইন। কবে ও কোথায়?’ ওধার থেকে হ্যাপি স্মাইলি এল, সঙ্গে লেখা, ‘কাল জানিয়ে দেব। গুড নাইট।

ঘুম চটকে গেছে মামপির, মাথা আগুন, রাত বেশী না হলে মা-র ঘরে গিয়ে একচোট ঝেড়ে আসত, এই পরিমান বাড়াবাড়ি করার সাহস পেল কোত্থেকে? যাকে-তাকে তার ফোন নম্বর দিয়ে দেওয়া? দেবার্ঘ্য ঘোষ নামের লোকটার সঙ্গে দেখা করবে সে, কড়া ডোজ দিয়ে আসবে।

 

(ক্রমশঃ)

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন