সমকালীন ছোটগল্প |
আড়াল
বিকেলটা গড়িয়ে নামছে কৃষ্ণচূডার ডালপালা বেয়ে। গভীর আলস্যে অপেক্ষা করছি আঁধার কালো রাতের। সন্ধ্যের অন্ধকারটা আমার খুশীর আলো, প্রকৃতির আশীর্বাদ। জ্বলন্ত দিনের আলোয় আমার মুখটাকে আড়াল খুঁজতে হয় - অন্ধকারে তো সে বালাই নেই। ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি পার্কের কোণার বেঞ্চিতে বসেই। প্রাণচঞ্চল বাচ্চাটা - বাচ্চু বলেই ডাকছে শুনছি ওর মা - বল নিয়ে ছোটাছুটি করছে দুরন্ত খুশীতে। মাঝে মাঝেই দমকা বাতাসে দু একটা ফুল পাতা উডে উডে আসছে আমার দিকে।
ছেলেটা সবে বলটা ছুঁড়েছে ওর মায়ের দিকে, টাল সামলানোর আগেই একটা কালো বিদ্যুৎ পার্কের অন্য কোণ থেকে ঝলসে এলো বাচ্চুকে লক্ষ্য করে ঐ বলটার উদ্দেশ্যেই। কুচকুচে কালো ডোভারম্যান। অবিশ্বাস্য গতিতে মাঝ আকাশেই বলটা ধরে বাচ্চুর দিকে ছুটলো কুকুরটা। ততক্ষণে আতঙ্কে নীল হয়ে দৌড়ে আসতে শুরু করেছে বাচ্চু, আমার দিকে। দু পা এগিয়ে ছোঁ মেরে তুলে নিলাম ওকে আমার কোলে। পরম আশ্রয়ে কান্নাভেজা মুখটা আমার কাঁধে ডুবিয়ে ফোঁপাচ্ছে আর ঐ ডোভারম্যান মুখের বল পায়ের কাছে নামিয়ে উন্মুখ আকাঙ্ক্ষায় বাচ্চুর দিকে তাকিয়ে হাঁপাচ্ছে। ফোঁপানি থামিয়ে ছেলে হাসিমুখে আমার দিকে তাকাতেই যথারীতি ঘটনাটা ঘটলো। মুহূর্তে ওর মুখের খুশীর আলোটা নিভে গিয়ে আতংকের অন্ধকারে ডুবে গেল। সরসরিয়ে কোল থেকে নেমে ছুটলো মায়ের সন্ধানে, ভয়াবহ কুকুরও তখন আমার থেকে কম বিপজ্জনক।
দু:খে অভিমানে আজকাল আর আমার চোখে জল আসে না। একটা চোখ তো ঢিবির মত বন্ধ, অন্যটা ঠিকরে বেরিয়ে আসছে - জল বেরোবে কোথা থেকে? বেরোয় তো বড় জোর অপমানের বাষ্প আর জ্বালা - কেউ দেখতেও পায় না। কেউ আমার অত কাছে আসেও না যে তাপ উত্তাপ টের পাবে। মুখ ফুটে আমার দু:খের কথা কাউকে জানাতেও পারি না - আমি তো বোবা!
এই আমি - ছোটবেলা থেকেই হাসি আর অত্যাচারের পাত্র। স্কুল, পাড়া, বাজার থেকে ময়দান পর্যন্ত আমার এই বীভৎস চেহারাটার জন্যে প্রচন্ড নরকযন্ত্রণা ভোগ করে আসছি। মা-বাবা ছোটবেলাতেই গত। মামাতো দাদাবৌদির কাছেই আছি। বৌদি তো আমার ঠিকরে আসা চোখ, তেবড়ান লম্বা নাক, এবড়ো খেবডো দাঁত আর সঙ্গে দুটো গজদাঁত নিয়ে সদাই সন্ত্রস্ত। প্রথম দৃষ্টিতেই সবাই আমার মুখে একটা জঘন্য জন্তুর চেহারা দেখে চমকে ওঠে। দাদাকে কতবার বলতে শুনেছি - “লেখাপড়াটা ঠিক করে কর, না হলে রাস্তায় দাঁড়ালে ঐ চেহারা দেখে কেউ ভিক্ষে দিতেও ভয় পাবে”। বৌদি ওর সুন্দর রঙ করা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বলে দিয়েছে, “তুমি যখন তখন হঠাৎ করে আমার সামনে চলে এসো না তো ঠাকুরপো, আমার অস্বস্তি হয়”। ফুটফুটে ভাইঝি ঝুমকিকে বলতে শুনেছি, “কাকুকে দেখলে আমার ভীষণ ভয় করে মা!” দোষ দিই না কাউকেই - আমার শরীরটাও বাড়তে বাড়তে একটা গরিলার আকার নিয়েছে।
এরা তো আমার আপনজন - স্কুলের ছেলেদের ব্যবহার এর থেকে আর কত ভালো হতে পারে? বিশেষ করে আমি যখন দুর্ভাগ্যক্রমে, সব পরীক্ষাগুলোতে প্রথম সারিতেই থাকি! আমার ওপর ওরা নির্বিচারে অত্যাচার চালাতো, মিথ্যে নালিশ করতো, খাতাপত্তর ছিঁড়ে দিত, ইচ্ছে করে খেলায় বাদ দিত আর প্রত্যেকটা অঙ্গভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিত, ওরা কতটা ঘেন্না করে আমায়। শিক্ষকদেরও কখনও ওদের তেমন করে শাসন করতে দেখিনি। বাড়িতে দাদার চড়-চাপড়, বৌদির খোঁচা স্কুলের ঐ নরকযন্ত্রণা থেকে সহনীয় ছিল। ছেড়ে দিলাম স্কুলে যাওয়া। পাড়ায় পাড়ায়, চায়ের দোকানে, বাসস্ট্যান্ডে দূর থেকে তাকিয়ে দেখি মানুষ কত সুন্দর চেহারার হতে পারে। দীর্ঘ নি:শ্বাসটা নি:শব্দেই মিলিয়ে যায়।
সেদিন নদীর পাড়ে একলা দাঁডিয়ে ভাবছিলাম - নদীটা সত্যি কতটা গভীর! যদি কোনদিন ঝাঁপ দেবার দরকার হয়, ডুবতে পারবো তো? হঠাৎ…
“এই মন্টু, এখানে কী করছিস?”
চমকে তাকালাম মাণিকদার দিকে। একটা ভাঙ্গা দোমড়ানো দরমার ঘরের ভেতরে টিমটিমে আলো - সেখান থেকেই বেরিয়ে এসেছে ও।
“কী করছিস - এ্যাঁ? যা বাড়ি যা শালা! ইয়ার্কী করছিস এখানে?”
আস্তে আস্তে ফিরে আসছি - ঘরের ভেতরে দু চারটে ছায়ামূর্তি লন্ঠনের আলোতে রহস্যময়। হাল্কা বাতাসে ছায়াগুলো দেওয়ালে কখনও অতিকায় দানব কখনও ভৌতিক বক্ররেখা - হেলছে দুলছে। জড়ানো অষ্পষ্ট কথাবার্তা, কাঁচের গেলাসের ঠুনঠান আর শালপাতা, প্লাস্টিক মোড়কের খড়খড়ানি।
“এই মন্টু, এদিকে আয়!” গোবিন্দদা - মুদির দোকান চালায়। কানাঘুষোয় শোনা যায় নানারকমের অসামাজিক ব্যবসাও চালায় ও। পাড়ার মাস্তান, পুলিশদের আঙুলে নাচায়। পাশেই বুঁদ হয়ে ঢুলছে ভোঁদাণ, পাড়ার একমাত্র ইলেক্ট্রিশিয়ান, দোকান আছে ওর। একটু দূরে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মনা রিক্সাওয়ালা। আর একজনকে চিনতে পারলাম না। ঘরের বাতাস দমবন্ধ করা - চোলাই, পেঁয়াজ আর সিগারেটের ধোঁয়ায় অসুস্হ। দরজার সামনে দাঁড়ালাম একরাশ অস্বস্তি আর আশংকা নিয়ে।
ভোঁদা টলতে টলতে এসে আমার দু কাঁধে হাত রেখে মুখের কাছে মুখ নিয়ে একরাশ দুর্গন্ধ ছড়িয়ে বললো, “এই য্যে, গোয়িন্দদা, নদের নিমাই উত্তমকুমার এয়েচেন, নদীতে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল। এই নাও”-
“চুপ করে বোস ভোঁদা - কোন কোথা বলবি না এখন”। পুরোপুরি কর্তৃত্বের দাপট গোবিন্দদার গলায়। অনিশ্চিত আতঙ্কে স্হির তাকিয়ে আছি। হাসিমুখে গোবিন্দদা বললো, “আয় মন্টু আয়, এখানে বোস। ভয় পাস না এই কুকুরগুলোকে - তোকে কামড়াতে সাহস পাবে না। বোস”।
বসলাম গিয়ে - উপায় তো নেই। বাঁ হাত আমার কাঁধে রেখে ডানহাতে একটা মোটা কাঁচের গ্লাসের গাঢ় তরল পদার্থটা উপুড় করে গলায় ঢেলে ঠক করে রেখে বললো, “তোর খুব দু:খ, না রে মন্টে? দাদা বৌদি যা তা বলে, পাড়ার ছেলেগুলো জ্বালায়, স্কুলও ছেড়ে দিলি - তাই না রে? শোন মন্টু, পৃথিবীটা কার বশ বল তো? পৃথিবী টাকার বশত। জানিস তো? তুই যেদিন অনেক টাকার মালিক হবি, সেদিন দেখবি তোর ঐ মুখের দিকে কেউ তাকাতে সাহস করবে না, সবাই কথা বলবে তোর ঐ জুতোর দিকে চোখ রেখে। আজ এই সব হারামজাদাগুলোকে চিনে রাখ - সেদিন দেখবি এই ছুঁচোগুলোই তোর দরজায় লাইন মারবে সব উপহার টুপহার নিয়ে তোকে, তোর বৌকে তেল মারতে”।
ততক্ষণে মনা একটা বোতল থেকে ওর গেলাসটা আবার ভর্তি করে দিয়েছে। এক চুমুকে অর্ধেকটা গলায় নামিয়ে গোবিন্দদা আবার বললো, “এই টাকা আমি তোকে দেবো। আমার কাছে কাজ কর - স্কুলে তো ভাল ছেলেই ছিলিস, ছ্যাঁচড়াদের উৎপাতেই তো স্কুল ছাড়তে হলো। তুই পারবি, তোকে আমি অনেকদিন ধরেই নজরে রেখেছি। বন্ধু-বান্ধব ধারে কাছে আসে না, অকারণ হা হা হি হি নেই, একলা ঘুরে বেড়াস দেখি। তোকে দিয়ে আমার কাজ হবে রে! চলে আয়, ভয় নেই তোর। ভাল কাজ দেখাতে পারলে হাজার পাঁচেক দেবো, তারপর তো চলতেই থাকবে। পারবি না? আর দাদাকে বলবি গোবিন্দদার দোকানে অর্ডার সাপ্লাইএর কাজ করছিস। একটা সাইকেলও দেবো তোকে। আমার সংগে থাকলে কোন কুকুর শেয়ালের সাহস হবে না তোর সংগে লাগতে”।
মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে - পাঁচ হাজার? দাদা তো সবসময়েই শোনায় ‘মাস গেলে দুহাজার তিনশো টাকা হাতে আসে’। নাকে মুখে উনুনের ঝাঁঝ - গুমোট আবহাওয়াটা ভারী হয়ে বুকে চেপে ধরেছে আর ঐ মিশ্র উৎকট গন্ধটাও মগজের ভেতর ঢুকে উথালপাথাল করছে । হুঁশ ফিরলো গোবিন্দর গলার স্বরে। অনেকটা আদর করেই যেন মাথার চুলগুলো মুঠো করে ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বললো, “ঠিক আছে, এখন তুই যা, ভেবে দ্যাখ। রাজী থাকলে পরশু এই সময়ে এখানে আসিস - দোকানে যাবি না। যতদিন আমার সঙ্গে থাকবি, তোর সব ভার আমা। মনে রাখিস, এখানে যা কথাবার্তা হবে যদি অন্য কেউ জানতে পারে, তবে তোকে আর নদীতে ঝাঁপ দিতে হবে না। যা গতর বানিয়েছিস হারামজাদা, পাড়ার কুকুরগুলোর তিনদিনের ভোজ হয়ে যাবে। পাড়ার লোকেরা অবশ্য তোর ছাড়ানো চামড়াটা দেখে চিনতেও পারবে না যে ওটা তোরই মোড়ক ছিলো। তোর
ঐ
চোখদুটো দিয়ে তো তখন আর কোন কাজই হবে না, ওগুলো তোর বৌদির কাছে পৌঁছে যাবে। যাঃ, ভাল
করে ঘুমিয়ে নে দুদিন”।
***
অন্ধকার ভেঙ্গে ঘরে ঢুকতে ঐ মোমবাতির হাল্কা আলোটাই চোখে ঝাঁঝ লাগালো। একই দৃশ্য, পাত্ররাও এক - তবে কেবল অনন্তদাকে আজ এক্স্ট্রা দেখলাম। টেলিফোনে কাজ করে, আর যন্ত্রপাতি, হ্যান্ডসেট, তার-টার নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘোরাঘুরি করে টেলিফোনের গোলমাল সারাবার কাজে।
হ্যাঃ হ্যাঃ করে হেসে উঠলো গোবিন্দদা, “জানতাম তুই আসবি। বুদ্ধিমান ছেলেরা সুযোগ হাতছাড়া করে না - কি বল? বস এখানে, আমাদের প্ল্যানটা ভাল করে শুনে নে!”
প্ল্যানটা খুবই সোজা। ৩৪ নম্বর বাড়ির জোনাকী মিত্র কেরিয়ারের পেছনে ছুটে বিয়ে করে উঠতে পারেনি। বড় মালটিন্যাশনালের উঁচু ডালের অফিসার। অনন্তদা টেলিফোন ট্যাপ করে জেনেছে জোনাকি পাঁচ তারিখে ভোরের ফ্লাইটে সিংগাপুর যাবে বান্ধবীর বিয়েতে ওর অর্ডারী শাড়ি গয়নাগাঁটি নিয়ে। বান্ধবীর সাহায্যের জন্যে নাকি অনেক বিদেশী মুদ্রাও নেবে সঙ্গে। “তোর না লাগলে কী আছে! ফেরত আনবো ডলারগুলো? তুই ভাবিস না, তোকে দিয়ে আসবো”। হাসতে হাসতে বলছিল জোনাকী - ও শুনেছে। চার তারিখে সন্ধ্যবেলা ৩৪ নম্বর হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যাবে, কিছুক্ষণের মধ্যেই জোনাকী ভোঁদাকে ডাকবে লাইন চেক করতে। তখনই তার পেছন পেছন অন্ধকারে মনা, মাণিক আর সদানন্দ ঢুকে পড়বে। জোনাকীকে নিমেষে অজ্ঞান করে ওর আলমারী থেকে গয়না, টাকাপয়সা, শাড়ি-টাড়ি সব ফর্সা করে বেরিয়ে আসবে আর ভোঁদাকেও চেয়ারে বেঁধে রেখে আসবে। আমার কাজ খুই সহজ, রাস্তায় হাঁটাচলা করা আর ঐ বাড়িতে কেউ ঢুকছে দেখলে বাঁশীতে হিন্দী সুর বাজিয়ে ওদের সাবধান করে দেওয়া। গোবিন্দদা কঠিন নির্দেশ দিয়েছে, “জোনাকির গায়ে বেজায়গায় কেউ হাত লাগাবি না শূয়ারের দল। জানতে পারলে ঐ হাতের ওপর স্টীমরোলার চালাবো শালা। আমার দোকানের লক্ষ্মী ও - অনেক টাকার জিনিষ যায় ওর কাছে প্রত্যেক মাসে। আর তুমি ভোঁদুরাম - জোনাকী যখন বাড়ি ফিরবে, তোমার চাঁদমুখটা একবার দেখিয়ে দিও দিদিমনিকে যাতে অন্ধকার হলেই তোমার শেয়ালমুখটা দিদিমনির সবপ্রথমে মনে পড়ে লাইন ঠিক করতে”।
“যদি আমাকে না ডাকে? মিস্ত্রী ডাকার কথা মনে না পড়ে ? হয়তো দরকারই হলো না - তখন?”
“ওরে গাড়োলসম্রাট, ওর বাড়িতে গ্যাস নেই, সব বিজলীতে চলে। মাইক্রোওয়েভ, হিটার, ঘড়ি, ওয়াশিং মেশিন - সব। ইলেক্ট্রিক না থাকলে ও একেবারেই অন্ধ। আর না ডাকলে? আমি মন্টুকে পাঠাবো আমার দোকানের বিলটা দিয়ে - ওই হাবেভাবে বোঝাবে তোর কথা। তারপর তোকে এসে খবর দেবে মন্টু”।
বাহ্, চৌখস মাথা। সব দিক দিয়েই পরিষ্কার। এত সোজা ব্যাপারটা? কিন্তু গত তিনদিন ধরে এই সোজা ব্যাপারটাই আমার মাথা কুরে খাচ্ছে। জোনাকীদিদিকে দূর থেকে দেখেছি আমি, কাছে কখনও যাই নি। সুন্দর সাজগোজ, রাস্তায় কারোর সঙ্গে দেখা হলেই মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে “কী, কেমন আছো?” দাঁড়ায় না - ঐ চলতে চলতেই। রাস্তার কুকুরগুলোকে প্রায়ই গোবিন্দদার দোকান থেকে বিস্কুট কিনে খাওয়ায়, পাড়ার ক্লাবেও ক্রিকেটের সেট কিনে দিয়েছে। দিদি এত ভাল আর গোবিন্দদার থাবাটা ওর ওপরেই পড়তে হবে? টাকা পয়সার এত লোভ যে ভাল কাজের সব মহিমা পাপের অন্ধকারে তলিয়ে যাবে? সেদিন হাবেভাবে ভোঁদাকে বোঝালাম, এ যাত্রায় আমাকে বাদ দিতে - মনটা কিছুতেই সায় দিচ্ছে না যে! সিঁড়ির ওপরে বসেই কথা হচ্ছিল। কিছুক্ষণ মেঝেতে কালো পিঁপড়েগুলোর সারির দিকে তাকিয়ে হঠাৎই পায়ের বুডো আঙ্গুলটা পিষে চালিয়ে দিল ওদের শোভাযাত্রার ওপরে - দিশেহারা হলো ওরা। নিষ্ঠুর আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে এবারে আমার দিকে তাকালো - “দ্যাখ মন্টে , তুই আমাদের প্ল্যানটা আগাগোড়াই জানিস। গুরুর নিয়ম হচ্ছে - যারা প্ল্যানে ঢুকে পড়েছে একবার, তারা হয় আছে, না হলে নেই। আর গুরুর নেই মানে আর কারুর কাছেই নেই, মানে পৃথিবীতেই নেই আর কি। এরকম দু একজন আমার জানাশোনা, হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গেল - কেউ আর কখনও দেখেনি তাদের। তাহলে…”
তুমুল অনিচ্ছা সত্ত্বেও চার তারিখটা ক্যালেন্ডারের পাতার ওপর ঝড়ের বেগে এসে গেল। বুকে ধড়ফড়ানি বাড়ছে, মনের ভেতর কুমীর দাঁত ঘষছে আর মাথায় দুম দুম করে হাতুড়ির বাড়ি। ঘড়ির কাঁটা একশ মিটার ফ্ল্যাট রেসের গতিতে অবিরাম স্রোতে তরতরিয়ে এগিয়ে চলছে। কিছু একটা করতে হবে, কিছু একটা - এ জিনিষ হতে দেওয়া যায় না! কী করি, কী করা যায়?
‘পর্ণকুটীর’ কোঅপারেটিভের পাম্প হাউসের ছাত পার হয়ে সূর্যটা শেষ দেখা দিয়ে নেমে গেল - ৩৪ নম্বরে নিঃঝুম অন্ধকার, দুএকজন মোমবাতি জ্বালিয়েছে, কারোর জেনারেটর। মনোরঞ্জন সময়মতই বাতির ফিউজটা উড়িয়েছে। বাকি সব নিয়ম মতই চলছে - অফিসফেরৎ কর্মী, পানের দোকানে বেচাকেনা, রিক্সার ঠুনঠান সব। জোনাকী মিত্রর অফিসের গাড়িটাও এসে গেল - ও নেমেই অন্ধকার দেখে গোবিন্দর দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো।
“একটা
মোমবাতি দিন না - আর মাসের বিলটাও দিন। টাকাটা এখনই দিয়ে দিই, কাল সকালেই আবার কয়েকদিনের
জন্যে বাইরে যাবো”।
“এই নিন মোমবাতি, বিলটা পাঠিয়ে দিচ্ছি একটু পরেই।
বাইরে যাচ্ছেন দিদি? তাড়াহুডোর দরকার নেই তো। ফিরে এসে দিয়ে দেবেন। দেশলাই আছে বাড়িতে,
দিদি?”
“হ্যাঁ
হ্যাঁ, দিন একটা। অন্ধকারে খুঁজে পাবো কি না জানি না”।
ইস
এত চমৎকার ভাবে ভেতরের দাঁত আর নখগুলো আড়াল করে রাখে কী করে গোবিন্দদা?
পাশের
দোকান থেকে ভোঁদার গলা - “দিদি, বাড়ি গিয়ে দেখুন। অসুবিধা হলে ডাক দেবেন, লাইন-ফিউজ-কানেকশনগুলো
চেক করে দেব। গোবিন্দদার দোকানেই ফোন করে দেবেন, নম্বরটা ঐ বিলেই থাকবে”।
“হ্যাঁ, ঠিক আছে। কী ঝামেলা বলুন তো - কাল ভোরবেলা
বেরোতে হবে আর এখনই…” ক্লান্ত মুখে বিরক্তিটা অন্ধকারেও চাপা পড়লো না।
এক্কেবারে প্ল্যানমাফিক চলছে সব। বিজলী নেই। ভোঁদা মুখটা দেখিয়ে দিয়েছে সুযোগ বুঝে। ওর কাজও আপাতত শেষ, এবার আমার প্ল্যানটাই কেবল বদলে নিয়েছি আমি। একটা কাগজে বড় বড় করে লিখেছি, “দিদি, ভোঁদাকে ডাকবেন না, খুব বিপদ আছে পেছনে। আলো এমনিই এসে যাবে অন্য কেউ নিশ্চয়ই খবর দেবে”। পকেটে শক্ত করে কাগজটা ধরা আছে। রাস্তায় কিছুই করা যাবে না, চারদিকে শকুনের চোখের পাহারা। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না আর আমি তো আনকোরা নতুন - প্রথম পরীক্ষা দিচ্ছি। দিদি ঘরে ঢুকলেই আমি ওটা হাতে দিয়ে দেবো।
তাই হলো। জোনাকী ঘরে ঢুকেই দরজার পাশের চেস্ট অফ ড্রয়ারের ওপর মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দরজা বন্ধ করতে ঘুরে দাঁডিয়েছে, আমি ততক্ষণে ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করেই পকেটে হাত দিয়েছি। তখনও মোমের দুর্বল আলো ঘরের কোণায় কোণায় পৌঁছায়নি। ঘষা আলো ছায়ার দোলায় আমার বীভৎস কদাকার মুখটা দেখে অবশ্যম্ভাবী বিপদের খাঁড়া কাটাতে জোনাকির শরীরটা কঞ্চির মতো সটান খাড়া। ঐ নরম সরম চেহারায় এত বিদ্যুতের গতি? আমি কাগজটা বের করার আগেই পাশের টেবল ল্যাম্পের স্ট্যান্ডটা সপাটে আমার মাথায় মুখে কপালে ঠুকে যাচ্ছে। আমার মুখে তো আর্তনাদেরও ভাষা নেই। প্রতিটি আঘাতে গরম রক্তের ঝাপটাও আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। দুহাতে মাথা মুখ ঢাকতে পারার আগেই চরম আঘাতটা ঠিক কানের পাশে পড়ল, বাজের মত। হরিণের গতিতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল জোনাকী - আমি আছড়ে পড়লাম মাটিতে উপুড় হয়ে।
অবচেতন
মনে আমার ঘৃণ্য মুখটাকে আড়াল করতেই বোধহয়!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন