কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১৫




ফ্রান্সের পর ব্রিটেন। গ্রেট ব্রিটেন। আজ এই আলোচনা শুরুর আগে দুটো ছোট ফুটনোট দিয়ে রাখি। এক, ইউরোপের মূল ভূখন্ডের ওপরে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েল্‌স নিয়ে গড়া দ্বীপপুঞ্জকে গ্রেট ব্রিটেন বলা হয়। সেই কারণেই এই সিরিজে  আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই কখনো ইংল্যান্ড লিখিনি, ব্রিটেন লিখেছি। কারণ সব  সময়েই এই পুরো দ্বীপপুঞ্জের সিনেমা একত্রিতভাবে দেখতে চেয়েছি। এবং আজ কিন্তু আমি গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে আয়ারল্যান্ড নামক দ্বীপকেও জুড়ে নেব, যাতে আলোচনা পূর্ণতা পায়। লঘুচ্ছলে বলতে পারি, আজ স্কচ হুইস্কি আর আইরিশ হুইস্কির মল্টেড বার্লি একসঙ্গে পরিবেশন করব। দুই, আপনারা অনেকেই জানেন যে ব্রিটিশ পরিচালক আলফ্রেড হিচকক্‌ এক সময় ব্রিটেন ছেড়ে হলিউড পাড়ি দেন। উল্টোদিকে স্ট্যানলি কিউব্রিক আবার হলিউডের সঙ্গে মতানৈক্যের জন্য এক সময় হলিউড ছেড়ে ব্রিটেন পাড়ি দেন। তো, এরা যে সময়ে ব্রিটেনে ছবি বানিয়েছিলেন, আমি সেই সময়ের ছবিই আলোচনায় নেব, অন্য সময়ের নয়।

তাহলে বেশ বড়সড় এক লিস্ট দিয়ে শুরু করা যাক। ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের সেরা কুড়ি। হিচককের ‘দ্য 39 স্টেপ্‌স’ (১৯৩৫), লিনের ‘ব্রিফ এনকাউন্টার’ (১৯৪৫), ‘গ্রেট এক্সপেক্টেশনস’ (১৯৪৬), ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই’ (১৯৫৭) ও ‘লরেন্স অব আরাবিয়া’ (১৯৬২), আর্চার্সের ‘দ্য রেড শুজ’ (১৯৪৮), রিডের ‘দ্য থার্ড ম্যান’ (১৯৪৯), কিউব্রিকের ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’ (১৯৬৮) ও ‘ব্যারি লিন্ডন’ (১৯৭৫), অ্যান্ডারসনের ‘ইফ...’ (১৯৬৮), কেন লোচের ‘কেস’ (১৯৬৯), জোনসের ‘মন্টি পাইথনস্‌ লাইফ অব ব্রায়ান’ (১৯৭৯), হাডসনের ‘চ্যারিয়টস্‌ অব ফায়ার’ (১৯৮১), বয়েলের ‘ট্রেনস্পটিং’ (১৯৯৬), জো রাইটের ‘অ্যাটোনমেন্ট’ (২০০৭) এবং ম্যাককুইনের ‘হাঙ্গার’ (২০০৮)। এরসঙ্গে স্কটল্যান্ডের দুটো ছবি আলাদা করে নেবঃ হার্ডির ‘দ্য উইকার ম্যান’ (১৯৭৩) ও রামসে-র ‘র‍্যাটক্যাচার’ (১৯৯৯), এবং আয়ারল্যান্ডের-ও দুটো নেবঃ শেরিডানের ‘মাই লেফট্‌ ফুট’ (১৯৮৯) ও লোচের ‘দ্য উইন্ড দ্যাট শেক্‌স দ্য বার্লি’ (২০০৬)।

এর ভেতর মাত্র ছ’খানা ছবি নিয়ে আজ বিশদে আলোচনা করব -- ‘দ্য থার্ড ম্যান’ (১৯৪৯), ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’(১৯৬৮), ‘কেস’ (১৯৬৯), ‘ট্রেনস্পটিং’ (১৯৯৬), ‘র‍্যাটক্যাচার’ (১৯৯৯) এবং ‘দ্য উইন্ড দ্যাট শেক্‌স দ্য বার্লি’ (২০০৬)।

ক্যারল রিডের ‘দ্য থার্ড ম্যান' দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্ত্তী সময়ের সাসপেন্স ছবি। স্থান অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা। জোসেফ কটন এসে যুদ্ধ পরবর্ত্তী ভিয়েনায় উপস্থিত হয়। উদ্দেশ্য, তার পুরনো বন্ধু অরসন ওয়েলেস-এর (সিটিজেন কেন-এর সেই  বিখ্যাত ওয়েলেস) চাকরির প্রস্তাবে সাড়া দেওয়া। কিন্তু সেখানে এসে সে দেখে তার বন্ধু আর নেই, পথ দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এরপর বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে কটনের মনে হয়, ওয়েলেসের দুর্ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়। সে ভিয়েনায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ঘটনার অনুসন্ধান চলার সময় আবার হঠাৎ ওয়েলেস উদয় হয় এবং এবার সে সত্যিকারের খুন হয়। ছবি জুড়ে টানটান উত্তেজনা। 

কিন্তু এই সিনেমার থিম নয়, একে খ্যাতি দিয়েছিল এর লেন্সের কাজ। এই সাদা-কালো ছবির সিনেমাটোগ্রাফি এতই বিখ্যাত যে তা আলোচনা না করলে এই ছবির কথা সম্পূর্ণ হবে না। প্রথমত, প্রায় সময়েই কোন সাবজেক্টকে ফ্রেমের সামনে রেখে জার্মান এক্সপ্রেসনিজম ফুটিয়ে তোলার অন্যতম উদাহরণ এই ছবি। চোখ ধাঁধাঁনো আলো, চমকে দেবার মত আলো এবং ক্যামেরার ডাচ অ্যাঙ্গল (খানিকটা বাঁকা, যেটা এর আগেও বার্তোলুচির ‘দ্য কনফর্মিস্ট’ নিয়ে বলেছিলাম) অনবদ্য। সাধারণত ডাচ অ্যাঙ্গল মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা বা সাসপেন্স  বোঝানোর জন্য কেউ কেউ ব্যবহার করেন, যা এই সিনেমার প্রতি ছত্রে। এর ওপর আছে শুটিং-এর জায়গাগুলো। প্রতি শটে বেছে বেছে এমন পারিপার্শ্বিক  ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন ব্যাপারটা দুর্দান্ত ফুটে উঠেছে। এবং তার ওপরে রয়েছে সাউন্ডট্র্যাক। অসাধারণ থিম মিউজিক, যা থেকে পরবর্ত্তীকালে ‘লা ডোলচে ভিটা’র মিউজিক পর্যন্ত প্রভাবিত  হয়েছিল। এমনি এমনি কি এই সিনেমাকে ব্রিটেনের সর্বকালের সেরা ছবি ধরে নেওয়া হয়!

স্ট্যানলি কিউব্রিকের ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’ (১৯৬৮) সেই ছবি যা আমি পৃথিবীর প্রথম বারোখানা ক্লাসিক মাস্টারপিস সিনেমার লিস্টে রেখেছি। সুতরাং আজ একে নিয়ে বিশদ আলোচনা করব। এই ছবির স্ক্রিনপ্লে লেখক, পরিচালক ও প্রযোজক কিউব্রিক। অবশ্য কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার সি ক্লার্ক-ও কিউব্রিকের সঙ্গে এই ছবির স্ক্রিনপ্লে লিখেছিলেন, তারই এক গল্প ‘দ্য সেন্টিনেল’  (১৯৫১)–এর ছায়া অবলম্বনে। এই ছবির ভেতর আমি অনেক কিছু খুঁজে পাই। অস্তিত্ববাদ, মানুষের বিবর্তন, মনস্তত্ব, প্রযুক্তিবিদ্যা, বিশ্বাসযোগ্য স্পেশাল এফেক্ট, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং অন্য গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা। ভুললে চলবে না, আর দশটা ছবির তুলনায় এই সিনেমা আলাদা।

মনোলিথ নিয়ে 2001-এর গল্প শুরু। সভ্যতা শুরুর আগেই কে বা কারা পৃথিবীতে এক মনোলিথ রেখে গেছে, যা বিজ্ঞানের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এরপর  মানুষ চাঁদে পাড়ি দেয় এবং সেখানে এইরকম আরেক মনোলিথ পায়। কোন্‌ অ্যালিয়েনরা এইসব মনোলিথ রেখে গেছে এবং তারা কী বোঝাতে চায়, সেই নিয়ে মানুষ আর কম্পিউটারে টানাটানি শুরু হয়। যে জিতবে, সে বিবর্তনের আরো কাছাকাছি পৌঁছে যাবে।

আমি ঠিক এখান থেকে 2001–এর আলোচনা শুরু করব। কীভাবে একটা সিনেমা গ্রেট হয়ে ওঠে? কীভাবে গ্রেট তকমা পেরিয়ে টাইমলেস মাস্টারপিসে  তার স্থান হয়? সিনেমাটোগ্রাফি? এডিটিং? অভিনয়? ডায়লগ? নাকি এসব ছাড়িয়ে আরো ওপরে পরিচালকের অন্য কোন মুন্সিয়ানা যা ছবিকে দর্শকের মনে গেঁথে রাখে? আমার মতে, সিনেমায় এক অনন্য ও স্বতন্ত্র ব্যাপার থাকা দরকার, যা দর্শক আগে অন্য কোন ছবি থেকে পায়নি। তবেই সেই অদৃশ্য সূতো তৈরি  হয়। 2001 সিনেমায় ক্যামেরার কাজ আর স্পেশাল এফেক্ট বাদ দিয়ে যদি শুধুমাত্র থিম নিয়ে কথা বলি, তাহলে দর্শক হিসেবে ‘বাঃ’ বলতে বাধ্য হব এর  শেষ দৃশ্যের জন্য। আবার সমালোচক হিসেবে যদি দেখি, তাহলে কোথাও যেন একটা খটকা থাকবে কারণ ‘ডঃ স্ট্রেঞ্জলাভ’-এর পর এই ছবিতেও যেন  সূক্ষ্মভাবে কিউব্রিক মানবসভ্যতা নিয়ে হতাশ মনে হয়েছে। যদিও এই সিনেমার ছত্রে ছত্রে বুদ্ধি লুকিয়ে আছে, কিন্তু কিউব্রিক নিজে দর্শকের অবচেতন মন নিয়ে বেশি ভাবিত ছিলেন। ফলে উনি এই ছবি নিয়ে কিছুই চাপাতে চাননি। এক ইন্টারভিউতে কিউব্রিক বলেছিলেন ‘you’re free to speculate as you wish about the philosophical and allegorical meaning of the film – and such speculation is one indication that it has succeeded in gripping the audience at a deep level – but I don’t want to spell out a verbal road map for 2001 that every viewer will feel obligated to pursue or else fear he’s missed the point’.

সায়েন্স ফিকসন হিসেবে এই ছবি আমার তালিকায় সর্বকালের সেরা হিসেবে থাকবে। এবং যদি ভুল না করি, তাহলে মানতে হবে যে এই সিনেমাই সেই পথিকৃত ছবি যা পরবর্ত্তীকালে আরো অনেক পরিচালক ও সিনেমাকে পথ দেখিয়েছে বক্স অফিস হিট কল্পবিজ্ঞান ছবি বানানোর। এবং কিউব্রিককে কুর্নিশ জানাব এই সিনেমার কোন সিকোয়েল তৈরি না করার জন্য। তবে হ্যাঁ, আবারো অস্কার কমিটিকে ‘কানা’ বলতে বাধ্য হচ্ছি।       

১৯৬৮ সালের উপন্যাস ‘এ কেস্ট্রেল ফর এ নেভ’ অবলম্বনে ১৯৬৯ সালে কেন লোচের তৈরি ‘কেস’ (কেসট্রেল বা চিলের সংক্ষিপ্ত রূপ) ইংল্যান্ডের নিম্নবর্গের  শ্রমিক শ্রেণীর কথা ও খুঁতযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার কথা ফুটিয়ে তুলেছে। বিলি একজন  টিনেজার, যার পরিবারে তার মা আর দাদা। বিলি স্কুল বা লেখাপড়া ভালবাসে না। অবাধ্য। মায়ের কাছে বা দাদার কাছে বকুনি, মার খায়। সে একদিন গাছে চিলের বাসা থেকে এক চিলের বাচ্চা চুরি করে। তারপর তাকে বাজের মত শিকারী পাখি হবার জন্য ট্রেনিং দিতে শুরু করে। সেই ট্রেনিং দেবার জন্য সে একটা বই চুরি করে। কিন্তু বিলির দাদা রেগে গিয়ে শেষ দৃশ্যে সেই চিলকে মেরে ফেলে।

এই সিনেমার প্রথম আকর্ষণ বিলির ভূমিকায় কিশোর ডেভিড ব্র্যাডলি-র  অভিনয়, যে আগে কোনদিন অভিনয় করেনি। কিন্তু তারও ওপরে লোচের ক্যামেরার প্যানোরামিক চোখ আর সিনেমার থিম। শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি লোচের  সহমর্মিতা এবং নিম্নবর্গের জনগণের জন্য খুব কম শিক্ষার সুযোগ, যা নিয়ে  বারবার ইংল্যান্ডে সমালোচনার ঢেউ উঠেছে, তা লোচ অনায়াসে এই সিনেমায় দেখিয়েছেন। আরো এক সহজ ভুল উনি অভিভাবকদের চোখে আঙুল দিয়ে এই ছবিতে দেখিয়েছেন। যখন বাচ্চা বড় হয়ে উঠতে থাকে, সে চায় তার পরিবারের সবার ভালবাসা। তা না করে তাকে বারবার সমালোচনা করলে বা দূরে ঠেলে দিলে সে কিন্তু আস্তে আস্তে বিলির মত হয়ে উঠতে পারে। বিলি যা চেয়েছিল কিন্তু পায়নি, সেই সবকিছুর প্রতীক এখানে ‘কেস’ বা পোষা চিল। স্বাধীনতা,  গর্ব, সন্মান ও নিজস্বতা। বিলি আর কেস এখানে কনট্রাস্ট। একজন একজন উড়ন্ত ও স্বাধীন। অন্যজন পরাধীন, বন্দী। আর এই কনট্রাস্টের মাঝে লোচের ক্যামেরা ফ্রেম থেকে ফ্রেমে ঘুরে বেড়িয়েছে, দর্শকের ইচ্ছের মত।  

ব্রিটেনে অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভুগতে থাকা এডিনবারা অঞ্চল আর তার কিছু হেরোইন আসক্ত তরুণ, এদের নিয়ে তৈরি ড্যানি বয়েলের ‘ট্রেনস্পটিং’ (১৯৯৬),  মনে হয় যেন আজো আমাদের সমাজের এক জ্বলন্ত সমস্যা। ব্রিটেনের সর্বকালের সেরা ১০টা ছবির ভেতর এই ছবি আসবেই।

এডিনবারার রাস্তায় রাস্তায় হেরোইন আসক্ত মার্ক রেন্টন আর তার নেশাখোর বন্ধুদের দৌরাত্ম। রেন্টন ড্রাগ ছাড়তে চেষ্টা করলেও সে পারছে না। এদিকে  রেন্টনের পরিবার পরিজনদের সঙ্গে দিনে দিনে তার সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। এমনকি তার ১৪ বছরের প্রেমিকার সঙ্গেও। এই সিনেমার প্রতি সিন খুব শক্তিশালী। পেছনে ‘পটভূমি সঙ্গীত’ ব্যাপারটা আরো জোরালো করেছে। পপ কালচার বলুন, হিপি কালচার বা পাঙ্ক কালচার... এই ছবির সঙ্গে আপনি মিল পাবেনই।

ভাল অভিনয়, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, যথাযথ এডিটিং, নিজস্ব স্ক্রিপ্ট। আর হ্যাঁ, যেটা বলতেই হয়, সেটা হল এই সিনেমার মন্তাজের কাজ। পরপর তিনখানা সিন ব্যবহার করে মন্তাজ। কেউ সহজে এই সাহস দেখাবেন বলে মনে হয় না। সব মিলিয়ে এই সিনেমা সত্যি ব্রিটিশ ক্লাসিক।

লিন রামসে-র ১৯৯৯ সালের সিনেমা ‘র‍্যাটক্যাচার’ আরেক অদ্ভুত সিনেমা। মনে  রাখার মত থিম, যার মাঝে কৈশোরের পরাবাস্তব মনোস্তত্ত্ব ঢুকে ছবি আরো জমাট করে তুলেছে। ‘কে’ ছবির সার্থক উত্তরসূরী।

পটভূমিকায় ১৯৭৩ সালের গ্লাসগো। পুরনো আমলের স্ট্রাকচার, যেখানে কোন বাড়িতেই গরম জলের লাইন নেই, ঘরের ভেতর স্নান করার বা টয়লেটের কোন সুবিধে নেই। এইসমস্ত বাড়ি ভেঙে নতুন করে তৈরি হচ্ছে। এইসব বাড়ির লোকজনকে অন্যত্র সরানো হচ্ছে। এর মাঝে ডাস্টবিন ফেলার শ্রমিকরা হরতাল করায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। শহরতলীর মাঝে পাহাড়প্রমাণ নোংরা  জমছে এবং বেড়ে চলেছে ইঁদুরের উৎপাত। এইরকম এক পরিবার, যার সদস্য  কিশোর জেমস, অপেক্ষা করছে কবে তাদের নতুন হাউজিং-এ সরানো হবে। জেমস অন্যদের থেকে একটু আলাদা। তার কল্পনার জগৎ আছে, সে সবকিছু মুখ ফুটে বলতে পারে না। তার সামনে তার বন্ধু খালের জলে ডুবে মারা যাবার পর সে আরো চুপ হয়ে যায়। জেমসের থেকে সামান্য বড় মার্গারেট অ্যান একদিন স্থানীয় ছেলেদের অত্যাচার থেকে ছাড়া পাবার পর জেমস তার চশমা খুঁজে দেয়। তারপর তাদের বন্ধুত্ব হয় ও দুজন মিলে পরাবাস্তব এক জগতে ঢুকে যায়। সেই জগৎ যেখানে সমস্ত ইঁদুরেরা উড়ে চাঁদে পৌঁছে যাচ্ছে। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় জেমস খালে ঝাঁপ মারছে, এবং স্বপ্নে দেখছে তারা নতুন বাড়িতে ঢুকছে।

থিম ছাড়াও এই ছবিতে ক্যামেরার কাজ ভাল। ক্লোজ-আপ শট, ডিসট্যান্ট শট, মুভিং শট, মোটামুটি সবই আছে। শুরুর দৃশ্যে জানালার পর্দা নিয়ে জেমসের স্লো মোশনে খেলা আর তার মায়ের থাপ্পড় বুঝিয়ে দেয় বাস্তব আর কবিতার  মাঝামাঝি কোথায় এই সিনেমার দ্বন্দ্ব। জেমসের বড় হবার ভয়। জেমসের মুখে  ফড়িং-এর মত ঘাস লেগে থাকা বা জানালা দিয়ে বিস্তীর্ণ গমের ক্ষেত দেখা –  এগুলো ক্যামেরাকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। কিন্তু কোথাও কোথাও লিন  ক্যামেরার এফেক্ট ধরে রাখতে পারেননি। যেমন জানালা দিয়ে আদিগন্ত গমের  ক্ষেত দেখা। জেমস একসময় সেই ক্ষেতে লাফ মারে। ক্যামেরাও জেমসকে ধরে রাখতে গিয়ে ফোকাস করে সেই ক্ষেতেই। ফলে জানালা ও ফ্রেম হারিয়ে যায়। এরকম কয়েকটা জায়গা বাদ দিলে সার্বিকভাবে ক্যামেরার কাজ মনে রাখার মত। 

কেন লোচের ‘দ্য উইন্ড দ্যাট শেক্‌স দ্য বার্লি’ (২০০৬) আয়ারল্যান্ডের   স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আইরিশ গৃহযুদ্ধ, মোটামুটি ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ অব্ধি - এই পটভূমিকায় তৈরি। এই ছবি নিয়ে কিছু না বললে লোচের ছবি ও তাঁর দর্শন  বুঝতে অসুবিধে হবে। তাই এই ছবি বাছলাম। প্রথমেই বলি, ড্যামিয়েন ও’ ডোনোভানের চরিত্রে সিলিয়ান মার্ফি অনবদ্য। এই ছবিতে ড্যামিয়েন একজন ডাক্তার, যে গ্রাম্য আয়ারল্যান্ডের পটভূমি ছেড়ে লন্ডনে গিয়ে চাকরি করবে বলে তৈরি হচ্ছে। ঠিক সেই সময় ব্রিটিশ সৈন্য তাদের গ্রাম আক্রমণ করে। ড্যামিয়েন এই বীভৎসতা দেখে তার ভাইয়ের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সৈন্য আয়ারল্যান্ডকে স্বতন্ত্র প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করতে রাজি হয়ে যায়। ড্যামিয়েনের ভাই টেডি এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু ড্যামিয়েন ও আরো প্রচুর আইরিশ যোদ্ধা এই প্রস্তাবে রাজি হয় না। তারা আয়ারল্যান্ডকে স্বাধীন দেশ হিসেবেই চায়, অন্য কোন শর্তে তারা রাজি নয়। ফলে আবার শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। দু’দলের ভেতর।

আইরিশ যুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল। বেশিরভাগ অভিনেতা আইরিশ। লোচ শ্রদ্ধার  সঙ্গে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে আইরিশ বিপ্লব শুধুমাত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল না, শুধু পতাকার পরিবর্তন নয়, বিপ্লবীরা চেয়েছিল আমূল সামাজিক পরিবর্তন। দীর্ঘ রক্তপাত। ফলে এই সিনেমা দেখতে দেখতে আপনার ইরাক বা ভিয়েতনামের কথা মাথায় আসবেই। এবং তখন আপনি বুঝতে পারবেন লোচের সিনেমায় সামাজিক সচেতনতা কোন পর্যায়ে। কিন্তু সবার ওপরে লোচের সেই মুগ্ধকর প্যানোরামিক ক্যামেরা। প্যানপাইপের মত আইরিশ উপত্যকায় যা ফ্রেম থেকে ফ্রেমে ভেসে চলে। তাই বলে ভাববেন না এটা আয়ারল্যান্ড পর্যটনের অ্যাড। লোচ মাঝে মাঝেই হাল্কা ডার্ক রং, ভরন্ত রং বা ধূসর আলো – এইসব ব্যবহার করে মেঘলা আইরিশ জলবায়ু ফুটিয়েছেন। এবং পুরো সিনেমা লোচ এমনভাবে বানিয়েছেন যে কখনো গতি খর্ব হয়েছে মনে হয়নি।    

একদম শেষে বলি, জন ফোর্ডের ‘দ্য কোয়াইট ম্যান’ (১৯৫২) আয়ারল্যান্ডের  গ্রাম্য জীবনের এক ক্লাসিক রোমান্টিক দলিল। কিন্তু এই সিনেমাকে আইরিশ সিনেমা হিসেবে লিস্টে রাখতে পারলাম না যেহেতু জন ফোর্ড নিজে হলিউডের পরিচালক। কিন্তু সিনেমাটা বেশ ভাল – দেখতে ভুলবেন না।

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন