কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

প্রদোষ ভট্টাচার্য্য

 

প্রসঙ্গঃ তরুণ মজুমদার



আগমন

দেশে ফিরে প্রথম বড় পর্দায় বাংলা ছবি দেখলাম সেই লেক টাউনের জয়ায় আমার অতি প্রিয় পরিচালক তরুণ মজুমদারের আগমন। আপনাদের মনে করিয়ে দিই যে ১৯৮৪-তে বিদেশ যাত্রার আগে এই প্রেক্ষাগৃহেই দেখেছিলাম তরুণবাবুর সে বছরের নতুন ছবি অমর গীতি। ২রা ডিসেম্বরে ১৯৮৮-তে মুক্তি পাওয়া আগমন ১৯৮৮-তেই দেখেছি না ১৯৮৯-এর গোড়ায়, তা সঠিক মনে নেই। তরুণবাবুর শ্রেষ্ঠ ছবির মধ্যে আগমনকে ফেলব না ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘ চার বছর প্রবাসের পর এর চেয়ে তৃপ্তিকর নতুন বাংলা ছবি কি হতে পারত জানি না! তাঁর অনেকগুলি আগের ছবির স্মৃতি যে জাগিয়ে দিল তাঁর এই নতুন উপহারটি! প্রথমেই গান ‘শুনুন শুনুন বাবুমশাই’ (কণ্ঠে শিবাজী চট্টোপাধ্যায় ও অন্যান্য) মনে করায় ফুলেশ্বরীর শীর্ষসঙ্গীত, যাতে মূল কণ্ঠ ছিল মান্না দে’র। চরিত্রগুলির নাম ভুলে গেছি, তাই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম ব্যবহার করেই বলছি, দামাল ছেলে (মাঃ স্বর্ণেন্দু) তার সাগরেদদ্বয় গোবিন্দ আর ভোলা (এই দুটি চরিত্রের নাম মনে আছে) মনে পড়ালো শ্রীমান পৃথ্বীরাজ-এর রসিক আর তার বন্ধুদের। তবে রসিকও তার বদমেজাজী মাস্টারমশাইকে রসগোল্লার সঙ্গে কড়া জোলাপ মিশিয়ে খাওয়ায়নি যা আমাদের খুদে নায়ক করেছে! তার পোষা ব্যাঙকে নিয়ে সে ভাব জমায় জমিদার  বাড়ির ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে। দুজনে একদিন গিয়ে পড়ে জঙ্গলের মধ্যে মন্দিরে। সেই মন্দিরের পুরোহিত হাস্যোচ্ছলে তাদের অভিহিত করেন ‘ভৈরব’ আর ‘ভৈরবী’ বলে। জমিদার বাড়িতে ততক্ষণে হৈচৈ পড়ে গেছে – মেয়ে কোথায়? ঠিক যেমন বিনিকে নিয়ে তুলকালাম হয়েছিল দাদার কীর্তিতে। সেবারে মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়েছিল, বিনি যে গিয়েছিল তার হবু-বরের সঙ্গে! এখানে কিন্তু সাক্ষাৎ জমিদার বাড়ির খুকী ফিরল সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে, তাও আবার গ্রামের মধ্যবিত্ত ডাক্তারের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) বিচ্ছু ছোট ভাইয়ের! অসহায় খুকীর প্রাণপণ প্রতিবাদ সত্বেও রুমাল  দিয়ে মুছিয়ে দেওয়া হলো তার সিঁদুর – যে রুমাল সে বড় (দেবশ্রী রায়) হয়েও সযত্নে রেখে দেবে নিজের কাছে। এদিকে ধৈর্যচ্যূত দাদা হাতে তুলে নেবেন বড় জমিদারবাবুর (উৎপল দত্ত) চাবুক! মারে অর্ধমৃত কিশোরটিকে গ্রামের রাস্তার ধার থেকে কুড়িয়ে আশ্রয় দেবে এক যাত্রাদল। সেই দলের সঙ্গেই গ্রামে-গ্রামে ঘুরবে আমাদের নায়ক, আর তার স্নেহময়ী অভিভাবিকা হবেন সেই দলের মুখ্য নাচিয়ে (সন্ধ্যা রায়)। দু’জনের মধ্যে গড়ে উঠবে ভাই-বোনের সম্পর্ক। যখন পাতানো দিদি (বাড়িতে যে ভুমিকা পালন করতেন ছেলেটির বৌদি – সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়) নেচে- নেচে গাইছেন ‘প্রেমের পিপাসা নিয়া ছাড়িলাম কূল / বুঝিনি তো এ সাগর অতল-অকূল’ (কণ্ঠে আশা ভোঁসলে ও অন্যান্য), তখন কিশোর হঠাৎ গলা মেলায় আস্থায়ীতে (সৈকত মিত্র)। চশমখোর অধিকারী (অনুপকুমার) ভেবে ফেলেন যে এই বসে-বসে খাওয়া গলগ্রহটিকে এবার দলের কাজে লাগানো যাবে। নতুন পালা লেখা হয়, দিদি-ভাইকে নিয়েঃ ‘যশোদা-দুলাল’। এরই মধ্যে কিশোর পরিণত হয় যুবকে (তাপস পাল)। দলের ময়না (পাপিয়া অধিকারী) তার ওপর হামলে পড়লেও নায়ক তাকে প্রত্যাখ্যান করে; নায়িকা যেমন সেই সিঁদুর-মাখা রুমাল নিয়ে বিভোর, নায়কও স্মৃতিতে ডুবে থাকে সেই সিঁদুর-কৌটো নিয়ে, যার থেকে সে নায়িকাকে সিঁদুর পরিয়েছিল।

এরপর কাহিনী এগিয়ে চলে যাত্রাদলের সঙ্গে। এক গ্রামে সন্ধ্যা রায়-অভিনীত চরিত্র দেখে গাছতলায় বসে এক দৃষ্টিহীন বৃদ্ধ গাইছেন, “ভালোবাসার এই কিরে খাজনা! /  দিয়ে ফাঁকি ওড়ে পাখি, / যতই ডাকি, আর ফেরে না!” (কণ্ঠে মান্না দে)। এ যে তারই বাবা! সম্পূর্ণ গানটির মধ্যে দিয়ে আমরা দেখি সন্ধ্যা রায়ের চরিত্রটির দুর্ভাগ্যের ইতিহাস। প্রেমে পড়ে বাড়ি থেকে পালানো, তারপর মদ্যপ প্রেমিকের তাকে অন্যের হাতে বেচে দিয়ে অর্থোপার্জনের কু-চেষ্টা, আর সেখান থেকে কোনমতে নিজেকে রক্ষা করে যাত্রাদলে যোগদান। ভাবাবেগ-তাড়িত মেয়ে তার বাবার পায়ের কাছে রেখে আসে তার গলার সোনার হার। অবশেষে যখন সে ভাই আর ভাই-বৌয়ের মুখোমুখি হয়, ভাই দিদির মুখে থুতু দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয় – অবশ্য বাবাকে দিদির দেওয়া সোনার হারটি সে সযত্নে তার স্ত্রীকে হস্তান্তর করে দিয়েছে! উদভ্রান্ত দিদি ছুটতে-ছুটতে সম্ভবত ঝাঁপ দেয় নদীতে। দিদির খোঁজে পাতানো ভাইও যাত্রাদল ছাড়ে। এরপর ঘটনাচক্রে পাতানো ভাই ট্রেনে গান-গেয়ে ভিক্ষা করা এক বৈরাগীর সঙ্গ পায়। ‘বিধি, তোর খেলা তো বুঝি ন রে, এ কেমন খেলা’ গাইতে গাইতে (দ্বৈতকণ্ঠে মান্না দে ও শিবাজী চট্টোপাধ্যায়) গেয়ে তারা ভিক্ষা করছে, এমন সময় ঘটে ট্রেন-দুর্ঘটনা! সন্ধ্যা রায় ইতিমধ্যে আশ্রয় পেয়েছেন সেই গ্রামের জমিদার-বাড়িতে যেখান থেকে আমাদের কাহিনি শুরু হয়েছিল। আর  যাত্রাদল আহত পাতানো-ভাইকে পথে খুঁজে পেয়ে তাকে শুশ্রূষা করে সারিয়ে তুলে এসে হাজির হয় সেই একই গ্রামে!

ইতিমধ্যে, নায়িকা বড় হওয়ায় তার সম্বন্ধ করা হয় এক ধনী, পোশাকে-আচারে পশ্চিমী (অতএব খারাপ!) ছেলের সঙ্গে। পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখতে এলে, নায়িকা (দেবশ্রী রায়)-কে তার বাবা আদেশ করেন গান গাইতে – ঠিক যেমন ‘দাদার  কীর্তি’-তে সরস্বতীর বাবা করেছিলেন। সরস্বতীর কণ্ঠে তরুণবাবু চমকে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। ‘আগমনে’র নায়িকা তার ছোটবেলার সাথীকে মনে করে অত্যন্ত সময়োপযোগী গান গেয়ে ওঠেন, আমার অভিজ্ঞতায় তরুণবাবুর ছবিতে এই প্রথম নজরুলগীতি, ‘শূন্য এ বুকে পাখী মোর আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়’ (হৈমন্তী শুক্লা)!

এবার জমিদার-বাড়িতে বসে যাত্রাগানের আসর। ‘পলাতক’ (১৯৬৩) ছবিতে প্রথম  দিকে গোলাপ (অনুভা গুপ্তা) ও অন্যান্যদের মুখে শোনা গিয়েছিল ‘সখী, মন যে আমার কেমন-কেমন করে’। ছবির পরমক্ষণের ঠিক আগে এই গান আবার শুনি রুমা গুহঠাকুরতা এবং অন্যান্যদের মুখে। ‘আগমনে’ও শুরুর দিকের গান ‘প্রেমের পিয়াসা নিয়া’ আবার চক্রাকারে-আবর্তিত হয়ে ফিরে আসে, এবার মূল গায়িকা ময়না (পাপিয়া অধিকারী, কণ্ঠে অরুন্ধতী হোম চৌধুরী)। তারপরই আমাদের নায়ক আসরে নামেঃ ‘যদি কেহ কৃষ্ণ চায়, কোন বাধা বাধা নয়! / সুখ কৃষ্ণ, দুখ কৃষ্ণ, তবে রাধা রাধা হয়!’ অবশ্যই গান গাইতে-গাইতে ‘পলাতক’-এর নায়কের মতো নায়ক মূর্ছা যায় (‘পলাতক’-এ অনুপকুমার অভিনীত চরিত্রটি ঠিক অজ্ঞান হয়নি, কাশির দমক ওঠায় গান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল), আর অবশেষে কাহিনির রাধাকৃষ্ণের মিলন হয়।

ছবির বাড়তি প্রাপ্তি ছিল এক আসরে, যখন অর্ধোন্মত্ত, স্থূলরুচির শ্রোতারা খেউড়-গানের দাবি তোলে তখন ময়না আর নায়ক মিলে তাদের শান্ত করতে আসরে নেমে গায়, ‘ঢাক-গুড়গুড়, ঢাক-গুড়গুড়, গোপন কথা বলি, / আজ এখানে হবে বধূ ভালোবাসার বলি!’ এর পরেই নায়ক শ্রোতাদের লজ্জা দিয়ে একক কণ্ঠে গায়, ‘এতো ভালোবাসা নয়, ভালোবাসা নয়, কামনা-জড়ানো চাওয়া! / আঁধার পেরিয়ে, আঁধারের সাথে, আঁধারেতে ডুবে যাওয়া!’ দুটি গানেই নায়কের কণ্ঠ ছবির সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়!

মনে পড়ে, ‘আগমন’ দেখার কিছুদিন পরে ট্যাংরার চীনে রেস্তোরাঁয় হঠাৎ তরুণবাবুর দেখা পাই, আর বিদেশে মানসিকভাবে তৃষিত থাকার পর তাঁর ছবি যে কতখানি তৃপ্তি দিয়েছিল তা জানিয়ে পরিচালকের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করি।

আপন আমার আপন

১৯৯০-তে দেখা প্রথম বাংলা ছবি, আমার হবু-স্ত্রীর সঙ্গে শ্যামবাজারের মিনারে তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘আপন আমার আপন’। আমার কাছে ছবির মুখ্য  আকর্ষণ ছিল, ১৯৮৯-তে মনপ্রাণ হাহাকারে ভরিয়ে দিয়ে প্রয়াত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি দৃশ্যে উপস্থিতি। ঐ দৃশ্যে তিনটি বাক্য তিনি উচ্চারণ করেছিলেনঃ “আমি... এর প্রস্তাব সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি,” আর নায়ক (তাপস পাল) তার গান শেষ করার পর, “বেশ গেয়েছো, বাবা! দেখো, এ কণ্ঠ যেন হারিয়ে না যায়!” মনে হয়, ছবির যে প্রিন্টটি এখন পাওয়া যায়, তাতে এই তৃতীয় বাক্যটি নেই!

ছবিটির সপক্ষে বলব যে তরুণবাবুর অন্যান্য ছবিতে যেভাবে শহুরে বিত্তবানদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়, এখানে দীপঙ্কর দে-সঙ্ঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়-শতাব্দী রায়-ইন্দ্রাণী দত্ত-দের পরিবারের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে বিত্তের দম্ভে এবং প্রেমে ব্যর্থ হবার তাড়নায় সাময়িকভাবে বিপথগামী প্রসেনজিতের চরিত্রটিও শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত অনুমানযোগ্য পদ্ধতিতে আত্মত্যাগ করে নিজেকে উদ্ধার করেছে।

ছবির বড় খামতি তার মুখ্য গানটির সুর, যে গানের ওপর পুরো কাহিনিই নির্ভর করছেঃ ‘আঁধারে কখন এসে জ্বালবে প্রদীপ তুমি! / পথের খোঁজে, পথের মাঝে হারিয়ে গেছি আমি!’ সুরকার রাহুল দেব বর্মণ এবং গায়ক অমিতকুমার, দুজনেই হতাশ করেছেন! একেই বলে, বিসমিল্লায় গলদ! যাঁর সুরের স্পর্শে চিরকাল প্রাণ পেয়ে এসেছে তরুণ মজুমদারের ছবি (এই ছবি অবধি সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম হিন্দি ‘বালিকা বধূ’; বাংলা ‘নিমন্ত্রণ’ ও ‘অমর গীতি’ ছবিদুটিতে সুর সৃষ্টিতে যোগ দিয়েছিলেন যথাক্রমে নির্মলেন্দু চৌধুরী এবং রামকুমার চট্টোপাধ্যায়), তিনি এই ছবিতে শুধুই পার্শ্বচরিত্র! অন্য গানগুলি অবশ্য মন্দ নয়।

চাওয়া-পাওয়া

১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠীর নামে তরুণবাবুর প্রথম পরিচালনার কাজ উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত এই ছবিটি। ১৯৮০-র শেষে ‘দাদার কীর্তি’ মুক্তি পেয়ে প্রভূত সাফল্য লাভ করার পর আকাশবাণীতে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে তরুণবাবু এটিকে ‘অত্যন্ত দুর্বল ছবি’ বলেন। তখন এ ছবিটি দেখিনি। আশির দশকের শেষে বা নব্বই-এর গোড়ায় নন্দনে ‘চাওয়া-পাওয়া’ দেখে পরিচালকের এই উক্তির কারণ খুঁজে পাইনি। যেসব বিদেশী কাহিনী, এবং সেইসব কাহিনী-আধারিত বিদেশী ছবি থেকে এদেশে একাধিক ছবি হয়েছে, ‘চাওয়া-পাওয়া’ সেই গোত্রের একটি। স্যামুয়েল হপকিনস অ্যাডামস রচিত ছোট গল্প ‘Night Bus’ (১৯৩৩) অবলম্বনে ক্লার্ক গেবল ও ক্লোদেত কলবের অভিনীত ১৯৩৪ সালের ‘It Happened One Night’ চলচ্চিত্র থেকে ১৯৫৬-তে তৈরী হয় রাজ কাপুর-নার্গিস অভিনীত ‘চোরি-চোরি’, ১৯৫৭-তে দেব আনন্দ-কল্পনা কার্ত্তিক অভিনীত ‘নও দো গ্যারা’, আর ১৯৫৮-তে দেব আনন্দ-ওয়াহিদা রেহমান অভিনীত ‘সোলভা সাল’ ছবির গল্পেও ‘It Happened One Night’-এর প্রভাব আছে। অবশেষে ১৯৫৯-এ আসে ‘চাওয়া-পাওয়া’। হয়তো এই কারণেই তরুণবাবু তাঁর প্রথম-পরিচালিত ছবির প্রতি একটু বীতশ্রদ্ধ। যাইহোক, একজন উত্তম-সুচিত্রা ভক্ত হিসেবে আমার কাছে ছবিটি খুবই মার্জিত এবং উপভোগ্য। বিশেষ করে ছবির গানকে যে সংলাপের মতো ব্যবহার করা যায় তা’ দেখা গেছে সুচিত্রার মুখে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘খেলা নয়, নয় / এই যে কাছে ডাকা’ আর তার উত্তরে উত্তমের মুখে হেমন্তকণ্ঠে ‘যদি ভাবো এ তো খেলা নয়’ গান দুটিতে। তবে লক্ষ্যণীয় যে এরপর এই জুটিকে নিয়ে তরুণ মজুমদার আর ছবি করেননি, যদিও তাঁর স্মৃতিকথা ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’-তে দুজনের প্রতিই কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করা আছে।

আলো

‘চাওয়া-পাওয়া’-র পর এক দশকেরও বেশি বড় পর্দায় তরুণবাবুর সঙ্গে দেখা  হয়নি। আবার দেখলাম এবং মুগ্ধ হলাম ২০০৩ সালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘কিন্নরদল’ অবলম্বনে চিত্রিত ‘আলো’ দেখে (প্রেক্ষাগৃহ শ্যামবাজারের মিনার)। আটখানি রবীন্দ্রসঙ্গীতে সমৃদ্ধ এই ছবিটির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তরুণবাবুর চিত্রবিশ্বে নতুনঃ নাম-ভূমিকায় ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, তাঁর স্বামীর চরিত্রে কুণাল মিত্র, পার্শ্ব চরিত্রে ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়, আলোর একাধিক বোনেদের একজনের ভূমিকায় সৌমিলি বিশ্বাস, এবং অভিষেক চট্টোপাধ্যায়, যাঁর অভিনীত চরিত্রটি অনুপকুমারকে মনে করাচ্ছিল। তরুণবাবু তাঁর বেশির ভাগ ছবিতে যেভাবে  ‘God made the country, and man-made the town’-এর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেন, এ ছবিতে তার খানিক ব্যতিক্রম ঘটেছে। গ্রামের অভাব, সংকীর্ণমনস্কতা, কিছু ব্যক্তির – বিশেষ করে ঋতা দত্ত-চক্রবর্তী অভিনীত নারীচরিত্রটির ক্রুরতা, কিছুই আড়াল করা হয়নি। বরং শহর থেকে আসা আলোর স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা আর মানুষকে আপন করে নেওয়ার মানসিকতায় শেষ অবধি আপ্লুত হয়েছে সবাই। আর এই কাজে অবিস্মরণীয় হয়ে উঠেছে আলোর মুখে ‘শ্রাবণের ধারার  মতো পড়ুক ঝরে’ গানটি (কণ্ঠে অরুন্ধতী হোম চৌধুরী), বিশেষ করে তার সঞ্চারী এবং আভোগ অংশ, আর ঠিক তার আগে গানের যন্ত্রানুসঙ্গঃ

‘যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে,

তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখা রে!

যা কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার, জীবনহারা,

তাহারই স্তরে-স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা।

নিশিদিন এই জীবনের তৃষার ‘পরে, ভুখের ‘পরে –

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে!’

কাহিনী যে বিয়োগান্ত দিকে মোড় নেবে, তার পূর্বাভাস এসেছে আলো তার কিন্নরদলকে নিয়ে গ্রামে নৃত্য-গীতানুষ্ঠান করার সময়ে নাচের সঙ্গে যে গানটি পরিবেশন করেঃ

‘আমার রাত পোহাল শারদপ্রাতে –

বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে?’

সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে আলোর মৃত্যুর সংবাদে সারা গ্রাম যখন মুহ্যমান, তখন হঠাৎ এক রাতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে তারই কণ্ঠেঃ

‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,

আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে।

….

তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি?

সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি!

নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,

আসব-যাব চিরদিনের সেই আমি!’

উদভ্রান্ত হয়ে গ্রামের মানুষ আলোর বাড়িতে ছুটে গিয়ে দেখে অন্ধকারে বসে এক  ছায়ামূর্তি! না, প্রেতাত্মা নয়, আলোর স্বামী। গ্রামোফোনে সে বাজাচ্ছে স্ত্রীর প্রয়াণের আগে রেকর্ড করা শেষ গান। আর তার প্রতিভূ সে রেখে গেছে তার কন্যাসন্তানের মাধ্যমে!

রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগে তরুণবাবুর জুড়ি মেলা যে ভার, সেই আশির দশকের গোড়ায় ‘দাদার কীর্তি’ দেখেই বুঝেছিলাম। এবারেও তিনি হতাশ করেননি।

ভালোবাসার অনেক নাম

 

‘আলো’-র তিন বছর পর (২০০৬) সেই মিনারেই স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে দেখি, আবার বিভূতিভূষণের ছোটগল্প অবলম্বনে ‘ভালোবাসার অনেক নাম’। ছবির অন্যতম আকর্ষণ ছিল মুখ্য চরিত্রে উত্তমকুমারের নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায় আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছোট নাতনী মেঘা। এছাড়া ‘বালিকা বধূ’-র (১৯৬৭) পর এই প্রথম তরুণ মজুমদারের ছবিতে এলেন মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়! তবে, কাহিনীতে নিজের কনিষ্ঠা কন্যাকে বোনের ভূমিকায় অভিনয় করাবার সিদ্ধান্ত কার ছিল, কে জানে! অন্যান্য ভূমিকায় যথাযথ রূপদান করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র, তাপস পাল প্রমুখ। মনোজ মিত্র অভিনীত কন্যাদায়গ্রস্ত স্টেশনমাস্টারের মেয়ে বুলবুলির ভূমিকায় (সম্ভবত) মৌলি ভট্টাচার্য খুবই উপভোগ্য, কারণ বিমলকে (গৌরব) আকর্ষণ করতে – এই নবাগত গ্রামের ইস্কুলমাস্টারের গলাতেই বাবা মেয়েকে ঝোলাতে চান – বুলবুলি পুরনো দিনের বাংলা ও হিন্দী ছবির গানের সুরে তার প্রেম নিবেদন করে! বিমলের চরিত্র ‘ফুলেশ্বরী’-র কেদারকে (শমিত ভঞ্জ) মনে করায়। এছাড়া তার মুখে প্রাঞ্জলের কণ্ঠে ‘আমি অল্প নিয়েই থাকতে পারি, যদি পাই একটু ভালোবাসা’, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে শিবাজী চট্টোপাধ্যায়ের গলায় ‘ও নিঠুর দয়াল, এ কী তব খেলা’ (যা হেমন্তকণ্ঠে শোনা একাধিক গানের সুর মনে জাগিয়ে তোলে), আর একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের মন-ছোঁয়া প্রয়োগ (‘নয়, নয়, নয় এ মধুর খেলা) হৃদয়ে দোলা দেয়। তবে, ‘আলো’-র পর ‘ভালোবাসার অনেক নাম’ একটু নিস্তেজ লাগে।

(ক্রমশ)

 

 


1 কমেন্টস্:

  1. মেলায় হাওয়াই মেঠাই পাওয়া যায়, দেখতে সুন্দর কিন্তু সারবত্তা তেমন কিছু নাই তরুণ মজুমদারের ছবি গুলো সেইরকম,দু চারটি বাদ দিলে বাদবাকি ছবি গুলো বাংলা সিনেমার একশ বছরের ইতিহাসে জায়গা নাও পেতে পারে

    উত্তরমুছুন