কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

সুকান্ত দেবনাথ

 


ধারাবাহিক উপন্যাস

           

দূরত্ব




 

(১১)

এখানে এসে আমি কিছুটা বায়াস হয়ে পড়ি। আমার মধ্যে যেন পক্ষপাতিত্ব ভর করে। নিজেকে কিছুতেই ছিনিয়ে নিতে পারি না, আবেগের বসে কস্তূরীর ফেলে যাওয়া ঘৃণাগুলি কুড়িয়ে সাজিয়ে রাখি চৌকাঠে। আমার ছেলে ছাদ থেকে নেমে এসে দেখে তার বাবা একভাবে তাকিয়ে আছে সাদা পাতার দিকে। তার ভয় হয়, তাকে তার মার সাথেই বাকি দিনগুলি কাটাতে হবে না তো। বাবা যদি খুব রাগ করে তবে এমনই ভাবে চুপ হয়ে যায়। সে ভিতরে ভিতরে কিছু একটা নিরাপত্তা হীনতায় ভুগতে থাকে। আমি তাকে বলি তোর ঠাকুমা কোথায় রে। উঠে যাই কোথায় মা আছে।

‘কার কোল খালি করে চলে এসেছে এ ছেলে?’ অনেক বছর আগে এক পথ-শিশুর দিকে তাকিয়ে বলেছিল মা। কেননা ছেলেটিকে দেখে কোনো ভাবেই ভিকিরি বলে মনে হচ্ছিল না। আমাদেরই মতো সাধারণ ঘরের ছেলে বলেই মনে হচ্ছিল। কাছে গিয়ে মা তার নাম জানতে চাইল। সে উত্তর না দিয়েই যেন খুব ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে ছিল।

-মা চলো, কি দেখছও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

-না তেমন কিছু নয়, ওই ছেলেটি, দেখে তো মনে হচ্ছে ভালো ঘরেরই ছেলে।

-হতে পারে, আমাদেরই মতো ঘরের। হারিয়ে গিয়েছে হয়তো।

-না মনে হচ্ছে হারায়নি, সে পালিয়ে এসেছে।

-পালাবে কি কারণে, এতটুকু ছেলে।

-হারিয়ে গেলে নিজের নাম বলতো, ঘরের ঠিকানা বলতো, বাবার নাম বলতো। এভাবে পালিয়ে যেত না।

-কিন্তু যে নিজেই আর ধরা দিতে চায় না, তাকে আর ধরে রাখবে কিভাবে।

মা তাও এক করুণা ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিল ছেলেটির দিকে। যেন তার নিজের ছেলেই হারিয়ে গিয়েছে। সত্যি কি মায়ের আমার আগে কেউ হারিয়ে গিয়েছিল।

নিরাপত্তা হীনতা এও এক অসুক, তারও বৈচিত্র আছে জীবনে। আমি মায়ের সেই হারিয়ে যাওয়া ছেলের দিকে তাকিয়ে মনে করেছি সেই হয়তো আবার কস্তূরীর কোলে ফিরে এসেছে।

বা হয়তো আমার হাত ধরে উঠে এসেছে সাথীর বুকের উপর। আমি কিন্তু বাস্তবে এই সব কথার দোলা চালে, ভুলেই গিয়েছিলাম যে সাথী আসলে এক পরনারী। যে কিছুটা হয়তো সাহচর্য্য দিয়েছে, তবু। কে জানে কখন উঠে এসেছি তার ডিম লাইট বিছানার উপর। তার ছড়ানো স্বপ্নের উপর, বা তার বীজিত পলাশীর ময়দানে। আসলে মানুষ তো কখনও না কখনও কিছুটা সমকক্ষ পছন্দ করে, যে তার মতো হবে। যে তার মতো করে দেখবে পৃথিবী। ভালোবাসবে বা ভালোবাসা বা মন্দবাসা থেকে অনেক দূরে গিয়েও অন্তত একই রকম কষ্ট পাবে কোথাও কেটে গেলে। আমার তো গোটা জীবনই কেটে টুকরো টুকরো হয়েছে। আমি তা দেখাই কিভাবে। তুমি দেখবে আমার রাতের সঙ্গিনি। জীবন ভরে আছে শুধু (ফ্রাসটেশনে)। মুখ দিয়ে আজকাল গালি উঠে আসে, এমন কি ছেলের সামনেও নিজেকে ধরে রাখি এমন সময়। সাথী, আমি দেখতে পাচ্ছি, তোমার কাপড়ে যে হলুদ লেগে ছিল উঠে এসে আমাকে রাঙিয়ে দিচ্ছে। আমি সেই যে কিছুটা দূরে সরে এসে দেখছিলাম, তারপর তাকে ছুঁতে যেন বাধ্য হয়েছি। তার মাথায় হাত রেখে ফিরে এসেছি আবার। সাথী ঘুরে তাকিয়ে দেখেছে আমাকে। তার দৃষ্টি কি শূন্য, নাকি আমাকে সে শূন্য করে দিতে চায়। অভিমান ছিল চোখে নাকি তৃষ্ণা। আমি আবার সেই মুখের ভিতর গল্প ভাবতে শুরু করি। সে ইশারায় ডাকে, আমাকে ডাকলে কেন?

-সাথী আমি জানি, আমি আজকাল গল্প বলা থেকে সরে এসে জীবন বলা শুরু করেছি। আসলে জীবনটা তো আর গল্প নয়, যে তার কোনো শুরু বা শেষ থাকবে। তার নায়ক থাকবে নায়িকা থাকবে, ভিলেন থাকবে ক্লাইম্যাক্স থাকবে। জীবনের তো মাত্র একটি পথ আছে। সেখানে সবার মাঝেই ভালো-মন্দ, প্রেম-অবিশ্বাস আছে এবং। তুমি দেখো আমি ঠিক একদিন এই জীবনের কথা পৃথিবীর সবকটি দেয়ালে লিখে দিতে পারবো।

সাথী আমাকে বলে

-কিছু চান না জীবনের কাছে?

-কি চাইবো।

-সব পেয়েছেন?

-সব দিতে চেয়েছিলাম।

সাথী উঠে এসে আমার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। আমি বলি

-আমি যে তোমার স্বামী নই, স্বামীর মতো দেখতে।

-জানি তাই, নাহলে একটা কিছু চাইতাম।

-কি চাইতে?

-হাসি পায়।

-তাও বল।

-একগাছা শাঁখা বাঁধানো, আপনিই তো লিখছেন আমার কথা, তাও কেন জিজ্ঞেস করেন।

আমি ঠিক তখনই সাথীর মুখ কল্পনা করে কস্তূরীর বুকের উপর হাত রাখি। কস্তূরী আমার দিকে ফিরে বলে

-এত অন্যমনস্ক হয়ে কোথায় থাকো সারা দিন।

আমি বলি – কেন ঘরেই তো থাকি।

-ছেলের জ্বর এসেছে সন্ধ্যে থেকে জানো? ভাইরাল মনে হচ্ছে।

আমি ছেলের দিকে ঘুরে তাকিয়ে দেখি, সে নয় তার জায়গায় সাথীর সেই ছোট্ট ছেলেটি শুয়ে আছে, আর আমি যে মুহূর্তে সাথীর মুখ থেকে শীৎকারের শব্দ শুনে নিজেকে মূল্যবান মনে করবো ভেবে ছিলাম, তার বদলে সে যেন মুখের উপর কাপড় রেখে আমাকে দেখাতে চাইছে, তার ছেলেটিরও গায়ে জ্বর। কিভাবে যে ঠাণ্ডা লেগেছে, সে নিজেও জানে না। আমি সেই সত্যি আর মিথ্যের মাঝে পড়ে যেন দোলা খাচ্ছি।

এখন আমি এটুকুই দেখতে পাচ্ছি আরও সব চরিত্রের পাশাপাশি একটি শিশুও এখানে মূল চরিত্রে পরিণত হচ্ছে। এবং আমাকে এগোতে হচ্ছে তার অসুস্থতার দিকে। তবে কি আমাকে তার মৃত্যু লিখতে হবে। আমি মৃত্যু লিখতে লিখতে নিজেকেই যেন তার পরোয়ানা দিয়ে ফেলেছি। এসেছে তারা দেখে গেছে আমাকে। বলেছে, যা কিছু তুমি হারিয়েছ, তার মূল্য কি দেবে না। বলেছি দেবো কিন্তু তারও যে বিপরীত মূল্য আছে, তার কি হবে। তারা বলেছে যেমন। বলেছি যেমন আমার মৃত্যু যদি নিজেই একটা ক্যারেকটার হয়, তবে সে যখন আমার কাহিনী লিখতে বসবে, তখন জীবনের শেষ হবে তার জন্মের মুহূর্ত। আর এ ভাবেই এগিয়ে যাবে তার উপস্থিতির সার্থকতা। এখন এই শিশুর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, তার মা কতটা অসহায় হতে পারে। যখন তার বাবা নেই ঘরে। আর সে নারী কি আমার দৃষ্টি তার শিশুটির দিকে ফেরাবার জন্যই, নিজেকে আমার হাতে সমর্পণ করেছে।

-সাথী আমাকে একবার দেখতে দাও।

-কি দেখবেন। ওর গায়ে জ্বর, বার বার ফিরে আসছে। কত বলেছি কিন্তু শোনেনি কেউ। রক্ত পরীক্ষা করার দরকার ছিল।

-কোনো ডাক্তার দেখানও হয়নি। সারাদিন যে ভালই দেখলাম।

-সারাদিন থাকে ভালো, রাত হলেই গা গরম হয়ে ওঠে।

আমি যেন চরম অপরাধীর মতো সরে আসতে বাধ্য হই। কি করছিলাম আমি এই কিছুক্ষণ আগে, কস্তূরী উঠে বসেছে, আমাকে দেখছে যেন মর্মভেদী।

আসলে বাঁচার জন্য মানুষের সর্বান্তিক চেষ্টা, কিভেব সে এই এক গলা জল থেকে ও প্রান্তে উঠে যাবে। আমি সাথীর মাঝে যেভাবে উঠে যেতে দেখেছি নিজেকে। যেন অনুভব করেছি তার নিঃসঙ্গতা।

আমি হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখলাম আমার কাগজ পত্রের মধ্যে যে কল্পনার স্রোত বয়ে যাচ্ছে, তার মাঝে একটি শিশু শুয়ে আছে নিশ্চিন্তে। কপালে তার অল্প অল্প ঘাম দ্যাখা যাচ্ছে। গায়ে হাত রাখলাম। আমার হাত যেন দেয়াল ভেদ করে এই বাস্তব থেকে অন্য এক জগতে পাড়ি দিল। দেখছি আধশোয়া তার মায়ের বুকের দিকে ঝুঁকে আছে সেই শিশু। তার মা যেন নিজের প্রাণ ঢেলে দিচ্ছে তার ছেলের দিকে। বাইরে ভোরের আলো ফুটে উঠছে একটু একটু করে।

-আমি শৈলেশকে ফোন করে দিয়েছি। হয়তো কিছু পরেই চলে আসবে।

কস্তূরী বলল আমাকে। আমি বললাম

-কেন ডেকেছ?

-কেন মানে, ছেলেকে মনে হচ্ছে হসপিটালে নিতে হবে দেখতে পাচ্ছ না।

-পাচ্ছি কিন্তু, সে তো আমিই পারতাম। আবার তোমার ভাইকে ডাকলে কেন।

-জানি তুমি পারবে, কিন্তু বড় বোনের প্রতি কি ভায়ের এইটুকু দায়িত্ব থাকতে পারে না।

আমি জানি কি পারে বা কি পারেনা। কিভাবে মানুষ নিজের গুরুত্ব বজায় রাখতে চায়, যাতে কেউ ভুলে না যায় অন্তত। শৈলেশ এসেছে এবং তার সাথে আমি ছেলেকে নিয়ে ছুটে এসেছি হসপিটালের ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে, চারিদিক নিস্তব্ধ। এখানে এমনই এক হাওয়া সারাটা সময় বয়ে থাকে। যেন কিছু হল এই, বা হবার অপেক্ষায় সবকটি চেয়ার একা বসে আছে। শৈলেশের সাথে তাই সামান্য জ্বর নিয়েও ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছি।

শৈলেশ আমাকে বলছে – কখনও ওই তালতলার ঝুপড়ির মাঝে গিয়েছেন?

-কেন কি আছে সেখানে?

-না বললাম গিয়েছেন কিনা জানতে চাইছি।

-যাইনি, তবে শুনেছি ভিতরে এত অলিগলি আছে যে, ঠিক ঠাক না জানা থাকলে। মানুষ রাস্তা হারাতে বাধ্য।

-না আমি সে সব কথা বলছি না।

-তবে কেন, কি জানতে চাইছ।

-ওখানের বাচ্চাদের দেখেছেন কোনোদিন।

-দেখেছি মানুষ আর জন্তু জানোয়ার একই সাথে বড় হয়।

-না তারা জন্তু জানোয়ার নয়, বরং আমাদেরই সমাজের উদ্বৃত্ত। সমাজের নিজস্ব সব চাহিদা থেকে জন্ম আর মৃত্যু। বাচ্চাগুলো যে কিভাবে বড় হয় দেখলে অবাক লাগে। শুধু এখানে নয় সব জায়গায়। এতদিন দেখে দেখে অবশ্য চোখ সোয়া হয়ে এসেছে।

আমি হেসে বললাম - এতদিন পরে হঠাৎ কি দেখে এসব বলছ। ওই ঝুপড়ীর ভিতর গিয়েছিলে নাকি।

-গিয়েছিলাম তবে অন্য কারণে।

আমার মনে হল, সে হয়তো কোনো মেয়ের জন্য সেখানে গিয়ে থাকবে। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো বস্তি এলাকার মেয়েদেরও সে নিতে শুরু করেছে ভেবে কিছুটা যেন খারাপ লাগলো। বললাম

-যে কারণই হোক না কেন সমাজ আছে তো তার ভালো এবং মন্দ, সব দিকই আছে।

শৈলেশ বলল – আর আপনারা বলছেন শুধু ভালো দিকটিই তুলে ধরতে যাতে বাইরে থেকে যারা আসবে তাদের দেখতে ভালো লাগে।

-না শৈলেশ শুধু ভালো দিক নয়, ধর আমরা সবাই কিন্তু একটা মৃত্যুর জন্যই বেঁচে আছি। মানো বা না মানো। তুমি কি ওই বস্তিতে কোনো শিশুর মৃত্যু দেখেছো।

-দেখেছি, যার সাথে গিয়েছিলাম, তার ঘরে এই একটি বাচ্চার মারা যাওয়ার জন্যই গিয়েছিলাম।

-কার বাচ্চা মারা গিয়েছে ওখানে? তোমার কোনো বান্ধবীর?

-সে সব কথার কি প্রয়োজন, কেউ ছিল যার সাথে আমি শুধু পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দেখেছি। কিন্তু কিছুই করার ছিল না।

-সরকারি হাসপাতালে দেখাতে পারতে তো।

-ওটাই তো কথা, ওটাই তো বলতে চাইছি, ঘর আছে, দুয়োর আছে, জল আছে, লাইট আছে, এবং সাথে সাথে এই অদ্ভুত এক ধারনাও আছে। জীবন বা মৃত্যু তেমন বড় কিছু নয়। বাঁচা বা মরাও তেমন বড় কিছু নয়। গায়ে যতক্ষণ জোর আছে, আবার হবে ক্ষতি কি। আর এদিকে আমি আপনি আমাদের সমাজ, কত কি যে ভাবি আমরা। অর্থহীন সবকিছু অর্থহীন।

-ঠিক করে বল শৈলেশ, কে ছিল সেই মেয়ে, যার বাচ্চা মারা গেল। কিভাবে পরিচয় হল তোমার সাথে।

শৈলেশ কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলো একভাবে, তারপর জানালা দিয়ে হাঁসপাতালের বাইরের দিকে, রাস্তার দিকে। হয়তো বলতে চাইছে না। বা হয়তো ভাবছে কেন বলবো। আমি আবার বললাম - আমাকে কি বলতে কিছু অসুবিধা আছে শৈলেশ।

-মন করুণ এক সন্ধ্যে ছিল, একটি হোটেল ছিল, আমার মতো আগে পিছে কিছুই না ভাবা এক মানুষ নিজের মধ্যে ডুবে ছিল। কে কোথা থেকে এসেছে, কে কোথায় যাবে আমি কিভাবে জানবো তাই না। তাই জানতে চাইই না, শুধু কাজের জন্য কাজ তারপর তুমি তোমার আমি আমার। আসলে আমি কোনোদিন কারোর ঘরের কথা জানতে চাইই না। বিশেষত যাদের সাথে আমি আমার সময় কিছুটা ভাগ করতে চাই, কারণ বেশির ভাগই তারা মিথ্যে কথা বলে। নজর থাকে শুধু টাকার উপর। এই মেয়েটিকেও  তেমনই মনে হয়েছিল। কিন্তু কি জানেন, কিছু অনুভূতি আছে যা মানুষ হয়তো আকাশ থেকে নিয়ে আসে। হয়তো জন্ম দেওয়ার  আগেই ঈশ্বর ভরে দেয় মানুষের ভিতর। তাই না সে মানুষ হয়। তেমনই অনের মিথ্যেয় পোড় খাওয়া লোক, অনেক অবিশ্বাসের মাঝে বড় হওয়া লোক। ঠিক একদিন সামান্য এক কথায় কেমন যেন বদলে যায়। আমিও হয়তো সেই মেয়েটির একটি মাত্র ফোনে বদলে গিয়ে থাকবো। আমার সাথে থাকাকালিন তার একটি ফোন এলো, ফোনের কলার সাউন্ড এত বেশি ছিল যে ওপারের কথাও শুনতে পাচ্ছিলাম। কোনো এক বাচ্চা খুব অসুস্থ ছিল, আর তার মা খুব বিষণ্ণ আর যেন নির্লিপ্ত ভাবে বলছিল, আগে কাজ করি তবে তো পয়সা আসবে। আমি শুধু মাত্র কাজের টাকা দিয়ে চলে আসতে পারলাম না। ভাগ্যক্রমে দ্যাখা গেল সে আমাদের এই তালতলার ঝুপড়ির মেয়ে।

এই তো, এই তো আমি চাইছিলাম। আমার চরিত্রের বাস্তব রূপ, যদিও সে অন্য কোনো জায়গায়, যদিও তার অন্য এক রূপ। কিন্তু জীবন তো আছে, সংগ্রাম তো আছে। সেই তো স্বামী ছাড়া একা এক মেয়ে, আমার দ্যাখা এতগুলো মেয়ের মাঝে অনন্য। হতে পারে সেও কোনো প্লাস্টিকের শাঁখা পলা পরা। হতে পারে সেও একগাছি শাঁখা বাঁধানর স্বপ্ন রেখেছিল সেই বাচ্চাটির বাবার কাছে। হতে পারে সেও তার বাবা-মায়ের বা শ্বশুর-শাশুড়ির ফিরে যাওয়া নিয়ে বেঁচে আছে। শৈলেশ আমি জানি তুমি অনেক জীবন দেখছো। সমাজ কিভাবে তোমাকে দেখেছে সে কথা এখানে নগণ্য, তুমি তো অনেক মানুষ দেখেছো। যা আমি পারিনি। কি হয়েছিল শৈলেশ সেই বাচ্চাটির। সে কি সুস্থ হতে পেরেছিল?

-না পারেনি, বাচ্চাটি সেদিন মারা গিয়েছিল। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক ছিল কেননা, কিছুটা ফিজিক্যালি এবং মেনট্যালি চ্যালেঞ্জড ছিল বাচ্চাটি, মারা যাওয়ার সময় তার আট-নয় বছর বয়স হয়ে থাকবে। ততদিন পর্যন্ত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সব সময় বিছানাতেই শুয়ে থাকতো। বাপ ছিল, দেখেছিল বেশ কয়েক বছর, কিন্তু পরে ফ্রাসটেশানে একদিন নাকি বাচ্চাটিকে মেরে ফেলতে গিয়ে ছিল। তার মা দেখে ফেলে, সেদিন থেকেই সেই লোকটি কোথায় চলে যায়, পরে অবশ্য খোঁজ পেয়েছে। সে তার এক খুড়াতো বোনের সাথেই আছে। কিন্তু সে সব কথা নয়, আমি তো বলছিলাম সেই মেয়েটির কথা। কত কম বয়স, দেখে মনেই হয়না যে কোনো বস্তি এলাকায় থাকে, দুচার কথা ইংরেজিও বলতে পারে। হয়তো শিখে নিয়েছে কাস্টমারের খাতিরে। আমি বললাম কি হয়েছে, সে বলল তেমন কিছুই না, হয়তো ছেলেটি আজ মারা যাবে।

-তারপর কি হয়েছিল, তুমি গিয়েছিলে?

আমাদের কথা শেষ হল না, শৈলেশ উঠে গেল। আমার ছেলে ঠিক আছে একদম, তাকে ঘরে নিয়ে যেতে হবে। আমিও এগিয়ে গেলাম। কিন্তু গল্প যে শেষ হল না। কোথায় যাব আমি, আমার যে মন মানেনা। বুকের ভিতর কে যেন সারাদিন খোঁচা মারে। কি হল সেই মেয়ের তারপর? সেকি এত সহজ ভাবেই নেমে নিলো তার ছেলের মৃত্যু।

সাথী তুমি কি মেনে নিতে পারবে তোমার ছেলের মৃত্যু। কেউ তো নেই তেমন দেখার। আমি জানি, আমি দেখেছি তোমাদের গ্রাম। আমি দেখেছি এমন আরও অনেকগুলি গ্রামের ছবি। যেখানে এমন জন্ম বা মরে যাওয়া তেমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। আবার হবে ক্ষতি কি। নাহয় একটিকে বাঁচানো গেল না। সরকারি হসপিটাল আছে, সেখানে নিয়ে যাও। দেখাও, যদি ভাগ্যে থাকে বেঁচে যাবে।

সাথী তেমনই কি আমিও তোমার ছেলেটিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবো সারাদিন।

 

(১২)

একটি সাদা ওড়না উড়ে যাচ্ছে, একটি মেয়ে ভুলে গেছে বুক উন্মুক্ত হয়ে গেছে তার, একটি শিশু মেয়েটির বুকে জড়িয়ে আছে যেন সুবর্ণলতা। সে ছুটে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর শুরু থেকে শেষের দিকে। সে যেন খুঁজে চলেছে কিছু। তার ভাই তার বাবা তার স্বামী, কেউ নেই। যে আছে সাথে, সে তার আপন নয়। এখন কি করবে সে নারী। সে কি তার সেই ক্ষত খুলে দেখাবেনা। হোক সে পর তবু তো স্বামীর মতো দেখতে। আপনি কি করতেন সে সময়ে। হ্যাঁ, আমি আপনাকেই বলছি আমার পাঠক। বা তুমি কস্তূরী, তুমি কি করতে, যদি তোমার ছেলে এভাবে পিতৃহীন পড়ে থাকতো। সামনে যদি ভাইও না থাকতো। কাউকে ডেকে আনতে না?

-ছেলেটির জ্বর কিছুতেই নামছে না। আপনি কি কিছুই করতে পারেন না?

কেউ কিভাবে না বলে এই মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে। বললাম দাও আমাকে। তারপর এক যুদ্ধ চলল যতটা নিজের বুকের ভিতর। ততটাই বাইরের পৃথিবীর সাথে। রাত শেষ হবে, ভোর হবে কিছুটা তারপর তো এগিয়ে যাব। কিন্তু সেই রাত যেন আর শেষই হতে চায়না। ছেলেটির গায়ের উত্তাপ বাড়তে থাকে একটু একটু করে। সাথী আমার রূমাল চেয়ে নেয়। জল পট্টি দেয়। অথচ উত্তাপ। সে আমাদের নিয়েই যাবে দুঃখের পাতালে।

শৈলেশ তুমি চলে যেওনা, আমাকে খানিক সময় দাও। আমি শুনতে চাই সেই মেয়েটির কথা। যার ছেলেটির জন্য তুমিও সেদিন এই আমাদের তালতলার বস্তিতে গিয়েছিলে। কি দেখেছিলে আমাকে বলে যাও।

শৈলেশ আমার দিকে তাকিয়ে যেন তার চেতনা থেকে কিছু সময় তুলে আনল। তারপর বলল – একটি প্লাস্টার হীন দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ঘর। উপরে টালি। সামনে বারান্দা আর ভিতরে এক মানুষ সোয়ার মতো ছোট্ট একটি খাট। একটি শীর্ণকায় ছেলে শুয়ে আছে। গায়ে রং জ্বলা চাদর। শরীরটাকে কেউ যেন ভেঙে চুরে, বেঁকিয়ে শুয়িয়ে রেখেছে। মাথা একদিকে ফেরানো, হয়তো সে মাথাটুকু পর্যন্ত নিজে থেকে নাড়তে পারেনা। ঘরের ভিতর দুজন মহিলা, হয়তো পাশেই থাকে তারা। একজন বসেছে তার মাথার কাছে। অন্য জন দাঁড়িয়ে আছে দূরে। দেখেই বোঝা যায়, যে বসে আছে সে হয়তো তাও কিছুটা দ্যাখা শুনা করতো। আর যে দাঁড়িয়ে তার চোখে কিছুটা দয়া, কিছুটা যেন ঘৃণার ভাব। আমি এই ছেলের মাকে নিয়ে ছুটে এলাম ঘরে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব, মনে হচ্ছে সে যেন বাতাস টানতে পারছে না। হাঁ করে অনেকক্ষণ ধরে টেনে যাচ্ছে। তারপর কিছুক্ষণ একেবারে চুপ। আবার হাঁ করে আছে। ছেলেটির মা আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন কথা বলতে চেয়েও চুপ করে গেল। আমি বললাম, কি হয়েছে? কোথাও এডমিট করা যাবেনা। শহরের ভিতর এও এক শহর জানেন, যেমন মানুষের ভিতর অনেকগুলি মানুষ থাকে। এখানের সমাজ এখানের জীবন, এখানের মানুষের চাহিদা। এখানেও প্রেম আছে, এখানেও দখল আছে। বছর বিশেক আগের কথা মাথায় আসে আমার। এক বন্ধু প্রেমে এক মেয়েকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে ছিল ঘর থেকে। সে মেয়ে তখন পোয়াতি ছিল কি তার ভান করে লোক লাগিয়ে ছিল সেই ছেলেকে ধরে আনার জন্য। আমরা ছিলাম সেই ছেলেকে বাঁচাবার দলে। যদিও কাজটা খুব বেশি আনন্দের ছিল না। এবং খুবই রিক্স ছিল কেননা সেই মেয়ে ছিল এই তালতলার বস্তির। আর আমাদের মনে সেই সদ্য যৌবনে বেশ ভয় ছিল এই থানায় হাজিরা লাগানো ক্রমিনালদের। নিজেদের দ্বারায় কিছু হবে না, সে ছেলে মার খাবেই। যদিনা কোনো নেতা সাথে থাকে। সেই দেখেছিলাম তালতলার বস্তি আর এই দেখলাম। তখন অবশ্য দেখার মধ্যে অনেক ফারাক ছিল।

শৈলেশ এক ফিরে আশা চোখ নিয়ে তাকালও আমার দিকে বলল – আমি যার সাথে এই ঘরে এসেছি তার তো চোখে কোনো জল নেই। অথচ জল গড়াচ্ছে তার প্রায় আপাহিজ বাচ্চার চোখ থেকে। বললাম, কোথাও নিয়ে গেলে হয়না? সে বলল – কোথায় নিয়ে যাবেন, ওর চলে যাওয়াই যে লেখা আছে।

ব্যাস এটুকুই আর কিছু না, আর কিছু শৈলেশ বলল না আমাকে। কারণ তার যাওয়ার সময় হয়ে আসছিল। উঠে গেল সে, এতক্ষণ আমাদের ঘরে থেকে। আমি ঘুমন্ত ছেলের সামনে বসে, আর কস্তূরী ছেলের ওষুধগুলো সাজিয়ে রাখছে। ছেলে ঘুমাচ্ছে শান্ত ধীর। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

পিতৃত্ব তুমি কি শুধু মাত্র নিজের ছেলের উপরই ঝরে পড়। নাকি তোমার ভিতরে যে ঘর করে তার বাদ বিচার নেই। আমি যদি এখন সাথীর ছোট্ট ছেলেটিকে কোলে নিয়ে ভোর হওয়ার অপেক্ষা না করি। তবে কি কিছু অস্বাভাবিক দেখাবে। নাকি বসে বসে এই সব দেখার মধ্যে কিছু গৌরব আছে। এ গ্রামে কোনো পুরুষ নেই, কে নিয়ে যাবে কোথায়? কতদূর নিয়ে যেতে পারবে তারা। খুব বেশি হলে সদর হসপিটাল। তার বেশি কি সম্ভব। হ্যাঁ, আমার পক্ষে সম্ভব কেননা, আমি জানি বহু বার বহু মানুষকে নিয়ে গিয়েছি। এবাও ঘরের দরজা খুলে বেরলাম। আলো তখনও দ্যাখা যায়নি। রাতের পাখী জাগেনি তখনও। সাথিও ছুটল আমার পিছু পিছু। কেন জানিনা আমার মনে হয়েছিল এইটুকু ছেলের পক্ষে এতটা জ্বর হয়তো একদমই ভালো নয়। যতটা পারা যাবে তাও হয়তো খুবই কম। আমি ছুটতে শুরু করি। সাথী যেন আমাকে দেখে দিশেহারার মতো শুধু একবার শাশুড়ির কাছে বলে নেয়, ছেলের খুব জ্বর। ওর বাবা ওকে নিয়ে গেছে ডাক্তারের খোঁজে। তার শাশুড়ি শুনে বলে – জ্বর, এখনও সারেনি? আর তার বাবা কখন এলো?

-এসেছে ভোর রাতে। আপনারা ঘুমিয়ে ছিলেন তাই আর ডাকা হয়নি?

-এখন কোথায় গেল?

-ছেলেকে নিয়ে, আমিও যাই দেখি।

সাথীও আলথালু ভাবে আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। তারপর এক যুদ্ধ চলে এক সংগ্রাম। একদিকে মৃত্যু অন্যদিকে আমি।

আমি আমার ছেলের মাথায় হাত রেখে তাকিয়ে আছি দেয়ালের দিকে। সেখানে যে সাদা ক্যানভাস উঠে এসেছে, তা ছবির জন্য নিজেকে উজাড় করতে চায়। একদিকে কস্তূরী একদিকে সাথী মাঝে হসপিটালের লম্বা করিডর। কেউ নেই সে করিডরে, ফাঁকা, দাঁড়িয়ে আছি আমি একা। অসহায় লাগছে খুব, নিজেকে অসহায় লাগছে। আমার বন্ধু বান্ধব। আমার কলিগ। আমার চেনা পরিচিত এত হাজারো মানুষ। এখানে নিজেকে কত স্বাধীন মনে হয়। স্বাবলম্বী মনে হয়। কিন্তু এই গ্রামে কার কাছে যাব আমি, কাকে কাছে ডেকে বলবো ছেলেটিকে কিভাবে বাঁচাই। এ যে আমার সন্তান তুল্য। আমি জন্ম দিয়েছি। নাহয় তার মাকে আমি আদর করিনি কোনো দিন, সৃষ্টি করেছি আর ছেড়ে দিয়েছি এই দুঃখের ম্যারাথনে। তবুও সে আমাকে বলেছে আমি আপনার উপর ভরসা রাখি। আর কেউ না থাকলেও আপনি আছেন আমি জানি। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।

আমি উঠে গেলাম, আমার যে অনেক কাজ পড়ে আছে। শৈলেশের সাথে দ্যাখা করা বাকি আছে। বাকি আছে সেই তালতলার ঝুপড়িতে একবার অন্তত যাওয়া। কেননা আমি নিজে চোখে একবার সেই মহিলাকে দেখতে চাই। যে তার বাচ্চার জন্য নিজেকে এভাবে উৎসর্গ করেছিল। তারপড় অবশ্য চেয়েছিল তার বাচ্চা যেন শান্তির এক মৃত্যু পায়। কেননা তার কি বা ভবিষ্যৎ থাকতে পারে। বসে আছি কাগজ কলম আর ল্যাপটপের সামনে। কস্তূরী পিছন থেকে বলল – তোমার কোনো ক্যারেক্টারের মৃত্যু লিখছও নাকি।

মৃত্যু, কতবার আমি এই শব্দটি লিখেছি। কতবার উচ্চারণ করেছি জীবনে। হিশেব করলে অন্তত হাজার দশেক হবে, কি তারও বেশি হতে পারে। কিন্তু সেভাবে কি অনুভব করতে পেরেছি কে এই মৃত্যু। কেন আসে, কেন সাথে থাকে। আমাদের জীবনের সাথে সাথেই তো নাড়ির টান। জীবন ছোট হয়, তো বড় হয় সে। তারপর একদিন যখন সেই অবিসম্ভাবি মুহূর্ত এসেছে কেউ বলল

-আপনি এবার ফিরে যান। আমি আছি আমি দেখবো।

-তুমি একা কত করবে?

-আমি তো ওর মা, আমি নওই তো কে করবে?

সাথীর বাচ্চাটি শুয়ে আছে যেন নিশ্চিন্ত ঘুম। তার নাকে মুখে নল, অক্সিজেন, স্যালাইন চলছে। বেডের চারিদিকে মেশিন, বিভিন্ন স্ক্রিনে বিভিন্ন ছবি ভেসে উঠছে। ছেলেটি কিন্তু তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে, হয়তো মাকে খুঁজতে চাইছে। আমি পাশে তাকিয়ে দেখছি, এই তো কিছুক্ষণ আগেই যেন রাতের অন্ধকারে সাথী ছেলেটিকে দুধ দিচ্ছিল। আর এই আমাদের গোটা একদিনের ছুটো ছুটির পর, কিছুটা শান্তির সময়। ছেলেটির হয়তো ফুসফুসে কিছু দোষ আছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট।

আমি কস্তূরীর দিকে ফিরে বললাম – না আমি এখনও কোনো মৃত্যু লিখে উঠতে পারিনি। আমার দুর্বলতা আছে, বরাবর আমার দুর্বলতা। সব মানুষের প্রতি।

-তাহলে আমাকে দাও, আমি লিখে দিচ্ছি।

-তুমি পারবে? নিজের ছেলের মৃত্যু লিখতে।

-নিজের কোথায়, আমি তো সেই কাল্পনিক মানুষগুলির মরে যাওয়া লিখছি।

-কাল্পনিক হলেও তুমিই তো জন্ম দিয়েছও।

-আবার জন্ম দেব তাহলেই তো হল।

কস্তূরী স্বাভাবিক কথা বলছে, কিন্তু আমি কি পারবো?

-কস্তূরী, একটা কথা আছে শুনবে?

-বল, কি কথা বলতে চাইছও আমাকে।

-ধর তোমার এক খুব গরিব বোন আছে, যার একটি দু’ই কি আড়াই বছরের ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই নিজের বলার। বর খুব দূরে থাকে, ধর সউদি বা কোনো মিডিল ইস্টের কোনো দেশ। সেখানে লেবারের কাজে গিয়েছে। ধর তার শ্বশুর বাড়ির লোক বসে আছে কবে তার ছেলে অনেক টাকা কামিয়ে ফিরে আসবে আর তারা তাদের দেশে ফিরে যেতে পারবে। সে ছোট্ট ছেলে যদি খুব অসুখে পড়ে। তার মারা যাওয়াকে কি তুমি মেনে নিতে পারবে?

-তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন কোন দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য বসে আছে?

-ধর ফের বাংলাদেশ?

-তোমার কথায় অসঙ্গতি আছে, উদ্বাস্তুরা কি ফিরে যেতে চায়? তোমরা কি এখনও ফিরে যেতে চাইবে?

-সময় সে কথাই বলে হয়তো, কিন্তু আমার প্রশ্নটা আলাদা। ওই বাচ্চাটা কি বাঁচবে তোমার হাতে।

-না, আমার মনে হয় সে বাচ্চা বাঁচবে না। যদি আমি তার মায়ের কথা লিখি।

-কেন?

-বাচ্চাটা মারা গেলেই তার মাতৃত্ব ফুটে উঠবে বেশি।

আমি কস্তূরীর চোখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। এও তো এক মা, তবু অন্যের বাচ্চা মারা যাওয়া কতটা স্বাভাবিক। উঠে আসি নিজের বিছানার এক কোনায়। আমার আর মন বসে না কোনো কাজে। মা কি ও ঘরেই আছে।

 

(১৩)

সময় এগিয়ে চলেছে জীবনের, সামান্য একটি রাতের গল্প লিখতে গিয়ে একের পর এক মানুষের ছেলেমানুষি নিয়ে জীবন গড়ে চলেছি আমি আধ-পাগল। আর সবকটি চরিত্র নিজেদের মাঝে সম্পর্ক সাজিয়ে নিয়েছে। আজ দেখছি উঠে এসেছে সেই ফেরিওয়ালা মেয়েটি, অনি মাসি এসে দাঁড়িয়েছে পাশে, কারখানার গেটের ফুলুরি বিক্রি করা মহিলাটি নিজের এনামেলের থালাতে অনেকটা পরিমাণ ফুল নিয়ে এসেছে যেন আশীর্বাদ। আমি এক এক করে প্রত্যেকের দিকে তাকিয়ে যেন খুঁজে চলেছি কিভাবে যে এই সামান্য ছেলেটিকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দি। এই ছিল তাহলে আমার নিয়তি। এবং আমাকে এই রাতের ভিরতে ডেকে নিয়ে আসার কারণ। একটি শিশু যার নিজের বলতে অসহায় মা ছাড়া তেমন কেউ নেই। যে নিজেকে বিলিয়ে দিতেও চায় তার ছেলেকে বাঁচাবার জন্য। সন্তানের জন্য সব হওয়া যায়, স্বার্থপর হওয়া যায়, আত্মকেন্দ্রিক হওয়া যায়, এমনকি পতিতাও হওয়া যায়। তুমি যদি নিজেরটা না বাঁচাতে পার তো আর তোমার জন্মের আর কি মানে রইলো। ঠাকুমার চোখে আমি হয়তো চিরজীবন এই কথাই দেখে এসেছি। যা শেষমেশ এক বিচ্ছেদে শেষ হয়েছে। মিলন সেও তো এক বচ্ছেদ জীবনের, প্রেমের থেকে বিচ্ছেদ। আমি এক এক করে প্রতিটি মানুষের কাছে নিজেকে নিয়ে দাঁড় করাতে চেয়েছি।

মা তুমি কি করতে আমার জায়গায় থাকল। তুমিও কি এভাবেই এক নাম ধাম না জানা মেয়ের প্রতি কঠিন হতে পারতে। তোমার কি ভয়ে বুক কাঁপত না। মনে হত না যে সেই বাচ্চাটি তোমার নিজের ছেলেও হতে পারে। মা বলল

-দ্যাখ তুই যে মেয়ের কথা আমাকে বলছিস তার তো প্রথম সন্তান নাকি?

-হ্যাঁ। প্রথম ছেলে।

-তাহলে তার এমন একটি ছেলের মরে যাওয়া তেমন কিছুই নয়। বুঝলি, আমাদের সময়ে যখন সবার ঘরেই এভারেজে তিন চারটি ছেলে মেয়ে হত, তখন দেখা যেত সব মায়ের কলেই কোনো না কোনো ছেলে মারা গিয়েছে। কেউই আর বাকি নেই। তা সে সময়ের কথা যদি ভাবি তো একটা নাহয় ছেলে এই মেয়েও মারা গেল। কি আর হবে?

সেই তো কি আর হবে, শরীর যখন আছে তখন আবার নাহয় আরও একটি ছেলে হবে। শৈলেশ তুমি কি বলতে তোমার জায়গা থেকে। তোমার তো আবার কোনো মায়াই নেই কারোর প্রতি। তুমি তো নিজের থেকে বেশি কিছু ভাবই না। তোমার ও শরীর আছে আর তারও শরীর আছে। মাঝে আছে এই কাল্পনিক সাঁকো, যেখানে আমি হয়তো বৈঠা নিয়ে বসে আছি পারাপারের জন্য। শৈলেশ আমাকে বলল

-সেও এক বড় প্রশ্ন জামাইদা। মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। শরীর আমারও আছে শরীর তাও আছে। কিন্তু দুজনের ব্যাবহার একদম আলাদা। আবার কাজ একই। একই সুতোর দুপ্রান্ত ধরে দুদিকে টানছি।

-তুমি কিন্তু সেই তালতলার মেয়েটির কথা শেষ করনি।

-ও, সে মেয়েটি। সে আছে হয়তো আরও ভালো। কেননা তারও তো একটা ছেলে মারা গেছে। হ্যাঁ, সেদিন সন্ধ্যায় সেই আপাহিজ বাচ্চাটির মরদেহ যখন নিচ্ছি, মনেই হয়নি যে একটি বারো তের বছরের ছেলে। এতই হালকা ছিল যে মনে হল চার কি পাঁচ বছর হবে। যখন বার করলাম ঘর থেকে দেখি চারিদিকে লোক সব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন শুধু অপেক্ষায় ছিল কবে তারা এই খবরটি পাবে। মেয়েটিকে তারা সান্তনা দেওয়ার ভিঙ্গিতে তাকাচ্ছে তার দিকে। যেন এক অশুভ আত্মা ছিল, আজ চলে গিয়ে বাঁচিয়ে দিল। কিন্তু কি জানেন, যতই কঠিন হোক সময়, যতই সে মানুষের হিতের জন্য হোক। নিজের সন্তান নিজেরই হয়। এমনকি সে পাকা বেশ্যার হলেও। যার কাছে কাপড় তুলে শুয়ে পড়া পায়খানা করার সামিল। সেও যখন নিজের ছেলের মৃত্যু দেখে না ভিতর থেকে ভেঙে যায়।

আমিও তো ভাঙছি প্রতি দিনই তো ভাঙছি। সাথীর ছেলেটিকে নিয়ে বসে আছি কোলে করে। সে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, সিস্টাররা ছুটোছুটি করছে। কেউ ডাক্তার ডাকতে গেছে। প্রতিটি মানুষ যাকেই আমি চিনি, ডেকে বলেছি সাথীর ছেলেটিকি বেঁচে থাকবে। তার কি বেঁচে যাওয়া ভালো। নাকি সে মরে যা পুঁজি দিয়ে যাবে, তা আঁকড়ে ধরে আমি বেঁচে থাকবো। সবাই না বলেছে। সবাই।

তবে হ্যাঁ, একজনের কাছে এখনও যাওয়া হয়নি। সেই মাস্টার মশাই মানে কস্তূরীর বাবা যে গোটা জীবন ডায়াইলেকট্রিক্যাল মেটিরিয়াল আর সারপ্লাস ভ্যালু নিয়েই কাটিয়েছে। আর এখন পড়ে আছে তার কোন পেছন দিকের ফেলে আসা বন্ধুর সাথে। যাকে সে একসময় অশিক্ষিত বলে অবজ্ঞা করে ছিল।

-আমি আপনাকেই জিজ্ঞাসা করছি। আপনি কি করতেন যদি আপনার সেই চির আকাঙ্ক্ষিত অনি মাসীর কোল, এভাবেই আপনাকে কেউ ফাঁকা করে দিতে বলতো। পারতেন?

-দেখো তুমি তো আমার জামাই, আর শৈলেশ হল ছেলে। সে যেমনি হোক না কেন। আমি জানি তুমি যেমন তোমার বাবার গুণ পেয়েছ। শৈলেশও তার মায়ের গুণ পেয়েছে। এখন প্রশ্ন হল শৈলেশের মা যদি অনি হত তবে। বা যদি বল যে অনির ছেলেরা এখন কি করছে। আমি বলবো তারা একটা পরম্পরাকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যা ভারতীয়।

-না আমি তা জানতে চাইছি, অনি মাসীর ছেলে হলে কি আপনি তাকে মেরে ফেলতে পারতেন?

-দেখো আমি একবার অনির জন্য একগাছা চুড়ি বানিয়ে নিয়ে গিয়ে ছিলাম। এবং অবশ্যই তোমার শাশুড়িকে লুকিয়ে। যদিও লুকোনোর তেমন কোনো কারণ ছিল না। কেননা কাজের অসুবিধা হয় বলে সে শাঁখা পলা কিছুই পড়তো না। তাও লুকনো কেন জানিনা আমার মধ্যে এক অ্যাডভেঞ্চার এনে ছিল।

-রেখেছিল অনি মাসি?

-সে কথা তো বলা যাবেনা। তাহলে তো তোমার ছোট গল্পের সংজ্ঞায় মিল খাবে না। তবে এটুকু বলতে পারি অনির ছোট ছেলেটি ছিল বড় মায়া ময়। সে যদি ছেলেটিকে ওই নিঃসন্তান দম্পতীর হাতে তুলে দিত আমি উঠে পড়ে লাগতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি।

-হলে ভালো হত?

-অবশ্যই যদি তুমি কিছু করতে চাও, বাচ্চাটিকে মেরে ফেল। দেখবে মেয়েটি দুঃখে তোমার কাছে চলে এসেছে।

আশ্চর্য, সত্যি জীবন বড় স্বার্থপর। কেননা আমি যদি কাউকে নিজের পায়ের নিচে নামাতে চাই। তাকে ঋণের তলায় দাবিয়ে মারতে হবে। সে নিজে থেকেই সমর্পণ করবে। কোনো খেদ থাকবে না ভিতরে। আনি মাসি তুমি যদি সেদিন তোমার ছেলেটিকে দিতে পারতে তবে এক নতুন অধ্যায় ও হয়তো। কিন্তু তা হয়নি, এবং কস্তূরীর বাবা এই ওলডেজ হোমে শেষ পর্যন্ত এসে ভাবতে শুরু করেছে সেদিন যদি ছেলেটিকে সত্যি দিয়ে দিত, তবে।

এক সংগ্রাম বসে ছিল শুরু হওয়ার অপেক্ষায়, অথচ সাথী দেখো কিভাবে আমি সেই রাত্রি থেকে একবারও চোখের পাতা এক করতে পারিনি। বসেছি তোমার বুকের পাশে। আর এক এক করে সকলে দেখতে এসেছে। আমার মা, কস্তূরী, শৈলেশ, কস্তূরীর বাবা, অনি মাসি। যারা আমার চারিদিকের বাস্তব চরিত্র। আর কাল্পনিক যারা তাদের মধ্যে তোমার শাশুড়ি এসেছে ঠিক খোঁজ করে করে। যদিও তাঁকে বলেই আসা হয়নি। তবুও তিনি এসেছেন, বসে আছেন তার নাতির সামনে, ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে। আমি কিছুটা সরে এসেছি, আমাকে যদি চিনে ফেলে। এই তো কিছুক্ষণ আগে এখানেই নিজের ছেলের মঙ্গল কামনা করে বসেছিলাম। আর এখন মনে হচ্ছে সে হসপিটালেই ফাঁকা এক করিডরে, হঠাৎ দেখা হল। কিন্তু কার সাথে? বলবো, নিজেরই সাথে। আমি দেখছি সাথীর আসল স্বামী এসেছে, এবং দাঁড়িয়ে আছে করিডরের একেবারে শেষ প্রান্তে। মাঝখানে এক বিশাল ফাঁকা জায়গা। আমি দেখতে পাচ্ছি অবিকল আমারই মতো, বা হয়তো আমি নিজেই। আমারই মুখ কিন্তু তার পিছনের গল্পও কি এক। জানি ঠাকুমা যদি আজ থাকতো ঠিক একটা গল্প বানাত। অবশ্য যার কোনো মিলন থাকতো না। শেষে এক বাস্তব দিয়ে আমাদের মনেও দাগ রেখে যেত। ঠাকুমার আজ না থাকাই ভালো।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন