কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৩



 শ্বেত-তত্ত্ব


পুরনো সাদা বাড়ির ভেতরকার ঠাসা আসবাব, কিউরিও, মূর্তি, দেবতা, শয়তান, শিল্প, স্থাপত্য -- ট্র্যাক করে এগিয়ে চলছিলো ক্যামেরা। সন্ধ্যা আসন্ন। অন্ধকারে সাদা বাড়ির কালো বৈঠকখানার, কালো বারান্দার, কালো ঘরের নিকষ কৃষ্ণবর্ণ ফার্নিচার চুপিচুপি কথা বলছে, যেন ক্রাইজ অ্যান্ড হুইস্পারস-এর বিখ্যাত ওপেনিং ট্রলি।

 

সন্ধ্যা

সাদা বাড়ির গায়ে দিনের অন্তিম লাল আলো তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে, যেমন নরম গালে আচম্বিতে ছুঁয়ে যায় নশ্বর অথচ আসক্ত আদর। আসক্ত কিন্তু অশক্ত। রাত নামছে। কাল সকালের আগে তার আর দেখা হবার নয় সাদা বাড়ির সঙ্গে। কিন্তু সকাল যদি না হয়, তবে? বাড়িটা যদি এই রাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে?  সকালবেলার লাল আলো আর যদি খুঁজে না পায় শ্বেতপাথরের বাড়িকে? উদ্বিগ্ন বাড়ির রাতে ঘুম হবে না আজ। যে লোকটা রোজ রাতে ঘুমোনোর সময় ভাবে, সকালে যদি আর ঘুম না ভাঙে, আজকের রাতই যদি শেষ রাত হয় তার জীবনের, আর এমনটা ভাবতে ভাবতে যে ইন্সমনিয়াক লোকটা একদিন না ঘুমোতে পেরে মধ্যিরাতের আকাশে নক্ষত্রের হাতছানি শুনতে পায়। এ বাড়িও তেমন। ঠাসা জিনিসপত্র ঘরে ঘরে। কত ছবি, টেবিল, চেয়ার, খাট, সোফা, আলমারি, কত কত ঝাড়লণ্ঠন! নানা দেশ থেকে এনে জড়ো করা! দিনের বেলা কত মানুষ শহরের নানা প্রান্ত থেকে দেখতে আসে। টিকিট কেটে দেখে যায় থোক থোক জিনিস। আর রাত নামলে? রাত নামলে কে দেখে ওদের? কী দেখে? কে, কী বা কারা ক্যামেরা রোল করে অন্ধকারে?

 

রাত

আসবাবেরা দর্শনীয় বস্তু হয়ে রয়ে গেছে। কেউ তাদের ব্যবহার করে না। রাত্রিদিন  তারা কারুর না কারুর দৃষ্টিবদ্ধ হয়ে থাকতে চায়। দৃষ্টিবদ্ধ না হলে যেন অস্তিত্ব নির্মূল হয়ে যাবে। তাই তো ক্যামেরা লাগানো আছে ঘরে-বারান্দায়। লোকে ভাবে সিসিটিভি পাহারা দেবার জন্য, পাছে দামি দামি জিনিস চুরি হয়ে যায়! কিন্তু ক্যামেরাগুলো আসলে আছে ওদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে! সাদা বাড়িটায় কি এককালে বিশপ বার্কলে থাকতেন? রাতে কেউ আসে না বাড়ির ভেতর। পাহারাদাররা আউটহাউসে থাকে। ক্যামেরাগুলো ট্র্যাক করতে থাকে সারারাত। স্থানু বস্তুপৃথিবীর অপলক যন্ত্রণা উথলে আসে আবয়বিক দৃশ্য পরম্পরায়। গলার কাছে আটকে থাকে বেয়াদপ দুঃখবিলাসী ঠান্ডা লাগার মত।

 

সকাল

প্রভাতকালীন রক্তিমতা ঘিরে ধরে সাদা বাড়িকে! আসবাবগুলোর সরণহীন শরীর জুড়ে কত রঙের রামধনু খেলে যায় কে জানে? সরণহীন হতে পারে কিন্তু স্মরণহীন নয় তারা! আরও একটা দিন বেঁচে থাকবে সাদা বাড়ি আর এই নির্মোহ স্থবিরতার ক্লান্ত প্রদর্শনশালা! বাঁচবে আর বলবে, 'আবয়বিক' বললে কেমন 'অবায়বিক' শব্দের মত শোনায়! বস্তুরা জানে সকল কিছুই একদিন বায়বীয় হয়ে যাবে! বাতাস দৃষ্টিবদ্ধতার তোয়াক্কা করে কই? লোকটা ঘুমোতে পারে না, পাছে ঘুম আর না ভাঙে! নিদ্রাহীন রাত্রি শেষে নিষ্পলক এক সকাল আসে। প্রাতঃকালীন লাল আলোয় লোকটার ঘুমহীন চোখ ঝাপসা হয়ে সফেদ বাতাসে মিশে যায় একলা হরীতকীর মত। 

 

 



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন