কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

সুস্মিতা হালদার

 

সমকালীন ছোটগল্প


অ-পুংসক

 

(১)

 

কল্যাণী সীমান্ত-শিয়ালদা লোকালটা তাড়াতাড়িই অ্যানাউন্স করে দিয়েছিল। রাইট টাইমেই। ওদিকে তিননম্বর প্ল্যাটফর্মে কৃষ্ণনগর কিংবা রাণাঘাট লোকালের আশায় বসেছিল আলোলিকা সীমান্ত লোকালের কোন ঠিক নেই এমনিই মাঝরাস্তায় চোদ্দবার দাঁড়ায়, অন্য গাড়িগুলোকে জায়গা দিয়ে মানে কৃষ্ণনগর, লালগোলা সব আগে পেরিয়ে যায়, ওদের পিছু পিছু ঢিকিঢিকি করে যায় সীমান্ত লোকাল  ব্যারাকপুর ঢোকাতেই একঘণ্টা লাগায় তাহলে তো সোদপুর আর কথাই নয়! তাই কৃষ্ণনগর কিংবা রাণাঘাটের আশাতেই বসেছিল কিন্তু আজ কপাল ভাল তাই তাড়াতাড়ি সীমান্তটা অ্যানাউন্স করে দিল ঠিক দুটো তিরিশেই প্ল্যাটফর্মে ঢুকিয়েও দিল ট্রেন তিন নম্বর থেকে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মটা অনেকখানি দূর আলোলিকা এখন প্রায় সাত মাসের পোয়াতি ভারি পেট নিয়ে কোনরকমে প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে ট্রেনে উঠল লেডিসেই উঠল আর একটু হলে এটা মিস হয়ে যেত দুপুরবেলায় ডাউনের সীমান্ত লোকালগুলো মোটামুটি বেশ ফাঁকাই থাকে লেডিস তো প্রায় ফাঁকা। কম্পার্টমেণ্টে উঠে দেখে নিল কোন দিকটায় রোদ সেরকম আসছে না ট্রেন তখন ছেড়ে দিয়েছে কোনরকমে রডগুলো ধরে ধরে আস্তে আস্তে এগোল ভেতরের দিকে স্টেশন ছাড়ার সাথে সাথে বড্ড ঝাঁকুনি দেয় ট্রেনটা আলোলিকা ভাবছিল জানালার ধারের সীটটা নেবে এমনিতেই পেটে ব্যথা উঠছে মাঝে মাঝে বমি বমি ভাবও আছে কিন্তু উপায় নেই সাথে শাশুড়ি আর ননদও আছে ভালো সীট দুটো ওদের জন্য দিয়ে থার্ডে বসল আলোলিকা থার্ডে বসা মানেই হকারদের ঠেলাকুচো, যাত্রীদের গুঁতো খেয়ে খেয়ে যাওয়া আর ফোর্থে বসাও যা, না বসাও তা বিরক্তিভাব নিয়েই বসল আলোলিকা

-“বৌদি জল খাবে? কষ্ট হচ্ছে?” ননদ একবার জিজ্ঞাসা করল।

-“না রে, তুই খা এখন জল খেলে বমি এসে যাবে

শাড়ির আঁচলের খুঁটটা দিয়ে গলা-ঘাড়ের ঘামটা মুছে নিল চেপে চেপে শাড়ি পরে যেন কষ্টটা আরও বেশি হচ্ছে পেটের কাছেই সায়ার দড়ির চাপ, আবার কুচিগুলোপড়েছে। কিন্তু শাশুড়ি ঠাকরুণ আবার পছন্দ করেন না চুড়িদার পরা- টরা। গেরস্ত বাড়ির বৌ- বাইরে কখনও চুড়িদার পরতে নেই। আবার তাঁকে কিছু বলতে গেলেই বলেন, “এই একবার পোয়াতি হয়েছ তাতেই সারা বাড়ি মাত করে দিচ্ছ বৌমা। আর আমি চার-চার বার পোয়াতি হয়েছি। এত বড় পেট নিয়ে  সংসারের সব কাজ করেছি। আর এই শাড়ি পরেই। তোমাদের মতন এমন গা দেখানো নাইটি কামিজ পরিনি বাপু কোনদিন।” অগত্যা কী আর করা যায়! শাশুড়ির মুখে মুখে তো আর চোপা করা যায় না। নিঃশব্দে মেনেই নেয় সব।

আলোলিকার বিয়ে হয়েছে দু’বছর আগে। বহরমপুরে ওর শ্বশুরবাড়ি। স্বামী প্রাইভেট  ল্যাবরেটরিগুলোয়, তারপর ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় টেকনিশিয়ানের কাজ করে। দিন তিনেক আগে শ্বশুরমশাইয়ের বাইপাস অপারেশন ছিল। কল্যাণীর গান্ধী মেমোরিয়াল হসপিটালেই হয়েছে। অপারেশনের দিন আলোলিকার স্বামী আর ননদ এসেছিল। ভাসুর আর দেওর তো আলাদা হয়ে গিয়েছে আলোলিকার বিয়ের আগেই। মা-বাবার সাথে ওরা সে রকম যোগাযোগ রাখে না।বাপ মরার আগেই নিজেদের ভাগ-বাঁটোয়ারা বুঝে নিয়ে নিজেদের মত সংসার পেতেছে। দাদা-ভাই বেইমানি করলেও মেজছেলে একমাত্র বুড়ো মা বাপকে ছেড়ে যেতে পারেনি। সংসারের জোয়াল এখন ওরই ওপর। আলোলিকা হল মেজ বৌ। ওর স্বামীই দায়িত্ব নিয়ে শ্বশুরের অপারেশনটা করাল। ওর বিয়ের যখন সম্বন্ধ আসে দুবছর আগে  তখনই শুনেছে শ্বশুরের হার্টের অসুখ। শ্বশুর বৌমা-নাতি দেখে যেতে চান। তাই তো তড়িঘড়ি করে বিয়ে আর দু বছরের মাথায় পোয়াতি। সংসার বোঝার আগেই বড়সড় দায়িত্ব একখানা চাপিয়ে দেওয়া হল ওর ওপর। কী কারণ, না শ্বশুরমশায়  চান নাতির মুখ দেখে মরতে। হার্টের অসুখ, কোনদিন টুক করে মরে যাবেন ঠিক নেই। স্বামীর মুখেই শোনা এটা। শাশুড়ি-শ্বশুর ওর সামনে এ ব্যাপারে কোন উচ্চবাচ্য করেন নি। অবশ্য স্বামীটিকে সেই ফুলশয্যার রাত থেকে দেখেই তো মনে হয়েছিল ওর হয় কনট্রাসেপটিভ নিতে হবে, নয় তো বছর বছর পোয়াতি হতে হবে।  বিয়ের পর তো বৌ স্বামীরই সম্পত্তি, তাই যেমন খুশি ভোগ করলেই হল। রোজ রাতে স্বামীর অতিরিক্ত ভালবাসায় হাঁপিয়ে উঠেছে আলোলিকা। শুধু পোয়াতি হবার পর যা একটু রেহাই পেয়েছে।...  আলোলিকার এক এক সময় মনে হয় এর চাইতে একজন নপুংসকের সাথে বিয়ে হলেও ভাল হত।

-“কোথায় নামবেন?” প্রশ্নটা শুনে চোখ খোলে আলোলিকা। সীটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে ছিল বমিভাবটা কাটানোর জন্য। চোখ খুলে দেখে হালিশহর এসে গেছে।

-“হুঁ?... সোদপুরে নামব।” খানিক থেমে উত্তর দেয় আলোলিকা।

-“একটু চেপে বসবেন? আপনি নেমে গেলে আমি থার্ডে চলে যাব। আমি শিয়ালদা যাব।”

-“আপনি বসুন। আমি একটু ফাঁকাটায় দাঁড়াই।” হালিশহরে ওঠা ভদ্রমহিলাকে জায়গা ছেড়ে উঠে গেল আলোলিকা। মানুষ কী অদ্ভুত! দেখতে তো পাচ্ছে চোখে, আলোলিকার অবস্থাটা। মেয়ে হয়েও বোঝে না কষ্টটা কতটা। পোয়াতি অবস্থায় চাপাচাপি করে তিনজনের সীটে চারজন বসা যায়? এখনি না সরলে ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দেবে। তার চেয়ে উঠে যাওয়াই ভাল।

-“কী হল বৌমা?” আলোলিকা উঠে যেতেই শাশুড়ি জিজ্ঞাসা করেন, “বমি লাগছে নাকি?”

-“না মা। গরম লাগছে তাই একটু ফাঁকাটায় দাঁড়াচ্ছি। হাওয়া আসছে এখানে।” উত্তর দেয় আলোলিকা।

-“দেখো, দরজার ধারে যেও না।” শাশুড়ি আবার সাবধান করে দিলেন। সেটা আলোলিকার জন্য চিন্তায় না। ওর পেটের ভেতর যে আছে, তার যাতে ক্ষতি না হয়, তার জন্য।

-“বৌদি, ব্যাগটা দেবে।” ননদ আবার একটু সোহাগ দেখায়।

-“নে তাহলে। ওপরে তুলিস না। কোলে রাখ।” ব্যাগটা ননদের হাতে দিয়ে একটু আরাম করে দাঁড়ায় আলোলিকা। এখন আরও বেশ কয়েকটা স্টেশন। মাঝে কতবার যে দাঁড়াবে আবার। প্রায় ঘণ্টা খানিক পর মাকে দেখতে পাবে ও। আলোলিকার বাড়ি সোদপুরে। ও, বাড়ি নয়... বাপের বাড়ি ! হপ্তা দুয়েক আগে মা-বাবা এসেছিলেন বহরমপুরের বাড়িতে। তখনই বারবার বলে দিয়েছেন, প্রথমবার বাচ্চা হচ্ছে, বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয় যেন, অন্তত দু’তিনমাস আগে। শাশুড়ি অবশ্য আরো আগেই পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। পোয়াতি অবস্থায় তো আলোলিকা ছুটে-দৌড়ে বাড়ির ফাই-ফরমাস খাটতে পারছে না। বরং ব্যথা উঠলে, বমি হলে ওরই সেবা-শুশ্রূষা করতে হচ্ছে শাশুড়ি-ননদকে। এতো ঝক্কি কে পোয়াবে শ্বশুরবাড়িতে! তার ওপর কোনভাবে পা পিছলে পড়ে গিয়ে বাচ্চাটা যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে তার দায় তো শ্বশুরবাড়ির ওপরই বর্তাবে। তার চেয়ে মানে মানে বাপের ঘর পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো। ওদের মেয়ে ওরাই বুঝুক। শাশুড়ি শুধু অপেক্ষা করছিলেন শ্বশুরের অপারেশনটার জন্য। সেটা ভালোয় ভালোয় হয়ে গেছে। অপারেশনের দিন আলোলিকা আর ওর শাশুড়ি আসতে পারে নি। তাই আজ এসেছিল। বেলা ১২টা-১টার দিকে হসপিটালের ভিজিটিং আওয়ার। তখন গিয়ে দেখে এসেছে। আলোলিকাকে ওর বাপের বাড়িতে রেখে আগামী পরশু শাশুড়ি আর ননদ ফিরে যাবে বহরমপুর। ফাঁকা বাড়ি দু-একদিনের বেশি রাখলে চুরি ডাকাতি হয়ে যেতে পারে, তাই ওরা চলে যাবে। আলোলিকার স্বামী ছুটি নিয়েছে কয়দিন। বাবার দেখাশোনা ও-ই করছে।

 

(২)

 

টাফট হাততালির আওয়াজে ঘোর কাটে আলোলিকার। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কতকগুলো হিজড়ে উঠে গিয়েছে।

-“দে মা দে।” আলোলিকার মাথায় হাত রেখে বলে হিজড়ে দলেরই একজন। টাকা চাইছে। ওরা নিলে দশটি টাকাই নেয়। তার বেশিও কিছুতেই নেবে না। না থাকলে পাঁচটাকা করে কম নেয়।

-“বুল্টি, ব্যাগটা দে তো।” ননদকে বলে আলোলিকা। ব্যাগ থেকে পার্স বের করে দেখে গোনাগুনতি টাকা রয়েছে। তিনজনের টোটো ভাড়াটুকু। ননদ শাশুড়ির কাছে নিশ্চয় বাড়তি টাকা আছে। কিন্তু ওরা বের করবে না। চাইতে গেলেও নানান কথা শোনাবে।

-“নেই গো। শুধু বাড়ি যাওয়ার টোটো ভাড়াটুকু আছে। কিছু মনে কোর না।” কাঁচুমাচু হয়ে বলে আলোলিকা। এদের একটু ভয়ই পায় ও। মুখের যা ভাষা ! ও ভাষা সহ্য হয় না ওর।

-“ঠিক আছে।” বলে হিজড়েটা চলে যায় অন্যদিকে।

-“এদের উপদ্রব যে কবে বন্ধ হবে! এদের জ্বালায় ট্রেনে বাসে ওঠাও দায়।... সরকার থেকে এতকিছু করছে এদের জন্য, আইন বানাচ্ছে, তাও এভাবে এক্সটর্ট  না করলে যেন গা জুড়োয় না।” একজন মাঝবয়সী মহিলা বলে উঠলেন।

-“ও যতই আইন আসুক, ওদের স্বভাব চরিত্র পালটাবে না। ভিখিরিকে রাজপ্রাসাদ দিলে সে কি তার মর্যাদা দিতে পারে?” পাশ থেকে একজন মন্তব্য করলেন।

আলোলিকার এসব পিএনপিসি বড় বিরক্ত লাগে। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে দেখে ও। হকাররা কীভাবে জিনিস বিকোয়, দরদাম করে এসব দেখতে থাকে। ট্রেনের দরজা  দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরেটা। আজ ভিড়টা তবু গা-সওয়া। ট্রেনটাও বেশ জোরেই টানছে। নিজের অজান্তেই বারবার ওর চোখ যাচ্ছিল হিজড়েগুলোর দিকে। একজনের থেকে টাকা নিয়ে আবার তালি বাজিয়ে বাজিয়ে আর একজনের কাছে গেল। “অ্যাই লাল হেডফোনওয়ালি, দে মা দে।” নামগুলোও বেশ ভাল দেয়। কোন যাত্রীকে ডাকে, “এই নীল চুড়িদার”, কাকে বলে, “এই চশমাওয়ালি”, হাসিও পায় শুনে! কিন্তু ওরা এভাবে লোকের কাছ থেকে টাকাপয়সা চেয়ে নিজেদের ছোট করে কেন? এই তো হকারগুলোও কিছু না কিছু বিক্রি করে পয়সা রোজগার করে। ওদের মত ছোলা-মুড়ি, দরবেশ, ছোটখাটো গয়নাগাঁটি, রুমাল-মোজা, মাথার ক্লিপ, এসব বিক্রি করে তো রোজগার করতে পারে।... কেন যে নিজেদের সম্মান ওরা নিজেরাই নষ্ট করে, তা ওরা নিজেরাই জানে কিনা সন্দেহ! ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে আলোলিকা।

পলতা স্টেশন আসতেই কয়েকজন ধাক্কাধাক্কি করে উঠতে গিয়ে হিজড়ে দলের একজনের সাথে জোর গণ্ডগোল বেধে যায়। দু’পক্ষই অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে দেয়। ভিড়টা এখন বেশ ভালোই হয়েছে। ব্যারাকপুরে আরও বাড়বে। চিৎকারের মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া গলার কথাগুলো কানে আসে আলোলিকার।

-“তা কী করব বল! তোদের মত কপাল করে তো আর আসিনি যে চাকরি করব,  ব্যবসা করব। তাই এভাবে তোলাবাজিই করতে হয় আমাদের।”

দেখে ভিড় ঠেলে, কথাগুলো বলতে বলতে ওর এদিকেই আসছে ওই হিজড়েটা, যে ওর কাছ থেকে টাকা চেয়েছিল। দুবার ফট ফট করে তালি বাজিয়ে আবার কথা শুরু করে, “জন্মের পর হয় মায়ে বাপে ফেলে দেয়, না তো একটু বড় হলে যখন দেখে হিজড়ে জন্মেছে তখন দিয়ে আসে হিজড়ে পল্লিতে। আর তোরা গাল পাড়ছিস তোলাবাজ বলে, দিবি আমায় কাজ তোদের বাড়িতে? তোদের কিচ্ছু ভাবতে হবে না মা, রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করা, এমন কি এঁটো বাসনও ধুয়ে দেব। সারাদিন খাটব। কিন্তু মাস গেলে হাজার দশেক টাকা হাতে দিস। শুধু তো একা নই, আমাদের অনেককেই দেখতে হয়। দিবি টাকা?... মাস গেলে মাইনে দেওয়া তো দূরের কথা মা। তোরা কাজই দিবি না। ভাববি তোদের বাড়িতে চুরি করব। তোরা তো বিশ্বাসও করতে পারিস না আমাদের...। আমরা তো সেবার চেষ্টা করেছিলাম, সেলাই দোকান দিতে। আমাদের পাড়াতেই। পাটির লোকেরা এসে তুলে দিল।”

কথাগুলো শুনতে শুনতে মনটা খারাপ হয়ে যায় আলোলিকার। আনমনে হাত রাখে নিজের পেটের কাছেই। ভাবে একবার ডেকে জিজ্ঞেস করবে হিজড়েটাকে, কোথায় থাকে? ওদের পাড়া মানে কোনটা? কাছেই দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু যেচে জিজ্ঞাসা করতে একটু ভয়ই পেল।

ব্যারাকপুর আসতে একসাথে অনেকজন নামতে গিয়ে, আর ওপাশ থেকে সব উঠতে গিয়ে আবার ধাক্কাধাক্কি লাগল। এ অবশ্য রোজনামচা। এটুকু ধাক্কাধাক্কি না হলে আর শিয়ালদা লোকাল! হঠাৎ ব্যথায় চিৎকার করে উঠল আলোলিকা। কেউ  একজন উঠতে বা নামতে গিয়ে ভারি ব্যাগ দিয়ে অসাবধানে ধাক্কা মেরেছে আলোলিকার পেটে। ওর চিৎকার শুনে শাশুড়ি-ননদ দুজনেই সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ওই হিজড়েটা এসে ধরে আলোলিকাকে, “কী রে মা, কী হয়েছে?”

-“একটু বসব?” গোঙাতে গোঙাতে বলে আলোলিকা।

-“এদিকে এসো বৌমা।” শাশুড়ি ডাকে।

-“বৌদি দাঁড়াও আমি বেরোচ্ছি,” ভিড় ঠেলে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে ননদ বুল্টি।

-“তোদের বেরোতে হবে না, বস ওখানে,” ছেঁড়া ছেঁড়া গলায় হিজড়েটা বলে ওঠে। “ওদিকে ভিড়ে বসানো যাবে না। আমি দেখছি।”

আলোলিকাকে ধরে, ভিড় আলগা করে, একপাশে নিয়ে গিয়ে বসায় হিজড়েটাই।  জোরাজুরি করে ধারের দিকে, থার্ড বা ফোর্থে একটু জায়গা করে দেয়।

-“জল খাবি মা?” জিজ্ঞাসা করে আলোলিকাকে।

ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে ও। তখন পেটের ভেতরটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। ভয় হচ্ছে, বাচ্চাটার কিছু হয়ে গেল না তো! হিজড়েটা নিজে হাতে ওকে জল খাওয়ায়, আশেপাশের যাত্রীদের থেকে জল চেয়ে নিয়ে।

-“ভালো লাগছে রে মা?” আলোলিকার মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করে।

-“একটু... ভালো।... তুমি কোথায় নামবে?” ওর হাতটা চেপে ধরে আলোলিকা।

-“টিটাগড়।... এই এসে গেল পেরায়।”

-“আমার জন্য অনেক করলে গো। কী বলে যে ধন্যবাদ দিই তোমায়!

-“কথা বলিস না বেশি। কষ্ট হবে।... আমি আসি। সাবধানে নামিস।” যেতে গিয়েও থেমে যায়, “মা রে, একটু তোর পেটটায় হাত দিতে দিবি?”

-“ছেঁড়া ছেঁড়া গলাটায় কেমন যেন কান্না-চাপা স্বর ভেসে উঠল। আলোলিকার হঠাৎ মুচড়ে উঠল মনটা।

-“হ্যাঁ, দাও না।... নড়ছে? বুঝতে পাচ্ছ?”

হিজড়েটার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে পেটে চেপে ধরে আলোলিকা।

-“কমাস হল রে?”

-“সাতমাস।” হাঁপাতে হাঁপাতে বলে আলোলিকা।

-“আমায় ডাকবি? ও জন্মালে?”

-“হুঁ। কিন্তু তোমায় জানাব কীভাবে? কোথায় থাক তুমি?”

আলোলিকা দেখে, হিজড়েটার চোখে জল। কোনমতে জলটা মুছে একটু হেসে উত্তর দেয় সে, “না রে। আমায় ডাকিস না। ডাকবি বললি এটাই অনেক আমার কাছে। তোর বাচ্চার ভাল হোক। আমি এখানেই আশীব্বাদ করছি।” একটু থেমে আবার বলে, “কী চাস? ছেলে না মেয়ে?”

আলোলিকা একটু মুচকি হাসে।

-“মেয়ে হবে তোর মত। ফুটফুটে। রাজকন্যে। ...উঁ... না না, ছেলে হবে। রাজপুত্তুর।” নিজের মনেই বিড়বিড় করে হিজড়েটা। ট্রেন তখন টিটাগড় ঢুকছে। হঠাৎ খেয়াল হতেই হুটোপুটি করে নামতে যায়। আলোলিকা ওর শাড়ির আঁচলটা চেপে ধরে।

-“কী বলছিস?” আলোলিকার কাছে এগিয়ে আসে আবার, “নামতে হবে আমায়। ইস্টিশান এসে গেছে।”

আলোলিকা ওর হাতটা চেপে ধরে, “যদি বলি, তোমার মত একজনাকে চাই?”

হিজড়েটার চোখে এক অদ্ভুত দৃষ্টি। কান্না-আনন্দ মিশে গেছে চোখের লাল আভাটুকুর সাথে। অস্ফুটে বলে ওঠে, “কী বললি?”

আলোলিকা ওর চোখের দিকেই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে, “বললাম তো! ছেলেও চাই  না, মেয়েও না। একজন হিজড়েকেই চাই আমার সন্তান হিসেবে।”

 

 


6 কমেন্টস্:

  1. তৃতীয় দুনিয়ার মানুষদের নিয়ে এমন সহমর্মী মননের গল্প লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  2. খুব ভালো লাগলো । আমরা আসলে, মাঝে মাঝে ভুলেই যায় যে, ওরাও মানুষ ।

    উত্তরমুছুন
  3. এমনভাবে চেতনার‌ও ‌বদল শুরু হোক।

    উত্তরমুছুন