কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

পায়েল চ্যাটার্জি

সমকালীন ছোটগল্প

 


জলসত্র

 

সময়: এপ্রিল, ২০৪০

প্রথম দৃশ্য:

মিত্র ভবন

 

মিস্টার মিত্র: গত দু'দিন ধরে একটা জলজ্যান্ত জীব মিসিং, আপনারা উদ্ধার করতে পারছেন না! সত্যি আমরা এত এগিয়ে গেছি, কিন্তু আপনাদের বিভাগ সেই একই রয়ে গেল, নো চেঞ্জ!

ইন্সপেক্টর বক্সী: মানুষ খোঁজা আর পোষ্য খোঁজা এক নয়! মানুষের সঙ্গে কিছু ভ্রাম্যমান যন্ত্র থাকে যেগুলোর উপস্থিতি ট্র্যাক করে মানুষটির খোঁজ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

মিসেস মিত্র: ইয়েস! ইয়েস! দেয়ার ওয়াজ অ্যা ট্র্যাকার ইন হিজ নেক্। ওটা ট্র্যাক করুন ইমিডিয়েটলি।

অতুল: ওটা গতকাল থেকে অনেকবার ট্র্যাক করার চেষ্টা অলরেডি করা হয়েছে। কিন্তু সবটাই ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগ আপনাদের কেসটা নিয়ে যথেষ্ট কন্সার্ন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমরা এ বিষয়ে ক্লুলেস।

ইন্সপেক্টর বক্সী: ইনি আমাদের হাইকমিশনার অতুল রায়। আচ্ছা এই বাড়ির অন্যান্য জিনিসপত্র ঠিক আছে তো? সে সব চেক-টেক করেছেন? আমরা আজ ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেব।

মিস্টার মিত্র: সেরকম কোনো বড় জিনিস চুরি হয়েছে বলে তো মনে হয় না। আই মিন টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি সবই ব্যাংক এবং লকারে। বাকি ফার্নিচার ও অন্যান্য দামি জিনিস কিছু খোয়া গেছে বলে তো দেখছি না।

মিসেস মিত্র: গত দু'দিন ধরে রক্সি মিসিং, এর থেকে বেশি মাইনুটলি চেক করার মত মানসিকতা আমাদের ছিল না। আমাদের এই বাড়ির কেয়ারটেকার রায়াকে বলেছি ও স্টোররুমটাএকবার দেখবে সেখান থেকে কিছু মিসিং কিনা।

 

(ট্রে হাতে রায়ার প্রবেশ)

 

রায়া: না ম্যাডাম , স্টোররুমে সব জিনিসপত্র ঠিকই আছে।

অতুল: আপনাদের কেসটাতে এই বিষয়টা সবচেয়ে অদ্ভুত! কোন চুরি নেই, অন্য কোন ক্রাইম নেই, শুধু একটা কুকুর মানে আপনাদের অবলা পোষ্যটা মিসিং।

মিসেস মিত্র (উত্তেজিত হয়ে): রক্সির হারিয়ে যাওয়াটাকে তাহলে আপনারা ক্রাইমের আওতায় ফেলছেন না!

অতুল: আমি ঠিক ওভাবে বলতে চাইনি। সাধারণত অপরাধ হলে অপরাধী কোন সূত্র ছেড়ে যায়, এখানে অদ্ভুতভাবে তেমন কিছুই নোটিশ করিনি। এই ক্রাইমটার কোন মোটিভ খুঁজে পাইনি। আচ্ছা এই বাড়িতে আপনারা দুজন ছাড়া আর কেউ থাকে?

মিস্টার মিত্র: আমরা দুজনেই ওয়ার্কিং। সকালে বেরিয়ে যাই, রাতে ফিরি। ছেলে বিদেশে পড়াশোনা করছে। একরকম রায়াই এই বাড়ির সমস্ত কাজকর্ম করে। রক্সি সারাদিন আমরা না ফেরা পর্যন্ত রায়ার সঙ্গেই থাকতো।

অতুল: মিস্ রায়া, সেদিন আপনি রক্সিকে নিয়ে পার্কে গিয়েছিলেন! তারপর থেকেই ও মিসিং। একটু ডিটেইলে বলবেন?

রায়া: ওকে রোজই আমি বিকেলে পার্কে নিয়ে যাই। ঐদিকের পেট পার্কটাতে। তারপর সময়মত ওকে নিয়ে ফিরেও আসি। আপনি চাইলে গার্ডকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। তারপর ওকে বাগানে রেখে আমি বাড়ির কিছু কাজকর্ম করতে ভিতরে গিয়েছিলাম। ফিরে দেখি ও কোথাও নেই।

ইন্সপেক্টর বক্সী: এই বাড়ির কোন পিছনের দরজা-টরজা আছে? বাগান নিশ্চয়ই পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।

মিস্টার মিত্র: সার্টেনলি! ওইদিকে আমাদের ওয়াটার ব্যাংক আছে। ওখানে একজন সিকিউরিটি গার্ডও আছে ইভেন। পিছনের দরজা একটা আছে বটে,কিন্তু ওটা দীর্ঘদিন খোলা হয় না। আর ওটা দিয়ে কেউ ঢুকলে গার্ডের নজরে পড়বেই।

অতুল: হুম। মিস রায়া, আপনার বাড়ি কোথায় ?

রায়া: কলুতলা লেন।

মিসেস মিত্র: আপনারা প্লিজ রায়াকে সন্দেহ করবেন না। রক্সি ওয়াজ ভেরি ক্লোজ্ড টু রায়া। আচ্ছা রক্সি বেঁচে আছে তো?

অতুল: আমাদের সন্দেহের অভিধানে কোন নাম বাদ পড়ে না। এনিওয়ে , কোন অঘটন ঘটে থাকলে নিশ্চয়ই খবর পেয়ে যেতাম। হোপফুলি তেমন কিছু হয় নি।

মিস্টার মিত্র: রায়া, তুমি ওদের চা টা দিয়ে ভিতরে যাও। আপনারা চা খান।

ইন্সপেক্টর বক্সী: একটু খাবার জল পাওয়া যাবে?

মিস্টার মিত্র: সো সরি! রক্সির চিন্তায় আসলে আমাদের ওয়াটার ব্যাংক থেকে জল নিয়ে ফিল্টার করাই হয়নি। বেশ কয়েকদিন আগের ফিল্টার করা জল দিয়ে কাজ চালাচ্ছি। আসলে ড্রিংকিং ওয়াটার এর যা ক্রাইসিস !

মিসেস মিত্র: আপনারা চা খান প্লিজ। ওতেও খানিকটা তেষ্টা মেটে। আর ফিঙ্গারপ্রিন্টগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ে নিন।

 

দ্বিতীয় দৃশ্য:

গোয়েন্দা বিভাগ, লালবাজার

 

অতুল: 'সময় বহিয়া যায় জলের ন্যায়'।

ইন্সপেক্টর বক্সী:স্যার, জল এখন সময়ের থেকেও দামি। মিত্র ভবনে সেদিন দেখলেন না! খাবার জল দিলই না। ওদের তো ওয়াটার ব্যাংক আছে।

অতুল: থাকলেই কি আর তোমার-আমার মত অপ্রয়োজনীয়' অতিথিকে দিয়ে নষ্ট করবে!

ইন্সপেক্টরক্টর বক্সী: আমরা অপ্রয়োজনীয়! ওদের দরকারেই গিয়েছিলুম কিনা! বলে কিনা চা খেয়ে জলতেষ্টা মেটাও! আক্কেল বলিহারি!

অতুল: রক্সি নামক সারমেয়টির একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য! ওয়াটার ব্যাংক আর কজনের বাড়িতে থাকে বল! রক্সির হারিয়ে যাওয়ার দৌলতেই ওই বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হলো।

 

ইন্সপেক্টর বক্সী: তা বটে! মাসের শুরুতেই মাইনের এক-তৃতীয়াংশ হাওয়া হয়ে যায় এই জলের বদান্যতায়। মাঝে মাঝে বাবা, দাদু এদের উপর খুব রাগ হয়! এরা যদি একটু বুঝে জল খরচ করত! তাহলে আমাদের আর এইদিন দেখতে হত না।

অতুল: তুমি বুঝে খরচ করো তো? না হলে তোমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এর ফল ভোগ করবে। লাস্ট যে দুটো কেস সল্ভ করেছি, সব জল চুরির কেস।

ইন্সপেক্টর বক্সী: আমাদের আর বুঝে  খরচ না করে উপায় আছে! স্যর, ফিংগারপ্রিন্ট এনালাইসিস ডান।

অতুল: ফলাফল?

ইন্সপেক্টর বক্সী: মিত্র দম্পতি এবং রায়া ছাড়া আর কোনো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পেলাম না।

অতুল: রক্সি কখনোই একা একা বাড়ির বাইরে বেরোয় না। গার্ডও কোন বাইরের লোক দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। আচ্ছা এই রায়ার ডিটেলসটা একটু কালেক্ট করো তো।

ইন্সপেক্টর বক্সী: হয়ে যাবে আগামীকালই। তবে রক্সি যে কারও সঙ্গেই গেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেন। কারন ওর ট্র্যাকারটা কেউতো খুলে নিয়েছে।

অতুল: গুড পয়েন্ট। যে খুলে নিয়েছে সে বিকলও করে দিয়েছে। তুমি আমাদের গার্ডদের একটু অ্যালার্ট থাকতে বলতো। ট্র্যাকির নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে । মানে রাস্তাঘাটে আর কি।

ইন্সপেক্টর বক্সী: ওকে। কিন্তু এখনো এই পোষ্য চুরির কারণ খুঁজে পাওয়া গেল না। টাকা পয়সা বা অন্যান্য কিছু দাবি করে কোন ফোন তো এখনো মিত্র বাড়িতে আসেনি।

অতুল: সেটাই, দেখা যাক। রক্সির তদন্ত করে বক্সী। বেশ ছন্দ মিলেছে কিন্তু।

 

তৃতীয় দৃশ্য:

গোয়েন্দা বিভাগ, লালবাজার

 

অতুল: দেখুন, আপনি যদি এভাবেই মৌনতা অবলম্বন করেন তাহলে আমাদের আপনাকে অন্য বিভাগে পাঠাতে হবে।

ইন্সপেক্টর বক্সী: ট্র্যাকারে কিন্তু আপনার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে উইথ টাইমিং।

অতুল: আপনার পারিবারিক অবস্থা সম্বন্ধে আমরা খোঁজ নিয়েছি। আপনার চাকরি যাতে চলে না যায় সে জন্যেই গোটা বিষয়টা মিত্র ভবনে না জানিয়ে আমরা আপনাকে পার্সোনালি ডেকে এনেছি। এখন আপনি সাহায্য না করলে আমরা মিত্র ভবনএ বিষয়টা জানাতে বাধ্য হব।

রায়া: না, প্লিজ। আমি চাকরিটা হারাতে চাইনা।

অতুল: সেটা রক্সিকে চুরি করার সময় মনে ছিল না! কোথায় রক্সি? তাকে কি আপনি....?

রায়া: না না। ও আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে আছে। ওর বাড়িতে একটা ক্যানেল আছে। পুরোপুরি সেফ।

ইন্সপেক্টর বক্সী: বলিহারি দূঃসাহস আপনার! তা এই দুঃসাহসিক কর্মটি করার লক্ষ্য কী ছিল?

রায়া: জল

অতুল: মানে?

রায়া: আমার বাবা ক্রনিক ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস এর রোগী। প্রতিদিন প্রায় ৪.৫ লিটার থেকে ৫ লিটার জল প্রয়োজন হয় ডিহাইড্রেশন আটকাতে। আমি কোনভাবেই সংসার চালিয়ে এক্সপেন্সেস ম্যানেজ করতে পারছিলাম না। তাই বাধ্য হয়ে...

অতুল: বাধ্য হয়ে আপনি জল চুরি করলেন।

ইন্সপেক্টর বক্সী: স্যার, তিন নম্বর কেস এটা। তা পোষ্যটিকে চুরি করতে গেলেন কেন?

রায়া: রক্সি খুব ভালো জাতের শেফার্ড। ও আমায় সেদিন মিত্র ভবনের স্টোর রুম থেকে কয়েকটা ওয়াটার ভেসেল  নিতে দেখেছিল।

অতুল: সিকিউরিটি গার্ডের চোখ এড়িয়ে আপনি এসব করলেন কিভাবে?

 

রায়া: ওই সময়টা গার্ড একটু বাড়ি গিয়েছিল এক ঘন্টার জন্য। আপনাদের কাছে এই কথাটা লুকিয়েছে। ভয়ে।  আর আমার বাড়িও কাছেই। প্রথমে ওয়াটার ভেসেল বাড়িতে রেখে আসি। তারপর রক্সিকে বান্ধবীর ডগ হাউজে পৌঁছে দিই।

অতুল: রক্সির ট্র্যাকারটা খুলে নিয়েছিলেন, যাতে কোনভাবেই ওর লোকেশন ট্র্যাক না করা যায়।

রায়া: বিশ্বাস করুন রক্সিকে আমিও ভালবাসি। মিত্ররা যদি স্টোররুমে ওয়াটার ভেসেল খোঁজ করতেন! ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পুলিশ-টুলিশ। মাথা কাজ করছিল না। অথচ জলটাও ভীষণ প্রয়োজন ছিল।

অতুল (ব্যঙ্গাত্মক হাসি): হুম। ওরা ওয়াটার ভেসেলএর খোঁজ করলো না। রক্সি নিখোঁজ ডায়েরি পুলিশকে মিত্র ভবন অবধি পৌঁছে দিল।

রায়া: জলের অভাবে ডিহাইড্রেশন হয় বাবার। আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছে। কোনমতে ম্যানেজ করেছি। এদিকে মিত্র ভবনে ওয়াটার ভেসেল থরে থরে সাজানো। দেখে নিজেকে সামলাতে পারিনি।

অতুল: ওদের কাছে চাইতে পারতেন।

রায়া: আগে চেয়ে দেখেছি। ওরা নিজেরা সঞ্চয় করে রাখে, অন্যকে দেয় না।

ইন্সপেক্টর বক্সী: ওরা কি প্রয়োজনাতিরিক্ত জল সঞ্চয় করেন? এটা তো বেআইনী।

অতুল: আপনি বিষয়টা পুলিশে জানাতে পারতেন।

রায়া: বেকারত্ব যে জায়গায় পৌঁছে গেছে, চাকরিটা খোয়ালে সংসার চালাতে পারবো না আমি।  আর পুলিশে জানাবো ! আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বহু বছর বেআইনিভাবে জল সঞ্চয় ও অপচয় করে চলেছে ওরা। আর আমরা প্রয়োজনীয় জলটুকুও পাচ্ছিনা।মাঝে মাঝে নিজের পূর্বপুরুষদের উপর খুব রাগ হয়। ওদের স্বার্থপরতার ফল ভুগছি আমরা'।

অতুল: সত্যি! জলের মতো একটা বেসিক নিডের জন্যও ক্রাইম হচ্ছে আমাদের সমাজে। ভাবতেও অবাক লাগে। চলুন মিস্ রায়া, আপনার বান্ধবীর ক্যানেলে।

রায়া: আমায় গ্রেপ্তার করতে হলে এখানেই করুন।

অতুল: ক্যানেল থেকে রক্সিকে উদ্ধার করে মিত্র ভবনে পৌঁছে দিতে হবে।

ইন্সপেক্টর বক্সী: স্যার, রায়া ম্যাডামের চাকরিটা?

অতুল: একটা ফাইল খোলো আজ। রক্সির তদন্তে বক্সী এই নামে। রিপোর্টে লেখ, একটি পথভ্রষ্ট পোষ্য কুকুর উদ্ধার ক্যানেলে। তাকে তার মালিকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সময় সেই বাড়ির বেআইনিভাবে জল সঞ্চয়এর খোঁজ মিলেছে। তাই ওই পরিবারের নামে জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। আর মিত্র ভবনে এই পথভ্রষ্ট পোষ্যটিক কিভাবে উদ্ধার করলে, তার একটা গল্প মনে মনে রেডি করে রেখো। বুঝলে বক্সীবাবু?

রায়া: থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

অতুল: মিস রায়া,একটা কথা মনে রাখবেন, কোন পরিস্থিতিতেই আইনকে ভরসা না করে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়া ভীষণ অন্যায়। বক্সী, চলো। এই তদন্তের রিপোর্টটা ওয়াটার ডিপার্টমেন্টকে দিতে হবে।


5 কমেন্টস্: