কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

   


      

 একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 

 (৬)

 

দ্বীপে নেমেই আগ্নেয় বলল, আমার খুব খিদে পেয়েছে। খাওয়াদাওয়ার পর বলল, আমার খুব ঘুম পেয়েছে, অনেকক্ষণ ঘুমাল আগ্নেয়। হৃদয় ছটফট করছিল। সময় নষ্ট হচ্ছে। ঘুম থেকে ওঠার পর আগ্নেয় বলল, এবার আমি সমুদ্রে স্নান করতে যাব। সমুদ্রতীরে আসার পর হৃদয় মনে করিয়ে দিল, আমরা নেহাৎ মজা করতে আসিনি এখানে। সেটা যেন ভুলে না যাই। 

ওরা সে কথায় আমলই দিল না। একেবারে ফাঁকা সমুদ্রতট। ধূ ধূ সাদা বালি। আর সেখানেই শুরু হল ওদের মজার খেলা। প্রথমে ওরা দুজনে সমুদ্রে নামল। স্রোতের মধ্যে ওদের হাবুডুবু খাওয়া দেখে হৃদয়েরও তীব্র ইচ্ছা হল ঢেউয়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার। ওরাও ওকে ডাকছিল। এতক্ষণ ওরা নিজেদের মধ্যে খেলছিল, মজা করছিল। একে অপরের দিকে মুঠো মুঠো বালি আর নোনাজল ছুঁড়ে দিচ্ছিল। কিন্তু হৃদয় যেতেই ওদের খেলাটা অন্যরকম হয়ে গেল।

হৃদয় বেশ কয়েকবার স্রোতে ঝাঁপ দিল। ওরা হৃদয়ের দিকে বালি আর কাদা ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছিল। হৃদয় অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল। একবার সে বলল, তোরা এরকম করছিস কেন?

আমরা মজা করছি। ওরা বলল।

কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ পেছন থেকে এসে আগ্নেয় ওর দুটো হাত ধরল, আর বিশ্রুত ওর পা দুটো ধরল। হৃদয় বিশ্রুতকেই দেখতে পাচ্ছিল, আর আগ্নেয়র গলা শুনতে পাচ্ছিল। কিন্তু বিশ্রুত যেন নিজের মধ্যে নেই। সে সম্মোহিতের মতো বারবার আগ্নেয়র দিকে তাকাচ্ছিল। আগ্নেয় চোখের ইশারায় যা বলছিল, সে তাই করছিল। ওরা দুজনে মিলে হৃদয়কে চ্যাংদোলা করে বারবার জলের মধ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। প্রথম কয়েকবার হৃদয়ের আপত্তিকর কিছু মনে হয়নি। যতই হোক, বন্ধুরাই তো করছে আর গোটা ব্যাপারটাই একটা মজা। কিন্তু একটু পরেই ব্যাপারটা আর মজা বলে মনে হলো না ওর কাছে।

বিশ্রুতর চোখের ভাষাই যেন বদলে গেছিল। আর আগ্নেয়র মুখের ভাষা। আর এই দুই ভাষাতেই কেমন একটা নিষ্ঠুরতা আর নির্মমতা প্রকাশ পাচ্ছিল। ওরা স্রেফ মজা করছিল না। হৃদয়কে যেন অপমানই করছিল। তাকে লাঞ্ছিত করছিল। তার কোনও বাধা বা আপত্তি কানেই নিচ্ছিল না। বরং তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিল জলের মধ্যে। তারপর আবার তুলে নিচ্ছিল আর সেই একইভাবে কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে ওর শরীরটা দুলিয়ে দুলিয়ে ঢেউ এলেই আবার তার মধ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। দুজনে দুদিক দিয়ে ধরে ওরা যখন ওর শরীরটাকে দোলাচ্ছিল, হৃদয়ের চোখে তখন ভেসে উঠছিল রঙবেরঙের ফুলের ছবি। সেই ফুলেদের কাছেই ওর যাওয়ার কথা ছিল। আর ওর বন্ধুরা ওকে কোথায় নিয়ে এসেছে। ওর চোখ বুজে আসছিল। সেই চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে নামছিল নোনা জল। কিন্তু ওর বন্ধুরা সেই জল দেখতে পাচ্ছিল না। সমুদ্রের নোনা জল ছাড়া আর তারা কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না।

দুই বন্ধুর সেই নারকীয় নৃশংস আচরণ যখন থামল, হৃদয় তখন শুধু ক্লান্ত বিধ্বস্ত নয়, বরং একদম বোবা বনে গেছে। ওর শরীরটাকে ওরা বালির মধ্যে নামিয়ে রেখেছিল। তারপর দুজনে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে করতে দূরে ঝাউগাছের আড়ালে কোথায় হারিয়ে গেল। হৃদয় পাশ ফিরে একবার সেদিকে তাকাল। নিজের অপমান বা লাঞ্ছনার কথা সে ভাবছিল না। প্রচণ্ড হেনস্থা হয়েছে সে। কিন্তু কেন হয়েছে সেই কারণটা ওকে তেমন করে ভাবাচ্ছিল না। কোনও রাগ বা প্রতিহিংসা ওর মনে জেগে উঠছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল একটা গোটা দিন ব্যর্থ হয়ে গেল। এখানে আসাটাই কোনও কাজে এল না। কত পরিকল্পনা ছিল ওর। কত কথা ছিল। ভেবেছিল প্রিয় বন্ধুদের নিয়ে স্বপ্নের ভেতর আরো একটু তলিয়ে যাবে। ফুলের বাগান নিয়ে একটা স্বপ্ন। সুন্দর একটা দিন কাটাবে। তার বদলে ওরা একদম উন্মত্ত হয়ে উঠল। ওদের সেই উন্মত্ততা মনে পড়লে শিউরে উঠতে হয়। মনে ত্রাস জেগে ওঠে।

অনেকক্ষণ এই একইভাবে শুয়ে রইল হৃদয়। তারপর একটু একটু করে উঠে দাঁড়াল। ওর জামাল্কাপড় এখন শুকিয়ে গেছে। কাদার টুকরোগুলোকে টোকা মেরে মেরে ফেলে দিল হৃদয়। তারপর কোনও রকমে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে পৌঁছল ঘাটে। ওখানে ওর বন্ধুরা আগে থেকেই ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। নৌকা করে ফেরার সময় কথা প্রায় হলোই না। বিশ্রুত চুপচাপ বসে রইল। আগ্নেয় ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। আর হৃদয় জলের দিকে তাকিয়ে রইল। পরদিন থেকে তিনজনেই আবার পুরোপুরি স্বাবভাবিক হয়ে গেল।

হৃদয়ের জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, ওরা কেন এরকম একটা অস্বাভাবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ করল! কিন্তু ও কিছু জানতে চাইল না। নিজের এই গ্লানিকর স্মৃতিকে ও যেন ভুলেই যেতে চাইল। ওর মনে হল এই নিয়ে বেশি খোঁচাখুঁচি করলে সেটা ওদের ফুলের বাগানের পক্ষে সুখের হবে না। ফুলই তখন ওর কাছে সবচেয়ে আগে। আর সবকিছু তুচ্ছ। কিন্তু ওরা যা করেছে, তাকে ওর গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। পএ সব শুনে সাঁঝ এরকমই বলেছিল ওকে।

কয়েকদিন পর বিশ্রুত এসে হৃদয়কে একটা অদ্ভুত খবর দিল। একটু সঙ্কোচ নিয়েই সে সব জানিয়ে বলল,

এই হল ব্যাপার...

তুই অতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলি? আগ্নেয় একবারও এসে তোর সঙ্গে কথা বলল না?

নাঃ।

ও তো ব্যাডমিন্টন খেলছিল। তোকে হয়তো দেখতে পায়নি।

পেয়েছে। তাছাড়া ওকে আমি কয়েকবার ডেকেওছি।

তবু এল না?

নাঃ।

ভারি অদ্ভুত তো! তা পরে ওকে আর ফোন করিস নি?

নাঃ।

হৃদয় বুঝতে পারল, বিশ্রুতর একটু অভিমানই হয়েছে। আগ্নেয় প্রায়ই বিশ্রুতর হোস্টেলে আসে। দুজনে মিলে আড্ডা দেয়, খাওয়াদাওয়া করে, একসঙ্গে অনেকটা সময় কাটায়। বিশ্রুত আগে কখনও আগ্নেয়র দ্বীপে, ওর বাড়িতে যায়নি। আগ্নেয় কয়েকবার বলেছে অবশ্য। সেই কথা রাখতেই বিশ্রুত গিয়েছিল। আর তখনই এসব ঘটেছে।

এই ঘটাওনার পর থেকে আগ্নেয়র সঙ্গে বিশ্রুতর দূরত্ব বাড়তে থাকে। ওদের সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। হৃদয় তখন বুঝতে পারে নি। পরে বুঝেছিল।

সাঁঝকে সে বলেছিল, আগ্নেয় আসলে ছোট্ট একটা প্রতিশোধ নিয়েছিল। আমার জীবনে ওর যে জায়গা ছিল, সেটা ও হারিয়েছিল বিশ্রুতর জন্যই। বিশ্রুতকে আমার কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য সরিয়ে নিয়ে ও আসলে বদলা নিতে চেয়েছিল। দেখাতে চেয়েছিল, চাইলে ও কী করতে পারে, কতদূর যেতে পারে, আমার কাছে যে ফুলটা ছিল সবচেয়ে দামি, সেটাকে কী অনায়াসে একটা সস্তা খেলনায় পরিণত করতে পারে! বিশ্রুতকে ও-ই উসকে ছিল আর তার পরিণতি ছিল আমার প্রতি ওদের ওই নিষ্ঠুর মজা করার ঘটনাটি। কিন্তু বদলা নেওয়ার পরই বিশ্রুতর প্রতি ওর সমস্ত আকর্ষণ চলে যায়। ধীরে ধীরে বিশ্রুতর প্রতি ও উদাসীন হয়ে যায়। আমার আর বিশুতর সম্পর্ক নিয়ে ওর আর তখন কোনও উৎসাহ ছিল না। ও ছিল অত্যন্ত দাম্ভিক আর বিশ্রুতকে কখনওই নিজের সমকক্ষ মনে করে নি...

সাঁঝ বলেছিল, তোর বন্ধুত্বকে তাহলে আগ্নেয় খুব গুরুত্ব দিয়েছিল বলতে হবে...

একটু সংশোধন করে হৃদয় বলেছিল, বন্ধুত্বকে নয়, বন্ধুত্ব থেকে পাওয়া আঘাতকে...

কিন্তু তোর তো আঘাত দেওয়ার কোনও ইচ্ছাই ছিল না। যা ঘটেছিল, তোর অজান্তেই ঘটেছিল। তুই বরং ওদের দেওয়া আঘাতকে আড়াল করতেই চেয়েছিলি...

বিশ্রুত আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। আমার স্বপ্নের অংশীদার। এটাই ছিল ওর দোষ। আগ্নেয়র দম্ভে ঘা লেগেছিলি। বিশ্রুতকে ও ব্যবহার করেছিল। আর আমাকে দিয়েছিল শাস্তি। ও আমাকে কী বলতো জানিস? মেগালোম্যানিয়াক। আত্মমুগ্ধ।

এটাও তো একটা ঈর্ষারই কথা। তোর স্বপ্ন এতে ছোটো হয়ে যায়। নিজে বড়ো হয়ে উঠিস। তুই তো নিজে বড়ো হতে চাস নি। শুধু নিজের জন্য ফুলের বাগান বানাতে চাস নি। এ-ও তোকে ছোটো করেই বলা কথা...

সে কথা তখন আমি বুঝি নি। ও দিনের পর দিন এই কথাটা বলে গেছে, আর আমি প্রশ্রয় দিয়ে গেছি...

ফুল তোকে অন্ধ করে দিয়েছিল। তুই আক্রমণ বুঝিস নি, বিরোধিতা বুঝিস নি, শ্লেষ বুঝিস নি। শুধু নিজের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিলি। তুই বড়ো হলে ওর তাতে আপত্তি কোথায় ছিল? কেন ও তোকে তোর স্বপ্নের চেয়ে বড়ো করে তুলতে চাইল, যাতে তোকে নিয়ে ও এইভাবে শ্লেষ করতে পারে, বিদ্রূপ করতে পারে, তোকে ছোটো করতে পারে? তুই ছোটো হলে, তোর স্বপ্নও যে ছোটো হয়ে যায়, তারই বা কী উচ্চতা থাকে? পুরোটাই আপত্তিকর। আসলে নিজের আত্মসর্বস্বতাকেই কী ও ঢাকতে চাইত তোকে আত্মমুগ্ধতার গঞ্জনা দিয়ে? কিন্তু যাই বলিস, তোর দোষও কিছু কম নয়। এমন বেভুল হলে চলে না। কষ্ট তুই নিজেও কিছু কম পাসনি। অন্যায় আর সঙ্কীর্ণতা ছুঁচের মতো ফুটেছে। তবু আপোশ করে গেছিস। আপোশ করে কী নিজের স্বপ্নকে পাওয়া যায়? কিছু পাওয়া যায়? বরং ছোটো ছোটো অন্যায় প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে ক্রমে বড়ো হয়ে ওঠে। অন্যায়ের চাপে স্বপ্ন তখন গুরুত্ব হারাতে থাকে। একসময়ে অন্যায়টাই গিলে খায় স্বপ্নকে। তুই ভুল করেছিস। প্রথম থেকেই তোর অত প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হয়নি। দৃঢ়তা দেখান উচিত ছিল। তুই দুর্বলতা দেখিয়েছিস। একটার পর একটা অন্যায় হয়ে গেছে। তুই চোখ বুজে থেকেছিস। এইভাবে কী কিছু পাওয়া যায়? তুই নিজেই নিজের তৈরি চোরাবালিতে তলিয়ে গেছিস। কিন্তু তোর প্রতি কেউ যে সহানুভূতি দেখাবে, সেই পথটাও খোলা রাখিস নি...

 

(ক্রমশঃ)   

 

 

                  

           

 

  

 

 

 

 

 

   


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন