কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

নিবেদিতা আইচ

 

সমকালীন ছোটগল্প


দুঃখের মতো অন্য কিছু

মা বোধহয় গরম তেলে পাঁচফোড়ন দিল মাত্র। সুঘ্রাণ ভেসে আসছে আমার ঘর অব্দি। বিছানার ওপর ছাদ থেকে তুলে আনা কাপড়গুলোতে কড়কড়ে রোদের ঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণে নাক ডুবিয়ে দিতে দিতে আমি ভাবি মানুষের ঘ্রাণের মত সুন্দর কিছু আছে? কিংবা মানুষের মনের চেয়ে অদ্ভুত আর কিছু হয়? মুখে একরকম বলে মনে মনে দিব্যি তার উল্টোটা আওড়াতে পারে। মুহূর্তেই কত রকম বিপরীতমুখী, অসম্ভব আর বিচ্ছিন্ন সব ভাবনা সে অনায়াসে ভাবতে পারে। নতুবা সেই সকাল থেকে বুলা আপার কথা ভাবতে থাকা আমি হঠাৎ করে কেন ঘ্রাণের কথা ভাবতে বসলাম!

এইতো সকাল বেলাতেই মাকে বলছিলাম পুতুল ঘুমালে আমি একটু আমার বন্ধু রেণুদের বাড়ি যাব, ফেরার পথে বুলা আপাদেরও দেখে আসব। কিন্তু মায়ের মুখে  খবরটা শোনার পর থেকে আর পা সরছে না। অথচ মা ভেবেছিল খবরটা শুনে আমি তক্ষুনি ছুট দিব।

আমার মনে পড়ে বুলা আপার কলাবেনি করা চুলে কিওকার্পিন তেলের ঘ্রাণ থাকত সবসময়।

মায়ের ঘরেও এখনো এই তেল আছে। শুধু আমিই একটা সময়ের পর আর এই তেল চুলে দিতে পারিনি। ঘ্রাণটা এতই বিতৃষ্ণা জাগাত।

রাইমসের বই আর খাতা পেন্সিল চারপাশে ছড়িয়ে পুতুল ঘুমিয়ে পড়েছে সেই কখন! আমি এইসব ভাবতে ভাবতে তখন থেকে হাঁটুতে মুখ ডুবিয়ে বসে আছি। বুলা আপার কথা মনে করে করে চোখ উপচে জল গড়াচ্ছে আমার, বুকের ভেতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে দিচ্ছে যেন কেউ। অথচ গত সাত বছরে একবারের জন্যও আমি চাইনি মানুষটার সাথে আমার দেখা হোক। সেই আমি এখন তার জন্য বুক ভাসিয়ে কাঁদতে বসেছি! মানুষের মনের মত সত্যিই অদ্ভুত আর কিছু নেই!  

কয়েকবার এসে ডাকাডাকি করে আমার হেলদোল না দেখে মা এবার আমার পাশে এসে বসল। মা তো জানে না কেন বরাবরই আমার একটা অস্বস্তি রয়ে গেছে বুলা আপাকে নিয়ে। শুধু মা নয়, আমি ঠিক কাউকেই বুঝিয়ে বলতে পারব না কোথায়, কীভাবে এই চোরকাঁটাটা আমার সঙ্গী হয়ে উঠেছে। আমি কিন্তু দীর্ঘদিন সবকিছু  ভুলে ছিলাম। মায়ের কাছে আসার দিন ঠিক হতেই আবার সেই খচখচানিটা শুরু হল। যদি বুলা আপার সাথে দেখা হয়ে যায় কিংবা সে আমাকে ফোন করে, আমার মুখে কথা ফুটবে তো? বাড়িতে এসে নিজে থেকে প্রসঙ্গটা তুলব না ভেবেছিলাম।  কিন্তু ঠিক মায়ের সামনে মুখ ফসকে বেরিয়েই গেল নামটা। তারপর মা যখন খবরটা দিল, আমি বুঝলাম এ জন্মে আর এই ভার থেকে আমার মুক্তি মিলবে না।

'বুলার জন্য মন খারাপ করিস না। ও নিজেই গানটান সব ছেড়ে দিয়েছিল। ওর তো মাথারই ঠিক ছিল না বছর দেড়েক ধরে। একদিন শুনলাম বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে কাউকে কিছু না বলে। ওর বড় ভাই নাকি রেল স্টেশন থেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ফিরিয়ে এনেছিল। অনেক কষ্ট দিয়েছে সবাইকে। নিজেও ভুগেছে। শরীর-টরীর ভেঙ্গে অমন সুন্দর চেহারাটা কেমন হয়ে গিয়েছিল। ওকে এ অবস্থায় দেখলে তোর বরং খারাপই লাগত।'

মা একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল। কান্নার বেগ বাড়তে বাড়তে আমি বোধহয়  তখন হেঁচকি তুলতে শুরু করেছিলাম। মা জোর করে খাবার ঘরে নিয়ে বসাল। বলল, তুই এমন করবি জেনেই তো ফোনে বলিনি খবরটা। ছোটবেলার বন্ধু বলে কথা! মেয়েটার কথা ভাবলে আমারই বুকটা পুড়ে যায় আর ওর মায়ের না জানি কেমন লেগেছে!

কী রে ঝুমু, যাবি একবার ওদের বাড়িতে?’ আমার প্লেটে খাবার দিতে দিতে মা জানতে চাইল। আমি সহসা উত্তর দিতে পারলাম না। তখন থেকে গলার কাছে শক্ত একটা পাথর জমে আছে আমার। কথার উত্তর না পেয়ে মা-ই আবার বলল, তোকে দেখলে আবার কান্নাকাটি করবে বুলার মা। থাক, গিয়ে কাজ নেই।

বুলা আপাটা রেল স্টেশনেই কেন গেল? ও কি আমার কাছে আসতে চেয়েছিল? ট্রেনে চেপে ওর কি অন্য কোথাও যাওয়ার মত জায়গা হয়েছে এতদিনে? কোন প্রেমিক, ভক্ত কিংবা আমি চলে যাবার পর অন্তত সেরকম কোন বন্ধু কি তার হয়নি? আমি মাঝেমাঝে ভাবি শুধু অন্যের প্রতি অভিমান করে নিজেকে ধ্বংস করে দেয় কেউ? আর ওর সাথে কাঁধ মিলিয়ে আমিও জীবনে থেমে থাকিনি বলে যেন মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে আমার!

পুতুলের পাশে শুয়ে শুয়ে এসব ভাবনার ব্যবচ্ছেদ করতে করতে আমি ছটফট করলাম বহুক্ষণ। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। পথের ক্লান্তির পর এই মানসিক চাপ আমার ভেতরের সবটুকু নির্যাস যেন শুষে নিয়েছিল।

ভরসন্ধ্যায় ধড়মড় করে জেগে উঠলাম। পুতুলটা কখন পাশ থেকে উঠে গেছে একবারের জন্য টের পাইনি। ওকে এদিক ওদিক খুঁজতে শুরু করতেই মা এসে বলল, তোর বাবার কাছে আছে। খেলছে। তোকে চা দিই?’  

আমি বললাম, আচ্ছা, বুলা আপাকে ওরা বিয়ে দেয়নি কেন? জানো কিছু? ওর  একটা সংসার হতে পারত! তাহলে হয়ত মেয়েটা…’

পুতুলের বইখাতা গুছাতে গুছাতে মা আমার দিকে একবার তাকাল। কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন শেষমেশ বলল না। আমি তবু শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। মা আপনমনে কাজ করতে করতে একসময় বলল, তুই কতদিন পর এলি, এসব কথা থাকুক না এখন। যে গেছে সে কি আর ফিরবে!

সত্যি বলতে মার চোখমুখ দেখে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কারণ আমি শোনার সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলছিলাম। মা তো জানে না, বিয়ের পর শুধু দূরত্ব কিংবা শরীরের কারণে নয়, এই এক বুলা আপাকে এড়াব বলেই আমি সহজে আসতে চাইতাম না এ শহরে। শাহীনও আমার অনাগ্রহ দেখে অবাক হত প্রথম প্রথম। বলত, তোমার দেখি উল্টো ধারা! মায়ের কাছে যেতে চাও না!  

এসবের ব্যাখ্যা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। শাহীনকে বুলা আপার কথা সেই যে একবার বলেছিলাম, এরপর থেকে ঐ নাম সে আর মুখেই নেয় না। আমাদের জানাশোনায় যেন এমন কেউ ছিল না কখনো। এমনিতে শাহীন এ শহরটা খুব ভালবাসে। ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস এখানে, পুরনো কিছু বন্ধু বান্ধবও আছে। সেই সকালবেলা নাশতা করে ওদের সঙ্গে আড্ডা দেবে বলে বেরিয়ে পড়েছে শাহীন। তারপর অনেক ঘুরেটুরে যখন ফিরল তখন অনেক রাতে।

রাতে ও নিচতলাতেই ঘুমাল। আর আমি পুতুলকে নিয়ে মায়ের ঘরে শুলাম। পুতুলকে নিয়ে এই এলাম প্রায় বছর তিনেক পর। শুক্র শনিবার মিলিয়ে শাহীন টানা ছুটি পেল বলেই শান্তিমতো আসা গেল।

এতদিন পর এসেছি বলে মায়ের সাথে কত গল্প যে জমে গেছে! টানা তিন চারদিনেও শেষ হবে না এসব গল্প। ঘুম আর হবে কি! আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে মা বলল, শোন না ঝুমু, পুতুলটা তো দেখতে দেখতে বড়ই হয়ে গেল। তোরা এবার আরেকটা বাচ্চা নিয়ে নে। এবার দেখবি আর অত সমস্যা হবে না। আমার কাছেই না হয় থাকলি।’

মায়ের কথা শুনে টুপ করে বুকের কোথায় পাথর চাপা দেয়া দিনগুলি জেগে উঠল। অথচ আমি ভেবেছিলাম সব হয়ত সামলে নিয়েছি। পুতুলের জন্মের আগের তিনটে  বছর আমার উপর দিয়ে যা গেছে সেসব ভাবতে গেলে রীতিমতো শিউড়ে উঠি। তখন মনে হত হয়ত কখনোই সংসারে আমি একটা শিশুর মুখ দেখতে পাব না। ধীরে ধীরে আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম অন্যের প্রাপ্য জিনিস কেড়ে নিয়ে জীবনকে কাণায় কাণায় পূর্ণ করা যায় না! যে অন্যায় আমি করেছি এরপর আমার  সাথে তো এমনই হবার কথা।

তুই তো বাড়িতেই থাকছিস, গানটানও আর করলি না সেভাবে। কত সুন্দর গলা ছিল তোর! চাকরি বাকরির নামও নিস না। সবই বন্ধ করে বসে আছিস যখনআমি চোখ বন্ধ করে রইলাম। মা জানে চুপচাপ সব শুনছি আমি। ছোটবেলাকার মতঝুমু এটা কর, ওটা করিস না এসব বলতে শুরু করলে আমি এমন ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতাম।

পুতুলকে গানের স্কুলে দিবি কিনা ভাবলি কিছু?’

আমি মুখ ফিরিয়ে রেখেই বললাম- ওর গান টান শিখে কাজ নেই।

কী সব বলিস! স্কুলে দেবার আসলে দরকার নেই, ও তোর কাছেই শিখবে!

না, আমার মেয়ে গান শিখবে না।

আমার কথার ভঙ্গি দেখে মা বোধ হয় ভীষণ অবাক হল। তারপর কিছুক্ষণ উসখুস করে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

পুতুল মাঝখানে শুয়েছে। ঘুমন্ত মেয়েটা লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলছে আমার মুখের ওপর। ওকে দেখলে আজকাল আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। ওর মতো বয়সেই তো মায়ের হাত ধরে গানের স্কুলে যেতাম। বুলা আপার সাথে পরিচয় ঐ স্কুলে গিয়েই। তার সাথে গানের তালিম নিতে শুরু করলাম আমিও। অল্প কদিনেই আমরা খুব বন্ধু হয়ে গেলাম। শেষদিন পর্যন্ত প্রিয় বুলা আপা আমাকে কী স্নেহটাই না করেছে! একটা সময় পর্যন্ত আমিও ওকে খুব ভালবাসতাম। কিন্তু যখন আমার চৌদ্দ পনের আর বুলা আপার ষোল কি সতের তখন থেকে আমি ওকে মনে মনে ঈর্ষা না করে পারতাম না। বুলা আপাকে তখন সবাই এক নামে চেনে। কী গায়কী তার! শুধু কি গানের গলা? একটা মানুষ দেখতেও এত সুন্দর হবে কেন! আর কেন সবাই শুধু তাকে নিয়েই মাতামাতি করবে? ওর ছায়ার আঁধারে আমি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিলাম।

অথচ আমি মনে মনে জানতাম আমিও কোনো অংশে কম নই। তাই ওকে ছাড়িয়ে যাবার জেদ চাপল ক্রমশ। আমি আরো অনেক বেশি পরিশ্রম করতে শুরু করলাম। সংগীত তো তাকেই ধরা দেয় যে তাকে অধ্যবসায় নিয়ে, ভালোবেসে সাধে। আমিও পরিশ্রমের ফল পেতে শুরু করলাম। বুলা আপার গমকি, বিস্তার, মুড়কি অনন্য হলে আমার ব্যাহেলাওয়া, মীর কিংবা তেহাই যে সেরকম - একথা আমাদের গুরু নিজমুখে বলতে শুরু করলেন।

তবু গানের ছাত্রীদের মাঝে সেরা একজনের নাম করতে হলে সে নাম হতো বুলা আপার। কারণ তার জীবনে এই এক গান ছাড়া আর কিছু ছিল না। এদিকে আমি ছিলাম পড়াশোনাতেও সমান মনোযোগী। গান কিংবা পড়াশোনা থেকে যেকোন একটা আমি বেছে নিতে পারতাম না। এ ব্যাপারটা গুরুজিও বুঝতেন। তাই সমস্ত প্রত্যাশার ভার বইতে হত বুলা আপাকে।

গুরুজির বাড়িতে যেবার শাহীনের সাথে আমাদের দেখা হল আমার মনে আছে সেদিনের কথা। প্রথমদিনই আমি ওকে লক্ষ করেছিলাম বুলা আপার গান শোনার  পর ওর চোখেমুখে মুগ্ধতা দেখেছিলাম আমি। তখন আমি অনার্স থার্ড ইয়ার। বুলা আপার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। রেজাল্ট হয়ে গেলেই আপার বিয়ে হবে বলে জানতাম। যদিও আপার অত তাড়াতাড়ি বিয়ে করবার মন ছিল না। এদিকে সে বছর স্কলারশিপ তখনো ঘোষণা হয়নি। সবাই জানত গুরুজি বুলা আপাকেই মনোনীত করবে। কারণ ওর একাডেমিক পড়াশোনাও শেষ হতে যাচ্ছিল। পরবর্তী বছর দুটো ও মন দিয়ে শুধু গানই করতে পারবে।

আমার তখন খুব উদ্ভ্রান্তের মত দিন কাটত। যদি স্কলারশিপটা আমি পাই তবে আমাকে অন্য শহরে যেতে হবে, পড়াশোনার মাঝে যেটা একেবারে অসম্ভব কথা। বাবা মা কিছুতেই রাজি হবে না। কিন্তু আমার যে তখন ভীষণ জেদ চেপে গেছে! বুলা আপাই কেন এবারেও আমাকে হারিয়ে দেবে?

আমি সেবার সেটা হতে দিই নি। ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে ঠিক করেছিলাম কী করতে হবে। সেদিন আমি শাহীনের সামনেই গুরুজিকে গিয়ে বললাম বুলা আপার বিয়ে ঠিকঠাক, রেজাল্ট হয়ে গেলেই ওর পরিবার ওকে বিয়ে দেবে। ও নিজেও বিয়ের জন্য মনে মনে প্রস্তুত। গুরুজি রাগ করবেন বলে মেয়েটা মুখ ফুটে বলতে পারছে না। বুলা আপা আমার এতগুলো বছরের ঘনিষ্ট বন্ধু বলে গুরুজি আমার কথাটা চোখ বুজে বিশ্বাস করেছিলেন।

শাহীন তখন কেবলমাত্র বুলা আপার প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠছিল। আমার মুখে খবরটা জেনে ওকে কি বিমর্ষ দেখাচ্ছিল সেদিন! শাহীন জানত না বুলা আপা আরো বেশি আগ্রহী ছিল ওর ব্যাপারে। হবে নাই বা কেন! শাহীন এমন সুদর্শন আর সঙ্গীতপ্রেমী ছেলে! ওর মতো সঙ্গী পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার।

আমাদের সবাইকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে গুরুজি যখন স্কলারশিপের জন্য অন্য একজন ছাত্রকে মনোনীত করলেন তখন অনেক কিছু বদলে গেল। ধীরে ধীরে বুলা আপার সাথে গুরুজির একটা দূরত্ব তৈরি হল। আপা সেসময় বিভিন্ন প্রোগ্রামে গান গাইতে শুরু করল। পরিবারের আর্থিক অবস্থা এমন ছিল যে এসব অনুষ্ঠানে টাকার বিনিয়মে গান না করে তার উপায়ও ছিল না। আমাকে কেউ কেউ বলত ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে গুরুজির কাছে ফিরিয়ে নিতে পারি কিনা। কিন্তু আমার তখন ওসবের সময় কোথায়! পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ততা। তাছাড়া আমি যেমনটা চাচ্ছিলাম তেমনটাই তো ঘটছিল তখন।

এর মধ্যে ঘটল অদ্ভুত একটা ব্যাপার। গুরুজি নিজেই তার বোনের ছেলে শাহীনের সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব পাঠালেন। আমি তখন ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছি। বাবা মাকে গুরুজি কি বুঝিয়েছিল আমি জানি না। ওরা বেশিদিন অপেক্ষাও করেনি। শাহীনের সাথে সত্যি সত্যিই আমার ঘটা করে বিয়ে হয়ে গেল। অথচ একসময় এই শাহীনকে দেখলে আমি বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিতাম! বুলা আপার প্রতি একসময় যার আকর্ষণ ছিল তাকে আমি কিছুতেই নিজের কাছে ঘেঁষতে দিতাম না

কী অদ্ভুত আমাদের মনের গতিপথ! বিয়ের কথা পাকা হবার পর থেকে আমার  মনে হল স্কলারশিপটা না পেলেও আমি শাহীনকে তো পেলাম! এও একদিক দিয়ে বুলা আপার হার।

এইসব স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই আমার মন আর শরীর অচল হয়ে পড়ে। এবার এখানে এসে যোগ হলো বুলা আপার সুইসাইডের খবরটা। নিজেকে অভিশাপ দিতে দিতে ভেতরে ভেতরে আমি কুঁকড়ে যাচ্ছি। ঈর্ষা কতটা নিচে নামাতে পারে একজন মানুষকে! বুলা আপা কতই না ভালবাসত আমাকে। যে গানের জন্য আমি সেই মেয়েটার সঙ্গে এমন করলাম, এতটা নিচে নামলাম, আমার ভেতর থেকে সেই গানটাই কবে যেন হারিয়ে গেল!

নিজেকেই নিজে অভিশাপ দেবার এই যে দুঃসহ ভার, যার সাথে আর কিছুরই তুলনা চলে না, যে ব্যথার কোন ওষুধ নেই বলে মনে হল, সে ব্যথাটাই কেমন ভোঁতা হয়ে গেল দুদিনের মধ্যে। মায়ের কাছে শুনলাম বুলা আপার একজন প্রেমিক হয়েছিল। ভাইদের সাথে বনিবনা না হওয়ায় বুলা আপা একদিন সেই লোকটার কাছে চলে যাবে বলে রওনা দিতেই ভাই এসে জানাল লোকটা বিবাহিত।

এটুকু জানার পর আমার মনে হল যেন মস্ত বড় একটা পাথর আমার বুকের উপর থেকে সরে যাচ্ছে। আমি মাকে বললাম, অন্যের দোষে নয়, নিজের নির্বুদ্ধিতার  জন্যই এসব মানুষ বারবার কষ্ট পায়।

তারপর কী হলো? মাস তিনেক আগে কোন এক বিষণ্ণতম ভোরে বুলা আপা অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিজেকে চিরদিনের জন্য ঘুম পাড়িয়ে ফেলল।

ধীরে ধীরে আমার অপরাধবোধটা কমে এলেও আমি কিন্তু পুরোপুরি নির্ভার হতে পারলাম না। বুলা আপাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় আমার বুকের মধ্যে কেমন অন্যরকম লাগছিল। করুণা, সমবেদনা বা মায়া নয়ব্যথার মত, দুঃখের মত একটা কিছু আমার পিছু নিল যেন। আমি বুঝলাম এই অন্য কিছুটা দীর্ঘদিন আমার সঙ্গী হয়ে থাকবে।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন