কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

মৌমিতা মিত্র

 

ভোরাই




প্রত্যেক ভোরের আলাদা রঙ থাকে।

ছোটবেলায় রেডিয়োর প্রভাতী গানের  অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে ঘুম ভাঙত। সূর্য আর সুরের সাতটা ঘোড়া উনপঞ্চাশ পবনের কাঁচি নিয়ে পিচুটিচোখের সেলোটেপটা যখন কেটে দিত, সে ভোর ছিল জাল জাল  নীল, তাতে দেঁতো নিমপাতার সবুজ হাসি...

বর্ষার ভোরগুলো দেখতে হত কখনো নীলচে ছাই, কখনো পার্পল, কখনো জলহস্তীর পিঠের মতো ধূসর, স্যাঁতসেতে। সারারাত বৃষ্টির গণহত্যার পর বৈপ্লবিক সকালটা হত আশ্চর্য ঝকঝকে।  তুলোট কিংবা সিপিয়ার বিধুরতা থাকলেও প্রিন্টটা কিন্তু ঝকঝকে।

মাউন্ট আবুর বারান্দায় যাওয়া দুবার… জীবনে প্রথমবার দেখেছিলা। এমন থমকে যাওয়া ভোর। একটা আঠালো নৈঃশব্দ্যের  কালচে সর পড়ে আছে চরাচরে…   কারোর কথাটি কওয়া মানা, কড়ে আঙ্গুলটি নাড়ালেই ফ্রেম থেকে আউট... নীচে এক পাল দামাল হাতি বুঝি সারারাত নিজেদের উদ্দাম আর বুনো হুল্লোড়ে মত্ত ছিল, তারপর ত্রিযামা ঠাকুরাণী যে-ই বলেছেন, 'গো... স্ট্যাচু' অমনি তারা জগদ্দল পাথর হয়ে গেছে।  তাদের প্রত্যেকের  অঙ্গভঙ্গী পড়ছিলাম, খুঁটিনাটি টুকে নিচ্ছিলাম মনের প্যাপাইরাসে, কতক্ষণ  ধরে যে  হস্তীলিপি পাঠ করছিলাম, কে জানে…  হঠাৎ একঝাঁক টিয়াকাঁচি ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে আকাশ  ছিঁড়েখুঁড়ে  বেরিয়ে গেল! ওমা! কোথায় কালচে সর, এ তো ধূসর সসপ্যানে নীল চা ফুটছে টগবগ করে…  

প্রতিবার ভোর এভাবেই ফাঁকি দিয়ে সকালের হাতে চাবি দিয়ে সরে পড়ে। দ্বিতীয়বারের আবু বারান্দা এত প্রসারিত ছিল না, তবু পার্কিংয়ের খেলনা ঘুমন্ত গাড়িগুলোর মাথায় চুমু খেয়ে আরও দূরে চোখ হেঁটে গেলে কতগুলো গাছ দিগন্ত কেটে ফালাফালা করছে দেখা যায় বৈকি।

কচি কড়াইশুঁটির পাতলা খোসার মতো সবুজ ভোর দেখেছিলাম নৈনিতালে। সেখানে গিয়েই প্রথম মনে হয়েছিল, গায়ে হলুদ যদি হয়, গায়ে সবুজ হবে না কেন? নৈনির জল সবুজ, পাহাড় সবুজ, শুধু হোটেল থেকে ঢিল দূরত্বের নাম না জানা ফুলের ঝাঁকড়া গাছটা পার্পল বাবরি নাচিয়েই চলেছে। আর আকাশটা নীল বটে!

ঘুম ঠেলে উঠে যখন বারান্দায় বসলাম, তখন দেখি, নয়না দেবীর  সবুজ টলটলে নয়ন-মণির মতো লেকে বেশ খানিকটা কালি গোলা রয়েছে। যখন টান ধরায় ডান পা'টা সামান্য নাড়ালুম, দেখি কালোর ডালা ফুরিয়েছে। তার বদলে উজাড় হয়েছে সবুজ...  দূরে ঘন সবুজ, মাঝেমধ্যে ফিকে সবুজ, স্রোতের বাঁকে এখানে ওখানে নানা মাত্রার সবুজ, বাঁ পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরতে কোনমতে সেটাকে চেয়ারে তুলে ডান থাইল্যান্ডে বহাল করে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে তানপুরার কানের মতো যেই না মোচড় দিয়েছি, অমনি দেখি, সবুজ জলে সোনার সুতোর ঝলমল!  নিমেষের মধ্যে খটাখট খটাখট তাঁত বোনা শুরু হয়ে শেষ! এপার থেকে ওপার সোনালী জরদৌসির কারুকার্য করা পান্নামোহিনী নৈনি শাড়ি…

ঝিঁঝিঁহীন পা'টা যথাস্থানে রেখে ওপরে চোখ তুললাম, পাতাহীন ঢ্যাঙ্গা একটা গাছের সাঁড়াশিতে বেকুব চাঁদ তখনো আটকে আছে। দিনের আলোয় বেআব্রু হওয়ার গ্লানিতে তার চোখমুখ ফ্যাকাসে, পারলে জল হয়ে গলে নৈনিতে মিশে যায়।

উদয়পুরের ভোরের আকাশে ছিল মুঠো করে গোল্লা পাকিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া কাগজের মেঘ… আর এখানে জল নীল। তবে কালো থেকে নীলে যাওয়ার আগে পার্পলে একবার চকিতে পানকৌড়ি ডুব দেওয়ার মুহূর্তটাই এখানে আনন্দিনী ভোরাইকে সূচিত করে। পাহাড় এমনভাবে বেষ্টিত রাখে লেককে,  যেন ইন্দ্রের সভায় সব দেবতাদের লোলুপতার সামনে নৃত্যরতা অভাগিনী বেহুলা। পিতৃতন্ত্রের পায়ে পায়ে ঠোক্কর খেয়ে তার  বুকে যন্ত্রণার ঢেউ ওঠে আর জীবনের  গতিস্রোত ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়। আরও দূরের পাহাড়গুলো ঝরে যাওয়া প্রেমিকের মতো...  নেই তবু রেশময় শ্রীমান…

ভাইজ্যাগ ভোরের সমুদ্র কিন্তু পুরীর সমুদ্রের মতো নিলাজ খলবলে দাম্বালে নয়, উঁহু। সে খুব শান্ত ঘরের লক্ষ্মী সমুদ্র। সেই যে সমুদ্র মন্থনে অপরূপা লক্ষ্মীশ্রী লাজে শিমুলটি হয়ে উঠে এসেছিলেন, তিনি বোধহয় তাঁর নীল ওড়নাখানা ফেলে গিয়েছিলেন ভাইজ্যাগে, তাই সেখানকার সমুদ্র এত লক্ষ্মী। তার আবার প্রহরী আছে কড়া কড়া। অসংখ্য আধডুবো, পৌনেডুবো সাড়েডুবো পাথর তার তটের বুকে ছড়ানো। তাদের গায়ে আটকে থাকা প্রবাল ঝিনুক জীবাশ্মের গয়না। কালো থেকে নীল হয়ে সোনানীল ঝিলমিল হয়ে ওঠার গপ্পোটা অবশ্য সব জায়গায় এক।

কিন্তু পুরীতে যেমন সূর্যদেবকে হাঁটতে দেখেছিলাম, তেমন আর কোথাও দেখিনি। কালচে নীল ধূসর স্রোতে মন-জাহাজ দিব্যি ভেসে তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ চোখে ঝিকিমিকি লাগতে দেখি, মাথার উপর অনেক কটা সূর্য!! আসলে ব্যাপারটা কিছুই নয়, মাথার উপর অনেকগুলো মেঘ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রাত্রিশেষের দোয়াত ক্যানভাসে তাদের অত চোখে পড়ে নি কিন্তু যেই সূর্যের হৃদয় টুকরো টুকরো হয়ে ওদের পিঁজে যাওয়া ঝুলিতে গিয়ে পড়ল, মনে হল স্বয়ং সূর্যই বুঝি হেঁটে হেঁটে প্রাতঃভ্রমণ সারতে বেরিয়েছেন। সে এক দেখার…   না... আত্মীকরণের দৃশ্য।

এমন কত ভোর আটকে অথবা মিলেমিশে আছে আমার নীলকন্ঠ জীবনে... মধুর বিষের মতো তারা জ্বালা ধরায়। আমার মনকে দুটি ছুট রণপা ধার দেয়। বলে আমাদের কাছে এসো। তুমিই মাউন্ট আবুর ভোরের টিয়াপাখি, নৈনির প্রায়ভাঙ্গা চাঁদ, উদয় ভোরের ধূসর পাহাড়ের ঝিকিয়ে ওঠা কান্নার দলা। এসো, তুমি আমাদের দৃশ্যগুলোকে চিত্রিত কর...

আমিও ছুট লাগাই... কবে কোন ভোরে কোন ভূমিকায় ঠোঁটটি লাল করে নামভূমিকায় নেমে পড়তে হবে, কে বলতে পারে...  আমার শুধু ভোরাই যোজন ছুট আর ছুট...

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন