আলিঙ্গন
বুড়ি পিয়ালীর হাত থেকে ছিটকে গেছে পৃথিবীটা। মানে গোটা কমলালেবু একটা হাত
থেকে পড়ে হারিয়ে গেছে। এখন নাতি নাতনিরা মোবাইলে বুড়োবুড়ি সেজে দেখাচ্ছে
নিজেকে। পিয়ালীর মনে পড়ে বুড়ি হবার পঞ্চাশ বছর আগের কলেজ লাইফের কথা। সাহাবুদ্দিনের ছবি আঁকার হাত ছিল দারুন। পিয়ালীর রাক্ষস চরিত্ররা সাহাবুদ্দিনের হাতে
চমৎকার ফুটে উঠত। আর ওর শত্রুরা সবসময় আপস করে নিতে ওর সঙ্গে। আর ইয়ার্কি মারতে মারতে ডাগর পিয়ালীর বৃদ্ধমুখ এঁকে দেখিয়েছিল। পিয়ালীর কপট রাগ দেখিয়ে ওকে
মারতে গিয়েছিল। এতে করে একটু জড়াজড়ি করা হয়ে গিয়েছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোনো
উদ্দেশ্য ছাড়াই। যেখানে যেখানে মুখ ভেঙে গর্ত ও শেড পড়ার কথা অবিকল এখন সে ওরকম হয়ে গেছে। একটা ওভাল শেপের মুখ ছ’কোণা পেয়ে ঝুলে আছে। এমনকি
ডাবল চিনটুকুও স্বমহিমায় বিরাজ করছে।
পিয়ালীর পিছনে পড়ে থাকে বিউটি পার্লারের মহিলারা। তারাই যেন নিজের মেয়ে। তারা
মুখ ও ত্বক উজ্জ্বল করার হাজারো প্রজাপতি ডানার বাংলা খুলে বসে তার সামনে।
এইসব রাসায়নিক শক্তির চমৎকারিত্ব তার মুখস্থ হয়ে গেছে। হয়তো সে একদিন
সেলসগার্ল হয়ে
যাবে। একদিন প্রচুর টাকা হবে তার।
সাহাবুদ্দিনের সন্তানরা এখন তার বন্ধু। নানারকম সামাজিক যোগাযোগের সব কটা ক্ষেত্রেই জাঁকিয়ে বন্ধুত্ব করে রেখেছে। সাহাবুদ্দিনের বাড়িতেই কিদোয়াই স্ট্রিটে গিয়ে প্রথম গরুর মাংসের সিঙারা খেয়েছিল। অনেক কষ্ট করেও সাহাবুদ্দিনের যমজ মেয়ের একজন কেন আত্মহত্যা করেছিল, পিয়ালী জানতে চায় নি। ইচ্ছে করলেই সাহেবকে প্রশ্ন করতে পারত কিন্তু সেটাই আর করার সুযোগ পায়নি। সাহাবুদ্দিনকে শেষ দেখেছিল ঢকঢক করে একগ্লাস জল খাচ্ছে কেমন যেন দুর্বল হাতে। ছবিতে বেঁচে থাকা সাহাবুদ্দিন বিড়ালের পাশে, মোনোক্রোমে বেঁচে থাকা জন্মদিন, জানা গেল উঁচু সিলিংয়ের ফ্যানের মিষ্টি হাওয়া, কাঁচি-সিগারেট-আলুভাজা, কখনো ধুলো লেগেছে গায়ে বলে কান্না, আর ছন্দে ছন্দে বলে ওঠা 'আর পারছিনা গুরু / সেই নার্সারি থেকে শুরু' ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঐ চল্লিশে কিছু দিন ধরে পিয়ালীর অক্ষয়যৌবনজনিত রোগে ভুগে চলার সময় এল। তখন শরীরময় কিন্নরী কিন্নরী গন্ধ। দেখা হয়ে গেল যোগাযোগহীন সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে।
পিয়ালীর হাত ধরে হেঁশেলের মৎস্যমুখর যে কোন রন্ধন জীবন্ত যৌবনময় হয়ে উঠছে
তখন। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে যে কোন সময়ে সাহাবুদ্দিনকে চিনে ফেলা যায়।
পীয়ালী
এক সেকেন্ড হাত ধোবার জায়গায় বেসিনে ধুতি পাঞ্জাবি পরা সাহাবুদ্দিনকে
দেখল তারপর ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল আর করমর্দন করার মধ্যে জ্বলে উঠল পুরনো আগুন।
দুজনের জগতের মধ্যে কত পার্থক্য! একজন নামী প্রতিষ্ঠিত অধ্যাপক। অন্যজন বৃহত্তর
রন্ধনের জগতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে।
এই জড়িয়ে ধরাটা ছিল একটা বোকা মেয়ের বিশেষত পয়সা না চেনা বোকা মেয়ের খাঁটি আন্তরিকতা। সঙ্গে ছিল চিৎকার ‘আরেঃ তুই!’ পর মুহূর্তেই পিয়ালী ওকে ছেড়ে
চারপাশে তাকায়। সে বলে 'এই যে সাবিত্রী, এই আমার দুই যমজ মেয়ে সহেলী আর
পিয়ালী।' সাহাবুদ্দিনের দাঁড়ি গোঁফময় মুখে লেগে আছে চাপা হাসি।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন