উদ্ধারণপুরের
ঘাট
মিলনের নাম রতন বা বঙ্কু অথবা আজিজার হলেও কিছু এসে যেত না! নামে
কিইবা এসে যায়! অমর দাস, বিল্টু! উদ্ধারণপুরের বোস পাড়ার কোণের একটেরে বাড়িটায় থাকতো।
মাত্র সতেরো তখন! সাঁতার কাটতে গেল পুকুরে৷ আর উঠলো না। অথচ সে তো অমর! ধর ঝিলমিল। নবীন স্যারের একমাত্র
কন্যা। সে রাতে কী ঘটেছিল জানা যায় না! ঝিলমিল আর ঘর থেকে বেরোতো না। দরজা, জানলা বন্ধ।
সারাদিন মুখ কালো করে বসে থাকতো। তারপর এক মহালয়ার ভোরে যখন সবাই বীরেন্দ্রকৃষ্ণতে
ব্যস্ত, চলে গেল! অথচ নাম ঝিলমিল। উদ্ধারণপুর নামটাই ভাবো! সেখানে মানুষ উদ্ধার হতেই আসে৷ আশপাশে কোথাও যখন জল থাকতো
না, উদ্ধারণপুরের ঘাটই ছিল ভরসা। উদ্ধারণ দত্ত বলে কি আদৌ কেউ ছিলেন? তিনি কি নিত্যানন্দের
কেউ ছিলেন? শ্রী চৈতন্য কি এখানে এসেছিলেন? গীতগোবিন্দ লেখার সময় কি জয়দেব এখানে আসতেন?
অবধুত এই ঘাট নিয়েই তো লিখেছিলেন! এখন ইলেকট্রিক চুল্লীর সময়। তবু এদিক ওদিক তান্ত্রিক বৈষ্ণবদের
আনাগোণা! এখানে আসলে কি সত্যি মানুষ উদ্ধার হয়ে যান? হয়ত ‘যায়’, নইলে ঝিনাইদহের
মিলন তার বিধবা বৌদিকে সাথে করে কাঁটাতার টপকে এতদূরেই কেন? সেটা ১৯৭০ সাল! সেখানে
ঠিক কী পরিস্থিতি ছিল! অবৈধ প্রেম
না’কি মুক্তিযুদ্ধ, দেশত্যাগের কারণ? না’কি স্রেফ সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে মানসিক
নির্যাতনের শিকার! অথবা উপার্জনের খোঁজে যেভাবে ছোটদেশ থেকে বড়দেশে মাইগ্রেট করে
লোক? সে অবশ্য প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা! তারপর ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী... যেভাবে
বুনো গাছ ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত!
সাঁতরাগাছির ঝিলে আর পরিযায়ী পাখি আসে না। আগে আসতো! কোন সুদূর
সাইবেরিয়া থেকে উড়ে উড়েই আসতো তারা। কেন আসতো? খুব ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতে? মিলনও হয়ত
একদিন এভাবেই! কিন্তু ক’দিন হল তার খুব শীত করে, কুঁকড়ে যায়, ভয়ে হাত পা গুটিয়ে আসে! ওই
যবে থেকে এন আর সি ভুত মাথায় ঢুকেছে! সারা
সকাল ধরে উদ্ধারণপুরের ঘাটে বসে সে কথাগুলোই ভাবছিলো মিলন। ক’দিন একনাগাড়ে বৃষ্টি
হয়! তার মধ্যেও ভোটার তালিকা সংশোধনীতে নাম তুলতে গেছে, ডিজিটাল রেশন কার্ডে লাইন
লাগিয়েছে... কিন্তু সে সবই তো এখনকার তথ্য, ১৯৭১এর আগের? না’কি ১৯৪৯এর?
কত লোক কত কীই বলে! মাথা গুলিয়ে ওঠে। আটষট্টি বছরের বুড়ো মাথা অত নিতে পারে? তাই
ভরা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই ও নৌকো পারাপার দেখে! পূণ্যার্থীরা ঘাট পেরোচ্ছেন! ঘাটের
সিঁড়িতে মাথা ছোঁয়াচ্ছে! মিলনের কেবল পেটের মধ্যে হাত ঢুকে আসে। শীত খুব! এই কী তবে
সাইবেরিয়া?
শরীরের ভেতর কেমন অস্বস্তি! পেট গুলায়। ভয়
কাটাতে বাকি পূর্ণাথীদের মত সেও জলে নামে ততক্ষণে লুঙ্গি ভেসেছে পেচ্ছাবে! অপবিত্র
হল ঘাট? পায়খানাও করে ফেলে... উদ্ধারণপুর না’কি গোটা ভারতই অপবিত্র! ডুব
দিলে বুদবুদ ভেসে ওঠে, মিলন আর ওঠে না! হয়ত উঠবে... কিছু দূরে... আর নৌকো করে অন্য
পূণ্যার্থীদের মত সেও পার হবে নদী! আর তথ্য লাগবে না! শীত নেই! সাইবেরিয়া থেকে সে
এখন মুক্তির আনন্দে... উদ্ধারণপুরের ঘাট
পার হচ্ছে...
ওঃ এই মুক্তির আনন্দ অনেকেই পেয়েছেন আরো অনেকে পাবেন
উত্তরমুছুন