কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৯

তুষ্টি ভট্টাচার্য




পদাবলি - ১০



(আমি-- আমি সামান্য শখের কলমচি। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি আর কী! আমার লেখার পাঠক খুবই কম যদিও। বড় বড় সাহিত্য সভায় আমাকে পাবেন না। পুরস্কারের বদলে তিরস্কারই পাই বরং। মনের দুঃখে ইচ্ছে জেগেছে পদাকে নিয়ে লিখতে। যদি যুগান্তকারী কিছু লেখা হয়ে যায়, অন্তত পদার নাম করে।
পদা— পদাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমারই বয়সী বলে ওকে আমার বন্ধু ভাববেন না। গরীব নয়, কিন্তু গরীব সেজে থাকে। বিচ্ছিরি রকম ড্রেস সেন্স, হয় পাজামার ওপরে টিশার্ট, নয় লুঙ্গির ওপরে ফুল শার্ট! আর পায়ে হয় কাপড়ের জুতো নয় প্লাস্টিকের চটি। সময়ে, অসময়ে হুটহাট আবির্ভূত হয়। আমাদের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। কথাবার্তার টপিক বিবিধ ভারতী থেকে বিলিতি আমড়া পর্যন্ত। গায়ে পড়ে এসে পিত্তি জ্বলানো কথা বলে। আমিও মাঝেমাঝে ওকে কিছু নিরীহ প্রশ্ন করে থাকি।
মাদাম তুভোঁ— আদপে ফরাসী হলেও এদেশের বাসিন্দা, রঙ জন্মসূত্রে সাদাই ছিল। এখন তাঁর তামাটে মোটা চামড়ায় খসখসে খড়ির দাগ। অত্যন্ত নাক উঁচু টাইপের। এবং জ্ঞানদা। এঁর কথা অর্থাৎ বাণী না শুনলে আমার আর পদার সম্পর্কটা ঠিক খোলসা হবে না। ইনি সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় এসে বাণী বিতরণ করে আমাদের আরও বিপাকে ফেলে প্রস্থান করেন।)
ওদিকের পাড়ার হুলো থেকে নেতারহাটের কালু, দমদমের মুনিয়া থেকে রাজাবাজারের আখতার, লেকটাউনের ববি থেকে গড়িয়ার টিনি, যে পারছে একটা ওয়েবম্যাগ খুলে ফেলছে ডোমেন ধার করে। লেখক/কবিরা তাতে পঙ্গপালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে লেখা দিয়েই চলেছে। ফলে এই ইম্যাগগুলোর আজকাল এফবিতে খুব বাড়বাড়ন্ত। এরমই এক ইম্যাগের হোতা একজন এবার আমায় শিখণ্ডী দাঁড় করিয়ে দিল, থুড়ি সম্পাদক বানিয়ে দিল। আর আমিও অতি উৎসাহে লেখা ‘সংগ্রহে’ মন দিলাম। যদিও 'সংগ্রহ করা' কাকে বলে আমি বুঝি না। কারুর নতুন বই বেরলেই দেখি, সবাই বলে সংগ্রহ করব। কীভাবে করে? কিনব বা পড়ব বললে নাহয় কিছু বোঝা যায়। শুভেচ্ছা বা অভিনন্দন জানায় যারা, তারা যে কিনবে বা পড়বে না সেও বোঝা যায় দিব্যি। কিন্তু এই সংগ্রহ করব শব্দটাকে বেশ সন্দেহজনক লাগে। মানে কী বা কীভাবে করে, কে জানে! যাই হোক, এই সম্পাদকের কাজটা বেশ ঝামেলার নিঃসন্দেহে। তবে সবথেকে রাগ হয় স্পেস সামলাতে। হাজার বার বললেও লেখক/কবিদের কেন যে ঠিকঠাক জায়গায় স্পেস দেন না বুঝি না। রেগেমেগে তাই একবার বলেই ফেললাম—ওরে! কতবার বলেছি...শব্দ আর যতিচিহ্নের মাঝে কোন স্পেস হয় না। যতিচিহ্নের ঘাড়েই আবার লিখবি না! এইখানে স্পেস দে! কে শোনে কার কথা! এইরকম অবস্থায় কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে হাজির হল পদা। এসেই বিনা ভূমিকায় আক্রমণ শুরু করল।
‘কী সব লিংক ছ্যারাচ্ছিস দেখছি কাল থেকে! তুই না মহান, মহত্তম লেখক/কবি! শেষে লিংক পিটিয়ে বাজার করতে হছে! ছ্যা ছ্যা!’
কেমন মাথার অবস্থা হয় এই হিংসুটেদের দেখলে! আমিও ছাড়বার পাত্রী নই-
‘হ্যাঁ রে পদা, পৃথিবীর সব হিংসুটেরা তোর মতো দেখতে কেন হয় রে?’
বুঝলাম খুব রেগেছে! বলল-
‘হিং দেওয়া কচুরি খেয়েছিস? না খেলে বলিস আমায়’।  
আমিও শুঁটি চিনি, গুটিয়ে থাকা জানি, বেরিয়ে আসাও জেনেছি। কেন জানি হঠাতই মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেল পদার কথা শুনে। তাই সবাইকে প্রকাশ্যে বলছি-
‘পদার মতো হিংসুটে প্রেরণা যদি না থাকত, আমি লিংক কেন, একটা মাছি বা মশার উৎপাত থেকেও রেহাই পেতাম না। ভাগ্যিস তুই ছিলি রে পদা!’
আমার এহেন উক্তিতে সে যে খুব বিগলিত হল, এমন না। বরং মুখে একটা তেতো খাওয়ার ভাব তুলে বিদেয় নিল।


এই ভাদ্র শেষে বেশ একটা নিটোল শ্রাবণ দিন পাওয়া গেছিল সেদিন। সঙ্গ দিল একটা নধর, তুলতুলে, আহ্লাদে ইলিশ। ভাজা, বেগুন ঝোল, ভাপা, তেল ইত্যাদির পরে হাতে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে চোখ অটোমেটিক জড়িয়ে এল। তারপর দেখলাম এক অথৈ নদীতে খলবল করছি আমি। পাশাপাশি শুধু শব্দ আর অক্ষর। আর শব্দ ও যতিচিহ্নের মাঝে ফাঁক দেখলেই জমিয়ে বসে পড়ছে একেকটা ঢ্যাবা চোখো ইলিশ। সে তাড়ালেও যায় না, খোঁচালেও নড়ে না। এদিকে ওই স্পেস ভর্তি ইলিশগুলো আর ওদিকে দেখি ভুল 'কি' দিয়ে তালা খুলছে কারা যেন আমার গেটের। এই কে রে?? বলে যেই তেড়ে গেছি, দেখি...আবার কতগুলো টাকলু, ভিলেন গোছের ইলিশ। স্বাদ যে ভাল হবে না সে চেহারা দেখলেই মালুম হচ্ছে। তারা আবার আমায় দেখে বলল, দীর্ঘ করবেন না স্যার! 'ই' হ্রস্বই ভাল। এইসব দেখেশুনে ঘুম তো চৌপাট প্রায়। মনে মনে বললাম, মা গো মা! আমি সম্পাদক হতে চাইনি, বিশ্বাস করুন! একটা নধর ইলিশ হয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম শুধু। যাকে আমিই কাটব, ধোব, রান্না করব। আর একাই খাব পুরোটা। সে আর হল কই! বদলে এই স্পেস ভর্তি করতে থাকা ইলিশ আর ভুল কি হাতে ধরা টাকলু! ছ্যা!!
স্বপ্নের ঘোর কাটাতে ফেসবুক খুলে স্ক্রল করছি আপন মনে। এ কী রে বাবা! যতই এগোই, গাল, গলায় ব্যান্ডেজের মতো মাস্ক পরে একেকজন মেয়ে হাজির হচ্ছে। আর তারপরেই ওই ব্যান্ডেজের দৌলতে গাল, গলার মেদ কমে দ্বিগুণ সুন্দরী তিনি! এদ্দিন ছিল ভুঁড়ি নিয়ে মাথাব্যথা। এরপর হয়ত কোনদিন দেখব, মমির মতো সারা শরীরে ব্যান্ডেজ করে মেয়েরা রোগা হচ্ছে। কী দিনকাল পড়ল রে পদা!! পদা বলল, ‘তুই মোটা বলে রোগা হতে বলছে ওরা। অন্যায় তো কিছু বলেনি। এই দ্যাখ না, আমায় যেমন মোটা, চাঙ্গা, তাগড়াই হতে বলে বারবার কয়েকটা হুমদো মতো রাক্ষস। আমি কি মোটা হয়ে যাব তাই বলে? বেশ আছি বাবা! তাচ্চেয়ে তুই এট্টু রোগা হ’।
এই জন্যই ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই না। শুধুশুধু রাগিয়ে দেয় আমায়। এদিকে বিশ্বকর্মা পুজোর নেমন্তন্ন খেয়ে এসে পদা খুব জোরে জোরে ঢেঁকুর তুলছে। দাঁত খিচিয়ে বললাম,
‘তা এখানে এসেছিস কেন? যা যা, বাবা বিশ্বকর্মার কাছে যা!’ দাঁত বের করে পদা বলল,
‘রাগ করিস না। পুজো এসে গেল। শপিং টপিং শুরু কর। আর দেখেছিস কী নোংরা তোর ঘরদোর…ছিঃ! সব সাফাই করে ফেল জলদি জলদি। নইলে মা দুর্গা এসে রাগ করবে’।
‘পঁচা, পূঁজা, পাঁপড়ি--এইসব প-এ চন্দ্রবিন্দু দেখলে পুঁজগন্ধ পাই। আর দূর্গা দেখলে দীর্ঘ উ গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে। পুজো এসে গেল আবার! নাটক করিস না তো! পালা এখন’।

বাটি হইতে নির্গত হইবার ক্ষণেই পদা মাদামের সম্মুখীন হইল। ফলে পলায়ন লাটে উঠিল তাহার। ছাতার বাঁট তাহার ঘাড়ে আঁকশির প্রায় লটকাইয়া মাদাম কক্ষে উপস্থিত হইলেন। আজ বুঝিলাম কাহারও রক্ষা নাই! কণ্ঠ শুষ্ক হইয়া আসিল। জল পান করিবার নিমিত্ত যে উঠিব, সে সাহস বা ক্ষমতাও আর রহিল না মাদামের রূপ দেখিয়া। রক্তচক্ষু হানিয়া মাদাম আমাকে, হ্যাঁ, আমাকে উদ্দেশ্য করিয়াই প্রশ্ন ছুড়িলেন—তা কী নিয়ে কথা হচ্ছিল শুনি? আমি কিঞ্চিৎ তোতলাইয়া কোনক্রমে জবাব দিতে পারিলাম—আজ্ঞে পু…পু…পু… আবারও ধমক খাইয়া চুপ করিয়া গেলাম। মাদাম এক নিঃশ্বাসে বলিয়া গেলেন, ‘বুঝেছি পুজোর বাজার নিয়ে ঘোঁট পাকাচ্ছ তোমরা। এই তোমরা, মানে এ যুগের নব্যরা শুধু পেতেই শিখেছ। বাস্তবটা কী জান? তাহলে শোন আমার অভিজ্ঞতার কথা। যাকে বলে আঁখো দেখা হাল। বাবাকে ছেলেমেয়ের মা দামী ব্র্যান্ডেড শার্ট কেনার জন্য পীড়াপীড়ি করছে। বাবা দাম দেখে প্রায় মূর্চ্ছা যায় আর কী! কেন রে বাবা! ওই দামে দুজনের স্কুলের একমাসের মাইনে দেওয়া যাবে। ব্র্যান্ড দিয়ে কি ধুয়ে জল খাব? মায়ের শোকেসে ঝোলানো একটি শাড়ি খুব পছন্দ। দাম শুনে তিনি দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। জিজ্ঞাসা করলে স্বামীকে বললেন, ধুর, ধুর! সামনে থেকে জঘন্য লাগছে। সেই তাঁরাই আবার ছেলেমেয়ের জন্য মহার্ঘ্য জামা কিনে দিলেন। আমি অন্তত একে স্নেহ বা ভালবাসা বলতে পারলাম না। ওঁরা আদপে প্রশ্রয় দিয়ে ছেলেমেয়ের মাথা খাচ্ছেন। নিজের অবস্থান জানিয়ে না দিলে পরবর্তী কালে ওদের দাবী বাড়তেই থাকবে। একটি, দুটি সন্তান বলে আজকাল বাবামায়ের তাদের নিয়ে যা আদিখ্যেতা দেখি, খুব রাগ হয়। হয়ত এই জন্যই নতুন প্রজন্ম ল্যাদখোর, পরিশ্রম বিমুখ। তারা রুটি তরকারি, ভাত ডাল খেতে লজ্জা পায়। দোকানের খাবার না হলে স্টেটাস বজায় থাকে না। জানে, সব তো না চাইতেই পেয়ে যাব। যাক গে! আমার রাগে কী যায় আসে!’


এই পর্যন্ত বলিয়া মাদাম অকস্মাৎ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। সম্ভবত ক্রোধ নিবৃত্তি হইয়া ঝিমাইয়া পড়িয়াছেন। পদা এই সুযোগে চম্পট দিল। আমিও কালবিলম্ব না করিয়া মাদামকে এক বড় প্লেট ভরিয়া মিষ্টাদি দ্রব্য আনিয়া দিলাম। মাদাম মনোযোগ সহকারে সবগুলি সাবাড় করিয়া ওইখানেই কুণ্ডলী পাকাইয়া শুইয়া পড়িলেন এবং গভীর নিদ্রায় ডুবিয়া যাইলেন। ঘুমন্ত মুখের মানুষকে আমার দেখিতে বড়ই ভাল লাগে। বোধকরি ঘুম হইতে নিষ্পাপ আর পৃথিবীতে কিছুই নাই।








0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন