কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৯

ফুয়াদ হাসান




কাঁটাতারে কারাগারে 

প্রথমে কোনটি দেব, দুঃসংবাদ না সুসংবাদ? আচ্ছা, আনন্দের খবরই দিই।
কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছ,
তার দু’দিন সগে মৃত্যু হয়েছে তোমার বাবার।
এফএম রেডিওতে কে যেন গাইছে, ‘ফুল নেবে না অশ্রু নেবে...’

*
নতুন নাগর পাইছস তয় হাছাই; ছডা মাস ধইরা কোনই খোঁজ-খবর নাইক্কা!
  সবুর ল, খালি একবার বাহির হইয়া লই, তোরে আমি কুত্তারে দিয়া...

সেই থেকে কুকুরটা অপেক্ষায় বসে রয়েছে, শুকিয়ে চৌচির, মুখ বেয়ে পড়ছে লালা!

*
চাইনিজ তালায় বন্দি টিনের ট্রাঙ্কের সাথে ডাণ্ডাবেড়ির মত শিকল লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে বাইশপাড়া হেফজ করা আটবছরের রোগা ঠ্যাঙে, ট্রাঙ্কের ওপর আধমনি পাথর আর ভেতরে নকশা করা ছেড়া কাঁথা, বকরি ইদের শুকনো  গোশত,
  মিষ্টি বড়ই আচার, লুঙ্গি পেঁচানো ঝাপসা হওয়া সাদাকালো মায়ের ছবি, বড় হুজুরকে কেও না বললেই হয়!

*
এখানে সকলে ধার্মিক বনে যায়
রবি ঠাকুরের মত দাড়ি রেখে দেয়
ছিঁচকে চোরের দল, যত বাটপার
ছিনতাইকারী; ধর্ষকের কাহিনী
দেখে মনে হয় এই তো কদিন হলো
পাক-স্থান হতে হজ্ব সেরে এসেছেন,
বখাটে জুয়ারি রাতভর সিজদায়
ভণ্ডের শেষ হতে চায় না নামাজ
ডাকু সর্দার দেখ কাঁদে মুনাজাতে
খুনির চোখে এ কেমন গ্লানির জল।
এখানে ওসব ছাড়া কী করার আছে!
       
*

এটা ভালো মানুষের জায়গা নয়,
সব ভালো লোক বাইরে,
তোমাদের ওখানে
মানে অন্য পৃথিবীতে;
এখানে যত খারাপের দল।
তুমি নির্দোষ কাওকে খুঁজে পাবে না এখানটায়
যদি পাও
তবে তার নাম ভুল কিংবা
একই নামের অন্য কারও সাজা ভোগ করছে
         
*
দেখেছি অনেক প্রহরীকে
আততায়ী হয়ে যেতে
দেহরক্ষী হয়েছে হন্তারক
তবু তোমাদের মাঝে এ-কেমন
পাহারাদার পোষার শখ
   
*
জেলগেটের মরচেপড়া গারদ ধরে প্রতিটাদিন এসে দাঁড়িয়ে থেকেও চেনা মুখটি আর দেখতে পায় না  কোনভাবে, তবে কী নেই সে -- পলাতক, গুমের ঘুমে --  মুক্তি পেয়ে গেছে চিরদিনের জন্য।
প্রধানতম ফটকটির কালচে মোটা দেয়ালে কেন যে লালরঙা গ্রাফিতি এঁকে গিয়েছিল, কী বা তার মানে, চোর-ছেঁচড়, রাষ্ট্রদ্রোহী, গুপ্তচরদের ভিড়ে  সে খবর কেউ খোঁজ করেনি।

*

প্রশস্ত দেয়ালে ঝুলছে -- এখানে চিকা মারা নিষেধ, পাশেই / সিনেমার পোস্টার -- বিচার হবে, নায়ক দাঁড়িয়ে আছে / বানানো কারাগারের শিক ধরে কয়েদির জামা পরে।
ভেতরে বিশেষ ভোজ, ইদ এনে দিয়েছে এ কেমন আমেজ, /--স্বজনহীন নামাজের পর চোর-পুলিশের কোলাকুলি হলে / ভোজবাজি, বিশইঞ্চি সাদাকালো টিভিতে রঙিন ঢেউ -- কারাঘরে
কখনও দর্শক চোখ লালায়িত, নিমেষে গম্ভীর, অশ্রুসিক্ত / কেউ বলছে অযথা চিৎকার করে -- 'পালিয়ে যা'; কড়া করতালি!  / জেল ভেঙে নায়কের পলায়ন বন্দিদের উৎসাহিত করে!
 
*

কারাগারে অলিন্দ নেই,
কয়েদিদের মত সশ্রম কারাদণ্ড
খাটে জেলের জেলার -- যাবজ্জীবন
বন্ধ প্রধান ফটক -- সর্বক্ষণ, গারদের
গরাদ ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে প্রহরীগণ
 
*

মাত্র ঊনত্রিশটা দিন, তাই বদলে দিয়েছে সবকিছু / অতঃপর কেউ আর বিশ্বাস করছে না, প্রেমিকার / সন্দেহবাতিক থাকে তাই বলে আত্মীয়-বন্ধুরা! / দেখতে পেয়েও কেমন অপরিচিতদের মতন / সটকে পড়ছে ছোট করে আলাপচারিতা, কী আর বলবো / মা-বাবা, ভাই-বোন -- সেই চোখগুলোও কেমন অচেনা / জেল খেটে ফিরে এসে কিছু আর আগেকার মত নেই।
*
নো মেন্স ল্যান্ডে কিছু নেই
ধূসর কাঁটাগাছগুলো
এক-একজন
সশস্ত্র সৈনিক

*

দিন কেটে যাবে,
এই তো কদিন,
দেখতে-দেখতে
কেটে গেল পাঁচ পাঁচটা বছর
দিন কেটে যায়,
দেখো চলে যাবে
চোখের পলকে -- পুরো এক যুগ
দিন কেটে যাবে,
এ আর এমন কী -- এক জীবন
*

পায়ুপথে পঞ্চাশ টাকার
পুরনো নোটটি
লুকিয়ে রেখেছিল
এমন একটি দিন আসবে বলে
বাংলা সাবান মেখে
খসখসে খুর দিয়ে
দাড়িগোঁফ পরিষ্কার করে দেয়
জেলের নাপিত
তিনবছর পর
বৌটার সঙ্গে দেখা হবে --
'চিট্ঠি আইয়ি হে...'

*

সন্ধ্যা পার হতে লাইট অন্ধ
সেলের শিকে লাঠি ঠেকিয়ে
মাথা নামাও, মাথা নামা...
বলে চিৎকার করে গার্ড
শীতের মত দীর্ঘ রাত
এক কম্বলে দুজন
এখানে অপরাধ
একটি মাথা ভূপাতিত
সারারাত জেগে রয় অন্যটি

*

ভেতর থেকে দিনরাত কী যেন খনন করছে কেউ
চতুর্দিকে টিকটিকি, না পারছে ধরে আনতে সেও
ধ্যানীবকের সাজে বিড়াল বসে রয়েছে আবছায়ায়
দিগভ্রান্ত আহত এক ইঁদুর -- সেও পালাতে চায়।

*

সব শালাকে শেষ করে ফেলবো
একটাও মানুষের জন্ম না
দুই পায়ের জানোয়ার
জাতসহ অমানুষ
হারামজাদা
শুয়োরের বাচ্চাগুলোকে
কুকুরের মত মারবো
এত ভয় কীসের
একটা খুনের শাস্তি যা
একই তা সহস্র খুনের

*

অন্ধকারে নিরিবিলি একা ঝিম ধরে
বসে থাকে, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেও
উত্তর দেয় না, ভ্যাপসা কারাকক্ষে শুধু
একটা আগুনে অারেকটা সিগারেট টানে...
ফাঁসির আসামি, স্ত্রীকে খুন করে নিজে
ধরা দিয়েছে থানায়! গত তেরোমাসে
দেখতে আসেনি একজনও, আর কটা দিন
বাকি ছিল, তাও সহ্য করতে পারলো না সে

*

টপকানো যায়
দেয়াল -- যত উঁচু হোক,
কাঁটাতার নয়

*

ব্যারিকেড ভেঙে সামনে
এগোলাম, একটিবার
কোন বাধাই মিললো না
পাথর ছুড়ে ফুটো করে
দিতে গেলাম নন্দিত
নেতার গাড়ি, তাঁরা দেখি
টুঁ-শব্দটি করল না
চোরের মত ফাঁড়িটির
সামনে দিয়ে আসলাম
গেলাম -- ছুঁয়ে দেখলো না
শহরে শেষ পাহাড়ের
কোথা থেকে তোমার ভেজা
ঘামমাখা ঘ্রাণের মত
পুরাতন একটি সুর
থেমে থেমে ভেসে আ সছে
খুঁজতে গিয়ে -- বন্দি






0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন