কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৯

পারমিতা চক্রবর্ত্তী




দেবদাসী 




পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রথা দাসপ্রথা । দাসত্ব বা দাসপ্রথার নামান্তর দেবদাসী  নারীদের নিয়ে একপ্রকার ব্যবসা চলে আসছে বহুযুগ ধরে। সেই ব্যবসায় আজও  ভাটা পড়েনি। অবাধে চলেছে। বেশ্যাবৃত্তি শুধুমাত্র নারীর জন্য ধার্য ছিল। এই  প্রকার ব্যবসায়ের মূলধন নারী। পৃথিবীতে সব থেকে আদিমতম প্রথা বলে যদি কিছু থাকে তা হল দাসপ্রথা। এই ইতিহাস মানুষকে বুঝিয়েছে দাসত্বের গ্লানি।  দেবদাসী সেই প্রথার নামাঙ্কমাত্র। দেবতার দাসত্ব করতেন যে নারী তিনি দেবতার দাসী অর্থাৎ দেবদাসী। তবে দেবতার নাম নিয়ে পৃথিবীতে যত অন্যায় হয়েছে, তা মানুষকে নিয়ে হয়নি। কীভাবে এই দাসপ্রথার প্রচলন হয়েছে, কীভাবে তা ব্যাপকতা লাভ করেছে, তার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানা যায়নি।

দেবদাসী বাস্তবিক পক্ষে পতিতারই এক শর্করামন্ডিত সংস্করণ বলা যায়। দাসপ্রথা এসেছে ইতিহাসের ঊষা মুহূর্তে। মানুষ যে দিন শিকার ও ফলমূল  আহরণ ছেড়ে জমি চাষ করতে শিখেছিল, যাযাবরবৃত্তি ত্যাগ করে গড়ে তুলল জনপদ ।  

ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাজপুরোহিততন্ত্র তখন থেকেই দাসপ্রথার শুরু। বিজয়ী রাজা বিজিত রাজ্যের মানুষকে নিয়োগ করতেন দাস রূপে। পুরুষকে বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমদানে এবং নারীকে বিনা প্রতিবাদে দেহদানে বাধ্য করা হত।  সময়ের মাপকাঠিতে দেখলে দেখা যায়, পতিতাবৃত্তি দাসবৃত্তির চেয়ে প্রাচীন।  



কোনও কোনও প্রাক-মানবজীবকে (Primates) যৌনতা বহির্ভূত প্রয়োজনে (non-sexual purpuses) যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হতে দেখা যায়। স্ত্রী-শিম্পাঞ্জী বা স্ত্রী- বেবুনকে দেখা গেছে খাদ্যের প্রয়োজনে পুরুষকে আকৃষ্ট করতে। মানুষজাতির ক্ষেত্রেও তা বিচিত্র কিছু নয়। দেহদানে পুরুষকে সন্তুষ্ট করার পর পুরুষ যখন তৃপ্তি ও ক্লান্তিতে হাঁপাতে থাকে, তখন পুরুষজন্তুর সংগৃহীত খাদ্যে নারী ভাগ বসায়। সুতরাং স্ত্রীলোকের পক্ষে আহার্য সংগ্রহ মানসে (যা নাকি পতিতাবৃত্তির মৌল প্রেরণা) দেহদানের প্রচেষ্টা ‘মানুষ’ নামক জীবের চেয়ে প্রাচীন - প্রাক্  মানব জীবদের ঐতিহ্যবাহী। যুগ যুগান্ত ধরেই এমন ধারণা চলে আসছে। একটা বিষয় বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, তা হল সভ্যতার ঊষা লগ্ন থেকে এই দেবদাসী  প্রথা দেখা যায়, তা রাজতন্ত্রকেন্দ্রিক নয়, বরং পুরোহিতকেন্দ্রিক। রাজপ্রাসাদে  সর্বদা দেহদানে  প্রস্তুত উপপত্নী, দাসী বা গণিকা এমনটা অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু মন্দিরে তাদের দেখা যায় কেমন করে? এবং এই দেবদাসীদের দেখা শুধুমাত্র একটি সভ্যতায় নয়, প্রায় প্রতি সভ্যতায় এদের দেখা গেছে। আর চূড়ান্ত বিস্ময়  হল - এরা পতিতা নয়। দেবতার নামধারী কিছু মানুষের পুজোর ফুল। কারণ ‘পতিতা’ শব্দের অভিধানিক অর্থ ‘অর্থের বিনিময়ে যে দেহদান ব্যবসায় লিপ্ত’।   এরা পতিতা নয় তিনটি যুক্তিতে, প্রথমত - এরা অর্থের বিনিময়ে মন্দিরে দেহদান  করত না। দ্বিতীয়ত - এরা সামাজিক বিধান মেনেই মন্দিরে সমবেত হত। এবং তৃতীয়ত - মন্দির থেকে দেহদান করে বেরিয়ে এসে নির্বিবাদে সমাজে মিশে যেত - কারও স্ত্রী, কারও মা হয়ে সুখে জীবন অতিবাহিত করত।  

এই প্রাচীনতম প্রথার তিনটি প্রকারভেদ লক্ষ্য করা গেছে। প্রথম প্রথায়, যৌবন উদগমের পর কুমারী অবস্থায় তাদের মন্দিরে যেতে হত আদিরসের প্রথম পাঠ  নিতে - মাত্র এক রাতের জন্য। দ্বিতীয় প্রথায়, তাদের মন্দির চত্বরে বেশ কিছুদিন যৌনজীবনের আদিপাঠ নিয়ে অভ্যস্ত হতে হত - কোথাও কয়েক সপ্তাহ, কোথাও বা কয়েক মাস। দুটি ক্ষেত্রেই মন্দির থেকে ফিরে তারা বিবাহ   করত। সমাজে কারোর কোন আপত্তি থাকত না। কারণ ব্যবস্থাটি ছিল সার্বজনীন। আজকের সতীত্বের ধারণায় এই ধারণাকে আমরা মানতে পারব না।  মানে সমাজে এখনও এটা প্রচলিত হয়নি। এক্ষেত্রে লেখার সাথে সামাঞ্জস্য রেখে বলি - পশ্চিমখন্ডে ডেটিং একটা স্বীকৃত প্রথা। বয়ঃপ্রাপ্তা হলে মেয়েরা পুরুষবন্ধুদের সঙ্গে সান্ধ্যভ্রমণে যায়, ফিরে আসে রাত করে। নির্জনে তারা কী করে, কেউ জানতে চায় না। শুনেছি সে দেশে মায়েরা এই পর্যায়ে মেয়েদের পিল  খেতে শেখায়। এই সার্বজনীন সামাজিক ব্যবস্থাটি সেখানে স্বীকৃত। ভারতীয় সমাজ এতটা অগ্রসর নয়। তবে এখন আমাদের সমাজে স্ত্রীকে কোনও গাইনোকলোজিস্টকে দিয়ে পরীক্ষা করাতে কোনো স্ত্রী লজ্জায় মুখ লুকোয় না।



তৃতীয় প্রথায়, কুমারী মন্দিরে যায়, আর ফিরে আসে না। সারাজীবনের জন্য দেবদাসী হয়ে যায়। প্রথম প্রথাটির প্রাচীনতম নিদর্শন হেরোডোটাস-এর বর্ণনায় পাওয়া যায়। ব্যাবিলনের মিতিল্লা মন্দির প্রসঙ্গে ইতিহাসকার লিপিবদ্ধ করেছেন – “ব্যাবিলোনীয়দের মধ্যে একটা লজ্জাকর প্রথা আছে। ব্যাবিলনের প্রতিটি রমণীকে জীবনে একবার অন্তত (রতি) মন্দিরে উপস্থিত হতে হবে এবং মন্দিরের অলিন্দে সার দিয়ে বসতে হবে। অজানা অচেনা পুরুষদল ঐ অলিন্দ দিয়ে  পদচারণা করবার অবকাশে রমণীদের ভিতর এক একজনকে পছন্দ করে তার কোলে একটি রৌপ্যমুদ্রা ফেলে দেবে। কে দিল, তা ফিরে দেখবার অধিকার মেয়েটির নেই। যে তাকে পছন্দ করল তার হাত ধরে মেয়েটিকে চলে যেতে হবে মন্দির চত্বরের বাহিরে নিভৃত নিকুঞ্জে। সেখানে সেই অপরিচিতকে সন্তষ্ট করার মাধ্যমেই মেয়েটি রতিদেবীর প্রাপ্য অর্ঘ্য মিটিয়ে দেবে। তারপর সে ফিরে যাবে নিজের সংসারে, সংসারধর্ম করতে। ঐ প্রথম রাতের পর আর কোনভাবেই মেয়েটিকে সতীত্ব থেকে টলানো যাবে না”।

গ্রীসের ইতিহাসে দেবদাসীর উল্লেখ পাই নানাভাবে। চিরতরুণ সূর্যদেবতা এ্যাপোলোর মন্দিরে সর্বত্রই দেবদাসী নিযুক্ত ছিলl লক্ষ্য করলে দেখা যায় এর পূর্বে ও পরেও সর্বত্র সূর্যদেবের দেবদাসী নিযুক্ত করা হয়েছে। গ্রীসের মন্দিরবালাদের বলা হত Hierodule। এদের দেখা যেত গ্রীসের প্রতিটি  দেবমন্দিরেই। গ্রীস সভ্যতার পর রোমান সভ্যতাতে দেবদাসীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। মন্দিরদাসীরা যে কার্যতঃ পুরোহিতদের মনোরঞ্জন করতেন, সে সম্বন্ধে ইতিহাস বহুবিধ তথ্য প্রমাণ দিয়েছে। তবে এই দেবদাসীদের সাথে রাজনটী ও নগরনটীদের আবির্ভাবের কথা জানতে পারা যায়। তবে দেবদাসী ও নগরনটীরা সকলেই যে ক্রীতদাসী ছিলেন না, এর পিছনে কতগুলো ধারণা দেখানো যায়, তা হল ক্রীতদাসী বা কৃতদাসী (যাদের যুদ্ধের ফলে দাসী করা হয়েছে) কোনরকম সামাজিক, নৈতিক অধিকার ছিল না। এদের নিজেদের গৃহে কোনরকম সম্মান বা স্বাধীনতা ছিল না। কিন্তু নগরনটীদের সম্মান, প্রতিপত্তি ছিল যথেষ্ট। এই নগরনটীদের গ্রীসে Hataera বলা হত। এদের গৃহে দেশের জ্ঞানী গুণীরা আসতেন। নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতেন এবং এদের মতামত শোনা হত অর্থাৎ সমাজে এদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। থিওডোরা নামে বাইজেন্টিয়ান সাম্রাটের পত্নী নিজে একজন Hataera ছিলেন। দেবদাসীদের সম্মানিত অস্তিত্বের প্রমাণ থাকলেও Hataera সমতুল্য ছিল না, কারণ তাদের আশেপাশে সর্বদা ধর্মের বাতাবরণ থাকত।



প্রেমে পড়া আর প্রেম লাভ করা, দুটো কি সমার্থক? একদমই না। প্রেম হল স্বর্গীয় শব্দ। আমাদের পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষ প্রেমে পড়ে। অর্থাৎ প্রেম লাভ করাটা খুবই দুষ্প্রাপ্য ব্যপার। প্রেমের দুনিয়ার কর্তৃবাচ্য-কর্মবাচ্য মানেই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। দেবদাসী ক্ষণিকাবাদী, প্রেমজীবনী - তাকে প্রহরে প্রহরে প্রেমে পড়ার অভিনয় করতে হয় , সেটাই তার পেশা। প্রতি রাতে নিত্য নতুন রসের নাগরের আবির্ভাব হয় তার জীবনে। অভ্যাসবশে অজানা,অচেনা পুরুষকে রাত্রীকালীন কিংবা সান্ধ্যকালীন আহার ভেবে তুলে নেয় হাতে, মধ্যরাতে মুক্তগ্রন্থী নাভিবন্ধের মেখলায় অভ্যাসবশেই তাকে স্পর্শ করায়, ভোররাতে ছুঁড়ে ফেলে দেয় অভ্যস্থ অবজ্ঞায় ‘পরশপাথর’ খুঁজে ফেরা খ্যাপার মতো। তাই তার জীবনে অনেক অনেক বড় জাতের প্রাপ্তি, যদি সে তার মুঠিতে ধরতে পারে তরুণ শিল্পীর একান্ত প্রেমকে। ভোগটাই চরম  সত্য জীবনে।

গ্রীক Hataera দের মতো জাপানে ‘Geisha’দেরও সামাজিক সম্মান যথেষ্ট ছিল।  এরা ছিল মূলত আলাপচারিণী। পরে অবশ্য এরা সোজাসুজি বেশ্যাবৃত্তিতে যোগ দিয়েছিলেন।  চীনের মন্দিরে দেবদাসী প্রথা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বলিদ্বীপ, জাভা, সুমাত্রা, শ্যামদেশ ও ব্রক্ষদেশেও দেবদাসীদের বিপুল সমাবেশ ছিল। দক্ষিণ আমেরিকার ইন্‌কা সভ্যতার ইতিহাসে দেবদাসীদের উল্লেখ আমরা পাই। ইনকা সম্রাটরা সকলেই ‘সূর্যের সন্তান’ বলে পরিচিত ছিল। এদের ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। এরা মিশরের ‘ফারাও’দের মতো সহোদরা ভগিনীদের বিবাহ করতেন। ইন্‌কা রাজ্যে সূর্যের মন্দির তত্ত্বাবধানে কাজ করতেন পুরোহিতগণ। সুন্দরী মেয়েদের অল্প বয়সেই বেছে নিয়ে Cuzco বা শিক্ষালয়ে নিয়ে যাওয়া হত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে পরে হয়  স্বয়ং রাজার উপপত্নী হতো অথবা ‘সূর্যকুমারী’ বা Virgins at the Sun রূপে মন্দিরবাসিনী হতো। এদের কাজ ছিল পুরোহিত, রাজা, রাজবংশীয় পুরুষদের মনোরঞ্জন এবং অন্যান্য শিল্পকাজ।

আজটেক সভ্যতার ইতিহাসেও সূর্য দেবতার আধিপত্য দেখা যায়। সূর্যদেব অথবা Huitzilopochtli প্রতি সন্ধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন এবং পরদিন সকালে পুনর্জীবন লাভ করেন। এই দেবতার পুনর্জীবন ত্বরাণ্বিত করার জন্য নরবলি দেবার পদ্ধতি প্রচলিত হয। Ahouritz০tleএর রাজত্বকালে ৮০,০০০ বন্দীকে বলিদান করা হয় এবং তাদের হৃৎপিণ্ড সূর্যের নিকট উৎসর্গ করা হয় ৷ এ সভ্যতার ইতিহাসে নারীবলি প্রাধান্য পেয়েছে  ৷দেবদাসী প্রথার মাধ্যমে নারী মাংসের দৃষ্টিভোগের পাশাপাশি নারীবলিদানের ইতিহাস ও লক্ষ্য করার মতো ৷দেবদাসী প্রথার ইতিহাস এই সমস্ত দেশেই কিছুটা অস্পষ্ট ও অনুমান সাপেক্ষ ৷

ঐতিহাসিক হেরোডোটাস্ খোলাখুলি বলেননি - ব্যাবিলনের রমণী কি কুমারী অবস্থায় রতি মন্দিরে আসত , অথবা জীবনের যে কোন পর্যায়ে  আসত ৷ কিন্তু ফিনিশীয় সভ্যতার হেলিওপোলিস এর মন্দিরে সমবেত হত শুধুমাত্র অক্ষতযোনি কুমারীর দল তারা তাদের কৌমার্যদান করে বিবাহিত জীবন যাপনের অনুমতি লাভ করত ৷[সূত্র] ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে সিরিয়ার রতি মন্দিরে এই প্রথা দীর্ঘদিন প্রচলিত ছিল ৷ মধ্যযুগের প্রারম্ভ কন্সতান্তইন সেই রতি মন্দিরটি ভূমিস্যাৎ করে সেখানে একটি গীর্জা নির্মাণ করে এ প্রথা রদ করিয়েছিলেন ৷ লিডিয়ার রতি মন্দিরেও কুমারীবলি প্রথা চালু ছিল কিন্তু সেখানেও সেটা ছিল অত্যন্ত দুঃস্বপ্ন ! 

কিন্তু আর্মেনিয়া অথবা পারস্যে এক রাতে মজুরি মেটানো যেত না ৷হতভাগিনীদের প্রত্যেককে একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত দেবদাসীর ভূমিকায় বন্দিনী হয়ে থাকতে হত ।একাধিক পুরুষ কর্তৃক দীর্ঘকাল ধর্ষিত না হলে মুক্তি ছিল না ৷ সমাজের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি এবং রাজা - রাজড়ার দলও নিজ নিজ কন্যাকে ঐ রতি মন্দিরে প্রেরণ করতে বাধ্য ছিলেন ৷সেখানে একাধিক অপরিচিত পুরুষকে দেহদানে ধন্য করে স্ত্রীলোকেরা পুরোহিতের অনুমতিপত্র হাতে নিজ নিজ পরিবারে ফিরে আসতেন ৷ বলা বাহুল্য, তাঁদের বিবাহ হত এবং ঐ দৈহিক দেবপূজার জন্যে  কেউ তাঁদের ঘৃণার চোখে দেখতেন না ৷" 



সিরিয়ার তাম্বুজ মন্দিরে ছিল এই প্রথার এক অদ্ভুত রকমফের ৷সেখানে এক লৌকিক দেবতার উপকথা আশ্রিত মৃত্যু এবং পুনর্জন্ম ঘিরে একটা বাৎসরিক অনুষ্ঠান হত বসন্তকালে ৷ অর্থাৎ পাতা ঝরার দিনে পৃথিবীর মৃত্যু হয় ৷'Autumn, a Dirge' দেব তাম্বুজ ভূতলশায়ী হন, তাঁর বার্ষিক মৃত্যু হয় ।প্রেমের স্পর্শে মৃতদেহে হয় নবজীবনের সঞ্চার ।মদনোৎসবের ঐ চিহ্নিত দিনে নাগরিকার দল সমবেত হয় মন্দির চত্বরে ৷তারা বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকে l তারপর কে যেন হেঁকে ওঠে ,তাম্বুজ জীবিত বলে ! ঐ তো তিনি ... তাঁকে বুকে টেনে নাও! রোদনক্লান্তা রমনীর দল কান্না ভুলে ছুটে আসে - ধরা দেয় অপেক্ষমান পুরুষদের কবাটবক্ষে ৷বাস্তকি সামাজিক শাসনকে বছরে একদিন শিথিল করা হয় মাত্র ।আফ্রিকার উত্তর উপকূলে ফিনিশীয় এবং কাের্থেজ সভ্যতাতেও এই প্রথা প্রচলিত ছিল। সেখানেও সমাজের সর্বশ্রেণীর মানুষ তাদের কন্যাদের (রতি) দেবীর মন্দিরে প্রেরণ করত। স্বামীর অঙ্কশায়িনী হবার পূর্বে তাদের হতে হত অজানা অযুত পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী।

ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে দাস প্রথার বিলোপ সাধনে আব্রাহাম লিংকনের প্রচেষ্টার কথা৷ বর্ণ বৈষম্যের মাধ্যমে দাসত্বের নতুন রূপের অভ্যাগমের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য এবং এই সংগ্রামে আত্মদান করে আন্তর্জাতিক শহীদের মর্যাদা পেয়েছেন মার্টিন লুথার ৷ কিন্তু এই সোনার অক্ষরে অনেক কালির অক্ষর চাপা পড়ে আছে ৷ হাওয়ার্ড ফাস্ট তাঁর "স্পার্টাকুস" গ্রন্থে অমর  করেছেন গ্ল্যাডিয়েটর নায়ক স্পার্টাকুসের অভ্যুথানকে, রোমান সাম্রাজ্যের দাসপ্রথার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য৷ কিন্তু কয়েকটি দৃষ্টান্ত ছাড়া আর কোন নামই ইতিহাসে পাওয়া যায় না , যারা এই দাসপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। 

খ্রীস্টান সম্প্রদায়ই প্রথম দাসপ্রথার বিরুদ্ধে মুখ খোলেন৷ রোম সম্রাটের সামনে সেন্ট পিটারের আত্মদান বড় উদাহরণ৷ ক্রীতদাসগণ ধীরে ধীরে সংঘবদ্ধ হয়ে খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে নতুন ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ধীরে ধীরে রাজশক্তির ক্ষমতা দুর্বল হয়ে ওঠে ৷ যে খ্রীস্টান সম্প্রদায় সাম্রাজ্যের অধিনায়কে বিরুদ্ধে মাথা তুলেছিল,তারাই গড়ে তুলেছে নতুন পবিত্র রোম সাম্রাজ্য৷ ধর্মগুরু পোপ যার  প্রতিনিধি। দাসত্বের ইতিহাসে সবচেয়ে নির্যাতিত নারী সম্প্রদায় ৷মানব সভ্যতার ইতিহাসে  নারীজাতিই প্রথম বলিরূপে ব্যবহৃত হয়েছে ৷নারীদেহ মাত্রই ভোগ্যবস্তু ৷ নেই মর্যাদা নেই অহংকার। পণ্যের মত দাসী বিক্রয় করা হত  হাটে বাজারে ৷বিংশ শতাব্দীর শেষপ্রান্তেও এই নারীব্যবসায়ে ভাটা পড়েনি ৷ অবাধে চলেছে ৷ পৃথিবীর প্রাচীনতম ব্যবসায় বেশ্যাবৃত্তি  শুধুমাত্র নারীর জন্য ধার্য ছিল৷ এই ব্যবসায়ের মূলধন নারী।দেবদাসী প্রথা সেই ব্যবসায়ের মূল শর্ত৷ যুগ যুগ ধরে চলে আসা ভারতবর্ষে সম্ভবতঃ এর প্রচলন ব্যাপকভাবে ৷ভারতীয় নারী সমাজ যুগ যুগ ধরে এই প্রথার প্রভাবে অত্যাচারিত । এই প্রথার বিরুদ্ধে যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম চলছে।  



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন