কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৯

ফারহানা রহমান




ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের জনক আন্দ্রেই তারকোভস্কি   





“মানুষ চায় জগতে পরিবর্তন আনতে, বিশ্বসমাজকে আরো উন্নততর করে তুলতে। দুটি জিনিসের মাধ্যমে এটা সম্ভব - একটি হচ্ছে জ্ঞান, অপরটি শিল্প।” – আন্দ্রেই তারকোভস্কি ছেলেবেলায় ক্ষুধার্ত অবস্থায় যে মানুষটির দিন কেটেছে এবং পরের দিনটি কী করে চলবে, কী খাবেন তার কোন নিশ্চয়তা যে মানুষটির একসময় ছিল না,  তিনিই একদিন প্রাচ্যের কবিতা ও সঙ্গীত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে নিজেকে উৎসর্গ করলেন আর এই মানুষটিই হচ্ছে জগতবিখ্যাত রুশ  চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই তারকোভস্কি। সিনামাকে তিনি কবিতা করে তুলেছিলেন। কবিতা যেমন জগত সম্পর্কে, মানবতা সম্পর্কে, সৌন্দর্যের বিমূর্ততা নিয়ে ভাবায়, জীবনবোধের সূক্ষতা প্রকাশ করার মৌলিক একটি ধারা, ঠিক তেমনি  তারকোভস্কির সিনেমাও দর্শককে বিশ্ব-জগতের অসীমতার ধারণাকে নিয়ে, ধর্ম- শিল্প-দর্শন ও মানবতা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। একজন কবির মতোই তিনি তার সিনেমায়, ছোট কোন একটি বিষয়কেই সুসমঞ্জস সমগ্রে পরিণত করতেন।  আন্দ্রেই তাঁর সিনেমাকে কখনোই পণ্য হিসেবে দেখেননি। সিনেমা তাঁর কাছে  ছিল স্রেফ তরতাজা শিল্পের আরেকটি রূপ। একজন ধার্মিক মানুষ হিসেবে তিনি ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য এবং মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্যই নির্মাণ করতেন চলচ্চিত্র। তাঁর জীবনের ধ্যান ধারণা, ভালোবাসা, আশ্রয় সবই ছিল তাঁর চলচ্চিত্র। একারণেই তারকোভস্কিকে বলা হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক ফিল্মমেকার এবং সিনেমার কবিপ্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক বারগম্যান তাঁর  সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমার কাছে তারকোভস্কিই সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচালক, তিনি চলচ্চিত্রের নতুন ভাষা উদ্ভাবন করেছেন, চলচ্চিত্রের প্রকৃতির প্রতি তাঁর ছিল সততা, যেমন করে প্রতিবিম্ব জীবনকে অধিগ্রহণ করে এবং জীবনের উপর স্বপ্ন প্রতিফলিত হয়। 
শিল্পীর জীবন সম্পর্কে, তাঁর নিজের কাজ অর্থাৎ চলচ্চিত্রভাবনা সম্পর্কে তারকোভস্কি মনে করতেন যে, শিল্পী সত্যের অনুসন্ধ্যান পরিত্যাগ করলে শিল্পকর্মে তার প্রভাব হয় সর্বনাশা, তাই শিল্পীর লক্ষ্য হতে হবে সত্য আর সেই  সত্যের দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথ পরিক্রমের জন্য তারকোভস্কির পছন্দ ছিল চলচ্চিত্র পরিচালনার কাজটি। তাঁর মতে, “সিনেমায় সবচেয়ে বড় হচ্ছে আর্টিস্টের তথা পরিচালকের মনোভঙ্গি। বিশ্বের বর্তমান সমস্যাগুলো তাঁকে তলিয়ে বুঝতে হবে। ডাক্তার যেমন অস্ত্রপ্রচার করে শরীরের অভ্যন্তরীণ ভাগ নিরীক্ষণ করেন রোগ নির্ণয়ের জন্য, তেমনি আর্টিস্টেরও উচিত ছবির মাধ্যমে বিশ্বের বর্তমান ও চিরন্তন সমস্যাগুলো দর্শকের সামনে তুলে ধরা। সমস্যাগুলো একবার জানা হয়ে গেলে বিশ্বের জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিবর্গ তার সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে পারেন।”     


আন্দ্রেই তারকভস্কি ইভানোভো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওব্লাস্টের ইউরিয়েভেটস্কি (রাশিয়ার কোস্ট্রোমা ওব্লাস্টের কাদিসস্কি জেলার জাভ্রাজে গ্রামে ১৯৩২ সালের ৪ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম আন্দ্রেই আরসেনিয়েভিট তারকোভস্কি। তিনি ছিলেন একইসাথে রাশিয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক, চলচ্চিত্র সম্পাদক, চলচ্চিত্র থিওরিস্ট, থিয়েটার ও অপেরা পরিচালক। দীর্ঘ শটের মাধ্যমে অপ্রচলিত নাটকীয় কাঠামো, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সিনেম্যাটোগ্রাফির ব্যবহার, আধ্যাত্মিকতা এবং জীবনের চিত্রকল্পের সঙ্গে আত্তীকরণের মাধ্যমেই তিনি চলচ্চিত্রের সার্থকতা খোঁজার চেষ্টা করতেন। সিনেমায় তাঁর অবদান এতটা প্রভাবশালী ছিল যে, অন্য কোন সিনেমাতে যদি কখনো একই ধরনের কোন শট  নেওয়া হয় তখন সেই কাজগুলির নাম হয়ে ওঠে তার্কোভস্কিয়ান কাজ।   

তারকোভস্কির মতে সিনেমার গূঢ় বৈশিষ্ট্য নিহিত কালচেতনায়। তিনি প্রকৃতপক্ষে তাঁর জীবদ্দশায় চিরকাল একাই সংকট, সমস্যা ও বিরোধের সঙ্গে লড়ে গেছেন। পথে পথে হোঁচট খেয়েছেন, দিনের পর দিন বেকার থেকেছেন। হেঁটেছেন তীব্র অনিশ্চয়তার পথে অথচ অবিচল থেকেছেন সাম্যের পথে, বিপ্লবী চেতনায় আর জীবনবোধের উন্মেষণে। শৈশবের জীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন,“আমরা সেসময় খালি পায়ে চলাফেরা করতাম। গ্রীষ্মকালে জুতোই পড়তাম না আমরা, কেননা জুতো ছিল না। শীতে আমি পশমি কাপড়ের বুট পরতাম এবং বাইরে যাবার দরকার হলে মাও তাই পরত। দারিদ্র্য সঠিক  শব্দ নয়, চরম দুরবস্থার চেয়েও খারাপ সেই অবস্থা। সম্পূর্ণ বোধাতীত, কল্পনাতীত। মা না থাকলে কিছুই হতো না, সবকিছুর জন্যই আমি মায়ের কাছে ঋণী।”   


শিল্পের উৎকর্ষের ব্যাপারে আপোষহীন তারকোভস্কির নির্মিত ফিচার ফিল্মের সংখ্যা মাত্র সাতটি। সেগুলো হচ্ছে - ইভানস চাইল্ডহুড (১৯৬২), আন্দ্রেই রুবলেভ (১৯৬৬), সোলারিস (১৯৭২), দি মিরর (১৯৭৫), স্টকার (১৯৭৯), নস্টাজিয়া (১৯৮৩) ও দি সেক্রিফাইস (১৯৮৬)তারকোভস্কি নির্মিত একমাত্র প্রামাণ্যচিত্র ভয়েজ ইন টাইম (১৯৮২) ইতালি থেকে প্রযোজনা করা হয়। এছাড়া ফিল্ম স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি দি কিলার (১৯৫৬), দেয়ার উইল বি নো লিভ টুডে (১৯৫৯) ও দি স্টিমরোলার এন্ড ভায়োলিন (১৯৬১) নামে তিনটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মা করেন। এত অল্পসংখ্যক চলচ্চিত্র তৈরি করলেও  তার প্রত্যেকটি সৃষ্টি সত্য ও সুন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রাপথে এক একটি নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।    

তারকোভস্কির বাবা ইউক্রেন বংশোদ্ভূত আরসেনি তারকোভস্কি ছিলেন প্রখ্যাত রুশ কবি এবং অনুবাদক। মা মারিয়া ইভানোভনা ভিশনিয়াকোভা তারকোভস্কায়া ছিলেন থিয়েটার ও ফিল্ম অভিনেত্রী, যিনি মস্কোর ম্যাস্কিম  গোরকি লিটারেচার ইন্সটিটিউটের গ্রাজুয়েট। ভল্গা নদীর তীরে গড়ে ওঠা শহর ইয়োরিয়েভেটসে কেটেছে তাঁর শৈশব। শৈশবে তাঁর অসংখ্য বন্ধু ছিল এবং তাঁর বন্ধুদের মাঝে তিনি খুব সক্রিয় ও জনপ্রিয় ছিলেন১৯৩৭ সালে তাঁর বাবা আরসেনি তারকোভস্কি সংসার ত্যাগ করলে তিনি এবং তাঁর ছোটবোন মার সাথে  মস্কোতে চলে আসেন। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর বাবা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তারকোভস্কির মার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে শিল্প ও সঙ্গীত ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করা তিনি ছেলেকে একটি মিউজিক স্কুলে পিয়ানো ক্লাসে ভর্তি করে দেন, একইসাথে একটি আর্ট স্কুলেও ভর্তি করান। ছবি আঁকা আর পিয়ানো বাজানো ছাড়াও তারকোভস্কি সাহিত্য এবং বিশেষত কবিতার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি ১৯৩৯ সালে মস্কোতে এসে ৫৫৪ নাম্বার স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা শুরু করেন। তবে যুদ্ধের জন্য পড়ালেখা স্থগিত হলে তাঁকে তাঁর মা ও বোনের সাথে নানির বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। ওখান থেকে ১৯৪৩ সালে ফিরে এসে তিনি আবারও আগের স্কুলে ভর্তি হন। মস্কোতে জামাস্কোভরেচিয়ে জেলার শশিপক স্ট্রিটে থাকা অবস্থায় নিয়মিত পড়ালেখার পাশাপাশি তিনি মিউজিক ও ড্রয়িং নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সোভিয়েত ফিল্ম স্কুল ভি.জি.আই.কে-তে ভর্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি সঙ্গীত এবং ড্রয়িংয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যান। এরইমাঝে ১৯৪৭ সালের নভেম্বর থেকে ৪৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি টিউবারকুলিস (যক্ষ্মা) রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকেন। তারকোভস্কি মনে করতেন, “একজন শিল্পী কখনো খুব  আদর্শ এবং আরামদায়ক থাকাকালীন অবস্থায় খুব ভালো কোন কাজ করতে পারেন না। শিল্পের জন্য চাই অপ্রাপ্তিকোন ফাঁপা পরিবেশে শিল্পীর পক্ষে বাস করা মুশকিল। শিল্পের জন্য চাপ দরকার, দরকার কষ্টের অনুভূতি। পৃথিবী যদি খুব আদর্শ জায়গা হতো তাহলে এখানে শিল্পের দরকার হতো না। অসুস্থ পরিবেশেই মহান শিল্পের জন্ম হয়।” মাত্র ৫৪ বছরের জীবদ্দশায় তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছে একের পর এক দুর্ভাগ্য, বাধাবিপত্তি  আর হয়রানি। সোভিয়েত চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত থাকার ২০ বছর কর্মজীবনে ১৭ বছর তাঁকে বেকার অবস্থায় থাকতে হয়েছে।


শিল্পী হিসেবে তাঁর কাজের স্বাধীনতার জন্য চিরকাল লালায়িত তারকোভস্কি নিজ দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে কখনোই তা পাননি। রাষ্ট্রের সদয় সম্মতি ছাড়া যেখানে একটি শটও  নেওয়া সম্ভবপর নয় সেখানে যে সিনেমা করতে গিয়ে তিনি প্রতিমুহূর্তে হয়রানির  শিকার হবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। প্রচলিত অর্থে চলচ্চিত্র বলতে যা বোঝানো হয়, তারকোভস্কির সৃজন প্রক্রিয়ায় আসলে আমরা সেটা দেখি না। তিনি চলচ্চিত্রের সাথে জীবনের চিত্রকল্পের সম্পূর্ণ আত্তীকরণের মাধ্যমেই চলচ্চিত্রের অস্তিত্ব ও সার্থকতা খুঁজে পেতেন। তাঁর কাছে চলচ্চিত্র মানেই সত্যের অন্বেষণ, দর্শন, মানব প্রবৃত্তি, অনুভূতির সাবলীলতা, শাশ্বত চেতনার প্রবাহমানতা অথচ কাঠামোগত প্রচলিত দৃশ্যবিন্যাসে অনীহা। তিনি ছিলেন এক স্বপ্নমগ্ন-প্রেমাতুর শিল্পী যিনি যত্নবান ছিলেন মানবিক সম্পর্কগুলোর প্রতি। মানব জীবনের বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছে। ফলে তিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিদ্বেষের অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রতিটি মানুষের অন্য মানুষকে চিনতে হবে। একবার চিনতে পারলেই মানুষের মধ্যে পারস্পারিক বোঝাপড়া এসে যাবে এবং সেখান থেকেই আসবে বিশ্বপ্রেম। যদিও পড়ালেখায় তিনি ভীষণ অমনোযোগী ছিলেন, তথাপি তিনি গ্রাজুয়েট হন এবং  ১৯৫১-৫২ সালে মস্কো ইন্সটিটিউট ফর ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজে (এটি ছিলো –ইউএসএসআর-এর বিজ্ঞান একাডেমির একটি শাখা) আরবি ভাষায় পড়ালেখা শুরু করেন। ­কিছুটা আরবি কথা বলতে ও লিখতে পাড়া সত্ত্বেও খুব শীগ্রি তিনি উক্ত পড়ালেখার উপর সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন এবং প্রথম সেমিস্টারের পর  আর পড়াশোনা করেননিএরপর তিনি একাডেমি অফ সায়েন্স ইন্সটিটিউট ফর নন-ফোরাস মেটালস এন্ড গোল্ড এ খনিজ সন্ধানীর কাজ নেন এবং এসময় তিনি সিদ্ধান্ত নেন ফিল্ম নিয়ে পড়ালেখা করার। ১৯৫৪ সালে গবেষণা অভিযান থেকে ফিরে আসার পর, তারকোভস্কি স্টেট ইনস্টিটিউট অফ সিনেমাটোগ্রাফি  (ভিজিআইকে)তে আবেদন করেন এবং চলচ্চিত্র পরিচালনার প্রোগ্রামে ভর্তি হন। এটি(ভিজিআইকে) রাশিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে একটি। তাঁকে খুব কঠিন প্রতিযোগিতায় পাস করে এখানে পড়ালেখা করতে হয়েছিলো। সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান নিকিতা ক্রুসচেভের শাসনামলে তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালকদের জন্য কিছু নতুন সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল১৯৫৩ সালের আগে পর্যন্ত বছরে খুব কম চলচ্চিত্র তৈরি হতো, তবে ৫৪ সালের পর থেকে  সেখানে নতুন নতুন পরিচালক আসতে থাকে এবং চলচ্চিত্রের সংখ্যা ক্রমশ  বৃদ্ধি পায়। ক্রুসচেভের সময়কালে তিনি সোভিয়েত সমাজে পশ্চিমা সাহিত্য, সিনেমা ও সঙ্গীত বিষয়ে বেশকিছু ডিগ্রি প্রবর্তনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ফলে  তারকোভস্কি ইতালিও নিও রিয়েলিজম চলচ্চিত্র, ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ এবং কুরোশাওয়া, বুনুয়েল, বার্গম্যান, ব্রেসোকে পরিচালক হিসেবে দেখার এবং তাদের তৈরি সিনেমাগুলো দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর ওপর  এই সকল পরিচালকবৃন্দের গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ফিল্মস্কুলে সিনেমা  তৈরির ব্যাপারে মিখাইল রম ছিলেন তারকোভস্কির শিক্ষক এবং পরামর্শক। যার ছাত্রদের মধ্যে শুকশিন এবং কোঞ্চালোভস্কির মতো প্রভাবশালী চলচ্চিত্র পরিচালকরাও অবশ্য ছিলেন। তারকোভস্কি মনে করতেন চলচ্চিত্র পরিচালক হবেন নানাদিক থেকেই একজন সংগ্রাহক। তার আবেগ অনুভুতির ব্যাপারগুলো, ইমেজগুলো, প্রকৃতপক্ষে তার পুরো জীবনটার সাথে একটি নির্দিষ্ট অর্থময় ব্যঞ্জনায় বেঁধে থাকবে। সেখানে অভিনেতাদের উপস্থিতি থাকুক না থাকুক তাতে খুব একটা বেশি কিছু যায় আসে না।     


১৯৫৬ সালে আরনেস্ট হেমিংওয়ের ছোটগল্প অবলম্বনে কিলার নামক প্রথম স্টুডেন্ট শর্টফিল্ম তৈরি করেন আন্দ্রেই। সেসময় ভিজিআইকে পড়তে গিয়ে তাঁর সাথে পরিচয় হয় ইরমা রাউসের। ১৯৫৭ সালের এপ্রিলে সহপাঠী ইরমা রাউসকে তিনি বিয়ে করেন। এর পরের বছর ‘দেয়ার উইল বি নো লিভ টুডে’ নামক আরও একটি শর্টফিল্ম বানান। ৫৯ সালে লেখেন কন্সেন্ট্রেটের স্ক্রিপ্ট। ১৯৬২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তাঁর প্রথম সন্তান সেঙ্কার জন্ম হয়। বাবা আরসেনি তারকোভস্কির নামেই ছেলের নাম রাখা হয়। ভিজিআইকেতে পড়ার সময়েই তারকোভস্কির উপর দারুণ প্রভাব পড়েছিলো চলচ্চিত্র পরিচালক গ্রিগোরি চুখরাইয়ের। ছাত্রের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে চুখরাই তার ফিল্ম ক্লিয়ার স্কাইসের জন্য সহকারী পরিচালক হিসাবে তারকোভস্কিকে নিতে চেয়েছিলেন। আন্দ্রেই প্রথমে আগ্রহ দেখালেও পরে তার গবেষণায় এবং নিজের প্রকল্পগুলিতে মনোযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ফিল্মস্কুলের তৃতীয় বছরে পড়ার সময় তারকোভস্কির পরিচয় হয় কঞ্চালোভস্কির সাথে। যিনি পরবর্তীতে রাশিয়ার একজন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক এবং স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। পরিচয়ের প্রথম থেকেই তারা দুজন ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তাদের চিন্তার জগত, ভাবনা ও পছন্দের জায়গার মিল এবং স্বপ্নের মিলগুলো তাদেরকে আরও বন্ধু করে তোলে। ১৯৫৯ সালে দুজন মিলে লিখে ফেলেন এন্টারটিকা-ডিসেন্ট কান্ট্রি নামক একটি স্ক্রিপ্ট। স্ক্রিপটি তারকোভস্কি ফিল্ম প্রোডাকশন ইউনিট লেনিনফিল্মে জমা দেনযদিও সেটি সেসময় এক্সেপ্টেড হয়নি। পরবর্তীতে তারা দ্য স্টিমরোলার এন্ড দ্য ভায়োলিন নামে আরেকটি সফল স্ক্রিপ্ট তৈরি করেন এবং সেটা বিক্রি করেন রাশিয়া ও ইউরোপের সবচেয়ে পুরনো ও বৃহৎ ফিল্ম স্টুডিও মসফিল্ডে। ১৯৬০ সালে এটি তারকোভস্কির গ্রাজুইয়েশন প্রোগামে কাজে লাগে যা তাঁকে ডিপ্লোমা পেতে সাহায্য করেছিল। ১৯৬১ সালে নিউইয়র্ক স্টুডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে এটি প্রথম পুরস্কার লাভ করে। ৬৫ সালের প্রথম থেকেই আন্দ্রেই তাঁর ফিল্ম প্রোডাকশন এসিস্টেন্ট লারিসা কিজিকোভার সাথে একসাথে বসবাস করতে থাকেন। ১৯৭০ সালে তাঁর প্রথম স্ত্রী ইরমার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি লারিসাকে বিয়ে করেন। ৭০ সালের ৭ অগাস্ট তাদের পুত্র আন্দ্রিয়ুস্কার জন্ম হয়। 
   
তারকোভস্কির প্রথম ফিচার ফিল্ম ইভান’স চাইল্ডহুড তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়। ১৯৬২ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এটি সর্বোচ্চ পদক গোল্ডেন লায়ন জিতে নেয়। এতিম ছেলে ইভান যার বাবা-মা-বোনকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সৈন্য দ্বারা হত্যা হওয়া এবং তার যুদ্ধের সময়কালীন অভিজ্ঞতা নিয়ে ছবি তৈরি করা হয়েছে। ছবিটিতে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি এবং বীভৎসতা দেখানো হয়েছে। এই সিনেমাটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তারকোভস্কি বলেছেন যে তিনি  যুদ্ধের প্রতি তার ঘৃণাকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন যেখানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পূর্বফ্রন্টে সোভিয়েত আর্মির সাথে জার্মান অয়েরমাট এবং জার্মান নাজির সাথে সরাসরি যুদ্ধের নানা ফ্ল্যাশব্যাক দেখানো হয় ছবিতে। ১২ বছর বয়সী ইভান যুদ্ধের স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। এবং গ্রামের একটি জলাশয় পার হয়ে যাওয়ার সময় সোভিয়েত আর্মি তাকে ধরে  নিয়ে যায় এবং ক্যাম্পে রাখে। সেখান থেকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানোর চেষ্টা করা হলে সে কিছুতেই স্কুলে না গিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত জানায়। ইভান তার বাবা-মার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকে। ফলে যুদ্ধের এক পর্যায়ে গভীর রাতে বনের জলাভূমিতে ক্যাপ্টেন কলিন এবং গেলসেভের সাথে একটি অপারেশনে গেলে ইভান বনের গভীরে নিখোঁজ হয়ে যায়। এবং যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে লেফটেন্যান্ট গেলসেভ জানতে পারে যে ক্যাপ্টেন কলিনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ইভান অপারেশনের সময় জার্মান আর্মির কাছে ধরা পড়েপরে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। ইভান’স চাইল্ডহুড ফিল্মটি সর্বপ্রথম তারকোভস্কিকে বহির্বিশ্বের কাছে পরিচিতি এনে দেয়। ১৯৬২ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এটি তাঁকে গোল্ডেন লায়ন পুরষ্কার এনে দেয় এবং সান ফ্রান্সিস্কো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গোল্ডেন গেইট এ্যাওয়ার্ড এনে দেয়। ৩৬তম একাডেমী এ্যাওয়ার্ডে বেস্ট ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ ফিল্ম হিসেবে মনোনীত হয়।   
    
১৯৬৫ সালে তিনি ১৫ শতকের আইকন পেইন্টার আন্দ্রেই রুবলভকে নিয়ে ‘আন্দ্রেই রুবলেভ’ নামেই একটি ফিচার ফিল্ম তৈরি করেন। ছবিটি তৈরির পর থেকেই সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ তাঁর উপর ভীষণভাবে রুষ্ট হয়ে ওঠেন। এবং সিনেমাটির ব্যাপারে প্রবলভাবে বাধা দিতে থাকেন। ফলে সিনেমাটিকে বহুবার  কাটছাঁট করার ফলে এটির বেশ কয়েকটি ভার্সন তৈরি হয়। ১৯৬৯ সালে এর একটি ভার্সন দেখানো হয় কান চলচ্চিত্র উৎসবে। ছবিটি সেখানে ফিপ্রেস্কি প্রাইজ জিতে নেয় আন্দ্রেই রুবলেভ রাশিয়ার সংস্কৃতির ইতিহাসে সবচেয়ে অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বদের একজন। তার জীবন ও শিল্পে, বিষয়বস্তুর ব্যতিক্রমী রসদ রয়েছে বলেই মূলত তারকোভস্কি তাঁকে নিয়ে ফিল্ম বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। সহজাত সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধির দৌলতে একজন চিত্রকর যে সময়টিতে বাস করেন, সেই সময়টির গভীরতম অর্থ অনুধাবন করাই ছিল এই সিনেমাটি তৈরি করার  প্রধান উদ্দেশ্য। এটি কোন ঐতিহাসিক বা জীবনীমূলক ছবি নয়। চিত্রকরের অর্থাৎ রুবলেভের শিল্পীসুলভ পরিণতি প্রাপ্তির প্রক্রিয়া এবং তাঁর প্রতিভা বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াটিই মূলত ছবিটির উপজীব্য যদিও এখানে রুবলেভকে কোন আইকন হিসেবে দেখানো হয়নি তবুও একজন শিল্পীর মানসিকতা ও সচেতনতা, অনন্তকালের জন্য তাঁর সৃষ্টির আত্মিক তাৎপর্যের আধ্যাত্মিকতাকে এখানে উপজীব্য করা হয়েছে ছবিটি তৈরি হয়েছে মূলত চিত্রকর রুবলেভের অনুভূতিকে কেন্দ্র করে। তারকোভস্কি নিজেই বলেছেন, ‘রুবলেভের জীবনকাহিনী সম্পূর্ণ রহস্যময়।... আমাদের কোন ইচ্ছেই ছিলোনা তাঁর জীবনের ধাঁধার জটগুলো খুলে দেখবার। বরং আমরা দেখাতে চেয়েছি এমন একজনের দৃষ্টিকে যিনি আশ্চর্য ও ভয়ংকর এক সময়ের রাশিয়াকে দেখেছেন। যে দেশ ক্রমশ আপন রূপ ধারণ করছিল।’ 


রাশিয়ার আইকন চিত্রশিল্পী রুবলেভের ভাবনা ও অনুভূতিকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে চলচ্চিত্রটিকবি-সন্ন্যাসী রুবলেভ পৃথিবীকে দেখেছিলেন একজন বালকের দৃষ্টিতে যার চোখের সামনে ঘটে চলেছিল একের পর এক পাশবিক হিংস্রতা ও নারকীয় ভয়াবহতা। তবু তিনি অন্যের প্রতি দয়া দেখিয়েছেন, বিলিয়েছেন প্রেম ও মমতা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে একমাত্র মনুষ্যপ্রকৃতির শুভচেতনা ও মুক্তমনের ভালোবাসাই পারে সব হিংস্রতাকে পরাজিত করে মানবিক এক পৃথিবী গড়তে। রুবলেভ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তারকোভস্কি বিশ্লেষণ করতে চেয়েছিলেন একজন শিল্পীর মানসিকতা ও সচেতনতা। তিনি দর্শককে দেখাতে চেয়েছিলেন দূষিত পঙ্কিল ব্যধিগ্রস্ত একটি কালেও, দুর্বিনীত সময়ের দাসত্বের মধ্যেও, ধ্বংসাত্মক লড়াইয়ের ভেতরেও কী করে সহমর্মিতা ও সহধর্মিতার আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয়আর সেখান থেকেই জন্ম হতে পারে ট্রিনিটির মতো মহান শিল্পের। আন্দ্রেই রুবলেভই প্রথম সিনেমা যাতে তারকোভস্কি রঙিন এবং সাদাকালো দৃশ্য পাশাপাশি ব্যবহার করেছেন, পরবর্তীতে তার অনেক সিনেমায় এ ব্যাপারটি আমরা দেখতে পাই।   

একটি গরম বায়ু চালিত বেলুনের যাত্রায় মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটি শুরু হয়। বেলুনটি একটি নদীর পাশের গির্জার সাথে একটি দড়ি দিয়ে পেঁচানো ছিল। ইয়ফিম নামে একটি লোক (নিকোলায় গ্লাজকোভ) বেলুনের নিচের দড়িকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করে উড়ার চেষ্টা করছিলেন। তার ওড়ার চেষ্টার প্রথম মুহূর্তেই নদী থেকে একদল অজ্ঞ মানুষে এসে হাজির হয় ও উড়ে চলার চেষ্টাকে ব্যর্থতায় পরিণত করতে ইফিমকে সহায়তা করছে এমন একজনের মুখে জ্বলন্ত কাঠখন্ড চেপে ধরে। এতকিছুর পরেও বেলুনটি সফল ভাবে আকাশে উড়ে যায়। ইয়েফিম আকাশে ওড়ার আনন্দ অনুভব করতে পারে ও উপর থেকে অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখার আনন্দে অভিভূত হয়। যদিও সে ক্রাশ ল্যান্ডিংকে কিছুতেই প্রতিহত করতে পারে না, ফলে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। এই পতনের পর পুকুরের পাশে  আমরা একটি বিষণ্ণ ঘোড়াকে গড়াগড়ি খেতে দেখি, ঘোড়াটি ছিল এইসব কিছুর একজন নীরব সাক্ষী। তারকোভস্কি সবসময় জীবনের প্রতিশব্দ হিসেবে ঘোড়াকেই দেখেছেন। তার মতে, ‘যখন আমি একটা ঘোড়ার দিকে তাকাই তখন জীবনের সারবস্তুর প্রত্যেক সংস্পর্শে আছি বলে মনে করি। সেটা সম্ভবত এই কারণে যে ঘোড়া একটি খুব সুন্দর জন্তু ও মানুষের বন্ধুতুল্য। তাছাড়া ঘোড়া ভীষণভাবে রুশীয় নিসর্গের বৈশিষ্টসূচকও বটে   

মধ্যযুগের মর্মবিদারক জীবন, মৃত্যু, প্রতিবেশের দুঃখ-কষ্ট ও যাতনা দেখে বিমূঢ় হয়ে একজন আদর্শবাদী তরুণ রুবলেভ যখন চিত্রকর থেকে নির্বাক সন্ন্যাসীতে পরিণত হয় তখন আমরা দেখতে পাই রঙিন ছবির মন্টাজ। কিন্তু সিনেমা শেষের দৃশ্যে রুবলেভ দেখে ছাদ থেকে পড়ে জীবন হারানোর ঝুঁকি নিয়েও একজন ঘণ্টা নির্মাতা একটি চার্চে প্রথমবারের মত ঘণ্টা লাগানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। ঘণ্টা নিয়ে তার কাজের সময়ে দেখানো প্রত্যয় ও আবেগ রুবলেভকে এতদিনের নীরবতা থেকে জাগিয়ে তোলে। তখন সে আবার অনুপ্রাণিত হয়। ফলে মানবিক সৃজনশীলতা, অধ্যাবসায় এবং বিশ্বাসের শক্তি রুবলেভকে তাঁর নির্বাক থাকার শপথ থেকে সরে আসতে বাধ্য করে। বৃষ্টিতে ঘোড়ারা ভিজে চলেছে এমন একটি ইমেজ দিয়ে এই অসাধারণ ছবিটি শেষ হয়।        
    
সিনেমাটিতে রুবলেভ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তাঁর প্রিয় অভিনেতা আনাতোলি সোলোনিৎসিন। যাকে তারকোভস্কির পরের সবগুলো সিনেমাতেই দেখা গেছে। আন্দ্রেই রুবলেভ ১৯৭১ সালয়ে মুক্তি পায়।

পোলিশ সাইন্সফিকশন লেখক স্তানিশল লেম-এর ১৯৬১ সালে প্রকাশিত  কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস সোলারিস অবলম্বনে আন্দ্রেই ১৯৭২ সালে সোলারিস মুভিটি তৈরি করেন। সোলারিস নামক একটি অদ্ভূত গ্রহের চারদিকে আবর্তনরত, মানুষের তৈরি একটি কৃত্রিম উপগ্রহে ঘটতে থাকা অদ্ভূত সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সিনেমাটির কাহিনী। ঘটনা সম্পর্কে জানার জন্য  পৃথিবী থেকে একজন মনোবিজ্ঞানী ক্রিস কেলভিনকে (দোনাতাস বানিয়োনিস) সেখানে পাঠানো হয়। এমন মনে হতে থাকে যে সোলারিস গ্রহটি নিজেই একটি বিশাল মস্তিষ্ক। কেলভিন লক্ষ্য করেন, গ্রহটি কৃত্রিম উপগ্রহের অধিবাসীদের অবচেতন মনে প্রবেশ করতে পারছে এবং সেখানে যা যা দেখতে পায় তাকে বাস্তবের মত তার সামনে এনে উপস্থিত করতে পারে। এভাবে একদিন কেলভিন তার মৃত স্ত্রী হারিকে নিজের ক্যাবিনেটে দেখতে পান। হারি পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় আত্মহত্যা করেছিল। একসময় স্পেসশিপের বিজ্ঞানীরা হারিকে তাঁর ১০ বছর আগে পৃথিবীতে থাকতে আত্মহত্যা করার কথা এবং সে যে প্রকৃত হারি না তা মনে করাতে সে তরল নাইট্রোজেন খেয়ে আবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু সেখানে আবারও তার পুনর্জন্ম হয়। তারকোভস্কির সোলারিস মুভিটি ব্যাক্তি এবং ব্যাক্তির দহনকে মুখ্য করে তৈরি করা হয়েছে।      
        
এরপর ১৯৭৩ থেকে ৭৪ পর্যন্ত তিনি মিরর সিনেমাটির শুটিং করেন। মিরর সিনেমাটি আসলে একটি আত্মজীবনীমূলক সিনেমা। এটি যদিও কিছুটা   অপ্রচলিত কাঠামোগতভাবে তৈরি করা সিনেমাটিতে তিনি তাঁর বাবা আর্সেনি  তারকোভস্কির কবিতা অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ছবিটি মূলত মার্গারিতা তেরেকোভা, ইগনাট ড্যানিলৎসেভ, আলা ডেমিডোভা, আনাতোলি সোলনিৎসিন, তারকভস্কির স্ত্রী লারিসা তারকোভস্কায়া এবং তার মা মারিয়া বিশনিয়াকোভাকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এখানে আমরা নানা আঙ্গিকে একজন মৃত্যু পথযাত্রী কবির অর্থাৎ তার বাবা আর্সেনি তারকোভস্কির স্মৃতিকে উন্মোচন হতে দেখিযিনি তার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর রাশিয়ার তুমুল সংঘর্ষপূর্ণ সময়ে তার সন্তান ও সংসারকে ত্যাগ করেছিলেন। দৃশ্যত এই থিমগুলিকে উপস্থাপন করার জন্য সিনেমাটিতে বর্তমান সময়ের সাথে শৈশবের  স্মৃতি ও স্বপ্নকে নিউজরিয়েল ফুটেজের সাথে সমসাময়িক দৃশ্যগুলির সমন্বিত করার চেষ্টা করা হয়। ছবিটিতে স্বল্প প্রবাহের ইমেজগুলোর গতি হারিয়ে তার সমৃদ্ধ এবং সংকেতিক প্রতীকীর সাথে একাত্ম হয়ে মিশে যেতে দেখি। যা আধুনিকতাবাদী সাহিত্যে চেতনা প্রযুক্তির প্রবাহের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মিররে আমরা আসলে অ্যালেক্সেরই শিশু, কিশোর এবং তার চল্লিশ বছর বয়সী জীবনে দেখতে পাই। একইসাথে তার আশেপাশের দুনিয়ার বিষয়-আশয়,   চিন্তাভাবনা, আবেগ এবং স্মৃতিগুলির বর্ণনাও এখানে দেখানো হয়। প্রাপ্তবয়স্ক আলেক্সকে শুধুমাত্র অল্পসময়ের জন্য দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু বেশিরভাগ দৃশ্যে কথোপকথনের ভঙ্গিতে ভয়েস-ওভার হিসাবে তার উপস্থিতি দেখি। চলচ্চিত্রের গঠনটি প্রচলিত প্লটে না ফেলে এতে নানা স্মৃতি ও স্বপ্নগুলোকে বিছিন্নভাবে দেখতে পাওয়া যায়। সিনেমাটি  তিনটি ভিন্ন সময় ফ্রেম অর্থাৎ যুদ্ধের আগের  ১৯৩৫ সালের শৈশবের স্মৃতি, ১৯৪০ সালের যুদ্ধকালীন সময় এবং যুদ্ধের পরের ১৯৬০/৭০ সালের মধ্যে পরিক্রমণ করতে থাকে। মিররে তারকোভস্কি প্রকৃতপক্ষে নিজের শৈশবের ছবিই আঁকেন। মস্কো থেকে যুদ্ধের সময় গ্রামাঞ্চল এলাকায় ফিরে যাওয়া তার বাবার সংসার ত্যাগ করা, একজন মুদ্রণযন্ত্রের প্রুফ-রিডার হিসেবে তার মার জীবন সংগ্রাম ইত্যাদিকে ঘিরেই মিরর সিনেমাটি গড়ে  উঠেছে। ছবিতে যুদ্ধ দ্বারা প্রভাবিত একটি শিশুর শৈশবের দুর্দশা চিত্রিত করা হয়েছে। আন্দ্রেই ১৯৬৭ সাল থেকেই ফিল্মটির স্ক্রিপ্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। তখন স্ক্রিপ্টির শিরোনাম ছিল কনফেশন, হোয়াইট ডে এন্ড অ্যা হোয়াইট, হোয়াইট ডে সিনেমায় কাজ করার সময় তিনি কখনোই অভিনেতা  অভিনেত্রীদের সাথে বেশি আলোচনায় যেতেন না। তিনি মনে করতেন সামগ্রিক স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে অভিনেতা জেনে গেলেই সে সচেতনভাবে চরিত্রটি অভিনয় করার চেষ্টা চালাবে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, ‘মিরর এর প্রথম দৃশ্যে যখন প্রধান চরিত্রাভিনেত্রী বেড়ার উপর বসে সিগারেট খেতে খেতে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে, আমি চেয়েছিলাম যে অভিনেত্রী মারগারিটা তেরোকোভা যেন চিত্রনাট্যের বিশদ কিছু না জানতে পারেতার মানে, সে জানেই না যে মানুষটা শেষ পর্যন্ত ফিরবে, নাকি সে চিরকালের জন্য চলে গেছে । এটা করা হয়েছিলো এই উদ্দেশ্যে যে যার চরিত্রে সে অভিনয় করেছে তিনি একদা যেভাবে থাকতেন ঠিক সেইভাবে সে ওই মুহূর্তে থাকবে ভবিষ্যৎ জীবনের ঘটনাবলির কথা না জেনেই। অভিনেত্রীটি যদি জানতো যে তার স্বামী আর কখনই ফিরবে না তাহলে নিঃসন্দেহে সে তার আগাম আশাহত অবস্থাটিকে অভিনয়ের মধ্যে আপনা আপনিই প্রকাশ করে ফেলত এবং না চাইলেও বড় পর্দায় তার হতাশার ভাব কখনো লুকানো যেত না।শুরুতে এই ফিল্মটিকে খুব একটা ভালভাবে নেননি সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ। সিনেমাটির উপর অভিজাততন্ত্রের দায় চাপানো হয়।  কর্তৃপক্ষ এটিকে তৃতীয় শ্রেণীর ফিল্ম হিসেবে গণ্য করেন এবং শুধুমাত্র তৃতীয় শ্রেণীর সিনেমা হলগুলোতে এবং শ্রমিক ক্লাবে দেখানোর অনুমুতি দেন।  সোভিয়েত সমাজে সেসময় কোন সিনেমা তৃতীয় শ্রেণীর তালিকাভুক্ত হলে সেটি  ফিল্মমেকারের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়া। এবং পরবর্তীতে সেই ফিল্মমেকারের কোন সিনেমাতে কেউ আর টাকা লগ্নি করতেন না। ফলে এ  সময় কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো তারকোভস্কিকে এবং সেই সময়টিতেই তিনি দেশের বাইরে গিয়ে সিনেমা তৈরি করার কথা ভাবতে থাকেন।    

প্রখ্যাত সোভিয়েত লেখক স্ক্রুগাৎস্কি ভ্রাতৃদ্বয়ের বিজ্ঞ্যান কল্পকাহিনী ‘রোডসাইড পিকনিক’ অবলম্বনে স্টকার সিনেমাটি তৈরি হয়। এই লেখক দুই ভায়ের সাথে  তারকোভস্কির দেখা হয় ১৯৭১ সালে। কিন্তু সিনেমার শুটিং শুরু হয় ১৯৭৬  সালে। ছবিটিতে সমকালীন কিছু নৈতিক সমস্যাকে তুলে ধরা হয়েছে। মানব জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের যে চিরন্তন দার্শনিক জিজ্ঞাসা সেটার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সিনেমাটিতে। সুখের অনুসন্ধ্যানে মানুষ যে ব্যর্থ হতে  বাধ্য, তারকোভস্কির উদ্দেশ্য ছিল সে কথাটিকেই স্টকারের মাধ্যমে তুলে ধরা। সিনেমাটিতে বাস্তব ও কল্পনা, লিরিকাল ও এপিক, মনোজগৎ ও বাস্তব জগতের  মেল বন্ধন দেখানোর প্রয়াস পেয়েছে। কোন একটি শুভ ব্যাপারে বিশ্বাস স্থাপন করে সেই লক্ষে পৌঁছানোর চেষ্টা করাই মূলত স্টকার সিনেমাটির মূল বক্তব্য।  একটি কাল্পনিক ভবিষ্যত সময়ে পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে পৃথিবীতে  একটি বিস্ময়কর অঞ্চলের উদ্ভব ঘটে, যেখানে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে  থাকে। মানুষের মাঝে এমন একটি বিশ্বাস আছে যে এখানকার একটি পরিত্যক্ত ভবনের কক্ষে প্রবেশ করলেই মনের সব ইচ্ছে পূর্ণ হয়। জায়গাটিকে জোন নামে ডাকা হয় এবং কক্ষটিকে বলা হয় রুম। এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে স্টকার নামে পরিচিত কিছু লোক আছে যারা অর্থের বিনিময়ে জোনে নিয়ে জেতে পারে। এমনই একজন স্টকার একজন বিষণ্ণ লেখক যিনি লেখার ইন্সপিরেশন খুঁজে চলেছে তাঁকে এবং একজন প্রোফেসর যিনি নোবেল প্রাইজ পেতে ইচ্ছুক এমন দুজন মানুষকে পথ দেখিয়ে নিষিদ্ধ ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে রুমে ঢোকার আগেই তাদের বিশ্বাস টলে যায়। জোনের অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের মনে প্রশ্ন জাগে। এমনকি স্টকারও সন্দিহান হয়ে ওঠে। তাই তারা জোনে প্রবেশ না করেই ফিরে আসে। চলচ্চিত্রে স্টকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন আলেকজান্দার কাইদানোভস্কি। বিশ্বের সেরা ৫০টি সিনেমার একটি হিসেবে স্টকারকে ধরা হয়। 
তিনি যুক্তরাজ্য ও সুইডেন ভ্রমণ করেন। সুইডেনে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃপক্ষের তৈরি বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনভাবে ফিল্ম তৈরি করার কথা ভাবেন। এবং সেখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৯ এর গ্রীষ্মে অর্থাৎ ১৬ জুলাই তিনি ইটালির রোমে যান। সেখানে তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু কবি টনিনো গুয়েরার সাথে যৌথভাবে তৈরি করেন ভয়েজ ইন টাইম নামের একটি ডকুমেন্টরি। ১৯৮০ সালে দুবন্ধু মিলে তৈরি করেন নস্টালজিয়া সিনেমাটির স্ক্রিপ্ট। ১৯৮২ সালে নস্টালজিয়া ফিল্মটা বানানো শুরু করেন। কিন্তু সামনে এসে  হাজির হয় ভীষণ বিপদ। মসফিল্ম কর্তৃপক্ষ আর অর্থলগ্নি করবেন না বলে জানিয়ে দেন। হাল ছাড়েন না তারকোভস্কিতিনি ইতালির পাবলিক ব্রড কাস্টিং কোম্পানি আরএআই ( রেডিওটেলিভিশন ইতালিয়ানা) এর আর্থিক সহায়তায় ফিল্মের কাজ শেষ করেন। পরে এটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শিত হয় এবং সেখানে এটি ফিপ্রেস্কি প্রাইজ এবং প্রাইজ অব দ্য ইকুমিনিক্যাল জুরি জিতে নেয়। রোবের ব্রেসোর সঙ্গে গ্র্যান্ড প্রিন্স স্পেশাল জুরি প্রাইজটিও জিতে নেন। একজন রুশ লেখক ও প্রোফেসর আন্দ্রেই গোরচেকভ রাশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতালির রেনেসাঁ স্থাপত্যের ইতিহাস পড়ান অথচ তিনি কখনো ইতালিতে যাননি। একসময় গবেষণার জন্য তিনি ইতালিতে যাওয়ার মনঃস্থির করেন। একজন দোভাষীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ইতালির নানা প্রাসাদ ও স্মৃতিসৌধ দেখা শুরু করলে তাঁর নিজের সমস্ত জ্ঞ্যান, গবেষণা ও পড়াশোনা সবকিছুই তাঁর কাছে একসময় নিরর্থক, মৃত ও শূন্য মনে হতে থাকে। তাঁর মনে হতে থাকে যে  যারা এইসব স্মৃতিসৌধ, প্রাসাদ গড়ে তুলেছেন বা কল্পনা করেছেন, তাদের আত্মা, হৃদয় এখানেই রয়ে গেছে, তারা সবকিছু বুঝতে পারেন, অবলোকন করতে পারেন। তিনি উপলব্ধি করেন শুধুমাত্র বইপত্র, পুঁথি পড়ে এতদিন তিনি যা কিছু ছাত্রছাত্রীদের শিখিয়েছেন তা আসলে কখনো পূর্ণত্বে পৌঁছাতে পারেনি। আসলে এইসব অভিজ্ঞতা, অনুভূতি সবই উপলব্ধির ব্যাপার, এগুলো কোন ক্লাসঘরে ছাপানো বইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তিনি বুঝতে পারেন না, দেশগুলোর মধ্যে এতসব দেয়ালের কারণটা কি? সেইসব কৃত্রিম রীতিনীতিসমূহ যা মানুষকে অপরের থেকে আলাদা করে দেয় সেগুলোকে তিনি গ্রহন করেন না। আর এগুলোই তার আতঙ্কগ্রস্ত যন্ত্রণাকে উসকে দেয়। দুনিয়াদারি সম্পর্কে তার এই অপাপবিদ্ধ দৃষ্টি এবং দেশ ছেড়ে আসার বাস্তব অবস্থার সংঘাতের মধ্যে একদিন ডোমেনিকো নামের একজনের সাথে তার পরিচয় ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। লোকটি প্রকৃতপক্ষে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও বিষণ্ণ একটি মানুষ যিনি সাত বছর ধরে তাঁর স্ত্রীসন্তানকে পৃথিবীর খারাপ সংস্পর্শ থেকে বাঁচানোর জন্য গৃহবন্দী করে রেখেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে একটি জলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে মিনারেল পুলের বা খনিজ পুকুরের একপাশ থেকে অন্যপাশ পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারলে এই পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। ডোমেনিকো তাঁর এই স্বপ্নটি পূরণ করার দায়িত্ব গোরচেভকে দেয়। গোরচেভ একসময় বিশ্বাস করতে থাকে যে তাঁর ভেতর ডোমেনিকো প্রবেশ করেছে ফলে সে একাধিক চেষ্টার পর জ্বলন্ত মোমবাতিটি পুকুরের অপর প্রান্তের একটি দেয়ালে প্রতিষ্ঠাপন করে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। তারকোভস্কি নস্টালজিয়া সিনেমাটিতে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত আবেগকে তুলে ধরতে চাননি  বরং এটিকে তিনি একটি রোগ বা এমন একটি অসুস্থতা হিসেবে দেখিয়েছেন যা মানুষের আত্মার শক্তি, কাজ করার ক্ষমতা, বেঁচে থাকার আনন্দকে নিঃশেষ করে দেয়। তিনি বলেন, ‘একটি কাহিনীর অবয়বে সমস্যাটির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, ইতালিতে আসা একজন সোভিয়েত বুদ্ধিজীবীর মধ্যে, আমি এই নস্টালজিয়ার ধরণ ও প্রবনতাকে খুঁটিয়ে লক্ষ করতে চেয়েছি।’  নস্টালজিয়া কি? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তারকোভস্কি বলেছিলেন, “নিছক অতীত সম্পর্কে শোকাচ্ছন্নতাই নস্টালজিয়া নয়। নিজের অন্তরের প্রতিভাকে গণ্য না করে, তাকে ঠিকভাবে সাজিয়ে না তুলে ব্যবহার না করে এবং এইভাবে নিজের কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে যে সময়কে বয়ে যেতে দিয়েছে তার জন্য বিষাদের অনুভূতিই নস্টালজিয়া।”     


১৯৮৪ সালের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটান সেক্রিফাইস ফিল্মটির প্রস্তুতির কাজে। ইতালিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আর কখনো সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরবেন না বলে ঘোষণা দেন। নিজ দেশে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারার কষ্ট থেকে তিনি মুক্তি চেয়েছিলেন। সিনেমার জন্য সর্বচ্চো আত্মত্যাগেও তিনি পিছুপা হননি কখনো। স্টকার  চলচ্চিত্র করার সময় ক্যান্সারের ঝুঁকি নিয়েই পরিত্যাক্ত পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের কাছে শুটিং চালিয়ে গেছেন। ধারণা করা হয় এরই ফলশ্রুতিতে স্বাধীনভাবে ফিল্ম তৈরি করে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা মানুষটির ১৯৮৫ সালে লাং ক্যান্সার ধরা পড়ে। অবশ্য এতো কিছুর পরেও তিনি ৮৫ সাল পুরোটাই সুইডেনে ছিলেন এবং দ্য স্যাক্রিফাইস সিনেমার কাজ চালিয়ে যান। সিনেমাটিতে আমরা মানুষিকভাবে  যন্ত্রণাক্লিষ্ট অ্যালেকজান্ডার নামের একজন মানুষকে দেখি যিনি পারমাণবিক বিপর্যয়ের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে তাঁর সবকিছু আত্মত্যাগে প্রস্তুত। তিনি মনে করেন যা কিছু তাঁর প্রিয় অর্থাৎ তাঁর বাড়ি, এমনকি তাঁর সন্তান লিটিল ম্যান তাঁকেও তিনি এই পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য স্যাক্রিফাইস করতে রাজি। ফলে একদিন তিনি তাঁর পরিবারের সবাইকে বাইরে বেড়াতে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং সমুদ্রের পাশে অবস্থিত নিজের অত্যন্ত প্রিয় বাড়িতিতে আগুন ধরিয়ে দেন। অ্যালেকজান্ডার ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন অথচ আমরা দেখতে পাই আকস্মিক এক দুর্বিপাকের ঘোষণায় তাঁর জীবনে চরম দুর্দশা ঘনিয়ে আসে। তখন সে তাঁর শেষ আশ্রয় হিসেবে ভাগ্যবানকেই আঁকড়ে ধরে এবং ঈশ্বরের সন্তুষ্টির জন্য তাঁর নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করেন। 
স্যাক্রিফাইস সিনেমাটির শুটিং শেষ হওয়ার পর ৮৬ সালের জানুয়ারিতে।  এরপর তিনি প্যারিসের একটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন। নানাবিধ ঝামেলার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ছেলে আন্দ্রিয়ুস্কা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ছাড়া পেয়ে এসময় বাবার কাছে আসে। তারকোভস্কির হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় ১৯৮৬ সালের ৯ মে মুক্তি পায় দ্য স্যাক্রিফাইস ছবিটি। এটিও কান চলচ্চিত্র ফেস্টিভ্যালে জিতে নেয় গ্রান্ড প্রিন্স স্পেশাল জুরি প্রাইজ, ফিপ্রেস্কি প্রাইজ এবং প্রাইজ অব দ্য ইকুমেনিক্যাল জুরি। বাবার অসুস্থতার কারণে ছেলে বাবার হয়ে পুরষ্কারগুলো গ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্যারিসের একটি হাসপাতালে আন্দ্রেই তারকোভস্কি মৃত্যুবরণ করেন।  ১৯৮৭ সালের ৩ জানুয়ারি ফ্রান্সের রাশিয়ান সেমেন্ট্রি সেন্ট জেনেভিয়েভ-দেসবোয়ারে সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে।



এপিটাফে লেখা হয় ‘দেবদূতের দেখা পেয়েছিলেন এই মানুষটি’   




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন