কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৯

শিবাংশু দে



জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের রানি ৪













আজ সকলই কিংবদন্তী, পাতালে বাস করলে গুঁড়ো
সন্ধ্যেবেলায় পা ছড়িয়ে বসতে নাকি পাহাড়চুড়োয়?
নিত্যি নতুন পোক্ত তাড়ি
সর্বনাশের স্বপ্নে মেশা আঁধার করা বিষের হাঁড়ির -
শক্তি, খেতে একচুমুকে, মন্দ নয় সে-কান্ডখানা!
জগজ্জীবন চমকে দিয়ে ভাসতো সুবাস হাস্নুহানার-
আজ সকলই কিংবদন্তী!...”

দশটার মধ্যে বাড়ির চাবি আমাকে গচ্ছিত করে কৌশিক তো ভেগে গেলো  আমি ঘরে উঁকি
দিয়ে দেখি দুজনে দুটো তক্তপোশে একেবারে পপাত চ। দেড় বোতল ঠররা তখনও স্টকে
রয়েছে। ভাবলুম ঘুমোক যতোক্ষণ পারে  আমি একটু খাবারদাবারের ব্যবস্থা করি নাহয় 
সদর বাজার ঘুরে আসতে আসতে দেখি দু'জনেরই ঘুম ভেঙে গেছে  হাতমুখ ধোয়াধুয়ি  
চলেছে কুয়োতলায়। আমি ঘরে ঢুকে পাতাফাতা সাজাতে সাজাতে দেখি কৌশিক ফিরে 
এসেছে।

-কী হলো, চলে এলি ?
-আরে বলিস না সুব্রতদা'কে তো চিনিস, আমার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার...
-চিনি তো..
-সে কম বয়সে পদ্যটদ্য করতো। গিয়ে বললাম আজ আমার বাড়িতে বুড়ো এসেছে, 
শিবাংশুকে একা ঠেকিয়ে দিয়ে এসেছি... ছেড়ে দিলে ভালো হতো..
-ছেড়ে দিলো ?
-দিলো তো... পদ্যের মহিমা খুব পাওয়ারফুল...

"কোথায় গেলি রে..." হুংকার দিতে দিতে নায়কের প্রবেশ  খালি গায়ে, কৌশিকের একটা 
লুঙ্গি জড়িয়ে, চুলের থেকে জল ঝরছে...
-আছি, আছি, তোমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করছি..
-বাহ বাহ, লক্ষ্মী ছেলে, বেদম খিদে পেয়েছে বুঝলি....
আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, আরেহ, এটা কে আবার ?
-  হলো শিবাংশু, জামশেদপুরের, তোমাদের লাইনের লোক...
-অ্যাই ব্যাটা, তুই জামশেদপুরের, কমল'কে চিনিস?
-হুমম, চিনি...
-ও পেয়েছেটা কী ? শক্তি চাটুজ্যে পদ্য দিলে লোকে কভারে সেটা ছাপে, আর  বলে কি 
দেরিতে পেয়েছি, ছাপবো-ই না...
- এই গপ্পোটা তো আমি জানিনা। ঠিক আছে দেখা হলে জিগাবো এখন...
-জিগাবি কী ? ওর বদলে এখন তোকে পেয়েছি, তোকে মেরে আমি এখন খন্ড'ৎ বানাচ্ছি দাঁড়া 
- অ্যাই বুড়ো, শিবাংশু'র সঙ্গে ঝাড়পিট কোরোনা, পাক্কা বিহারি, নিজে মার খেয়ে যাবে...
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস, ওকে এবার ছেড়েই দিই তবে...

কাছারির সামনে সরাইকেলা হোটেলে মাটনলিভারের একটা ফ্রাই দারুণ বানাতো। সেটার
সঙ্গে রুটিফুটি আর কিছু আনুষঙ্গিক নিয়ে এসেছিলুম  জমপেশ খাওয়া হলো একেবারে। শুধু
সেই ঠাকুরবাড়ির কবি ক্ষণে ক্ষণে এলিয়ে পড়ছিলো  ওস্তাদ বললেন,  ব্যাটা আসল মাল
কখনও খায়নি তো, স্কচ-ফচ খায়, টেঁসে না যায় আবার...
আমি কৌশিককে বলি, যা লেবুটেবু খাইয়ে বমি করিয়ে দে, নয়তো পরেশান করবে...
একটু পরে দু'জনে ফিরে আসে  ঠাকুরকবি কিস্যু না বলে সোজা তক্তপোশে গিয়ে শুয়ে পড়ে 
বাইরে তখন প্রচন্ড রোদ, এপ্রিলের শেষ  কৌশিক শুধায়, কী বুড়ো নিমডি যাবে নাকি?
-নাহ, আমি আর কখনও নিমডি যাবোনা  আমাকে একটা খাতা-কলম দে, আর বকবক
করিসনা একদম... নয়তো মেরে খন্ড'ৎ...
আমরা বেরিয়ে পাশের ঘরে চলে যাই।
রোদ একটু পড়তে কবি বললেন, হ্যাঁরে লুপুংগুটু যাওয়া যাবে ?
-হ্যাঁ, যাওয়া যায়, কিন্তু হেঁটে যেতে ঘন্টা খানেক লেগে যাবে..
-চল তাহলে...
-তোমার চ্যালার কী হবে ?
-আরে ওকে ঘুমোতে দে, সুখী বালক...

চাইবাসার অন্ধিসন্ধি কবির জানা। আমাদের জন্মের আগে থেকে, সমীর'দার প্রথম চাইবাসা
বাসের সময় থেকে ওঁদের এই সব গলিঘুঁজি নিয়ে কারবার। নিজেই রাস্তা চিনে চললেন তিনি 
এস পি জি মিশনের পিছনের মাঠ পেরিয়ে সোজা নামোদিকে আমরা চললুম লুপুংগুটু  ওখানে
একটা ক্ষীণ পাহাড়ি জলধারা ছিলো  পুরোনো বনস্পতি আর রোদে পোড়া ঘাসের মাঠ, 
মাঝখান দিয়ে পায়েচলা মেঠো রাস্তা  আর একটু এগোতেই একটি চেনা দৃশ্য। মৌয়া সেদ্ধ 
করছে কয়েকজন  গার্হস্থ্য ভাটি, শাদা ধোঁয়া আর   করছে মৌয়ার বাস  এই গন্ধটা 
আমার কখনও সহ্য হয়না  সুদূর কলকাতার কবিরা এই গরল সেবন করতে রাত জেগে 
ট্রেনে চেপে আসেন,কতোকাল হলো। কবি বলেন, ব্যস এখানেই বসা যাক । চাখনা বলতে ভেজা চানা আর
নুন-লংকা, আর কী চাই?
ঘর্মাক্ত শরীর, এলোমেলো কথামালা, কে জানে গরলই কি না প্রকৃত পানীয়, অমৃতই
বিষ...
ফিরে আসার সময় কবির হেঁটে আসার সাধ্য নেই। রিকশা নিতে হলো।

----------------------------------------

“প্লাতেরো আমারে ভালোবাসিয়াছে, আমি বাসিয়াছি
আমাদের দিনগুলি রাত্রি নয়, রাত্রি নয় দিন
যথাযথভাবে সূর্য পূর্ব হতে পশ্চিমে গড়ান
তাঁর লাল বল হতে আলতা ও পায়ের মতো ঝরে
আমাদের-প্লাতেরোর, আমার, নিঃশব্দ ভালোবাসা ।"

মধুরিমার বাবা ছিলেন একটু অন্যধরনের মানুষ। টাটাবাবার স্মেলটারের আগুন আর 
পুড়িয়ে দেওয়া উত্তাপ তাঁর ভিতরের জলধারাকে শুকিয়ে দিতে পারেনি। গান-কবিতাজীবনের
গভীরতর সন্ধানের দিকে অমলিন টান রয়ে গিয়েছিলো । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'চতুর্দশপদী
কবিতা' ছিলো তাঁর প্রিয় বিলাস । আমাদের বিভিন্ন আড্ডা-জমায়েতে অবাধ আসতেন।
বয়সের ফারাক বা বোধের পরিণতি আলাপের মধ্যে কোনও অস্বস্তির কারণ হতো না 
কখনও। চাইবাসা থেকে ফিরে মাঝেমাঝেই তাঁর বৈঠকখানায় আড্ডা হতো আমাদের। 
শক্তি ও বিনয়'কে নিয়ে আমার পাগলামির প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা ছিলো। এই দুই 
কবির কবিতা নিয়ে কথাবাত্তা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠতো প্রায়ই। সেই কথা 
চালাচালির চালচিত্রে শিবের মতন দাঁড়িয়ে থাকতেন জীবনানন্দ । রিমা আগের মতো 
ওদের বাড়ি গেলেই ঘরে এসে বসতো না । কখনও সখনও আসতো, কিন্তু মৌনতাই হয়ে 
যেতো তার অবয়ব। একদিন রাতে ওদের বাড়ি থেকে বেরোবার সময় এগিয়ে দিতে এলো 
বাগান পেরিয়ে । সেদিন চাঁদ ছিলো, হাওয়া ছিলো, ভাসাভাসি হাস্নুহানার গন্ধও ছিলো 
চারদিকে। এ রকম একটা সময়ে সে আমায় বলে, শিবাজিদা, আমাকে কোনোদিন
শক্তির কবিতা শোনাবে, বুঝিয়ে দেবে একটু?
-সে কী রে? তুই বাংলা কবিতা শুনবি ? তাও আবার শক্তির,...?
-কেন, কবিতা কি শুধু পর্ণার জন্য...? আমি....
-আরে শোন শোন... নিশ্চয় শোনাবো...
সে আর অপেক্ষা করেনি, রুদ্ধশ্বাসে ছুটে ফিরে গিয়েছিলো । এতো অচেনা হয়ে গেলো
মেয়েটা ।

অচেনা হয়ে গেলো তো অন্য মেয়েটাও। দিল্লির স্কলারশিপটা পর্ণাকে এগিয়ে দিয়েছিলো
অনেকদূর । ওখান থাকতেই ইন্ডিয়ানা থেকে একটা স্পন্সরশিপ পেয়ে যায় । আমিও খুব
উৎসাহী ছিলুম । যাবার আগে যতোদিন বাড়িতে ছিলো রোজ দেখা করতে চাইতো। সেই
পুরোনো যাবো কি যাবোনা,  হ্যামলেটীয় সংলাপও শুনতে হতো আমাকে । আরে দু'টো 
বছর তো, পলকে কেটে যাবে।

-তোমাকে বিশ্বাস করিনা...
-সেটা ঠিক, কিন্তু একটু করেই দেখোনা, ঠকবে না...
-নেচার অ্যাভরস ভ্যাকুয়াম...
-ভ্যাকুয়াম কোথায় ? ঘাড়ে চড়ে তো আছো-ই...
-সেটাই তো ভয়, সামনে আছি তাই ভালো ছেলে... নয়তো দেশে মধুরিমাও তো আছে...
-আহা ঐ মেয়েটাকে কেন বারবার না জেনে চিমটি কাটো...
-বাহ, স্বরূপ বেরিয়ে পড়েছে দেখছি.. এতো দরদ...
-লো, সুধরেগি নহি বিলকুল...
-নিজেকে শুধরাও আগে, আমি কিছুতেই যাবোনা....
-আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে...
-ঠিক, আমিই পাগল..

দিল্লি গিয়েছিলুম পর্ণাকে সী অফ করতে । কী দুর্বল চড়াইয়ের মতো ভাবসাব। এয়ারপোর্টের
গেটে দাঁড়িয়ে, যেন ঢুকলেই বিপদ । ওর বাবা-মা আমাকে বলছেন, ওকে বোঝাও।
বিদেশ-বিভুঁই জায়গা, কতো শক্ত হতে হবে...। কে কাকে বোঝায় ?

আমার বন্ধু সন্দীপন তখন কলম্বস, ওহায়োতে। ওর ঠিকানা দেওয়া ছিলো । খুব পরোপকারী
ছেলে, কোনও অসুবিধে হতে দেবেনা। কিন্তু কোনও আশ্বাসই যথেষ্ট নয় । তখন
অ্যারোগ্রামের জমানা। পাৎলা নীল কাগজ হয়ে অনেকদিন পর্ণা আমার কাছাকাছি ছিলো ।
কিন্তু সব নীল কবে জলের আল্পনা হয়ে মিলিয়ে গেলো, তার খতিয়ান আর রাখা হয়নি।
"হঠাৎ হারিয়ে গেলো, এলোমেলো হাওয়া, ভুল চাঁদ
তার নিচে দাঁত খুলে খোয়াই পেতেছে নীল ফাঁদ
বনের ভিতর হিংস্র জন্তু আছে, মানুষেরা আছে
গাছের শিরার মতো সাপ আছে ছড়িয়ে সেখানে-
এখন কোথায় সে কে জানে?
এখন কোথায় সে কে জানে? .....
...পাথর গড়িয়ে পড়ে, গাছ পড়ে বোধে
মানুষ হারায়, তা কি মানুষেরই ক্রোধে ? "



(ক্রমশ)


(সৌজন্য-গুরুচণ্ডালি)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন