কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৫

অনিন্দিতা গুপ্ত রায়

অচিন পাখি


প্রতিদিন সকালে পাখিটা ডাকে। ভোর হওয়ার আগে থেকে... তীক্ষ্ণ খসখসে কান্নার মতো একটানা গোঙানির আওয়াজটা ঘুমের ভেতর দিয়ে যেন হাড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে  যায়। চাঁপা গাছের ডালে পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটা অস্তিত্ব অনস্তিত্বর মাঝামাঝি আঠার মতো আটকে থাকা কান্নাটা। ওটা আমার সাতমাসে পেটের মধ্যে  মরে যাওয়া বাচ্চাটা রে... আমাকে ডাকে আর কাঁদে... সূপর্ণা বলেছিলচুপ্‌ কর, এরকম বলতে নেই! ম্লান হাসিটা সূপর্ণার... বেশ বলব না। তবে এটাই ঠিক। আমি জানি। ও যা খুশি জানুক, আমি অনেক চেষ্টা করেও দেখতে পাইনি আওয়াজের  উৎসটা ঠিক কী! খুঁজেই পাইনি। ওটা আদৌ পাখি, নাকি অন্য কিছু, কে জানে!   এরকম একেকটা কান্না থাকে। যেগুলোর সবগুলো তো আবার শোনাও যায় না সবসময়। একটা বল ড্রপ খেতে খেতে বুকের বারান্দা ধরে গড়িয়ে যায় আর কীরকম শিরশির করতে থাকে চোখের ভেতর... দেওয়ালের ওপর নখের আঁচড় কাটলে যেরকম হয়... অনেকটা সেরকম। শরীরে শরীর ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে একটা ঢেউ থেকে আরেকটা ঢেউ-এ যাওয়ার অসামান্য রতিবিন্দুতে যেরকম হারানোর ভয় কান্নার  মতো বাস্পায়িত হতে থাকে কখনো। আর ঠোঁটের ওপর বসে যায় দাঁত, আরো  তীব্রতায়, আরো আশ্লেষেএকটা দুপুর দিবি আমায়? বল্‌...! যেরকম দুপুরে জ্বর  বেড়াতে আসে পায়ের তফাতে। তাকে আলুভাতে, কালোজিরে বাটা, গন্ধরাজ লেবু দিই মুসুর ডালের তারল্যে। ভাদ্রের গলার ভাঁজে জমে ওঠা হিম, ব্যক্তিগত ঋণ, যেন কত বছরের পুরনো দোসর। সেইরকম একটা দুপুর পেয়ে বসছে আমাকে। হাতির দাঁতের একটা চিরুনি ছিল বাড়িতে। আর কোমর ছাপানো চুল। দুপুর রৌদ্রে আলো আঁচড়াতে আঁচড়াতে লম্বা বিনুনিতে কাঁচি লিখে দিয়েছিল কাটাকুটি আর গোল্লাছুটের খেলা। তুই ঠিক জানিস, এটা সেফ পিরিয়ড?... হ্যাঁরে বাবু! আর সেই জানা ভুল প্রমাণ করে  একটা ছোটগল্পের জন্ম হয়, আখ্যান। খান খান শব্দ করে ভাঙতে থাকে সকালরঙা আয়না। রোদ ঠিকরোনো কাচের একটা টুকরো আচমকা আলো ফেলে, তারপর  আলোর চৌকাঠ টপকে ধূলোর সমান্তরালে একটা সুঁড়িপথ খুলে যায়। খুব সাবধানে, আলগোছে ধূলো সরিয়ে সরিয়ে সেই পথটায় পা রাখি। একটা ওয়ান্ডারল্যান্ড ভেতরে। কবেকার হারিয়ে যাওয়া ফাউন্টেন পেনটা কুড়িয়ে পাই। এটা দিয়েই সেইসব চিঠিগুলো লিখতাম তোকে...। কী লিখতাম, এখন ঠিকঠাক মনে করতে পারছি না যদিও।  এপাড়ায় কোনো ডাকবাক্স চোখে পড়েনি তো অনেককাল! তাই অপেক্ষারা নেই। যেরকমভাবে, একলা একটা স্টেশনে বসে আছিস। হু হু হাওয়া। খুব কুয়াশা চারপাশে। দুপুরটাকে কীরকম ভোর বলে ভ্রম হচ্ছে। তুই একা, বিলকুল একা,  বেবাক। ভারি জিন্স্‌, ভারি জ্যাকেট, কায়দার টুপি, মাফলার, হাতমোজা, পাঢাকা জুতো। আর এসবের সাথে একদম কনট্রাস্টে তোর খোলা লম্বা আলুলায়িত চুলগুলো উড়ছে। কুয়াশার গন্ধ নিচ্ছিস তুই, আর কুয়াশা নেমে এসে তোর খোলা চুলে মুখ ডুবিয়েছে। হেনার গন্ধ, শ্যাম্পুর গন্ধ, ধূলোর গন্ধ, আর কুয়াশার গন্ধ মাখামাখি করছে। কোথাও কি যাবি তুই? নাকি আসবে কেউ? আরোহণ নাকি অবরোহণ... কি ঘটতে পারে? নাকি অন্য কোনও গল্প আছে ওখানে? ওই প্ল্যাটফর্ম, ওই নির্জনতা, ওই ভেজা বাতাস, ওই না আসা ট্রেন, ওই অন্যমনস্ক আলগা হয়ে বসে থাকা... আর ওই মারাত্মক দুটো লাইন। পাশাপাশি, সমান্তরাল। অনন্তের দিকে। উফফ্‌... কী সর্বনাশ! একথা আগে মনে আসেনি কেন? আর মনে আসেনি বলেই তোর চলে  যাওয়ার পথ ধরে এতক্ষণ লাল কার্পেট পড়ে থাকল অবিন্যস্ত। অথবা সেই গল্পের মতোই যদি কোনোদিন সেই ট্রেনটাই আর না এসে থাকে... এরকম কি হয় না, সত্যিই কি হয় না কখনো? আকাঙ্ক্ষিত লাস্ট ট্রেন যেমন আসে না কখনো...? জানা হয়নি। সম্ভাবনার পর সম্ভাবনা জুড়তে জুড়তে কেবল পরিধি থেকে ছিটকে উঠেছে চরিত্রগুলো। একটা পাখি কাঁদতেই থাকে। একটা বল বুকের ভেতর ড্রপ্‌ ড্রপ্‌ ড্রপ্‌...  একটা আন্‌সেফ পিরিয়ড... একটা অপেক্ষার স্টেশন... একটা কুয়াশার মধ্য দিয়ে ভেসে আসা অথবা না আসা ট্রেনের কেবিন থেকে... হাজারো খোয়াইসেঁ অ্যাইসি কি হর খোয়াইসেঁ মে দম নিকলে... বহত্‌ নিকলে মেরি আরমাঁ লেকিন ফির ভি কম্‌ নিকলে...             

1 কমেন্টস্: