হেরম্বচরিত
হেরম্ব ও জলধোয়া
হেরম্ব হেঁটে যায়। কান্নার পর কান্না পেরিয়ে শীত বর্ষা বজ্র ঝড় সব কিছু সঙ্গে
নিয়ে মাইলের পর মাইল। যাত্রাকালীন সময়পর্বে কত কত লোকমানুষের সঙ্গে তার দেখা হয়। দেখা
হওয়াটা বড় নয়। দেখা তো হতেই পারে। দেখা হওয়ার মধ্যে আবশ্যিক সূত্র সংযোগ অতি জরুরী ভাষ্যপাঠের মতো সংগত
হয়ে উঠতে থাকে। একেক হাট থেকে গোলকধাঁধার বৃত্তায়ন ভেঙে ভেঙে বিচিত্রতর সব হাট হেরম্বর
উল্লম্ফন ধ্বনি প্রতিধ্বনির চিরন্তনতার মতো ঘোর তৈরি করে। জলধোয়া বসুনিয়া আব্রাহাম মিনজ অথবা মেচেনীবুড়ি
বুধেশ্বরীর উষ্ণতায় আন্তরিক হয়ে উঠতে থাকবার এক রসায়নে নদী মাঠ প্রান্তর গঞ্জ হাট টাট্টুঘোড়া গরুর গাড়ির
হ্যাঁচোর প্যাঁচোড় সমস্ত আবডাল টপকে পুনরাবৃত্তির মধ্যে ডুবে যেতে চায় বারংবার। হেরম্ব হাঁটতে থাকে, সর্বঅঙ্গে মাখতে চায় কেবল
জীবন আর জীবন। নদীর শুকনো খাতে ভাবনাকাশিয়ার বনের মধ্যে মানুষের পায়ে পায়ে জেগে ওঠা নতুন
নতুন সব পথ ধরে ধরে তার হেঁটে যাওয়া অন্তহীন ও অতিজীবন্ত ছবির মতো আবশ্যিক হয়ে
ওঠে। আবশ্যিকতার বাঁকানো অংশগুলিতে কুশাণ পালার মেয়েরা কখনো নেচে ওঠে গানের সুরে
সুরে। নদীর কিংবা নদীখাতের খুব গোপনতা থেকে দোতারা বাঁশিও বেজে উঠতে পারে। বেজে ওঠার সাবালকত্বের জন্য
অপেক্ষা না করে হেরম্ব এগিয়ে যেতে থাকে হাঁটাপথে। জলধোয়া বসুনিয়ার সখ্যতাকে
অস্বীকার করা যায়; উপস্থিতিকেও। এই মতোন ভাবনাকে প্রামাণ্যতার
সহজিয়ায় ভাসিয়ে দেবার সুযোগ কখনো আসলেও সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করবার আগ্রহকে সামগ্রিক
এক জলবর্ষায় মিশিয়ে দিতে চাইবার প্রাণপণ আকুতিটুকু বুকের খুব নিজস্ব নিভৃতিতে ক্রমাগত
আগলে রাখতে চায় হেরম্ব। আত্মপরিচয় খুঁজতে গিয়ে রহস্যময় জীবনকথার জালে প্রবেশ করতে
গিয়ে সে কিন্তু তার সততাটুকু হারায় না। হেরম্ব হেঁটে যায় অতিবিরল এক দৃশ্যের গুরুত্বপূর্ণ
অংশ হয়ে।
হাটপুরাণ
জেগে থাকা হাটগুলি নদীনালার কোলে। হাট ঘুমোয় না। হাটতলা শান্ত হয় তবে ঘুমোয় না। না ঘুমোবার তত্ত্বতালাস
দু’একটা বেড়াল কুকুর গরু ছাগলের সযত্ন রচিত বিশ্রামাগারে পরিণত হয়ে উঠতে পারে। তখন হাটতলায় বেড়াতে বেরোয়
মহাকালের ষাঁড়। বাইসনের মতো বাঁকানো শিং-এর গাম্ভীর্যতায় মহামহিম দৃশ্যের মতো দৃশ্যান্তর যেন। শাকের আঁটি বিক্রি করতে আসা ধনবালা বর্মন, খইচালু দাস বিভ্রম ভেঙে
দৌড়তে পুনর্বার বিভ্রমেই ফিরে আসে তারা। হাট ঘুমোয় না, তবে আড়মোড়া ভাঙে, পাশ ফিরে শুয়েও পড়তে পারে
খানিকক্ষণ। মাইক বাজিয়ে জড়িবুটির কবিরাজি ঔষধ বিক্রি করতে থাকে নিয়ামত কবিরাজ। কবিরাজের কিসসাকথন থামতে না
চাওয়া ফুরোতে না চাওয়া গল্পগুলিকে প্রসারিত করে পল্লবিত করে। কবিরাজের গলার শিরা ফুলে
ওঠে, কাঁপুনি কম্পন এসে যায় খানিকটা। তার শাকরেদরা চা খায়, ঢোল বাজায়, জমায়েতকে সংগঠিত হতে দেবার
সুযোগ দেয়। হাট ঘুমোয় না, হাটে হাটে গড়াতে থাকে দাঁতব্যথার ঔষধ যৌবনবর্ধক টনিক বাতব্যাধির মালিশমলম। জমায়েত হাসে। হাসির লহর ওঠে। যেন ধানক্ষেতে হলখল, বাতাসফেরি। জমায়েত শুনতে থাকে
মিঞা-বিবির কিসসা, আলাদিন দেউনিয়ার চার নম্বর বিবির নিশিযাপন বৃত্তান্ত, চোরচুরনীর গান, আরো আরো কত কী! হাটের মূল অংশ বলে তো কিছু
নেই, গলি তস্য গলি গলিপথের যোগবিয়োগ প্রশাখার মতোন ছড়ানো অংশগুলির অধঃক্ষেপ জড়ো হতে
হতে একসময় হাট মূলগত ঐক্যের রূপ ধারণ করে। তখন কালো কালো মাথার জনসমাবেশ থেকে বোঝাই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে
যে, কোনটা হাটমুখি আর কোনটাই বা হাটফেরত। কৌতুকপ্রবণ এক সমাবেশ থেকে
প্রবেশ প্রস্থানের লোকপুরাণের মাথা তুলে দাঁড়ানো। লোকপুরাণ কি তবে অনিবার্য অংশ রূপে
হাটকে স্বীকৃতি দেয়, নাকি স্বীকৃতির অপেক্ষায় না থেকে
হাটই হাটপুরাণে রূপান্তরিত হয়ে লোকপুরাণের অভিনব ভাষ্য রচনা করে!
ইতিহাসটুকরো
এইভাবে জঙ্গলঘেরা এক জনপদের ভিতর এসে পড়ে হেরম্ব। ভয়াবহ সব জঙ্গল। দূরে দূরে ভূটান পাহাড়ের
দৃশ্যঘের। জঙ্গল সন্নিহিত অনেক অনেক জলাভূমি। বড় বড় মহিষের পাল শরীর
ডুবিয়ে বসে থাকে। এসব জঙ্গলের অনেকটাই কোচবিহারের রাজাদের রিজার্ভ ফরেষ্ট ছিল। একদা স্বাধীন, পরে করদ মিত্র রাজ্য। রাজা মহারাজা জমিদার
ব্রিটিশ রাজপুরুষেরা শিকার খেলতেন। বাঘ বাইসন হরিণ শুকর মারতেন। আগুন জ্বালিয়ে বিদেশী মদের
গ্লাসের সহযোগে ‘ক্যাম্প ফায়ার’ হতো। শিকারের হাঁকোয়ালী করানো হতো স্থানীয় গ্রামবাসীদের
দিয়ে। হেরম্বর স্মৃতিতে আছে এক রাজার শিকারযাত্রার বর্ণময় দৃশ্য। কাছেই ছিল রাজার দীঘি। শুটিংক্যাম্প। সাহেবপোতা।
চিলারাজা বা নলরাজার গড়। মহারাজার শিকারতাঁবু পড়ত শুটিং ক্যাম্পে। রাজার দিঘিতে স্নান সারতো
রাজাবাবুর যত হাতি ও ঘোড়ার দল। কোচবিহার রাজবাড়িও হেরম্বর দেখা। সে এক আলোয় আলোয় আতসবাজিতে
জেগে থাকা রাজনগর। উৎসবমুখর।
রাজাবাহাদুরের ছোটবোনের বিয়ে বলে কথা। সেই পাঁচশো বৎসরের জৌলুসময় রাজতন্ত্র আর নেই। রাজরাজেরাও কবে উধাও। হেরম্ব কি সামান্য
স্মৃতিকাতরতা টের পায়! স্মৃতিকাতর হয়ে পড়বার জন্য বিশেষ কোন আন্তরিকতা আছে বলে মনে
হয় না। তবু জীবন্ত, মৃত, অতিজীবিত স্মৃতিসমগ্রতা বিস্তৃত এক স্মৃতিখন্ডে হাত বোলাতে থাকে সদাতৎপরতায়। হেরম্ব তার সুপারী গাছের মতো মেদহীন সতেজ শরীর
নিয়ে স্মৃতিকাতরতার এ এমনই সংযোগ সমাধান সূত্রহীন জটিলতাময়তা, যার কোনো প্রতিশব্দ হয় না; আর খেই
হারানো মানুষের স্মৃতিমুখরতার আশ্রয়ের নিবিড় নৈকট্যে হেরম্বচন্দ্র তার ভবিষ্যতকে বুঝি ভবিষ্যত হীনতায় যুক্ত করে দেয়।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন