জিনাত ইসলাম
শূন্য ধ্রুবাঙ্কের পৃথিবী
“ভারত আমার ভারতবর্ষ স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো...”
জীবনের ১০টি বছর নিরবিচ্ছিন্ন
ভাবে বিদ্যালয় অ্যাসেম্বলীতে দেশমাতার উদ্দেশ্যে ভক্তিভরে এই বন্দনা করে এসেছে যে
ছোট্ট শিশু, সে হয়তো জানতেও পারেনি, সেই দেশের ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি একদিন তার কাছে নাগরিকত্বের
হিসেব চাইবে। এক নিঃসীম অন্ধকারে মুখ লুকাবে তার আত্মপরিচয়। তীব্র যন্ত্রণায় ছিঁড়বে মনের তার। ভারত ভাগ্যদেবতা তার ললাটে
এঁকে দেবে এক অন্তিম জিজ্ঞাসা চিহ্ন। প্রশ্ন একটাই - পুবের আকাশের ওই
সূর্য আসলে কার জন্য কিরণ দেয়? কাশফুলের নোয়ানো
মাথার কতটুকু আমার? হেমন্তের বাতাসের ঠিক কতটা
আমার শরীর ছোঁয়ার দাবিদার? শিউলির মলিনতার কতটুকু দায়
আসলে আমার? এই আমি যার অন্তিম সত্ত্বাটুকু শুধু এই দেশের জল, হাওয়া, নদী, পাহাড়ের জন্য, তবু সংকটের
মুখোমুখি একজন পরাজিত শৃঙ্খলা
ভঙ্গকারী সৈনিক ছাড়া আমি কিচ্ছু না। হোক তবে চর্চা সেই ঘাতকের
জীবনদর্শনের ইতিহাস।
একজন সৎ বিদ্যালয় পরিদর্শক
আমার বাবা বদলি হয়ে এলেন নতুন শহরে, বহরমপুর তার নাম। মুর্শিদাবাদ এক ঐতিহাসিক নামী এলাকার প্রধান শহর। বাবার বেতন সামান্য, তারপর আবার ‘বেজাত’। অফিসে প্রথমদিন চেয়ারটাও মিলল না। পাশে রাখা বেঞ্চে বসেই কাটল সদর
নর্থের নতুন জয়েন করা সাব ইন্সপেক্টরের দিন। বাড়িভাড়াও মিলল না তার। আমার মায়ের লাল রঙের টিপ ও মাথাভর্তি সিঁদুরের বিকল্প লাল শ্রীমতী কোম্পানির সিঙ্গার পারল না
শেষ রক্ষা করতে। আমাদের চুপিসারে জল বলতে শেখানো, ভাইজানকে দাদা বলতে,
চাচাকে কাকু বলতে, ফুফুকে পিসী বলানোর দীর্ঘ অধ্যাবসায় জলেই গেল। আমারা নকল করেও আসল
রঙের জালে ধরা পড়লাম। বাবার নিজের নাম ও গোত্রের সঙ্গে
সাযুজ্য থাকা এলাকায় যেতে না চাওয়ার জেদ
অগত্যা ছাড়তে হলো। ৯ নং, রানী মন্দির লেন, খাগড়ায় ঠাঁই হলো চারটি প্রাণীর। আমি ছয়, দাদার নয় বছর বয়স। নতুন বাড়ির ভাড়া নব্বই টাকা, যা বাবার আর্থিক অবস্থার সঙ্গে খুব ভালো ভাবে
ফিট হয়ে গেল। সরু চুলের মতো গলিরাস্তায় শুধু ছেলে-মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষৎ-এর লক্ষ্যে দিন
গুনতে লাগলেন তাঁরা। পাশেই এক ভেঙ্গে পড়া
যৌথ পরিবারতন্ত্রের শেষ পর্যায়ে উত্তীর্ণ এক বেসামাল ঘরানার দলবদ্ধ কিছু মানুষ
হলেন আমাদের প্রতিবেশী। জানতে পারলাম, আমাদের স্পর্শ করলে
তাদের স্নান করতে হয় বা কাপড় ছাড়তে হয়। সারা
পাড়া জুড়ে ছিল একটি টিভি। বাড়িওয়ালী হাত ধরে নিয়ে গেল
সেই বাড়িতে। অনেকটা দূরে আমাদের বসতে
দেওয়া হলো। অন্যরা সবাই টিভি রুমে ছিল। জিজ্ঞাসা করে জানতে
পারলাম, আমাদের ছোঁয়া যাতে অন্যদের না লাগে তাই এই বিশেষ ব্যবস্থা।
আমার মা আমাকে নিয়ে বাবার এক সহকর্মীর
বাড়িতে উলের ডিজাইন নিতে গিয়েছিলেন। সেখানেও আমাদের জন্য আলাদা কাপ ও আলাদা বসার জায়গা ছিল। একদিন দুপুরে আমার
গ্রামে থাকা কাকু এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। বলতে থাকলেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, “আমার পুলিশের চাকরিটা হলো না। আমাকে নাম জিজ্ঞাসা করে বাদ
দিয়ে দিল”। মাকে দেখলাম চোখ মুছতে মুছতে বলছে, “আমাদের কি চাকরি হয়? আমাদের নেবে না”। কানে প্রতিধ্বনি হতে থাকে আজও, দাদা খুব ক্ষোভের
সঙ্গে বাবাকে ফোনে বলছে, “আমার নামটা এমন রাখতে কে বলেছিল? সব ইন্টারভিউতে আমাকে বলছে, ইসলাম হো? ইসলাম
নাম হ্যায়? আমার কোনো ভালো চাকরি হবে না!” ‘গুহং ব্রম্ভ যদিদং
তে ব্রবীষ্মি ন
মানুষাচ্ছেষ্ঠতেরম হি কিঞ্চিৎ’ – অর্থাৎ ‘মানুষের
চেয়ে শ্রেষ্টতর আর কিছুই নেই’ – কথাটা কেমন যেন
প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলল আমার কাছে। ‘ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার
ধরি, আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি’ – গাইতে গিয়ে অস্ফূট কান্নায় গলা বুজে
আসত। হাতড়ে বেড়াতাম একজন
পরিত্রাতা, যে আমাকে মুক্তি এনে দেবে এই দুরপনেয় গ্লানি
থেকে। বুঝেছিলাম, আমার চিন্তা কল্পনা
ও স্বপ্নের জগতের বাইরে আছে এক ধ্রুবাঙ্ক, যা আমার আকার
চেহারা ছাপিয়ে অন্য কিছুকে বোঝায় আর
সেটা ভালো কিছু হতে পারে না; আর তার জন্য অন্যরা
আমাদের এড়িয়ে যায়, অপছন্দ করে, ভালোবাসে না। এক কুয়াশা ঘেরা
অচেনা জগতে বুকে ভর দিয়ে আমরা হা্ঁটা-চলা শিখলাম ধীরে ধীরে। শক্ত হতে থাকল মন, মানিয়ে নিতে শিখলাম সব অসঙ্গতিকে, বিসদৃশ সব
ঘাত-প্রতিঘাত ও অবিশ্বাস্য সত্যকে।
তখন ক্লাস টেন। বন্ধুদের মধ্যে কথা কাটাকাটি করে একজন বলে ফেলল, “তোরা তো যে পাত খাস সে পাত উলটাস”। এমন প্রবাদ বচনের আকস্মিক প্রয়োগে আমি রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম। তার সঙ্গে কথা বন্ধ হয়ে গেল অনেকটা সময়ের জন্য। কিন্তু আজও আমি বুঝতে পারিনি, হঠাৎ আমি বহুবচন ‘তোরা’য় রূপান্তরিত হলাম কী করে! আর সত্যি সত্যি এই পাত কিসের পাত ছিল আর কে উলটিয়েছিল আর কেনই বা সে দায় আমার ওপর বর্তাবে? এই অভিশপ্ত জীবন কয়েক মুহূর্তের জন্য খুব ভারবাহী হয়ে উঠেছিল সেদিন। যে নজরুল গীতি শুনতে আমি বিন্দুমাত্র আগ্রহী ছিলাম না কোনো এক অজ্ঞাত কারণে, আমার নাম এই বিভাগেই ঘোষণা হতে থাকল বারবার। ভুল করে, নাকি বৈধতা বিচারে, ঠাওর করে উঠতে পারিনি আজও। অনেকেই আমাকে আই.পি.এস নজরুল ইসলাম ও কবি নজরুল ইসলামের পারিবারিক কেউ বলে চিহ্নিত করেছে বহুবার। অপার বিস্ময়ে তাকেও মস্তিষ্কবন্দী রেখেছে অ-দৃষ্ট জীবন।
সময়ের সঙ্গে যেন বদলে গেল অনেক কিছুই। ভুলতে থাকলাম সব পুরনো স্মৃতি একটু একটু
করে। বাবার বদলি ও পদন্নোতি চলতে থাকল। অন্যান্য সব মধ্যবিত্তের মতো আমাদেরও একটি নিজের বাড়ি হলো। মা ছেড়ে দিলেন সিঙ্গার
মাথায় দেওয়া। আমিও কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথ ধরলাম। দাদাও ইঞ্জিনিয়ারিং
পড়তে থাকল। সেবার সরস্বতীপুজো উপলক্ষ্যে ঠাকুর নির্বাচনে আমি বাতিল
ঘোষিত হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হষ্টেলে। কেননা, আমি নাকি বৈধ নই! মনের দুঃখে সেইদিন
হস্টেল ছাড়লাম, পুজোর সময় থাকব না, এই অভিমান নিয়ে। পরে সেখানেই
শ্মশানের জুঁই গাছের ফুলের মতো কাটল দুটি বছর। পরীক্ষা শেষে আবার
পেয়িং গেষ্ট থাকার অভিজ্ঞতা। আবার বাতিল হবার পালা। মুখ বদল, শহর বদল, কিন্তু অবমাননা আর অমর্যাদার এক চেনা অন্ধ
পরিহাস শরীরকে এফোঁড় ওফোঁড় করতে থাকল নিঃশব্দে।
এই বাতিল হবার অন্তিম পরিণতি সর্বশেষ ভাষা পেল
শহরে ফ্ল্যাটের খোঁজে বেরিয়ে। আমাকে বলা হলো, এখানে আমি ফ্ল্যাট
কিনতে পারব না, মানে আমায় কিনতে দেওয়া হবে না। শান্তির শহর, পরিচ্ছন্ন শহর, ভালোবাসার শহর, ইতিহাসের
পীঠস্থানের বিশেষ কিছু এলাকার মাটি আমার জন্য
নয়। বাবা গর্ব করে বলতেন, “ন হি কল্যাণ কৃৎ
কশ্চিদ্দুরগতিং তাত গচ্ছতি” অর্থাৎ “কল্যাণকারীর কখনো দুর্গতি
হয় না”। বিষচক্রের মতো আবর্তিত হয়েছিল এই
কথা। এক অনির্দেশ্য
শক্তির উদ্দেশ্যে ভেতর থেকে মোচড় দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল ধিক্কার, কেন মানুষ করে জন্ম
দিলে? এই অশুভ শৃঙ্খলের পুনরাবৃত্তির অনিবার্যতা থেকে
রেহাই দাও।
ধারাপাতের মতো অকাতরে বর্ষণ হয়েছে
যে লাঞ্ছনা, তাকে আমি-মা- বাবা-দাদা পরিবারের
সবাই এক অমীমাংসিত অধ্যায়ের মতো জীবনের এক কোণে লুকিয়ে বিনা প্রতিবাদে এগিয়ে চলেছি। খণ্ডিত সব মর্মান্তিক
উপলব্ধিকে অনিবার্য মেনে নিয়ে যা মানুষকে ধারণ করে সুখে দুঃখে সর্বসঙ্কটে, তাকেই ধর্ম বলে
জেনেছি। “যত্র মে সজ্জতে
মনঃ” – বাবা বলতেন, এখানেই আমার মন
আসক্ত, এটাই আমার দেশ। আমিও বাবার মতো সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে
বলি, জীবনের সব ঋণ এখানেই শোধ করে যাব...। শরীর
মুক্তি পাক সেই মাটিতে যা একদিন আমায় ধারণে অস্বীকৃত ছিল এক
অত্যাশ্চর্য নীরবতায়, নির্লজ্জ স্পর্ধায়।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন