উত্তরকথা
‘হাটের মইধ্যে হাট
ও রে শামুকতলার হাট...’
মধ্য হেমন্তের নরম রোদের
ভিতর হন্তদন্ত হেঁটে যাচ্ছেন কইকান্ত। তার হাঁটায় হন্তদন্ত থাকলেও আদতে তা মান্যতা পায় না। তবে হাটের গমগম শব্দের মোহেই কইকান্তকে কিন্তু হেঁটেই যেতে
হয় বিল-মাঠ-নদীর অতলান্ত এক ইতিহাস-ভূগোলে। এসব কিন্তু তেমন প্রেরিত না হয়েও থাক থাক সাজানো ধানের গোলায়, আন্ধারে ঘুরে মরা ইঁদুরদের নিজস্বতায় আত্মলীন হতে
হতে ইতিহাসের ইতিহাস হয়ে ছড়িয়ে পড়ার চিরকালীন সত্যের মিথ যেন
বা! তখন দূরের মাঠপাথার জুড়ে কুয়াশা নামতে থাকে আর হাউহাউ কুয়াশা সর্বশরীরে মাখতে
মাখতে খুব সংগোপনে কইকান্তর মিলিয়ে যাওয়া অন্তবিহীন হাট-টাটের একেবারে অন্দরে
কন্দরে। সেই কত কত শতক শতাব্দীর
উত্তরাধিকার বহন করতে করতে কইকান্তর ক্রমে প্রবীণ হয়ে ওঠা। হেমন্ততাড়িত হাটের কোলাহলের
ভিতর দাঁড়িয়ে থেকেও সে বুঝে নিতে পারে, খুব শীত পড়বে এবার। জাড়ের দিনের স্বপ্নময়
অস্তিত্বকে সে মাঠ মাঠ শূন্য ও বিরান মাঠের আইলে আইলে বিছিয়ে
দিতে থাকলেও, কইকান্তর কিন্তু শরীরভরা এক ব্যস্ততা এসে যায়। তাকে তো ধানহাটার উত্তরপাঁকে গিয়ে রাধাকান্তর সাথে দেখা
করতে হবে! সেই কত কত দূরত্ব ডিঙ্গিয়ে খয়েরবাড়ি থেকে গরুরগাড়ি চেপে রাধাকান্ত এসেছে। তার বড়বেটির শেষুয়া বেটার বিয়ে নিয়ে কনেক বসাবসি আছে। রাধাকান্তর সঙ্গে তো আজকের
নয়, সেই তিন চার পুরুষের পরম্পরার সম্পর্ক। রাধাকান্তকে নিয়ে সে হাট থেকে বেরিয়ে প্রথমে
যাবে দইখোয়ার রাজেন বয়াতির বাড়ি। সেখানে দইচুড়া তামুক সেবনের কথা-আল্লাপ সেরে টেরে
রাধাকান্তকে নিয়ে আসবে নিজের বাড়ি। তারপর ঠিক হবে কইন্যা দেখার দিন। পছন্দ হবে বলেই মনে হয়। কেননা কইন্যা সোমেশ্বরীকে
কইকান্ত তো জন্মভরই জানে, চেনে। সোমেশ্বরীর বাপ হরমোহন তো রাধাকান্ত আর কইকান্ত, দু’জনেরই বাচ্চাকালের
দোস্ত। এত এত চিন্তাভাবনা নিয়েই সে ধানহাটির দিকে রওয়ানা দেয়।
(২)
‘ওরে আজার হস্তীক পার
করিছুং রে...’
বিহানবেলার রোদে ভিজতে
ভিজতে তখন নন্দরাণীর বেশ আলস্য আলস্য লাগে। চারপাশে নতুন ধানের গন্ধে হলখল করে
উঠোন-বাগিচা-ঘরবাড়ি। ধান ঝাড়ার শব্দে সুপারিবাগান থেকে শালিখেরা উড়াল দেয় নদী ও শ্মশানের দিকে। নন্দরাণী আসাম দেশের মেয়ে। তার দেশের বাড়ির কথা, বালিকাবেলার কথা, দান্তাল হাতির মাহুতের কথা, রাজবাড়ির কথা মনে পড়ে। এত এত স্মৃতির ভারে সে কি ঝুঁকে পড়ে
খানিকটা! তার চোখের জল থেকে সে কি বিনির্মিত করে তোলে কবেকার কত কত আবহমানের হাতিমাহুতের
গান- ‘ও মোর গনেশ হাতির মাহুত রে / মোক নিয়া যান বাপ ভাইয়ার দেশে’! জলাভূমিতে গা ডোবানো মহিষেরা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। সে এক স্বপ্নদুনিয়া! আর ফিরবে না। শুধু হরলালের দোতরায় জেগে উঠবে মইশালি
গান। কামলাকিষানেরা ধুয়া দেবে- ‘আজি ছাড়িয়া না যান / ও মোর বাচ্চা মইশাল রে’। সেও তো প্রাচীন হচ্ছে, কইকান্তর ঘর করছে আজ দুই কুড়ি বছর প্রায়। আসামের মেয়ে আজ উত্তরাঞ্চলের এক ভরা
গেরস্থির, হালবলদের, ধানসরিসার বিল-নদী-পুকুরের, জোতজমির অতিকায়ত্বের এক ভূবনজোতে থিতু হয়ে বসেছে। এত বড় সংসারের সব দিকেই তাকে খেয়াল রাখতে হয়। নন্দরাণী বিনা কইকান্তর জোতদারী অচল। স্মৃতি থেকে দ্রুত ফিরতে হয় তাকে সংসারের বাস্তবতার দৈনন্দিনে।
(৩)
‘কোলার ছাওয়া কোলাত আইসো
বটবৃক্ষের ছাওয়াত বইসো’
উত্তর জনপদের হিম ও হাওয়ায় হাওয়ায় কীভাবে ঘুরে বেড়াতে থাকে
রাধাকান্ত তার তালুকমুলুক, জমিজমা, নদীফরেষ্ট নিয়ে। রাধাকান্ত তার চোখের পাতায় জন্মমরণের এক মহাঘুম টেনে নিয়ে আসতে থাকলেও তার
যাপনের অপভ্রংশকে এক সাবলীল উপাখ্যানের গানশোলোকেই মিশিয়ে দিয়ে নিজেকে ভারমুক্ত
করে তুলতে থাকে। যেন বা
প্রস্তুতির নতুন এক পর্বান্তর শুরু হয়ে যায় এভাবেই! রাধাকান্তর বেশ মনে পড়ে, উত্তরাঞ্চলের হিম ও হেমন্তের মায়া মাখতে মাখতে সে কখন কীভাবে যেন চলে গিয়েছিল
সোনাপুরের চৌরাস্তায়। সেখানে পরেশের
দোকানে চা খেতে খেতে আসন্ন শীতের তীব্রতার কথা ভাবতে ভাবতে মেন্দাবাড়ির সেই বিবাগী
গন্ডারের বিরহ কাতরতাকে নিজের মধ্যেই জাড়িত করতে করতে ফুলমালার জন্য নয়া ধানের খই ও ইকবালের
তাঁতের শাড়ি কিনতে হবে, সেটাকেই মনে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টাটুকুন তার জাগিয়ে রাখতে হয়েছিল; কেননা, ভ্রম ও বিভ্রমের পাকে পাকে আটকে যাওয়াটা
তার স্বভাবের মহামহিম এক অংশই যেন, যা চিরকালীন ঘুমজাগরণের ছায়ায় ছায়ায় বেরে উঠতে থাকে! ঘোর কেটে যায়, আর সে দেখতে পায় তার পরম বন্ধু কইকান্ত
হাসিমুখে, গানের ঘোর জাগিয়ে জাগিয়ে তার দিকেই এগিয়ে আসছে, ধান পাট তামাকের মস্ত মস্ত খোলান ডিঙিয়েই। তবে কি বৃত্তান্তের বয়াতির মতোন রাধাকান্ত ও কইকান্তকে এখন ছেড়ে দেওয়া উচিত বাওকুমটা বাতাসের ব্যপ্ত পরিধির ব্যপ্ততায়!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন