প্রতীক্ষমাণ
তাসকিনা দাঁড়িয়ে। আসলে বসেইনি। এত ছটফটানি। অচেনা অজানা বিশাল রুমের এক প্রান্তে, ব্যাগ থেকে এটা ওটা বের করে দিচ্ছে। মানুষটা কি ওর খুব চেনা? কে জানে! যখন কথা বলে, এভাবে কি হাত নাড়ে? চাহনি কি এমন থাকে? কথা যখন বলে, ঠোঁট কি ওভাবেই নড়ে? ও জানে না তো! চেনা চেনা অথচ কী ভীষণ অচেনা। এটা কি ‘এলিয়েনেশান’? সামান্য খোলা দরজা দিয়ে দেখা যায় ফ্রেশরুমের ট্যাপ থেকে টিপটিপ পানি ঝরছে। গলা শুকিয়ে আসে ওর। সাঁই সাঁই ফ্যানের হাওয়ায় ভাসছে আফটারশেইভের সুবাস। বাইরে হট্টগোল নেই। হলেও বদ্ধ জানালা অব্দি এসে ফিরে যায় দূরান্তে। পর্দা সরানো মস্ত কাচের জানালায় হৈচৈ আলো।
অনর্গল বলেই যাচ্ছে তাসকিনা। ধারা বিবরণী। ‘এই রইল দোলনচাঁপা, এ বক্সে চিজ কেক, হলো আপনার? এখানে লেমন গ্রাস চা। এটা কিন্তু লেবু চা নয়। এক ধরনের হার্ব, লেবুর গন্ধে ভরা। ক্যামোমেইল-এর স্বাদ কী যে বিচ্ছিরি! চুমুক দিতেই শুকনো খড়কুটোর গন্ধ।’ অমল শুনছে সবই। ছোট খাটো ‘হ্যাঁ-না’, ‘এমনি-সেই তো-তাই তো’ দিয়ে কথার কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। ঠেলেঠুলে গুছিয়ে রাখছে জিনিসপত্র। হেঁটে বারবার দুহাত দূরত্বে এসে দাঁড়াচ্ছে। আরেকটু কাছেও হতে পারত কিংবা দূরে। ঘুরেফিরে হয়তো এটাই তার কাছে ঠিকঠাক মনে হয়েছে। এই পরিমিতিবোধ তাসকিনার ভালো লাগছে। আসলে সবাই ‘স্পেস’ দিতে জানে না। অমল জানে। ‘ওটা একটা ফেন্সী ব্যাগ - হ্যান্ডমেইড, আর এটা চাবির রিং, চলুন বেরিয়ে যাই, দেরি হচ্ছে কিন্তু’, তাসকিনা বলেই যাচ্ছে। এসিতেও সে ঘেমে শেষ। কোনটা যে ভাঁট, শিয়ালকাঁটা, কোনটা পুটুশ! সমস্ত এলোমেলো। বদ্ধ ঘরে এত বুনোফুলের ঝোপঝাড় সে পেল কোথায়, কে জানে! অস্থির সে। কেমন উড়ুক্কু যেন এই উড়ে যাবে!
‘ক্যামোমেইল’ এতক্ষণে একটা দীর্ঘ বাক্য বলে অমল - ‘ডেইজী ফুলের মতো এক ধরনের সুগন্ধী ভেষজ গাছ। পাতা-ফুল শুকিয়ে ওষুধি হয়।’ এসির সুইচ অফ করতে গিয়েও সে অফ করে না। কী ভেবে ফিরে আসে। আবার দু’হাত দূরত্বে। চিজ কেকের বক্স হাতে নিয়ে ফ্রিজে রেখে দেয়। ব্যাস কাজ শেষ। কিন্তু কেউ বলে না - লেটস মুভ। কেন বলে না? চৌম্বকীয় বলয়ে দুজন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বাকহীন। অচঞ্চল। ঠাণ্ডা হাওয়ার মৌনতায় অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা। এর কোনো মানে নেই। অথচ দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে। আসলে ওরা নড়তেই পারছে না। হতে পারে ইচ্ছে, প্রত্যাশা আরও অজস্র মিশ্র অনুভূতি জন্ম নেয় তাৎক্ষণিক। ভালোলাগা, ভালোবাসা, ব্রীড়ার সাথে মেশে করোটিতে ভাসতে থাকা একটা বিশুদ্ধ চাপা উদ্বেগ। সামান্য হলেও তো কাছে পাওয়া, অদ্ভুত এক জাদু টানে তাসকিনা বলে - ‘জাস্ট আ হাগ।’
ডান হাত বাড়িয়ে ওর বাঁ গালে হাত বুলিয়ে দেয় অমল। ধীরে। কী এক প্রশস্তিতে একটু একটু ভরে উঠছে ভেতরটা। নিবিড় বুকে মাথা রেখে তাসকিনার সব শান্ত। স্থির। নির্ভরতার বিন্দু থেকে এভাবেই জীবন পূর্ণবৃত্তে পরিণত। আর তক্ষুনি এক আকাশ আলো নেমে এসে তাসকিনার কপালে চুমু দিয়ে যায়। অমলেরও ভালো লাগছে নিশ্চিত। আরও কিছু চাইছে হয়তো। একটা যা-ইচ্ছে-তাই। তবু কী আশ্চর্য সংযত! আবিষ্ট দুজনই। অমলের স্নিগ্ধ চোখে স্বচ্ছ অবলেপে ছায়া ছায়া গাঢ় বেদনা। বেদনাই। কাছে গেলেই গভীর মগ্নতা অথচ তীব্র কষ্ট। সমস্ত ইচ্ছে ভাসিয়ে দিয়ে, নিরুপায় ভাসা ভাসা চোখ দুটো দেখছে, কোথায় ভেসে যাচ্ছে দূরে ইচ্ছের টুকরোগুলো...
কিছু পরে কাগজ উড়ছে। অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতির, গৃহীত দায়িত্বের। অমানিশির পাথুরে পথে এভাবেই গাড়ি থেকে ছুটে যায় লাগাম ছেঁড়া ঘোড়া। রাত-রঙা আবহাওয়ায় এক চামচ রোদ পড়ে না। সময় বয়ে যায় মাঝখান দিয়ে। তাসকিনা ভাবে - গত ডিসেম্বর গোছাতে না গোছাতেই কী নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে এই অক্টোবর, আর এভাবেই হয়তো বছর জুড়ে বাড়ে কমে আলো-ছায়া। জলপাই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আগন্তুক। প্রতীক্ষায়। কুয়াশাজনিত আবছায়ায় তবু বোঝা যায়, ঠোঁট নীলচে অবশ, কুঁকড়ে উঠছে। ওর শীত করছে খুব। তাসকিনা টের পায়।
চোখ থেকে জল আলাদা করে সে কি আরেকটু এগিয়ে যাবে?
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন