মুক্তচিন্তা, অসাম্প্রদায়িকতা বনাম সাম্প্রদায়িকতা ও গোঁড়ামী
(১)
সৃষ্টির আদি থেকে সভ্যতার আধুনিক অধ্যায় পর্যন্ত মানুষের
চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধিবৃত্তি অসংখ্য বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে
পার হয়ে এসেছে। নিষিদ্ধ ফল খেয়ে স্বর্গচ্যুত আদম-ইভই হোক কিংবা ডারউইনীয়
বিবর্তন তত্ত্ব, যেভাবেই পৃথিবীর
বুকে মনুষ্য প্রজাতির উদ্ভব ঘটুক না কেন, মানবজাতির আদি পিতা
থেকে শুরু করে পূর্বপুরুষগণ যদি ক্রমে
মুক্তচিন্তাকে গ্রহণ করতে না শিখতেন, তাহলে সেই গুহা মানবের গাছের ছাল- বাকল পরিধানের
যুগ অথবা তৎপরবর্তী প্রস্তর যুগের পাথর ছুঁড়ে শিকার করার যুগসন্ধিকালেই পড়ে থাকতে হতো মনুষ্যকূলকে।
সভ্যতার প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করার জন্য মানুষকে
গ্রহণ করতে হয়েছে কোনো না কোনো মুক্তচিন্তার সহায়তা। কাজেই মুক্তচিন্তার সঙ্গে নাস্তিকতার ধারণা গায়ের জোরে জুড়ে দিলেই
বাতিল হয়ে যায় না মুক্তবুদ্ধি্র প্রয়োজনীয়তা।
এবার আসি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে মুক্তচিন্তার স্থান নির্ধারণ
নিয়ে। অগ্নি উপাসনা থেকে শুরু করে পৌ্ত্তলিক, সনাতন ধর্ম, ইহুদী, বৌ্দ্ধ,
খ্রীষ্টান, জৈন, ইসলাম,
বাহাই, জরস্থ্রুশীয় যে ধর্মের কথাই বলি না কেন,
সবগুলি ধর্ম কিন্তু একই সময়ে আবির্ভূত হয়নি পৃথিবীতে। মানুষের চিন্তা-চেতনার বিবর্তনের সাথে সাথে
বিভিন্ন মহাপুরুষ বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হয়ে যুগোপযোগী অথবা তাঁদের যুগের
তুলনায় অগ্রসর ধর্মীয় ধ্যান ধারণা
প্রচার করে গেছেন। আমরা যদি ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়েই বিচার করি, তাউরাত, যবুর,
ইঞ্জিল, কুরআন – চারটি ধর্মগ্রন্থকেই কিন্তু ঐশীবাণই হিসাবে মেনে
নেওয়ার নির্দেশ আছে প্রতিটি মুসলমানের উপর। যদিও কুরআন নাজিল হওয়ার পর অন্য তিনটির প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে
গেছে বলে বলা হয়েছে।
একজন মুসলমান হিসাবে মনেপ্রাণে আমিও তাই ধারণ করে এসেছি
বাল্যকাল থেকেই। কিন্তু একজন সনাতন ধর্মাবলম্বীর লেখা একটি প্রবন্ধ এবং তাঁর তুলে ধরা
যুক্তি আমার মনে
সত্যিই দাগ কাটলো। তিনি লিখেছেন, “ইসলাম হচ্ছে
বহু ভাইবোনের সংসারের সেই কনিষ্ঠ সদস্যের মতো, যে সব বয়োজ্যেষ্ঠদের উপর ছড়ি ঘুরিয়ে সবার উপর কর্তৃ্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে
চায়”। তাঁর লেখায় কিন্তু যুক্তি আছে, বলতেই হবে।
প্রায় প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই তার অনুসারীগণই কেবল মাত্র বেহেশত/স্বর্গ/হেভেনে
যাওয়ার সুযোগ পাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন কে-ই বা চায় নিজের পিতৃপুরুষের
ধর্ম বাদ দিয়ে নরকবাসী হতে? আমার নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ কিউয়ি পরিবার তো রীতিমতোন শঙ্কিত আমার পরকালে
নিশ্চিত নরকবাস নিয়ে। কারণ, তারা এই বদ্ধমূল
ধারণা নিয়ে গোটা জীবন পার করে এসেছে যে, কেবলমাত্র জেসাস
ক্রাইষ্টই মানব জাতিকে পরিত্রাণের পথ দেখিয়ে হাত ধরে স্বর্গে নিয়ে যেতে পারেন। সেজন্য খুব বেশি শুভাকাঙ্ক্ষা থেকে ওরা আমাকে প্রায়ই জেসাসের অনুসারী হয়ে যেতে অনুরোধ জানায়। কিন্তু, আমার দেওয়া যুক্তির সামনে কখনোই ওদের এই আবদার ধোপে টিকতে পারেনি।
(২)
খোলাবাজার অর্থনীতির এই যুগে মুক্তচিন্তার বদলে গোঁড়ামির
কোনো ঠাঁই আছে কি? যদিও মুক্ত
বা খোলা শব্দটি ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দু’ভাবেই ব্যবহৃত হতে পারে। আমাদের দেশে খোলাবই মানে নকলের মহোৎসব।
পক্ষান্তরে বিশ্বের অনেক দেশেই কিন্তু শিক্ষার্থীদের তোতাপাখির মতো বইয়ের পাতা
মুখস্থ না গিলিয়ে বরং ওপেন বুক এক্সাম বা খোলাবই দেখে পরীক্ষার খাতায় লিখতে দেওয়া
হয়। লেখার ধরনে যাচাই হয় মেধা।
আবার এদেশে খোলাখাবার বললেই মনের পর্দায় মাছির ভনভন ভেসে ওঠে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খোলাখাবার বলতে রাস্তায় বিক্রি হওয়া অস্বাস্থ্যকর খাবারকে বোঝায়। কিন্তু থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইতালীর মতো অনেক দেশেই স্ট্রিটফুড বলতে মুখরোচক মজাদার খাবারকে বোঝায়। আবার খোলাড্রেন মানেই দুর্গন্ধের উৎস। খোলামন মানে উদারতা। খোলাহাওয়া মানে স্নিগ্ধ মুক্ত হাওয়া। চাকরিতে ওপেন এন্ড মানে দীর্ঘস্থায়ীতা।
কাজেই খোলা বা মুক্ত শব্দটি ভালোমন্দ দুই ভাবেই ব্যবহৃত হতে পারে অবস্থা ভেদে। তদ্রুপ মুক্তচিন্তা বা খোলামন কথাটিও ব্যক্তির মানসিক ও আদর্শগত অবস্থানভেদে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই অর্থেই ব্যবহৃত হতে পারে।
একটু ফিরে দেখা যাক মানুষের আদি ইতিহাসের দিকে। আদিম গুহামানব
যদি তার সময়ের তুলনায় অগ্রসর চিন্তা বা মুক্ত
চিন্তা বস্ত্রাদি বা পোশাক পরিধানের কন্সেপ্ট গ্রহণ না করত, তবে আজকের এই ফ্যাশন
ইন্ডাস্ট্রির রমরমা অবস্থান অঙ্কুরেই বিনাশ হতো। হয়তো ছাল বাকল গায়ে জড়িয়ে বিমান চালাতো
সুদক্ষ পাইলট। জেমস বন্ড তীর ধনুক চালিয়ে শত্রুকে ঘায়েল করত পাতার আভরণে। তেমনি যে কোনো ধর্মের অনুসারী হিসেবে আমরা
গোঁড়ামিকে আঁকড়ে ধরে নিজের বা পিতৃপুরুষের অনুসারিত বিশ্বাসকেই একমাত্র নির্ভুল ও
সঠিক বলে বিবেচনা করি। এ ব্যাপারে আমাদের মতামত পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে এখন। যদি
আদ্যিকালের সূর্য চন্দ্রের বা আগুনের অথবা অন্য কোনো প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনাকেই
জীবনের চরম মোক্ষ হিসাবে ধরে নিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন প্রজন্ম কালের
সাথে সাথে বিবর্তিত মুক্তচিন্তাশীল বিশ্বাসকে গ্রহণ না করত, তবে কোথায় থাকত আপনার
আমার আজকের এই হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রীষ্টান নিয়মকানুন নিয়ে গৌরবের বলিহারি রমরমা!
যে কারণে গ্যালিলিও, সক্রেটিসের মতো প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীদেরকে নিগ্রহ লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে, সেই সংস্কার প্রোথিত বিশ্বাস, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে মানুষকে কি মুক্ত চিন্তার দ্বারস্থ হতে হয়নি? হযরত মুসা (আঃ)এর প্রচারিত ‘টেন কমান্ডস’কে গ্রহণ করার জন্য তার পূর্বাবস্থার যথেচ্ছ যৌনাচার থেকে মানুষকে বেরিয়ে আসতে হয়নি? আবার মুসা (আঃ)এর যাদুকরী ক্ষমতার সময় পেরিয়ে, যীশুখ্রীষ্টের রোগ নিরাময় বা হিলিং পাওয়ারের উপর তাঁর অনুসারীদের নতুন করে বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়নি? মুহাম্মদ (সাঃ) কর্তৃক প্রচারিত কুরআন হাদিস কি সমাজে প্রথম থেকেই ছিল? এসব গ্রহণ করার জন্যও কিন্তু মানুষকে প্রথম মুক্তচিন্তার ধারক-বাহক হতে হয়েছে।
আবার আপনি যদি সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়ে থাকেন, তাহলে প্রশ্ন, আজও কি আপনি আপনার কন্যা বা বোনের স্বামী মারা গেলে, তাকে সতীদাহ প্রথায় আগুনে সহমরণে পুড়িয়ে মারবেন? আপনার ঘরের স্বল্প বয়সী কোনো আত্মীয়া বিধবা হলে, তাকে আজীবন নিরামিষাশী সাদা থানে মোড়ানো বৈধব্য ব্রত পালন করতে বাধ্য করবেন? এই সমস্ত অমানবিক প্রথা ভাঙতে মুক্তচিন্তারই দ্বারস্থ হতে হয়েছে সমাজ সেবকদের।
যে কারণে গ্যালিলিও, সক্রেটিসের মতো প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীদেরকে নিগ্রহ লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে, সেই সংস্কার প্রোথিত বিশ্বাস, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে মানুষকে কি মুক্ত চিন্তার দ্বারস্থ হতে হয়নি? হযরত মুসা (আঃ)এর প্রচারিত ‘টেন কমান্ডস’কে গ্রহণ করার জন্য তার পূর্বাবস্থার যথেচ্ছ যৌনাচার থেকে মানুষকে বেরিয়ে আসতে হয়নি? আবার মুসা (আঃ)এর যাদুকরী ক্ষমতার সময় পেরিয়ে, যীশুখ্রীষ্টের রোগ নিরাময় বা হিলিং পাওয়ারের উপর তাঁর অনুসারীদের নতুন করে বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়নি? মুহাম্মদ (সাঃ) কর্তৃক প্রচারিত কুরআন হাদিস কি সমাজে প্রথম থেকেই ছিল? এসব গ্রহণ করার জন্যও কিন্তু মানুষকে প্রথম মুক্তচিন্তার ধারক-বাহক হতে হয়েছে।
আবার আপনি যদি সনাতন বা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়ে থাকেন, তাহলে প্রশ্ন, আজও কি আপনি আপনার কন্যা বা বোনের স্বামী মারা গেলে, তাকে সতীদাহ প্রথায় আগুনে সহমরণে পুড়িয়ে মারবেন? আপনার ঘরের স্বল্প বয়সী কোনো আত্মীয়া বিধবা হলে, তাকে আজীবন নিরামিষাশী সাদা থানে মোড়ানো বৈধব্য ব্রত পালন করতে বাধ্য করবেন? এই সমস্ত অমানবিক প্রথা ভাঙতে মুক্তচিন্তারই দ্বারস্থ হতে হয়েছে সমাজ সেবকদের।
মুক্ত চিন্তার প্রসারের পথ কোনোকালেই সুমসৃণ ছিল না। আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার প্রথম ধারক ব্যক্তিদের গোপনে কবরখানায় মৃতদেহের শরীর ব্যবচ্ছেদ করে অ্যানাটমি জানতে হয়েছে। জোয়ান অফ আর্ককে দেশদ্রোহী হিসাবে ফাঁসিকাঠে প্রাণ দিতে হয়েছে। সক্রেটিসকে নিজহাতে হেমলক পান করতে হয়েছে। সীতার মতোন সতীকেও বনবাস যাপন এবং অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। ঘাইহরিণীর নিশীথ প্রণয়ের কবিতা লিখে জীবনানন্দকে চাকরিচ্যুত হতে হয়েছে। এরকম আরো অসংখ্য উদাহরণ আমাদের অতীত ইতিহাসে রয়েছে।
কাজেই কোনো রকম বিচার বিশ্লেষণ না করেই নবতর কোনো মত বা পথের বিরোধিতা, যে সস্কার থেকেই করা হোক না কেন, কোনো বাধাই প্রকৃত মঙ্গলজনক চিন্তা-চেতনাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি কোনো কালেই। আর নবতর সব ‘আইডিয়া’কেই গ্রহণ বর্জনের চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে সব যুগে সব কালেই। তাই আমাদের গঁতেবাঁধা মননে কোনো ধারণাকে নতুন ঠেকলেই, সর্বশক্তি প্রয়োগ করে তার বিরোধিতা না করে, সময়ের কষ্টিপাথরে তা যাচাই করার ঔদার্যটুকু সকল আধুনিক মানুষেরই থাকা উচিত।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন