কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

ঝুমা চট্টোপাধ্যায়

সুমি


নিজের পায়ের পাতার ওপর জলের ফোঁটাগুলোকে মন দিয়ে লক্ষ্য করছিল লীনা ফ্যাকাশে অনুজ্জ্বল লক্ষ্য করতে করতেই আপনমনে ডান হাতের তর্জনীটা কপালে উঁচু জায়গাটায় ঠেকিয়ে বুঝল, দারুণ ব্যথা জমে আছে এখানটায় ফোলাভাব একটুও কমেনি গায়েও হালকা জ্বর লীনা তরুণী নয়, কিন্তু একজন তরুণীর মতোই তার টানটান দেহাবয়ব সুতরাং পুরুষের চোখে যথেষ্ট লোভনীয় কপালের ব্যথা জায়গাটায় হাত দিয়েই একটা সেকেলে কাঠের চেয়ারে বসে লীনা কূট চোখে তার বহু শাখা প্রশাখাময় জটিল ও আপাত নিরুদ্বেগ সংসারের গৃহস্থালীটা জরিপ করবার চেষ্টা করছিল ছায়াঘন এই কুঞ্জবনে লীনা তার শরীর ও মেধা দিয়ে এতকাল সেচ সার জুগিয়ে এসেছে লাগামছাড়া অগোছালো ও কিছুটা স্বার্থপর স্বামীর ঘর করতে করতে কিছু বছরের মধ্যেই সে বুঝে গেছে, সতীত্ব বা  এককেন্দ্রিক জীবন কতই না অর্থহীন! হাস্যকর ও ফেক্! শরীরের বোধ তার  কোনোদিনই বেশি ছিল না কামোত্তেজনায় জ্বলেপুড়ে সে কোনোদিনই মরেনি আজও মরে না তাই বলে তার অভিধানে পরপুরুষ বলেও কোনো নির্দিষ্ট শব্দ নেই কিন্তু সেসব বেশ পুরনো কথা এখন লীনা এই বহু পর্দাময় একক জীবনের ওপাশে বসে নিজের একাকীত্বকে শান্তমনে উপভোগ করছিল তার আদ্যন্ত চিন্তা হলো  টিকে থাকার ভালোবাসার কথা সে ভাবে না পুরনো এই সেকেলে কাঠের  চেয়ারটা ছেড়ে দূরে কোথাও বের হতে তার অসম্ভব কুঁড়েমি আপন মনে  ব্যথাটায় আবার হাত বুলোয় জাম্বুবান স্বামীটার ওপর রাগ বা আবেগ কিচ্ছু হয় না আর বরং পায়ের পাতার ওপর জলের দাগগুলোকেই মন দিয়ে লক্ষ্য করে  সুস্পষ্টভাবে সেগুলো চেনা যাচ্ছে না দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে লীনা তার ফেসবুক অন্ করে জয়ন্ত অনলাইন ছিল ইনবক্সে তিনটে মেসেজ...

জয়ন্তর ঘুম ভাঙে খুব ভোরবেলা যখন সূর্য ওঠে না। আর ঘুম ভাঙলেই বড় একাভীষণ একাপাশের ঘরে বউ মেয়ে এক খাটে ঘুমোচ্ছে, মেঝেয় কিশোরী  ঝিতবু জয়ন্ত জানে, তার বহু বহু দূর পরিধির মধ্যেও কোনো মানুষ নেই। আত্মীয় না, বন্ধুবান্ধব কেউ নাসে একা এবং ঘুম ভাঙলে তারপর সারাদিন হাটে বাজারে অফিসে সন্ধ্যেবেলা বউয়ের সঙ্গে শপিংমলে সে দারুণ একাবাধ্য  হয়ে জয়ন্ত ফেসবুক খোলে এবং ফেসবুকে তিনশো তেত্রিশজন বন্ধুর আপডেট দেখে বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেখুব আন্তরিকভাবে লীনাকে লিখে পাঠায়, 'আজ সকালের রোদে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে'একাকীত্বের হিংস্র তরুণ  চিতাবাঘটা একটু দূরে বসে থাবা চাটে কিছুতেই জয়ন্ত ভালোবাসা নামক শব্দটা থেকে মন সরাতে পারে না। কী সাংঘাতিক দামী এবং ঝকঝকে! সর্বাঙ্গে  আভিজাত্যের স্থায়ী ছাপজয়ন্ত ভাবে, তার বউ অপর্ণা কি নিজেকে সংসারের জন্য নিংড়ে দিচ্ছে না? দিচ্ছে তো? শুধু আজকাল গাড়িতে উঠলে জয়ন্তর পাশে না বসে পেছনের সীটে বসে গিয়ে। বড় বেশি গম্ভীর থাকেতা বলে কি ভা্লোবাসা নেই? সে কি অপর্ণাকে ভা্লোবাসে না? এ কেমন ইল্লুতে কথা?

খুব ধীরে অনিশ্চয় এক মন নিয়ে জয়ন্ত তার লাঞ্চবক্সটা খোলেদু' মিনিট কী ভাবেতারপর টেবিল ছেড়ে রুমের বাইরে এসে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে তেমন বিশ্বাসযোগ্য কাউকে দেখতে না পেয়ে নিজেই সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় সোজাগেটের উল্টোদিকে রাস্তার ওপারে জারুল গাছের নিচে বসা মনা  পাগলার সামনে গিয়ে টিনের থালার ওপর লাঞ্চবক্সটা সোজা উপুর করে দেয় মনা পাগলার আজ মন ভালো নেই। রোজ রোজ মুড়ি খেতে কার ভালো লাগে? সঙ্গে সন্দেশ না, দুধ না, যতদিন জ্ঞান হয়েছে এই এক মুড়িই দেখে আসছেতাও যে বরাবর জুটছে, তাও নাতার ওপর আজ আবার সকাল থেকে পেটের সেই পুরনো ব্যথাটা চাগাড় দিয়েছেপাশেই কালু রাউত চা দোকানটা ভেঙে রাজ মিস্ত্রীদের দিয়ে ভালো দালান তোলাচ্ছে পুরনো দোকানের লাগোয়া নতুন কালু টী সেন্টারলাঞ্চবক্সের পরোটা ঘুঘনি খেয়ে ঢেকুর তুলল মনা। ব্যোম্ কালী! এবার দরকার একটু গরমা গরম চা কালো এবং গম্ভীর প্রকৃতির কালু রাউতের সামনে গিয়ে মিষ্টি করে বলল মনা, নতুন দোকানটা খুব সুন্দর হচ্ছে তো কালুবাবু!  দোতলার ভিত গেঁথেছ মনে হচ্ছে!
ভ্রু কুঁচকে কালু বলল, হ্যাঁ রে সম্মন্ধীর পু! তাতে তোর বাপের কী?
না এই আর কীএক ভাঁড় চা খাওয়াবে?
চা সস্তা দেখলি? জল খা বরং!
মনা বলল, সে তো পুরনো কথা। তুমি শালা শুয়োরের বাচ্ছা...
চিরকেলে ডাকাবুকো কালু লাফিয়ে এসে এক খামচায় মনার চুল ধরে ফেলল,  তারপর সপাটে গালে এক চড়
খবরদ্দার কালু! গায়ে হাত তুলবি না বলে দিচ্ছিকালই হিমালয়ে চলে যাব ব্যোম্ কালী! ধ্বংস করে দে মা!
চিবিয়ে চিবিয়ে কালু বলল, আর কোনোদিন গাল দিলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারব এবং বলতে না বলতেই আরও দুটো চড়
মার দেখে কিছু লোক জুটে গেছিলতাদেরই দুজন এসে শেষমেষ ছাড়িয়ে দিলকালু চলে গেলে হি হি করে হাসল মনাতারপর সবার দিকে চেয়ে বলল, বেশি লাগে নি
কিন্তু মুখে একথা বললেও মনার চুলের গোড়া জ্বলছে আর কানটা ভোঁ ভোঁ করছে খুব। বিড়বিড় করে বলল, একটাই তো মনা পাগলা! একটু কম সম মারলেই তো হয় বাপ্!
ভিড় ফাঁকা হয়ে গেলে একটু এদিক সেদিক করল মনা, তারপর রেল ব্রীজ পার হয়ে কাঁটাবেরিয়ার জঙ্গলে সারা দুপুরটা ঘুরে বেড়ালোনদী থেকে আঁজলা ভরে জল খেল, আস্তানায় ফিরল সন্ধ্যে পার করেআস্তানা বলতে আটাচাকীর পেছনের বারান্দাটের পেল, জ্বর আসছে। সটান কম্বল ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়ল

মাঝরাতে আকাশ ঘোর করে এলো বৃষ্টিঘুম চোখে মানুষ দেখল, বৃষ্টিজলের সাথে তারাকুচি ঝরে পড়ছে। বিভ্রমই বটে, কিন্তু মানুষ তো বিভ্রমই চায়!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন