কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১১ 




 

এই লেখার চার নম্বর পর্বে কিছু হলিউড ক্লাসিক নিয়ে আলোচনা করেছিলাম ও বলেছিলাম, কোন এক সময় গোটা পৃথিবীর কিছু ক্লাসিক সিনেমা নিয়েও লিখ্‌  যাতে আলোচনা সম্পূর্ণ হয়। এবার সময় হয়েছে সেই কথা রাখার। আজ খুব বাছাই করে গোটা পৃথিবীর মাত্র বারোখানা ক্লাসিক মাস্টারপিস সিনেমার এক লিস্ট বানাবঅবশ্য শুরুতেই বলে রাখি, আজ ইচ্ছে করেই এই আলোচনায় হলিউডকে ঢোকাবো না। নইলে ভিক্টর ফ্লেমিংয়ের ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ (১৯৩৯) বা অরসন ওয়েলেসের ‘সিটিজেন কেন’ (১৯৪১) বা জন ফোর্ডের ‘দ্য সার্চার্স’ (১৯৫৬) বা আলফ্রেড হিচককের ‘ভার্টিগো’ (১৯৫৮) হাসতে হাসতে এই ১২টা মুভির তালিকায় ঢুকে যেত।

আমার বাছাই প্রথম চার: রেনোয়ার ‘দ্য গ্র্যান্ড ইলিউশন’ (১৯৩৭, ফ্রান্স), ডি-সিকার ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ (১৯৪৯, ইতালি), ওজুর ‘টোকিও স্টোরি’ (১৯৫৩, জাপান), কিউব্রিকের ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’ (১৯৬৮, ব্রিটেন)

আমার বাছাই পরিবর্ত চার: কুরোসাওয়ার ‘রসোমন’ (১৯৫০, জাপান), বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ (১৯৫৭, সুইডেন), ফেলিনির ‘এইট অ্যান্ড হাফ’ (১৯৬৩, ইতালি), তারকোভস্কির ‘মিরর’ (১৯৭৪, রাশিয়া)।

পরবর্ত্তী চার: আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ (১৯২৫, রাশিয়া), ল্যাং-য়ের ‘মেট্রোপোলিস’ (১৯২৭, জার্মানি), ত্রুফোর ‘দ্য 400 ব্লোজ’ (১৯৫৯, ফ্রান্স), বুনুয়েলের ‘ভিরিডিয়ানা’ (১৯৬১, স্পেন/মেক্সিকো)

হ্যাঁ, একটা কথা আগেই শুনিয়ে রাখি, যেটা মাঝে মাঝেই আমি ফাটা রেকর্ডারের মত বলতে থাকি। মনে রাখবেন, এটা ‘আমার’ বাছাই পৃথিবীর সেরা ১২, ক্লাসিক ও মাষ্টারপিসযেগুলো মুভি সম্বন্ধে পৃথিবীকে বেশ কিছু ব্যাপার শিখিয়েছে – সিনেমা বলতে কি বোঝায়, কিরকম সিনেমা বানাতে হয়, কিভাবে বানাতে হয়অন্য কারো বাছাই সেরা ১২ এর থেকে আলাদা হতেই পারে, সেটাই স্বাভাবিক। যেমন, আমি জানি জগৎবিখ্যাত পরিচালক বা সমালোচকরা কখনোই ইংমার বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ বা ফ্রিজ ল্যাং-য়ের ‘মেট্রোপোলিস’ বা লুই বুনুয়েলের ‘ভিরিডিয়ানা’-কে সেরা ৩০-র তালিকাতেও রাখবেন না। কিন্তু আমি এদের সেরা ১২-য় রাখবো। কেন, সেটা আমি ব্যাখ্যা করব। বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে নির্মাণ ও ক্যামেরা – এগুলো মাথায় রেখে। হয়ত অনেকেই আমার লিস্ট দেখে নাক সিঁটকে বলবেন, ‘রসোমন’ এর জায়গায় ‘দ্য সেভেন সামুরাই’ রাখা উচিৎ ছিল, ‘দ্য গ্র্যান্ড ইলিউশন’ না রেখে ‘রুলস অব দ্য গেম’ রাখা দরকার ছিল, কার্ল ড্রেয়ারের ‘প্যাশন অব জোয়ান অব আর্ক' নেই কেন, হলিউডের সিনেমাকে ঢোকালে ‘অ্যাপোক্যালিপ্স নাউ’ বা ‘গডফাদার পার্ট ওয়ান’ থাকা উচিৎ ইত্যাদি ইত্যাদিতাহলে অধিক মর্মরে কাজ নেই, ‘আমার’ সেরা ১২ শুরু করি।

ইতালি থেকে আমার ক্লাসিক বাছাই ভিত্তোরিও ডি-সিকার ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ ও ফেদেরিকো ফেলিনির ‘এইট অ্যান্ড হাফ’এর ভেতর ‘এইট অ্যান্ড হাফ’ নিয়ে পরে আলোচনা করব। আপাতত এখানে শুধু ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ নিয়েই কাটাছেঁড়া

ফ্রান্স থেকে আমার পছন্দের তালিকায় জাঁ রেনোয়ার ‘দ্য গ্র্যান্ড ইলিউশন’ ও ফ্রঁসোয়া ত্রুফোর ‘দ্য 400 ব্লোজ’ আজ আলোচনায় রাখব শুধু ‘দ্য গ্র্যান্ড ইলিউশন’অন্য সিনেমাটা নিয়ে ফ্রান্সের আলোচনার দিন বলা যাবে। রাশিয়া থেকে ক্লাসিক লিস্টে থাকছে সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ ও আন্দ্রেই তারকোভস্কির ‘মিরর’তবে আজ শুধু ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ নিয়ে লিখব। জাপান থেকে আমি বেছেছি আকিরা কুরোসাওয়ার ‘রসোমন’ ও ইয়াসুজিরো ওজুর ‘টোকিও স্টোরি’। যদিও কুরোসাওয়া ও ওজুকে নিয়ে পরে বিস্তারিত কথা হবে, পৃথিবী খ্যাত পরিচালকদের নিয়ে আলোচনার সময়, তবুও আজ ‘টোকিও স্টোরি’ নিয়ে খানিকটা বলবজার্মানি থেকে আমি নিয়েছি ফ্রিজ ল্যাং-য়ের ‘মেট্রোপোলিস’। এটা আজ আলোচনায় রাখব। সুইডেন থেকে একটিই ছবি, ইংমার বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ বার্গম্যানকে নিয়েও পরে আলোচনা করব, এবং ওনার ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ নিয়েও  স্পেন/মেক্সিকো থেকে নিলাম লুই বুনুয়েলের ‘ভিরিডিয়ানা’। অসাধার ক্যামেরার কাজ ও থিম। স্পেন নিয়ে যখন আলোচনা করেছিলাম, তখন  বুনুয়েলের এই সিনেমাকে লিস্টে রাখিনি কার আমরা রহস্য নিয়ে কথা  বলেছিলাম। আজ আমরা এটা শুধু ছুঁয়ে যাব, বিশদ আলোচনা করব না। ব্রিটেন থেকেও একটা - স্ট্যানলি কিউব্রিকের ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’তবে না, এটাও আজ বলব না। ব্রিটেনের ছবি নিয়ে আলোচনার দিন এটা থাকবে। আজ আলোচনা ওপরের কয়েকটা মাত্র ছবি নিয়েই থাক। একদিনে বেশি ভাল খাবার একসঙ্গে হজম নাও হতে পারে।

১৯২৫। সিনেমা তখনো সাবালক হয়নি, নির্বাক। সেই সময় আইজেনস্টাইনের ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ (১৯২৫, রাশিয়া) রাশিয়ান জারেদের বিরুদ্ধে ১৯০৫ সালের বিপ্লবের একদম শুরুর দিকের এক দলিল। পোটেমকিন নামক এক কল্পিত যুদ্ধজাহাজে অফিসারদের বিরুদ্ধে সাধার নাবিকরা খাবারের গুণগত মান নিয়ে  বিদ্রোহ শুরু করে। পোটেমকিন জাহাজ-বন্দরে লাগার পর এই বিদ্রোহ ওডেসা শহরেও ছড়িয়ে পড়ে। রাশিয়ান সরকার পুলিশের সাহায্যে অনেক জনসাধারকে  গুলি করে মেরে এই বিদ্রোহ দমন করে। এই গল্প নিয়েই ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’।

বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত সিনেমা, এতই কুখ্যাত যে কোন এককালে বহুবছর ধরে রাশিয়া ও ইউরোপের অন্যান্য কিছু দেশে এই সিনেমা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু তা সত্বেও এই ছবি সিনেমার একদম শুরুর যুগের এক ল্যান্ডমার্ক। বিভিন্ন দেশে এই সিনেমা ফিল্ম স্টাডির ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যেক শট ধরে ধরে বোঝানো হয়। কার জাক্সটাপোজিশন বা পাশাপাশি দুটো জিনিষের বৈষম্য যেভাবে এই সিনেমায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তা এক কথায় অনবদ্য। একটা উদাহর দিই। নিরীহ মানুষের  ভয়ার্ত মুখ আর পাশাপাশি পুলিসের ভয়ডরহীন প্যারেডঅথবা রাষ্ট্রশক্তির কাছে মানুষ কত অসহায় বোঝানোর জন্য গুলিতে মৃত এক মানুষ আর পরের সিনে পা কাটা এক বিদ্রোহী। হঠাৎ হঠাৎ সিনে কাট্‌, খাপছাড়া মন্তাজ, এগুলো সত্বেও এই সিনেমা এখনো অব্ধি এক মিথ। কার এখানে ব্যক্তিগত কারণে কোন সিন টেনে  বড় করা হয় নি, কোন ব্যক্তিকে এখানে হিরো হিসেবে তুলে ধরা হয় নি, বিদ্রোহকে সমষ্টিগত কার হিসেবেই দেখানো হয়েছে, ১ ঘন্টা ১৩ মিনিটের পুরো সিনেমায়  সাউন্ডট্র্যাক লিরিকাল – এমনকি ওডেসার সিঁড়িতে গহত্যার সময়েও। সিঁড়ি দিয়ে  প্যারাম্বুলেটরে বাচ্চার গড়িয়ে পড়া থেকে শুরু থেকে বয়স্কার চিৎকারের ভঙ্গি অব্ধি কোনটাই অযথা বাড়ান হয়নি। আউটডোর সিনে ক্যামেরার রোলিং, ফোকাসিং, এগুলোও মনে রাখার মত। পোটেমকিন সমুদ্র থেকে এগিয়ে আসছে আর সমুদ্রতীরে সারি সারি ভাসমান ক্যানো – সেই ১৯২৫ সালে এই সিন যেভাবে তোলা হয়েছে, তা আজো শিক্ষণীয়। আমার মতে, এইরকম অ্যাগ্রেসিভ ক্লাসিক ছবি খুব কমই তৈরি হয়েছে।

এরপর আসব ১৯২৭ সালে রিলিজ হওয়া জার্মান এক্সপ্রেসনিজমের একদম শুরুর দিকের সিনেমা ফ্রিজ ল্যাং-য়ের ‘মেট্রোপোলিস’ প্রসঙ্গে। জার্মান এক্সপ্রেসনিজম বলতেই আমাদের চোখে ভাসে ‘ক্যাবিনেট অব ডঃ ক্যালিগারি’ (১৯২০) আর ‘নসফেরাতু’ (১৯২২)কিন্তু ‘মেট্রোপোলিস’ শুধু জার্মান এক্সপ্রেসনিজমের উদাহর হিসেবে নয়, সায়েন্স ফিকশন সিনেমা হিসেবেও ইতিহাসের পাতার শুরুর দিকে থাকবে যা দেখে পরবর্তীকালে ভুরি ভুরি সিনেমা তৈরি হয়েছে। সিনেমার কাহিনি কোন এক ভবিষ্যতের শহরকে ঘিরে। যার ওপরে উঁচু শ্রেণীর জন্য বড় বড় টাওয়ার, স্কাইওয়ে, অলিম্পিক স্টেডিয়াম, অবসরকালীল বাগান। আর মাটির নিচে আরেক সমান্তরাল অজানা জগৎ যেখানে শ্রমিকদের দিয়ে বেশি করে খাটানোর জন্য ঘড়িতে মাত্র ১০ ঘন্টা দেখানো হয়, তারা বস্তিতে থাকে, কাজ করতে করতে সবাই প্রায় মেশিন হয়ে গেছে। এক যুবক যখন এই অজানা জগতের দুঃখ দেখে ফেলে, সে তার পাশে পায় এক যুবতী মারিয়া-কে। আর সেখানে শুরু হয় এক সামাজিক ড্রামা। ভাবুন, কল্পবিজ্ঞানের ছলে দেখানো সমাজের দুটো সমান্তরাল শ্রেণী যা মার্কসের সময় থেকে আজ অব্ধিও ভয়ঙ্করভাবে প্রাসঙ্গিক। এই সিনেমার বিশেষত্ব হল অনেক বড় বড় সেট, হাজার হাজার এক্সট্রা অভিনেতা, দারু স্পেশাল এফেক্ট  – এগুলো সেই সময়ে প্রায় অকল্পনীয়। আমি এর সঙ্গে জুড়তে চাই ক্যামেরার আলোছায়ার কাজ আর ক্যামেরার অ্যাঙ্গল, যা না দেখলে ঠিক বোঝা যাবে না। আর পুরো সিনেমা জুড়ে কিছু না বলেও বারবার সমাজের এই ক্লাস সিস্টেমকে চাবুক মারা। যেখানে ফ্যাক্টরিতে এক শিফট্‌ শেষ হয়ে আরেক শিফট্‌ শুরু হচ্ছে, শ্রমিকরা একদিকে রোবটের মত ঢুকছে আর অন্যদিকে বেরিয়ে আসছে, সিনটা দেখলে শক্ত মনের মানুষও ভাবুক হয়ে উঠবে।

সায়েন্স ফিকশন হিসেবে এই সিনেমার অনেক ত্রুটি আছে। কিন্তু এই সিনেমাকে একদম ওপরের ক্লাসিক হিসেবে না রাখলে সাই-ফাই জেনারেশনকেই অস্বীকার করতে হবে। প্রায় একশ বছর আগে এক্সট্রা অভিনেতাদের ঠান্ডা জলে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হত তাদের মধ্যে রোবটের মত চলাফেরা আনার জন্য বা নায়িকাকে উঁচু জায়গা থেকে লাফ মারতে বাধ্য করা হয়েছিল বা তার গায়ে সত্যিকারের আগুন লাগানো হয়েছিল বা সেটের ভেতরে আয়না রেখে লোকজনকে ছোট দেখিয়ে মিনিয়েচার সেটের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হত যাতে এক শটেই পুরোটা টেক করা যায় – এগুলো এখন শুনলে গায়ে কাঁটা দেবে। জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এর সাথে সাথেই আলোছায়ার মাঝে আসল ও নকল মারিয়ার মুখের ভঙ্গি, ফ্রেডারের ভয়ার্ত মুখ – পুরোটাই উপভোগ্য। এবং ২০০৮ সালে এই সিনেমার ১৫৩ মিনিটের পুরো আদি সংস্কর খুঁজে পাওয়ার পর মনে হয়, এখন, এই সিনেমার ক্লাসিক উপাধি নিয়ে সমালোচকদের দ্বিধা থাকা উচিৎ নয়।  

জাঁ রেনোয়ার ‘দ্য গ্র্যান্ড ইলিউশন’ ১৯৩৭ সালে ফ্রান্সে তৈরি হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এক রোমহর্ষক ছবি যা একইসঙ্গে সূক্ষ্ম, বুদ্ধিদীপ্ত এবং অনুভূতিপ্রব। তদ্দিনে  অবশ্য সিনেমা খানিকটা সাবালক হয়ে গেছে, অর্থাৎ এই সিনেমা সবাক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানদের হাতে বন্দী কিছু ফ্রেঞ্চ সেনা-অফিসার পালানোর প্ল্যান করে। কিন্তু সেই প্ল্যান কার্যকর হবার আগেই এক সেনা অফিসারকে অন্য এক দুর্গম জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। এদিকে জার্মান অফিসার ও বন্দী ফ্রেঞ্চ অফিসারের ভেতর বন্ধুত্ব বেড়েই চলে যেহেতু দুজনেই তথাকথিত উঁচু শ্রেণীর মানুষ। অবশ্য তার মাঝেই সেই ফ্রেঞ্চ অফিসার আবারো তার মেকানিক-কে নিয়ে পালানোর প্ল্যান বানান।

আমি মনে করি এই সিনেমার বিশেষত্ব হল রেনোয়া একবার যুদ্ধ বাজে বা  অর্থহীন বা বিয়োগান্তিক, এসব কিছুই ক্যামেরায় না বলেও প্রতি ছত্রে বুঝিয়ে দিয়েছেন ‘ওরে হল্লা রাজার সেনা, তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল্‌’। ইউরোপিয়ান সভ্যতার একটা ক্লাস কনসাসনেস ছিল, বিশেষ করে উঁচু শ্রেণীর। রেনোয়া এই ছবিতে সেই ইলিউশন ভেঙে দিয়েছেন। দেখাতে চেয়েছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কর্তৃত্ব চলে গেছে সাধার মানুষের হাতে। আমি এই সিনেমাকে পরাবাস্তব বা ব্যঙ্গ ছবি বলব না, বরং মানবতাবাদী বললে ঠিকঠাক আখ্যা দেওয়া হবে। আমার দেখা-চেনা সিনেমা জগতে ফ্রান্স থেকে তৈরি হওয়া এটাই প্রথম সূক্ষ্ম ও বুদ্ধিদীপ্ত ছবি, যে কারণে আমি একে ক্লাসিক লিস্টে রাখতে দ্বিধাবোধ করিনি। এবং একজন  ফটোগ্রাফার হিসেবে আমার কাছে এই সিনেমার প্রধান আকর্ষ এর  সিনেমাটোগ্রাফি। রেনোয়ার ছবিগুলোর এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ক্যামেরার গ্লাইডিং, অনেকটা পাখির মত। ফলে একটা সিন যেন শেষ হয়েও চোখের সামনে রয়ে যায়। এই সিনেমায় তার অসাধার কিছু উদাহর আছে। যেমন ক্যাম্পে খাবার সময়। ক্যামেরা আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে, প্রতি খুঁটিনাটি ক্যামেরা বন্দী হতে থাকে, এক  চলমান ফ্রেমের মত – যতক্ষ না এই সিনের দরকার ফুরোয় (আমার মনে হয়  রেনোয়ার এই ক্যামেরা মুভমেন্ট থেকেই সত্যজিৎ রায় প্রতি সিনের ডিটেলিং শিখেছিলেন)। এর ফলে ব্যক্তিগত ডিটেলিং আলাদা করে দরকার হয় না, অনেক ফুল নিয়ে গাঁথা মালার মত এক বড় সিনে সেটাও এক অংশ হয়ে রয়ে যায়। এর সঙ্গে আছে এই ছবির অভিনয়। অপূর্ব। এই মুভি দেখার পর ক্যাপ্টেন ভন রফেনস্টাইন-কে কি আদৌ ভোলা যায়? এবং এই সমস্ত কারণেই ‘দ্য গ্র্যান্ড  ইলিউশন’কে খানিকটা এগিয়ে রেখেছি ‘রুলস অব দ্য গেম’-এর (১৯৩৯) থেকে।  

আমেরিকায় একটানা ২৬ সপ্তা জুড়ে চলা সাড়া জাগানো এই সিনেমাও কিন্তু ইতালি আর জার্মানি-তে অনেক বছর নিষিদ্ধ ছিল। এবং একসময় ফিল্মের নেগেটিভ হারিয়ে গেছিল। বহু বছর পর সেই নেগেটিভ পাওয়া যায়। আবার হইচই শুরু হয়। একেই হয়ত বলে পোয়েটিক জাস্টিস। এই সিনেমার লাইন ধরেই বলতে হয় - ‘নেইদার ইউ নর আই ক্যান স্টপ দ্য মার্চ অব টাইম’  

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে যে নব্য-বাস্তবতার ঢেউ উঠেছিল, তার সার্থক রূপায় ভিত্তোরিও ডি-সিকার ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ (১৯৪৯)একে ড্রামা না বলে  রূপক কাহিনী বলাই ভাল। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত রোমে এক বেকার যুবক অ্যান্তনিও এক কাজ খুঁজে পায় – দেওয়ালে পোস্টার লাগানোর। শর্ত একটাই – নিজস্ব সাইকেল থাকতে হবে। অ্যান্তনিওর স্ত্রী বিছানার চাদর বেচে তার পুরনো সাইকেল দোকান থেকে ছাড়িয়ে আনে। এবং অ্যান্তনিও বেরিয়ে পড়ে নতুন চাকরিতে। কিন্তু বিধি বাম। সাইকেল চুরি যায়। চোর ধরতে না পারলে সংসার চলবে না, অতএব অ্যান্তনিও নিজের ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে চোর ধরতে। চোর ধরা পড়ে না, কিন্তু অ্যান্তনিও হতাশার বশে অন্য একজনের সাইকেল চুরি করতে যায় ও ধরা পড়েঅনবদ্য থিম। এবং আজো প্রাসঙ্গিক, বিশেষ করে এই কোভিড পিরিওডে যখন চাকরি নিয়ে মানুষের মধ্যে হাহাকার। 

লুইগি বার্তোলিনির বিখ্যাত উপন্যাস (১৯৪৬) অবলম্বনে এই ছবি সিনেমার ইতিহাসের এক অন্যতম সহজ, শক্তিশালী ও উজ্জ্বল আর্ট-ফিল্ম। আমার এই ছবি আরো ভাল লাগে এর ক্যামেরার কাজের জন্য। একদম শুরুর সিনটা ভাবা যাক। একটা বাস আস্তে আস্তে এসে নতুন তৈরি হওয়া এক হাউসিং-এর মধ্যে দাঁড়াল, তার থেকে ভিড় বেরিয়ে মিশে গেল অন্য এক শটে এক বাড়ির সামনে, চাকরির আশায়। ক্যামেরা ধীরগতি। এরপর অ্যান্তনিও ভিড় থেকে আলাদা বসে। বেকারত্বের হতাশায়। সেখান থেকে একজন এসে তাকে কিছু বলার পর সে গিয়ে ভিড়ে মিশে গেল। ফ্রেমিংটা দেখুন। আর ঠিক এখানেই আপনার ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ ভাল লেগে যাবে। কার ক্যামেরা ইচ্ছে করলেই অ্যান্তনিওর সঙ্গে রোল করে এগিয়ে  যেতে পারত। কিন্তু তা না করে ক্যামেরা নায়ককে ভিড়ের ভেতর মিশে যেতে দিয়ে বুঝিয়ে দিল ঐ সমস্ত বেকারদের মাঝে সেও একজন। সিন কাট্‌। তারপরের সিনেই ক্যামেরা অ্যান্তনিওকে ধরে ফেলল। এরপর ক্যামেরা কখনো দর্শকের ভূমিকায়, কখনো অ্যাকশনে। রোমের রাস্তায় সেনাবাহিনীর গাড়ি চলে যাচ্ছে, সেটা ক্যামেরা যেমন দোতলার জানলা থেকে চুপচাপ দেখল, তেমনি টানেলের ভেতরে গাড়ি চেপে অ্যান্তনিওর এক সাইকেল তাড়া করে যাওয়া, সেটা ক্যামেরায় বেশ টানটান উত্তেজনা তৈরি করল। এই মুভি কেন সত্যজিতের এত ফেভারিট, সেটা না দেখলে বুঝবেন না। কেন সিনেমা জানতে, বুঝতে ও শিখতে হলে এই সিনেমা দেখা আবশ্যিক, সেটাও ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট একটানা না দেখলে বুঝবেন না। হ্যাঁ, যে কথাটা না বললে এই সিনেমার আলোচনা অসম্পূর্ণ  রয়ে যাবে, তা হল অ্যান্তনিওর  ছেলের রোলে ৯ বছর বয়সি এনজো স্টায়োলার দুর্দান্ত অভিনয়। এবং তার চোখের অভিব্যক্তি।  

ইয়াসুজিরো ওজু এবং তার ‘টোকিও স্টোরি’ (১৯৫৩) নিয়ে আমি পরে বিস্তারিত আলোচনা করব। আপাতত এটাই বলি যে ওজুর এই সিনেমায় আমার ভাললাগার প্রধান বিষয় হল ডায়লগ এবং মধ্যবিত্ত জীবনধারাওজুর সিনেমায় ক্যামেরার কাজ খুব একটা ভাল লাগবে না কার উনি মাটি থেকে কম উচ্চতায় ক্যামেরা  রাখতেন এবং প্রায় সমস্ত সিনেই ক্যামেরা হত স্ট্যাটিক যদিও ওজুর ক্যামেরার এই স্ট্যাটিক প্লেসিং আর অ্যাঙ্গল জাপানের সনাতনী প্রথাগুলো ভাল ফুটিয়ে তুলতে পারত বলেই সমালোচকরা মনে করেন, আমার মনে হয়েছে এর ফলে কোথাও কোথাও সিনগুলো স্লো হয়ে গেছে, ফ্রেমিং মার খেয়েছে। যদিও এই সিনেমার অন্যতম আসল ভাললাগা লুকিয়ে আছে এর প্লট আবেগপ্রব হয়েও মেলোড্রামা না হওয়ার মুন্সিয়ানায়।   

লুই বুনুয়েলের ‘ভিরিডিয়ানা’ (১৯৬১) এক সাহসি মাস্টারপিস। এর থিম এমন ছিল যে স্পেনে ও ভাটিকান সিটিতে এই সিনেমা বহুবছর নিষিদ্ধ ছিল ‘ব্লাসফেমাস’ হিসেবে। এক যুবতী সন্ন্যাসিনীকে নিয়ে সিনেমা চার্চ তো ভাল চোখে দেখবে না, সেটা ঠিক। অবশ্য এটাও ঠিক যে বুনুয়েলকে ব্ল্যাক কমেডি-র প্রাণপুরুষ বলা হয়ে থাকে। সেটা ‘ডিস্ক্রিট চার্ম অব বুর্জোয়া’ (১৯৭২) হোক বা ‘এক্সটার্মিনেটিং অ্যাঞ্জেল’ (১৯৬২)সমস্যাটা হচ্ছে, বুনুয়েল সুররিয়েলিস্ট সিনেমা বানালেও সেটা সামাজিক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। আর এজন্যই বুনুয়েলের সিনেমা বহুমাত্রিক। তাই আজো ভিরিডিয়ানা নিয়ে বিতর্ক থামেনি। কার এই সিনেমা প্রশ্নাতীত ভাবেই বুনুয়েলের  সেরা সিনেমা। বলে রাখি, এখানে ক্যামেরায় ডিপ ফোকাসের ব্যবহার বেশ ভাল।

তাহলে আমার সেরা বারোয় (হলিউড বাদে) যে যে দেশ উঠে এল, তারা হলঃ ইতালি, ফ্রান্স, রাশিয়া, জাপান, জার্মানি, সুইডেন, স্পেন, ব্রিটেন ও মেক্সিকোহয়ত এই লিস্টে আমি ইতালি বা ফ্রান্স থেকে আরো একটা করে সিনেমা নির্বাচন করতে পারতাম, কিন্তু তাহলে অন্য দুটো দেশ বাদ পড়ত যেটা আমি চাইনি। কার আমার মুখ্য উদ্দেশ্য পাঠককে গোটা পৃথিবীর সেরা ক্লাসিক ছবিগুলোর সঙ্গে পরিচয় ঘটানো, শুধু কয়েকটা দেশের ছবি নয়।  

পরিশেষে, ভাল লাগত যদি নিচে লেখা সিনেমাগুলোও আজ আমার ‘টাইমলেস ক্লাসিক’ লিস্টে রাখতে পারতাম যেগুলো আমার বিচারে সেরা ২০-র ভেতর অবশ্যই আসবে – রিডের ‘দ্য থার্ড ম্যান' (১৯৪৯, ব্রিটেন), ড্রেয়ারের ‘অর্ডেট’ (১৯৫৫, ডেনমার্ক), সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫, ভারত), ফেলিনির ‘লা ডোলচে ভিটা’ (১৯৬০, ইতালি), গোদারের ‘ব্রেথলেস’ (১৯৬০, ফ্রান্স), অ্যান্তনিয়নির ‘রেড ডেসার্ট’ (১৯৬৪, ইতালি), বার্গম্যানের ‘পারসোনা’ (১৯৬৬, সুইডেন), এরিসের স্পিরিট অব দ্য বিহাইভ (১৯৭৩, স্পেন)হ্যাঁ, এটাও বলে রাখি যে আমার পছন্দের আরো দুটো ছবি – কিয়ারোস্তামির ‘ক্লোজ-আপ’ (১৯৯০, ইরান) এবং কার-ওয়াইয়ের ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ (২০০০, চিন) এই ক্লাসিক লিস্টে থাকতেই পারত। রাখিনি শুধুমাত্র সাম্প্রতিক সিনেমা বলে। অবশ্য যেদিন ইরান বা চিনের ছবি নিয়ে আলোচনা করব, এগুলো অবশ্যই থাকবে।


1 কমেন্টস্: