কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১

সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

 

সমকালীন ছোটগল্প


একটি ধূসর স্বপ্ন

 

...হঠাৎ যেন এক মহাপ্রলয়! তারপর সব থমথমে! একটানা ধাতব শব্দের ঘোরে  জ্ঞান ফিরলে উপলব্ধি করি, মারা গেছি! আলগাভাবে উঠে বসতেই বুঝি, হ্যাঁ, সত্যিই মারা গেছি! কিন্তু কী করে মারা গেলাম?

চোখের সামনে এক প্রকাণ্ড কংক্রীট-নগরী। মাথার ওপর কালো আকাশ থেকে ঝুলে আছে দৈত্যাকার কার্বনের মেঘ। বুক ঝুঁকিয়ে তারা যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে উঁচু উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদগুলোকে। পায়ের তলা থেকে অ্যাসফাল্টের রাজত্ব ছড়িয়ে গেছে দিগ্বিদিকশূন্য অসীমে। একটু দূরেই বয়ে যাচ্ছে তরল পলিথিন আর কার্বন মোনো-অক্সাইডের নদী। পিঠে একটা ভারী বোঝা অনুভব করি, কিন্তু অসাড় শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নড়াতে পারি না! নাহ, এই উন্নত সভ্যতার রাস্তাঘাটে হেঁটে-চলে বেড়ানো ব্যস্তসমস্ত প্রাণীদের মানুষ বলে মনে হলেও আদতে একজনও  মানুষ নয়। প্রত্যেকেই মৃত, ঠিক যেমন আমি! কিন্তু, মারা গেলাম কী করে?

ধোঁয়ার স্পর্শের মত যেটুকু মনে পড়ে, খাপছাড়া, অগোছালো... রুডিগার, রুডিগারের নার্সারী, সেখানেই গেছিলাম তো কাউকে নিয়ে! তারপর... কে যেন বলেছিল, “আজ কিছু অর্কিড আর বনসাই আর ক্যাকটাসের ছবি আনবে”! রুডিগার নার্সারী, অনেক দূর, কয়েক আলোকবর্ষ, একটা প্রাসাদের মত পোড়ো বাড়ি! সেখানে ঢুকতেই শ্বাস নিয়েছিলাম বহু শতাব্দী পর, স্বপ্নের মত নরম, আর কেউ যেন খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিল! আমি তো দোষ করিনি কোনও, তবে? উন্নত হওয়া তো পাপ নয়! বাঁধন আলগা হলে একান্নবর্তী সংসারও খসে পড়ে একদিন আধুনিক মেঝেতে! টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় একান্ন পীঠ। কোথাও জলা-পুকুর বুজিয়ে, কোথাও বা জঙ্গল-জোনাকি সাফ করে গড়ে ওঠে ফ্ল্যাটবাড়ি কিংবা পরিপাটি দু’কুঠুরি। আকার বদলাতে বদলাতে কখন যে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে সমাজ! স্বাদ বদলাতে বদলাতে কবি হয়ে ওঠেন বিস্বাদের ঈশ্বর! আর রুডিগার সেদিন নেশা করে ঘুমিয়েছিল অসময়ে। তার এক অ্যাসিস্ট্যান্ট এসেছিল, মাথায় একজোড়া শিং আর হাতে স্মার্টফোন নিয়ে। তার কাছে আলগোছে জানতে চাই, অক্সিজেন আছে কিনা, কেননা আমার প্রিয় এক অফিসতরুণী অক্সিজেনের লোভে পরকীয়া করতো জনৈক লেজওয়ালা পুরুষের সাথে। তারপরই সব তালগোল পাকিয়ে যায়, রাগে গজগজ করতে করতে অ্যাসিস্ট্যান্ট চলে যায় ভেতরে! আর আরও কিছুক্ষণ পর লাল চোখ আর হাতে ধারালো কী একটা নিয়ে বেরিয়ে আসে রুডিগার! আমি শুনতে পাই কে যেন চিৎকার করে বলেছিল, “পাপ, পালিয়ে চলো এখান থেকে”! কিন্তু পিঠে একটা আস্ত বোঝা, আর... আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধাতব অস্ত্রটা এসে আঘাত হানে রদ্দি খবরের কাগজ আর টাংস্টেন দিয়ে বানানো মাথার সুড়ঙ্গে! মারা যাই...

কিন্তু মৃত্যুর পরই সব শেষ হয়ে যায় না! ৩০৩২ খ্রীষ্টাব্দের এই পৃথিবীতে মানুষ মারা গেলে চলে আসে আরেকটা পৃথিবীতে। জীবন আর মৃত্যুর ফারাক এখানে এতটাই ক্ষীণ যে... আরে, ওটা কে? আমার দিকে ওরকম ছুটতে ছুটতে আসছে কেন ছেলেটা? ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে দাঁড়ায় আমার সামনে, আর হাঁপাতে হাঁপাতে  বলে, “বাড়ি চলো পাপ! তুমি আজও একটা সবুজ ছবি কিনতে পারোনি, আন্টি খুব বকবে! তারওপর পিঠে অক্সিজেনের সিলিন্ডারটাও দুমড়ে ফেলেছো!’’

বাকরূদ্ধ অবস্থায় উঠে দাঁড়াতেই, ছেলেটা আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে কোথায় যেন নিয়ে যায়...

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন