কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২০

রঞ্জনা ব্যানার্জী


ভ্রম  


মদিনা বিবির ফুটফুটে কন্যাটি পাঁচ বছরে পড়লো। ননদ আঙুরির কাছেই বড়ো হচ্ছে হোসেন মোল্লাকে আব্বা ডাকে না, আঙুরির ছেলেদের মতো মামা ডাকে হোসেন মোল্লার বুকে সেই ডাক কাঁটা হয়ে খোঁচায়আঙুরি তাকে পেটের সন্তানের মতোই ভালোবাসেআঙুরির স্বামীর বাইরের পরত দেখে মেয়েটির প্রতি অনুভব আন্দাজ করা না গেলেও হোসেন মোল্লা জানে, মেয়েকে ছেড়ে নোয়াব মিয়া একদণ্ডও থাকতে পারে না। সেইবার আঙুরি দুইদিনের নায়রে এসেছিলভোর না হতেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে জামাই-মিয়া হাজির! মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে বুকে চেপে বারান্দায় বসেছিলচোখ ঝাপ্‌সা হয়ে গিয়েছিল হোসেন মোল্লারসেইদিন সন্ধ্যায় বৌয়ের কবরে হাত বুলিয়ে বলে এসেছিল, ‘মাইয়াটা তোরই। তোর মতই চক্ষু-জোড়া আর কোঁকড়া চুলের ঢাল,’ ঠিক তখন কবরের পাশে ঢ্যাঙা বড়ই গাছেরডালে বসা কাকটা বিশ্রীভাবে ডেকে উঠেছিল।

কী যে হয়েছিল মদিনা বিবির! হোসেন মোল্লা এখনও তার কিনারা পায়নি। মদিনা বিবির দু’ছেলে বাড়িতেই হয়েছিল; কোনো ঝামেলা ছাড়াই। এরপরে ওর বাচ্চা নেওয়ার কোনো ইচ্ছেই ছিলো না। এন জি ও’র আপারা দুইয়ের অধিক বাচ্চা হওয়ার কুফল ভালো মতই বুঝিয়েছিলনিয়ম করে বড়ি খেতো, তাও কীভাবে কী যে হলো!  

এরপর সাতমাস না পুরাতেই ব্যথা! হামিদা দাই হাত দিয়ে টেপাটেপি করে বাচ্চার ধুকপুকানি পায়নিসদর হাসপাতালে নেওয়া হলো। ডাক্তার জানালো জটিল কেইস। জেলা-শহরে নিতে হবে।
অবশেষে পেট কেটে ফুটফুটে পরির মতো মেয়েটা এলো দুনিয়ায়। কিন্তু জ্ঞান ফেরার  পরে বাচ্চার মুখ দেখেই মদিনা আঁতকে উঠেছিল, ‘আমার তো বেটা হইসে। কালা কুইচকুইচ্চাবামপাওত ছডি আঙুল!’ মদিনার শাশুড়ি সান্ত্বনা দিয়েছিল, ‘তোর জ্ঞান আসিল না। ভ্রম হইতাসে’মদিনার আম্মা বাচ্চাকে উল্টেপাল্টে নিচু স্বরে বলেছিল, ‘মাইয়ার গঠনে কিন্তু সাতমাসের ছাপ নাই, পূর্ণগর্ভই’

মদিনা বিবি হোসেন মিয়ার হাত ধরে কাঁদছিল, ‘আমার ছাওয়াল বদলাইসে। আইন্যা দ্যানডাক্তার নার্সেরা কওয়াকওয়ি করতেসিলো কুইচকুইচ্চা কালা ছাওয়াল, ছআঙুইল্যা, আমি হুনসি’হোসেন মোল্লার সন্দেহ যায় না, পেট কাটার সময় তো চেতন থাকে না। কীভাবে শুনলো? অতঃপর ডাক্তার আপার কাছেই গিয়েছিল জানতে। আপা উল্টে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি খুশি তো?’- ‘কী কন আপা!’ হোসেন মোল্লা অবাক হয়েছিল। ‘আমি না, বিবি কয় বাচ্চা বদলাইসে। আবার ময়-মুরুব্বিরা কয় সাত মাইস্যা গর্ভের মতন দুব্‌লা লাগে না বাচ্চারে’। ডাক্তার আপা ভ্রূ কুঁচকান, ‘আপনার মেয়েই হয়েছে হোসেন মিয়া। পরিবারে ফর্সা মানুষ নাই?’ হোসেন মোল্লা লজ্জা পায়, ‘আমার দাদিজান ফকফকা ফর্সা আসিলেন’ -‘তাইলে তো ঠিকই আছে। বিবিরে কন দাদীজানের মতই হইসে’তারপরেই মৃদু হেসে বলেছিলেন, ‘বাচ্চা হওয়ার পর মাঝেমধ্যে মায়েদের এইরকম হয়সব ঠিক হয়ে যাবে’

সব ঠিক হওয়ার সময় দেয়নি মদিনা। সেই যে হোসেন মোল্লার হাত ধরে মিনতি করে চোখ বুজেছিল, আর চোখ মেলেনিজ্বরে মদিনার গা পুড়ে যাচ্ছিলো সেদিন।  এমনকি কবরে নামানোর সময়ও হোসেন মোল্লার মনে হচ্ছিলো, মদিনার জ্বর সারেনি।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন