কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২০

তুষ্টি ভট্টাচার্য


পদাবলি - ১২  










(আমি-- আমি সামান্য শখের কলমচি। যা ইচ্ছে হয় তাই লিখি আর কী! আমার লেখার
পাঠক খুবই কম যদিও। বড় বড় সাহিত্য সভায় আমাকে পাবেন না। পুরস্কারের বদলে
তিরস্কারই পাই বরং। মনের দুঃখে ইচ্ছে জেগেছে পদাকে নিয়ে লিখতে। যদি যুগান্তকারী
কিছু লেখা হয়ে যায়, অন্তত পদার নাম করে।

পদা— পদাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। আমারই বয়সী বলে ওকে আমার বন্ধু ভাববেন
না। গরীব নয়, কিন্তু গরীব সেজে থাকে। বিচ্ছিরি রকম ড্রেস সেন্স, হয় পাজামার ওপরে
টিশার্ট, নয় লুঙ্গির ওপরে ফুল শার্ট! আর পায়ে হয় কাপড়ের জুতো নয় প্লাস্টিকের চটি।
সময়ে, অসময়ে হুটহাট আবির্ভূত হয়। আমাদের সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। কথাবার্তার
টপিক বিবিধ ভারতী থেকে বিলিতি আমড়া পর্যন্ত। গায়ে পড়ে এসে পিত্তি জ্বলানো কথা
বলে। আমিও মাঝেমাঝে ওকে কিছু নিরীহ প্রশ্ন করে থাকি।

মাদাম তুভোঁ— আদপে ফরাসী হলেও এদেশের বাসিন্দা, রঙ জন্মসূত্রে সাদাই ছিল। এখন
তাঁর তামাটে মোটা চামড়ায় খসখসে খড়ির দাগ। অত্যন্ত নাক উঁচু টাইপের। এবং জ্ঞানদা।
এঁর কথা অর্থাৎ বাণী না শুনলে আমার আর পদার সম্পর্কটা ঠিক খোলসা হবে না। ইনি
সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় এসে বাণী বিতরণ করে আমাদের আরও বিপাকে ফেলে প্রস্থান করেন।)

এদিকে টি-টোয়েন্টির সিজন শুরু হয়ে গেছে। এবারে আবার দাদার প্রতাপ দেখে কলকাতা
জুড়ে উৎসবের আতিশয্য বেড়ে গেছে। দিনরাতের টেস্ট চালু হল এই প্রথমবার। তাও
আবার গোলাপি বলে, তাও আবার ইডেনে। এমন ঐতিহাসিক দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে
কত কিছু যে হচ্ছে শুনছি… আকাশ থেকে গোলাপি প্যারাশুট নামছে, মাঠে গোলাপি লাইট,
এক্কেবারে পুরোই গুলাবি গ্যাংস্টারদের মতো ক্রিকেটাররা খার খেয়ে আছে। পাবলিকও।
পদাও কি আর থেমে থাকবে? উত্তেজিত হয়ে চলেই এলো লাফাতে লাফাতে। আমি ওকে
দেখেই মোক্ষম প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম- এ পদা! গোলাপি বল দেখেছিস? আমি দেখেছি।
ঢপ মারার আর জায়গা পেলি না? কোথায় দেখেছিস? অবশ্য ফেসবুকেই তো খুল্লমখুল্লা ঢপ
মারা যায়। তা ভাল করেছিস, দেখেছিস যখন...
না রে, সত্যিই দেখেছি। টিভিতে, কাগজে।
হ্যাঁ, যেমন তোকে দেখি রোজ বাজার করতে, মাছের বাজারে ঝগড়া করতে...
কীইইই! এত্ত বড় সাহস তোর! আমি এফবিতে বাজার করি, ঝগড়া করি...
যাহ ব্বাবা! সত্যি কথার জমানা নেই দেখছি!












সেই ঝগড়াই বেঁধে গেল প্রথম থেকেই। কোন কিছুই ও আর সাদা মনে নিতে পারে না।
এমন তিরিক্ষি হয়ে গেছে আজকাল যে, খুব বিরক্ত লাগে। মাদামের কাছে নালিশ করতে
হবে ওর নামে বেশ করে। মাদামও অনেকদিন হয়ে গেল আসেননি। শরীর খারাপ হল
নাকি! এইসব ভাবনা নিয়ে সেবারের মতো প্রথম ডে-নাইট টেস্টম্যাচ সাঙ্গ হল। পদাও আর
ফিরে আসেনি, মাদামেরও কোন পাত্তা নেই। বেশ চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। তবে চিন্তার
জন্য বেশিদিন সময় পাইনি অবশ্য। হেমন্তের ঝরাপাতার সঙ্গে আমার ভাবনাও অন্যখাতে
বইছিল। ব্যস্ততায় কেটে যাচ্ছিল বেশ। একে গরমের দুঃসহ ভার কমেছে, এনার্জি পাওয়া
যাচ্ছে অনেক বেশি করে। ফলে কাজকর্মে ডুবে থেকে, বাকি অকাজের ভাবনাগুলো ভুলতে
বসেছিলাম। এদিকে শীত তেমন ভাবে পড়ছে না, হাল্কা একটা আমেজ রেখে চলে যাচ্ছে।
ফলে চারিদিকে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে, সঙ্গে মশার উৎপাতে ডেঙ্গির প্রকোপ। আমি
নিশ্চিত হয়ে বসে আছি— পদার নিশ্চই ডেঙ্গি হয়েছে! এদিকে আমিও একটানা সর্দি,
কাশিতে নাজেহাল। শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ এখন সর্দি-জ্বরে ভুগছে। আর জ্বর হলেই
টেনশন— এই বুঝি ডেঙ্গি হল! এরকমই এক বিকেলে পদা হাজির হল আপাদমস্তক চাদর
মুড়ি দিয়ে। আমি জিজ্ঞেস করলাম-
‘কী রে জ্বর হয়েছে? সবার হচ্ছে দেখছি। এই যে একটানা সর্দিকাশি - সারছেই না। শীত
আসছে না বলেই তো!’
'হুঁ,
 ওই জন্য তো সেদিন বললাম তোকে। চল দক্ষিণমেরু ঘুরে আসি। পেঙ্গুইনের সঙ্গে সাঁতার
কাটবি, তিমির নাকে চুমু খাবি, সীলের গায়ে সর্দি মুছে দিবি... তা শুনলি কই!'
‘টাকা
 কে দেবে শুনি? তুই দিবি?’
'আমি
 কোথায় পাব? এই দ্যাখ চটি ছিঁড়ে গেছে। কিনে দিবি একটা? না, না, চটি না।
একজোড়া জুতো কিনে দে। শীত আসছে'।
হাঁচি কাশি ভুলে পদার দিকে চেয়ে ভাবলাম- এর হাত থেকে রক্ষা পেতে আমাকে সত্যিই
একদিন দক্ষিণমেরু যেতে হবে। কোথা পেঙ্গু, কোথা পেঙ্গু করে চেঁচিয়ে উঠেছি যেই, পদা
বলল, ‘কী! তোর ডেঙ্গু হয়েছে! যাক, ভালই হল, তবে ওটাকে ডেঙ্গু বলে না আজকাল।
আধুনিকতার দাবী মেনে নিতে শেখ এবার। বল ডেঙ্গি। ডেএএঙ্গিইইই...’

বেশ ছিলাম হতচ্ছাড়াটা না আসাতে। এসেই আবার শুরু হয়ে গেল আমাদের
খামচাখামচি। আর মাদামটাই বা কোথা হাওয়া হয়ে গেল কে জানে! বলতে না বলতে
লাঠি ঠকঠক করে মাদামের আবির্ভাব হইল।










বিলম্বের হেতু বর্ণনা করিতে বসিলেন শুরুতেই। তাঁর বক্তব্যের দীর্ঘসূত্রিতা কিঞ্চিৎ কাটিয়া
ছাঁটিয়া পেশ করিতেছি। অবশ্য তাঁহার বাণী নিঃসরণের অর্ধাংশ জুড়িয়া ছিল হাঁচি ও কাঁসি,
থুড়ি কাশির প্রাবল্য। সর্বোপরি, মাদামের অদ্যই শেষ আবির্ভাব, এই সংবাদে আমরা মূক
হইয়া পড়িলাম। মাদাম ত্রিশ বৎসর বাদে ফরাসী দেশে ফিরিয়া যাইবেন। আগামী খ্রীস্টমাস
ওই দেশেই কাটাইতে চাহেন তিনি। তাঁহার শেষ নিঃশ্বাস নিজ দেশেই নির্গত হউক— ইহাই
তাঁহার অন্তিম ইচ্ছা। অদ্য মাদামকে আমাদিগের আর বিরক্তিকর মনে হইল না। উপরন্তু
মাদামকে বিদায় জানাইতে হইবে, এই আশঙ্কায় আমাদিগের বুক ভাঙিয়া যাইতে লাগিল।
কণ্ঠ হইতে স্বর নির্গত হইল না। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে আকুল হইয়া আমি বারংবার মাদামকে
নিবৃত্ত করিতে চাহিলাম, উনি কাহারও অনুরোধে কর্ণপাত করিলেন না। স্বয়ং পদাও, তাহার
স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে ছুটিয়া গিয়া মাদামের পদপ্রান্তে বসিয়া বহুল পরিমাণ কাকুতিমিনতি
করিতে থাকিল। মাদাম অবিচল রহিলেন। অতঃপর, কোনরূপ উপায় না দেখিয়া আমাদিগের
চক্ষু হইতে অশ্রু নির্গত হইতে থাকিল। মাদাম আমাদিগকে আশীর্বাদ করিলেন মস্তকে
হাত রাখিয়া, মুখ চুম্বন করিলেন সাদরে। প্রস্থানের পূর্বে কহিলেন- ‘তোমরা ভালভাবে থাকবে
আশা করি। নিজের নিজের কাজে মন দাও। কর্মই পরম তপঃ!

মনে রেখ। আমি চলে যাচ্ছি, তোমরা নিজেদের মধ্যে আর ঝগড়া কোরো না এবার থেকে।
আমাকে তোমরা কথা দাও— নইলে দেশে গিয়ে মরেও আমি শান্তি পাব না। তোমরা কি
এটুকু পার না? আমার ওপর তোমাদের কি কোন মায়া মমতা জন্মায়নি? আমি মিনতি
করছি তোমাদের কছে…’

মাদামের অশ্রুসজল চক্ষু দেখিয়া আমাদিগের আবেগের বাঁধভাঙিয়া যাইল। দুইজনে
মাদামের পা ছুঁইয়া শপথ লইলাম— অদ্য হইতে আমরা আর কলহ করিব না। মাদাম ধীরে
ধীরে নির্গত হইলেন। যতক্ষণ না মাদামের চেহারা ঝাপসা হইয়া যাইল, আমরা তাঁহার
পথের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া প্রস্তরের ন্যয় দাঁড়াইয়া রহিলাম।

নতুন বৎসরের নতুন দিন যেন নতুনতর হইয়া মাদামের জীবনে আসিতে পারে, এই
কামনা করিলাম আমরা একযোগে। মাদাম তুভোঁ দীর্ঘজীবী হউন!



1 কমেন্টস্:

  1. সরস... ভালো থেকো পদা নতুন বছরে।
    ডেঙ্গু পেঙ্গু সামলে...
    শ্রাবণী

    উত্তরমুছুন