হজমি দাদু
ট্রেনে চাপলেই
দরজার ধারগুলো প্রায়ই একরকম ভাবে ডাকে। ডাকে, হয়তো বয়সকালীন
তৎপরতায়। ট্রেনের
জানালার ধারগুলোকে একটু অগভীর বলেই মনে হয়। ফিসপ্লেটের গন্ধগুলো ওই জালি জালি পাল্লাতে ধাক্কা খেতে খেতে একসময় সত্যিই সত্যিই
লোহার পাত মনে হয়। সেদিক
থেকে দরজাটা একটু সেফ। ফিসপ্লেট-ফিসফ্রাই, ফিসফ্রাই-ফিসপ্লেট-এর
পার্থক্য বোঝার জন্য খাতার পাতা মাঝ বরাবর
ভাঁজ করার দরকার পড়ে না। রোদগুলোর
সঙ্গেও ভালো রকমের বোঝা-পড়া হয়ে যায়। সেদিনও সেই রকমের বোঝা-পড়ার ধান্দায় ছিলাম, বা বলা ভালো নেশায় ছিলাম।
নেশাটা ভঙ্গ হলো একটা স্বাভাবিক রকমের কন্ঠস্বরে। যখন দমদমের মেট্রোর লাইনের নীচের
বস্তিগুলোতে থাকার ইচ্ছে হচ্ছিল।
ফাঁকা ট্রেন সাধারণত মাঝে-সাঝে স্বপ্নে দেখি। তবে মাঝে মাঝে সে স্বপ্ন সত্যি
হলেও অনেক কিছু চোখ ফস্কে বেরিয়ে যায়। তবে সেদিন ফ্রেম আউট হওয়ার আগে চট্ করে শাটার বাটন্ টা প্রেস করে ফেললাম।
মনে ধরল একজন ভদ্রলোক। সাদা পাজামা, সাদা পাজ্ঞাবী, এক কাঁধে কালো রঙের একটা ব্যাগ। এক হাতে হজমির একটা কৌটো। আর এক হাতে ওয়াকার।
ফোকলা দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে ইউনিভার্সিটি
পাশ করা বছর একুশের যুবক।
শুরু থেকে যে রোদটার সঙ্গে বোঝাপড়ায় ছিলাম, চট্ করে মনে হলো সেই কেমন যেন
ঘুরে বেরাচ্ছে কামরা থেকে কামরায়।
এ চেহারার ভরণ-পোষণ দেখে, মনে মনেও ‘ভদ্রলোক’ শব্দটা কর্পোরেট হয়ে উঠছে।
মাছ-ভাতের মতো সহজ ভাবে ভাবতে গেলে, একটাই শব্দ আসছে... 'দাদু'। পায়ের কড়ি আঙুল থেকে শুরু করে, হিউমেরাস-রেডিয়াস হয়ে... সবদিক বরাবর
দাদু।
চোখের সামনে ট্রেনের যাত্রীগুলো হুঠ-হাঠ করে হয়ে উঠছে, কেউ বা দাদুর মেয়ে, কেউ বা দাদুর
নাতি, কেউ বা দাদুর নাতনি। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে সমানুপাতিক হারে
কমতে থাকছে, দাদুর কৌটোর হজমি।
কী নামে যেন একটা ডেকে দুম করে, আমার হাতে গুঁজে দিল, আমসত্ত্ব-র মতো নোনতা দেখতে কিছু একটা।
আমি খেতে লাগলাম, আর অবাক হয়ে দেখলাম, দাদুর শাসন-ভালোবাসা আস্তে
আস্তে কেমন করে একটা আলগা মতো সত্যি হয়ে উঠছে পুরো কামরা জুড়ে।
সেই সত্যি-টার সঙ্গে প্রতিযোগীতায় নামছে, দাদুর
গলায় মাঝে মাঝে বলে ওঠা কিছু শব্দ।
‘আনার দানা...’
আমি ততক্ষণে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে ফেলেছি দাদুর ওয়াকারের গতিবিধি। আর কানে আসছে
দাদুর গলা, কেমন যেন শোনপাপড়ির মতো শোনাচ্ছে-
‘আমি চলে গেলে কিন্তু আর পাবি না!’
‘কোথায় যাওয়ার কথা বলছে দাদু?’
‘জানি না’।
তবে, সুযোগ বুঝে দশ টাকাটা বের করে সামলে-সুমলে ব্যাগে পুরে রেখেছি আনার
দানার প্যাকেটটা।
আর মনে পড়ছিল...
না না... ওদের বয়স তোমার থেকে অনেক কম।
আরে, হ্যাঁ গো.. আমি, একদম ঠিক দেখেছি।
হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে, ওরা যখন চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপালো, তখন ওদের কোনো
রকমের কোনো ওয়াকার লাগেনি।
ফন্ট্র ক্যামেরায়, তোমায় ধরে রেখে, দু’চার কথায়, ফেসবুকের টাইমলাইন
তাই আমার সাজানো হয়ে ওঠেনি।
ভাগ্যিস...!
নতুন করে চলতে দেওয়ার জন্য, প্ল্যাটফর্ম-এর কাছে আত্মসর্মপণ করেছে ট্রেনটা। যে যার মতো
ফিরে গিয়ে নতুন করে শুরু করার তালে আছে।
তুমি, তখন আলতো করে ট্রেনের বগিতে ঠেসান দিয়ে, ঝালিয়ে নিচ্ছো তোমার রোজকারের
অভ্যেস।
দু-চারজন কি ঘিরে আছে তোমায়?
জানি না...
আমি শুধু এইটুকু জানি যে, এইসময় ক্যানিংটায় বড্ড ভিড় হয়। তাই সোনারপুরটাই ধরতে হবে।
দুটো পঞ্চাশের ক্লাসে হজমিও কেমন যেন
হজম হয়ে যায়।
বেঁচে থাকে শুধু প্রতিদিনের গ্যাস-অম্বল।
আর ভুলে যাওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করে দিয়ে ফেলি ডাকনাম - হজমি দাদু।
মিশে যাই ভিড়ে।
প্রতিদিনের স্বভাবে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন