সমকামিতার চতুষ্কোণ
(এক)
বাংলায় সমকামিতা শব্দটির গঠন সংস্কৃত-সঞ্জাত। সংস্কৃত শব্দ
‘সম’-যার অর্থ সমান
অথবা অনুরূপ এবং ‘কাম’ শব্দের অন্যতম অর্থ যৌন চাহিদা, রতিক্রিয়া তথা যৌনতৃপ্তি। অতঃপর এই দুই শব্দের সংযোগে
উৎপন্ন সমকামিতা শব্দ বলতে আমরা বুঝি অনুরূপ বা সমান বা একই লিঙ্গের মানুষের (বা
প্রাণীর ক্ষেত্রে অন্য প্রাণীর) প্রতি যৌন আকর্ষণ। 'সমকামিতা' ইংরেজি প্রতিশব্দ হোমোসেক্সুয়ালিটি, যা এসেছে গ্রিক শব্দ ‘হোমো’ এবং ল্যাটিন
শব্দ ‘সেক্সাস’ থেকে। গ্রিক ভাষায় ‘হোমো’
বলতে বোঝায় সমধর্মী বা একই ধরনের। আর ‘সেক্সাস’ শব্দটির অর্থ
হচ্ছে যৌনতা ৷ সুতরাং 'সমকামিতা' শব্দটির
বিশ্নেষণ দেখে আমরা বুঝতে পারছি যৌনতা মুখ্য ৷ এখন যৌনতা বলতে আমরা সাধারণত নারী
পুরুষের মধ্যে যৌনক্রিয়া বা যৌনউত্তাপকে বুঝি। ‘যৌনতা’
শব্দটি বিতর্কিত ৷ সভ্যতার প্রথম দিকে সিন্ধু সভ্যতার দিকে তাকিয়ে বর্তমান ভারতীয় সংস্কৃতির
উদ্ভবের রেখাপাত করা যায়, যা প্রায়
৫৫০০ বছর আগেকার প্রাচীন মিশরীয় এবং সুমেরীয়
সভ্যতার সাথে সমসাময়িক ছিলো। ঐ সময়কালে, সামাজিক যৌন মনোভাব অনেকের অজানা ছিলো। যৌনতা সম্পর্কে সিন্ধু সভ্যতার মধ্যেই
প্রজনন প্রথার চর্চা পরিলক্ষিত হয়েছে।
তারপর সভ্যতার অগ্রগতির পর দেখা যাচ্ছে 'সমকামিতা' নিয়ে মানুষ
ভাবছে। একইসাথে
উভকামিতা ও বিপরীতকামিতার সাথে সমকামিতা বিপরীতকামী-সমকামী অনবচ্ছেদের অন্তর্গত
যৌন অভিমুখীতাকে তিনটি প্রধান ভাগের অন্যতম বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কিন্তু কেন সমকামিতা? কিংবা একই
লিঙ্গের মানুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ কেন? বিজ্ঞানীরা সমকামিতার প্রকৃত কারণ জানেন না, কিন্তু তারা বিশ্বাস করেন যে, জিনগত, হরমোনগত এবং পরিবেশগত কারণসমূহের এক জটিল আন্তঃক্রিয়ার ফলে
এটি ঘটে থাকে৷ কিন্তু এখন কেন মানুষের মধ্যে সমকামিতা প্রকোপ দেখা যাচ্ছে? 'প্রকোপ ' শব্দটি এই
কারণেই বললাম, বর্তমানে এটা ব্যাধির মতো বিস্তৃতি লাভ করছে৷ কিন্তু মানুষের সচেতন
পছন্দের কোনো ভূমিকা নেই? কিন্তু তারা এখন
জীববিদ্যা-নির্ভর তত্ত্বগুলো বেশি সমর্থন করে থাকেন, এর অন্তর্গত হলো জিন, মাতৃগর্ভের
পরিবেশ,
এই দুই প্রভাবের মেলবন্ধন অথবা এই সব কিছুর সাথে সামাজিক প্রভাবের
মেলবন্ধন।
যৌন অভিমুখীতা নির্ধারণে যে সন্তানপালন বা শৈশবের অভিজ্ঞতার
কোনো ভূমিকা আছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কেউ কেউ সমকামী যৌন আচরণকে অপ্রাকৃতিক
মনে করলেও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সমকামিতা মানব যৌনতার একটি সাধারণ ও প্রাকৃতিক প্রকরণ, এবং অন্য কোনো প্রভাবকের অস্তিত্ব ছাড়া এটি কোনো নেতিবাচক
মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। যৌন অভিমুখীতা পরিবর্তনের বিভিন্ন
কর্মসূচীর কার্যকারিতা সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ নেই ৷ এখন ‘সমকামিতা’ নামটিও লিঙ্গভেদের কারণে বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়৷ যা কিনা
পুরুষ ও নারী সমকামীকে চিহ্নিতকরণ করে থাকে ৷ প্রশ্ন উঠতেই পারে একদিকে সমকাম আবার
অপরদিকে লিঙ্গভেদে নামকরণ কেন ? তথ্য প্রমাণের
দ্বারা দেখা গেছে উভয় লিঙ্গের সরকামিতার ভাবনাচিন্তা থেকে এমন নামকরণ ৷
মহিলা সমকামীদের বোঝাতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দটি হলো
লেসবিয়ান এবং পুরুষ সমকামীদের ক্ষেত্রে
গে,
যদিও গে কথাটি প্রায়শ সমকামী মহিলা ও পুরুষ উভয়কে বোঝাতেও
সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়। নানা কারণে স্বঘোষিত সমকামীর সংখ্যা এবং মোট জনসংখ্যার
মধ্যে সমলৈঙ্গিক সম্পর্কে আবদ্ধ মানুষের অনুপাত নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। এই
কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হলো সমকামভীতি ও বিপরীতকামবাদের
সমর্থনজনিত বৈষম্যের কারণে অনেক সমকামী প্রকাশ্যে তাদের যৌনতা স্বীকার না করা।
অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও সমকামী আচরণের নিদর্শন নথিভুক্ত হয়েছে। অনেক সমকামী
মানুষ স্থায়ী পারস্পরিক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকেন, যদিও আদমশুমারির ফর্ম, রাজনৈতিক
পরিস্থিতি ইত্যাদির আনুকূল্যে তাদের আত্মপ্রকাশের পথ নিরাপদ হয়েছে, তবে সেটা
একেবারে সাম্প্রতিক কালে।
মূল মনস্তাত্ত্বিক গঠনের দিক দিয়ে এই সম্পর্কগুলো
বিপরীতকামী সম্পর্কের সমান। নথিভুক্ত ইতিহাস জুড়ে সমকামী সম্পর্ক এবং কার্যকলাপের
প্রশস্তি ও নিন্দা - উভয়েরই নিদর্শন মেলে ৷ কেবল প্রকাশের ভঙ্গিমা ও সংশ্লিষ্ট
সংস্কৃতিজনিত তারতম্য দেখা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার
উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়েছে, যার অন্তর্গত বিবাহ, দত্তক গ্রহণ ও
সন্তানপালন, কর্মক্ষেত্রে সমানাধিকার, সামরিক পরিষেবা, স্বাস্থ্য পরিষেবায় সমানাধিকার, এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক সমকামীদের নিরাপত্তার স্বার্থে অ্যান্টি-বুলিং আইন কার্যকর
রয়েছে ৷ ধীরে ধীরে সমকামীদের প্রতি সচেতনতা বেড়ে গেছে অনেক l কিন্তু ভারতবর্ষের মতো দেশে যেখানে ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’ এই মতবাদে বিশ্বাসী হয়েও ‘সমকামিতা’কে স্বীকৃতি দেওয়া
হয়নি তেমন ভাবে। আমাদের সংস্কৃতি যেখানে নারী পুরুষের
সহবস্থান যতক্ষণ না সামাজিক হয় ততক্ষণ পর্যন্ত বৈধ বলে মনে করে না ৷ আজও যৌনতা
নিয়ে বললে কিছু মানুষের ভ্রুকুন্ঠিত হয়। আমাদের সংস্কৃতি আমাদের পিছিয়ে রাখেনি আমাদের সংযত, পরিমিত, সুষ্ঠু
জীবনযাপন করতে শিখিয়েছে। একই ঘরে অভিবাকদের সাথে সিনেমা টিভি দেখতে বা যৌনদৃশ্যে বাবা মা'র সাথে সাথে সন্তানরাও স্বাভাবিক বোধ করেন না। এই আমাদের
সংস্কৃতি। তবে
এটা দ্রুত পরিবর্তনীয়।
ইসরাইলকে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সমকামীদের প্রতি
সবচেয়ে সহনশীল দেশ বলে মনে করা হয় এবং তেল আভিভকে একারণে ‘মধ্যপ্রাচ্যের পুরুষ সমকামী রাজধানী’ নামে ডাকা হয়, যা বিশ্বের সমকামীদের প্রতি সবচেয়ে বন্ধুসুলভ শহরগুলোর
মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। সমকামিতার
সমর্থনে তেল আভিভে প্রতি বছর বার্ষিক গৌরব মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
২০১৬ জেরুজালেমের ঘটনা: ইসরাইলে আলোচিত বার্ষিক র্যালিতে
সমকামীদের ওপর হামলাকারী ইয়েশাই শিলসেলকে
১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে দেশের আদালত। আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময় ইয়েশাই বলছিলেন, ‘‘আমি উপরওয়ালার ইচ্ছায় কাজটা করেছি। এরকম সমকামী র্যালি
যাতে ভবিষ্যতে না হয়।” এক ইসরাইলি
কট্টরপন্থী ইহুদি হামলা চালিয়েছে। র্যালি চলাকালে একটি ছুরি নিয়ে আকস্মিক হামলা
চালায় ওই ব্যক্তি। ২০১৬র ৩১ আগস্ট তার এলোপাথাড়ি ছুরির খোঁচায় আহত হয়েছিলেন ৬ জন।
এদের একজন তরুণী শিরা বানকী (১৬) হাসপাতালে মারা যান।
এর আগেও সে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। ২০০৫ সালে সমকামীদের একটি
র্যালিতে হামলা চালিয়ে চারজনকে ছুরিকাহত করার অভিযোগে কারাদণ্ড ভোগ করছিল সে।
কিছুদিন পরে সে কারাগার থেকে ছাড়া পায় এবং আবারও একই ঘটনা ঘটায়। ছয়জনকে
ছুরিকাহত করার পর ইয়েশাই শিলসেলকে ধরে ফেলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, প্রায় ৫ হাজার মানুষ এ আয়োজনে অংশ নিয়েছিলেন। তারা একটি রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একটি
সুপার মার্কেট থেকে একজন সেই ভিড়ের মধ্যে খোলা ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং
অংশগ্রহণকারীদের কয়েকজনকে ছুরিকাহত করে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, সরকারী অনুশাসন বৈধতা
দিলেও সচেতনতা বেড়ে ওঠেনি।
অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক সরকার প্রায়শই সমকামিতাকে এড়িয়ে যায়, এর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এবং একে অপরাধ হিসেবে
সংজ্ঞায়িত করে। মুসলিম দেশসমূহের সবগুলোতেই সমকামিতা অবৈধ। বহু মুসলিম দেশে
সমলিঙ্গীয় যৌনসংগমের ফলে আইনগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের সাজা প্রদান করা হয়, এরা হলো: সৌদি আরব, ইরান, মোরিতানিয়া, উত্তর নাইজেরিয়া, সুদান এবং ইয়েমেন।
ইরানের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমেদিনেজাদ ২০০৭ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তার
বক্তব্য প্রদানকালে বলেন যে, ইরানে কোনো
সমকামী লোকজন নেই। সম্ভবত, এর একটি কারণ
হতে পারে যে, তারা সরকারি তহবিল না
পাওয়া অথবা পরিবার কর্তৃক ত্যাজ্য হওয়ার ভয়ে তাদের যৌন পরিচয়কে লুকিয়ে রাখে।
(ক্রমশঃ)
তথ্যমূলক লেখা। ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন