উত্তরকথা
(২৮)
কুদ্দুস ও ইয়াসীনের কত কত
সময়াতীতের পরে আবার দেখা। কত পালটে গেছে ওরাও। সময়ের হাওয়ায় হাওয়ায় জীবন সব হিসেব
আদায় করে নেয়। দেখা সাক্ষাতের পর্বটা তুমুল আবেগময় হয়ে উঠলো। চোখের জল, মন কেমন, কিঞ্চিত
মান-অভিমান আর লজ্জা এসে কুয়াশার মতন ঢেকে দিল একসময় সব। তারপর চারপাশ থেকে বাদ্য
বাজতে শুরু করলো। কোমরে আঁচল জড়িয়ে মেয়েরা শুরু করলো নাচ আর নাচ। আবোর ঘর ঘুরে
ঘুরে নাতিপুতিদের সাথে রঙ্গে রঙ্গে মুখরিত এক দিন দুনিয়ার জন্ম দিতে দিতে আস্ত এক
গানবাড়িতেই হামলে পড়লো। দশ কুড়ি গ্রামগঞ্জের দিকে উড়ে যেতে থাকলো গানের পর গানের
সুর, নাচের ও বাদ্যের উৎসবগাথাও-
‘দেখরে মোর ঢক আবো
কেমন রে সোন্দরী
বোঁচা নাকত নথ পিন্ধিছে’
একসময় এই গান নাচের পাকেই আবার জড়িয়ে যেতে হলো কুদ্দুস ও
ইয়াসীনকে। তার পূর্বজন্ম থেকে আবার তীব্র লাফে, মত্ত হস্তীর বলে, ডোরাকাটা চিতার
ঝাপিয়ে পড়বার মতন রো রো চিৎকার করে একেবারেই গানবাড়ির মাঝে এসে দাঁড়ালো; শরীরময়
নাচের হিল্লোলে আবার গানের বাদ্যের এক যাদু ফিরিয়ে আনতে থাকলো উত্তরের এই আবহমান
দেশ দুনিয়ায়।
(২৯)
সেই ফিরে আসবার পরে কত কত দিন অতিক্রান্ত এক সময়ে এক শীতের সন্ধ্যেতে
রাধাকান্ত ও কইকান্ত গায়ে ভারী শাল জড়িয়ে শালকুমারের গীরি জোতদারের বাড়ি থেকে
তালুক মুলুকের গল্পগুলিকে নিয়ে ফিরছিল নয় এগারো হাটের এক শালজঙ্গলের মধ্য দিয়ে। তাদের দুপুরের
অতিভোজনের ফলজাত রসস্থ শরীর মহিষের গাড়ির
দুলুনিতে এসে পড়া আলস্য ও অন্যমনষ্কতা ভেঙ্গে দিয়ে কোথাও যেন ডুকরে কেদে ওঠা বাঘের
ডাক তাদেরকে সচকিত করেই ফেললো। গাড়িয়াল গতি আনতে চাইলেও ভয়ে পেয়ে গুটিয়ে যাওয়া মহিষেরা
স্থির দাঁড়িয়ে পড়ে। ভীত হওয়া ছাড়া তো আর কিছু করার নেই। তারা চুপচাপ বসে থাকে ছইএর
তলায়। কত দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেলো এইভাবে। অন্ধকার শীতরাত। ঘন হচ্ছে কুয়াশা। শিশিরের
শব্দ। এই শালজঙ্গল শেষ হলেই তো আবার সেই ধাইধাইবিটের ফরেষ্ট। উত্তরের হাতি বাঘ
বাইসন নিয়েই তাদের ঝুঁকির জীবন। কইকান্ত রাধাকান্তর দিকে তাকালো। তারপর নিয়তির
হাতে সব ছেড়ে দিয়ে তারা তামাকুসেবনে মনোযোগী হয়ে পড়লো। এমন কত পরিস্থিতির মুখোমুখি
হতে হয়েছে জনমভর। অবশ্য এখন শরীরে তারুণ্য নেই। সাহস কমে গেছে। একসময় বাঘের ডাক
দূরে সরে যেতে যেতে অদৃশ্য হয়েই গেলো। আর মহিষেরা স্থিরতা পেয়ে গেল। গাড়িতে গতি
এনে ফেলেই শরীরের পেশীতে কম্পন তুলে গাড়িয়াল গেয়ে উঠলো গান-
‘হামার দ্যাশত বড় বাঘের ভয় রে সোনা রায়
ফান্দে পড়িয়া বুড়া বাঘা কান্দে রে রূপা রায়’
বাড়ি ফেরার পরে এই গল্প পল্লবিত হতে হতে অনেক অনেক সময়
পেরিয়ে সেই আহত বাঘের কান্নায় গুমরে ওঠা শালফরেষ্টের নাম পালটে হয়ে উঠেছিল ‘বাঘাকান্দির
টাড়ি’।
(৩০)
সোমেশ্বরীর খুব মনে পড়ে বাবার দেশের সেই সব কুরুয়া পাখির
কথা। শরীরে মরণ জাগিয়ে উদাসীন হতে থাকা বড়বাবার কথা। এই সব শীতের দিনে সোমেশ্বরীর
অদ্ভূত উদাসীনতা জাগে। সে তখন একা একাই নিজের মতন গান ধরে, যদিও সেই গানের শ্রোতাও
একমাত্র সে-
‘ও কি ও মোর ভাবের দ্যাওরা রে
থুইয়া আয় মোকে তুই বাপ ভাইয়ার দ্যাশে’
এই মাইল মাইল মাঠখেত পাথারবাড়ির ভিতর, নদী জঙ্গল সরিসার
হলুদ বিস্তারের ভিতর, মেলা উৎসব গান নাচের ভুবনের ভিতর বেঁচে থাকতে থাকতে
সোমেশ্বরী কিন্তু জীবনের খুব গভীরতাতেই তার জীবনকে জন্মভর মেলে দিতেই থাকে, আর গানে গানে সে তার বেঁচে থাকতে চাওয়ার তীব্র এক
আকুতিকেই উত্তরের হাওয়ায় হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতে থাকে-
‘আরে হাত্তি মার্কা কেরাসিন কায় বা আইনছেন দ্যাশতে
বাপ রে বাপ মাও রে মাও আজি গাও ঝমঝম করে রে’
জন্মমরণের ভিতর আর কিছু নয়, কেবল
জীবন জেগে থাকে!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন