২২)
গল্পের গরু
চারানা আটানায় ছড়া, লিমেরিক, চুটকি, পান-দোক্তা সবই হয়েছে,
কিন্তু সে রকম গুছিয়ে প্রমাণ সাইজের গল্প লিখিনি একটাও। গল্পের জন্যে অন্য বিভাগ
আছে, তাতে যোগ্য ব্যক্তিরা লেখেন। আমাকে কাজলদা শুধু এইটার ভার দিয়েছেন। মোটামুটি
কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ঘেঁটে আমি মাসের নির্দিষ্ট সময়ে মাল সাপ্লাই করে এসেছি এ
পর্যন্ত।
এবার একটা গল্প লেখার ইচ্ছে হলো। ঐতিহাসিক না পৌরাণিক, তা আপনারা বুঝে
নিন। ইতিহাস আমাদের সামনে রোজই প্রায় নতুন
নতুন আঙ্গিকে আসছে তো আজকাল, এটাও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ছাড়া আর কী! রবি-সেক্সপীয়র
রবি-গান্ধী-ফলের রস সিধু-কানু-ডহরবাবু রামমোহন-বিধানসভা ইত্যাদি মণিমাণিক্যে ভরে
উঠছে ইতিহাসের কাঁথাঞ্জলি। কালানুক্রমকে তাই বিশেষ পাত্তা না দিয়ে আমি একটা গল্প
নামিয়ে দিচ্ছি এখানে। গল্পটার নাম হতে পারে ‘বেদুইন ডারুইন’ অথবা ‘সীতাসূত্র
সন্ধানে’। নাম-টাম কোনো ব্যাপার না, পড়েই দেখুন না।
শকুন্তলা
কণ্বমুনির তপোবনে লিচুগাছের ছায়ায় বসে শকুন্তলা বিড়ি
বাঁধছিল। গরমেন্ট
তামাকের ওপর বঙ্গলক্ষ্মী ট্যাক্স বসিয়ে বাংলার যুবক যুবতীদের বেশি করে
বিড়ি-সিগ্রেট খেতে নির্দেশ দিয়েছে। ফুলুরিশিল্পকে বাম্বু দিয়ে বিড়িশিল্পের তাই এখন
পোয়াবারো, যতই না ফরেন ইনভেস্টমেন্টের পোতিশ্রুতি থাক ফুলুরিতে। তবে সেজন্যে না, শকুন্তলার ব্যস্ততা
অন্য কারণে। কণ্বমুনির কাছে শেখ হাসিনা ঢাকায় তার অভ্যাগতদের জন্যে স্পেশ্যাল নীল
সুতোর বিড়ি চেয়ে পাঠিয়েছেন। তিস্তায় এখনো অবশ্য জল আসেনি, কোনোকালে যে আসবে, সে
ভরসাও তেমন নেই, তবে তিস্তা তো আছে! যতক্ষণ তিস্তা, কলম- কাগজ-দিস্তা। খালেদারে
ফুন দিয়া হাসিনা কইয়া দিসে, “ওনুষ্ঠানে লাল লুঙ্গি ফরবা না, মৌ-লোভী ছায়েব কইসেন
লাল লুঙ্গি ফরলে বুমিকম্ফো অইতে ফারে, নীল-সাদা ফরবা। তুমার না থাইকলা আমি তুমারে
ধার দিবানে। এ লইয়া কিন্তু তিস্তার পানি ঘুলা করবা না। ফরে দেখোন যাইবো"।
ইন্ডিয়ান লটবহর ঢাকায় যাওয়ার আগেই পাঁচ হাজার বিড়ি সেখানে
ক্যুরিয়ারে পাঠাতে হবে। কচকচ করে কাঁচি দিয়ে বিড়ির পাতা কাটছিল শকুন্তলা। দিন ঢলে
আসছে, মালিনীর জলে সূর্য ডুবে যাচ্ছে, হঠাৎ মুখ তুলে দেখল বেড়া ঠেলে ডারুইন ঢুকছে।
ডারুইনের মাথায় অল্প একটু ছিট আছে। আর্যভট্টর কাছে
বর্ণপরিচয় শিখতে গেছিল, কিন্তু দন্ত্য স-এ হ্রস্ব-উ ব-এ ওকার ধ কিছুতেই ঠিকঠাক
উচ্চারণ করতে পারে না, খালি বলে সুভোদ। গোপাল নাকি সুভোদ বালক। ব্যাকরণে অনাচার
বরদাস্ত করেন না আর্যভট্ট, রেগে চাপাতি ছুঁড়ে মারতে গেছিলেন – যে রকম একসময় কুঠার
ছুঁড়ে সারা পৃথিবী থেকে ক্ষত্রিয় বিনাশ করে ফেলেছিলেন উনি – কিন্তু বয়স হয়েছে তো,
আর এখন চাপাতির যুগ, টিপ ঠিক থাকে নি। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একটা কলাগাছের মধ্যে
চাপাতিটা গেঁথে গেল। তাতে খুশি হয়ে আর্যভট্টর বৌ মাতঙ্গিনী হাজরা সেই কলাগাছের থোড়
রান্না করে ফেলল খাড়া আর বড়ি দিয়ে। জম্পেশ হয়েছিল সেই শুক্তো। গরমেন্টের কেউ খেলে
শুক্তোশিল্পেও উন্নয়নের জোয়ার এসে যেত। আর্যভট্টর রাগ অবশ্য কমেনি। উনি রেগেমেগে
ডারুইনকে রঙ্গবিভীষণ খেতাব আর একটা নীলকমল প্লাস্টিকের চেয়ার উপহার দিয়েছেন।
ডারুইন যতই রুমাল দিয়ে মোছে, সে চেয়ারে
সবসময় একটু জল জমে থাকে। নিউটন একদিন ডারুইনের কাছে মন্দাক্রান্তা ছন্দ বুঝতে এসে
সেই চেয়ারে বসেছিল, পেছনের পকেটে মানিব্যাগে ইউরো ছিল, ভিজে লৎপতে হয়ে যাওয়ায়
‘ইউরেকা’ বসে চেঁচিয়ে উঠে বাগদাদের রাস্তা ধরে ছুটতে লাগল।
ডারুইন এরপর মগধে পন্ডিত রবিশঙ্কর আর শ্রীলঙ্কায়
পিথাগোরাসের ছেলে বররুচির কাছে দীক্ষা নিয়েছে। রবিশঙ্কর পড়াতেন ইকনোমিক্স, রেফার
করতেন বাৎস্যায়নের বইটা। তক্ষশীলার রাজপ্রাসাদে এই অর্থশাস্ত্র নিয়ে শ্রীচৈতন্য
মহাপ্রভুর সঙ্গে তর্কও হয়েছে ডারুইনের, সেখানে জাজ ছিলেন মেগাস্থিনিস। ডারুইন যত
বলে, যত মত তত পথ, চৈতন্য তত চেতন ভগতের ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আত্মত্যাগের উদাহরণ
দেয়। সুর করে গেয়ে ওঠে – "ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা তুমি কি বেসেছো ভালো / আজি এ প্রভাতে দু-বাহু বাড়ায়ে আলো আমার আলো"। ডিবেটে সুবিধে করতে না পেরে ডারুইন
জাফনায় বররুচির টোলে গিয়ে লসাগু-গসাগুটা শিখে নিয়েছে ভালো করে। সেই থেকে সে হাতে একটা লগ টেবিল নিয়ে ঘোরে,
আর মেয়েদের দেখলেই প্রেম নিবেদন করে। শকুন্তলাকেও করেছে। ব্যাটা জানে না, বাংলার
বীর বিজয় সিংহকে শকুন্তলা ফিরিয়ে দিয়েছিল বলেই তো ক্ষেপে গিয়ে সাতশো ইয়ারবন্ধু
নিয়ে ভেলায় চেপে সে হেলায় লঙ্কা জয় করে ফেলল। এমনকি বেণীমাধব শীলেরও চোখ ছিল
শকুন্তলার ওপর। তাকে নিয়ে তো মেয়েদের সে কী আদিখ্যেতা, সবাই বলে, বেণীমাধব,
বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাব। সে তুলনায় ডারুইন তো চুনোপুঁটি। তবু দ্যাখো, পেছন ছাড়ে না,
এদিক পানেই আসছে।
অসহ্য! শকুন্তলা বিড়িবাঁধা ফেলে রেখে সখী জয়ললিতার খোঁজে
আশ্রমের পর্ণকুটিরে ঢুকে গেল।
বৈদূর্যমণি
রাম তো সীতাকে নিয়ে
পুষ্পকরথে চড়ে ড্যাং ড্যাং করে লঙ্কা ছেড়ে অযোধ্যা চলে গেল, সঙ্গে গেল ভক্ত
হনুমান। এখন লঙ্কার কী হবে? বিভীষণ রাজা হয়েছে বটে, কিন্তু তার তো রাজ্য চালাতে
লোকজন চাই, মন্ত্রী-পাত্র-মিত্র-অমাত্য চাই। এতদিন দাদার সঙ্গে যুদ্ধ করছিল, এখন
কী করবে? দিন বদলে গেছে, সে মদনও নেই, সে মুকুলও নেই।
উপায় খুঁজে না পেয়ে বিভীষণ সারা দেশে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দিল,
সোনার লঙ্কায় উন্নয়নের জোয়ার এসেছে। এসো দেখবে এসো, চাইনিস ফ্রেন্ডস, জাপানিস
ফ্রেন্ডস। প্যামফ্লেট
ছাপিয়ে বিলি করতে লাগল লঙ্কার ব্রিগেড প্যারেডে। রাজপ্রাসাদের ছাদের কার্ণিশটা
হনুমানের লঙ্কাকান্ডের সময় আগুনে বেশ খানিকটা ঝলসে গেছিল, ওখানে পিচের চট দিয়ে
ঢেকে সেখানে মস্ত বড় একটা ফ্লেক্সের ব্যানার টাঙালো, তাতে বড় বড় করে লেখা – কথাঞ্জলতরলকলকলগীতিকা।
নিচে অভ্র কীবোর্ডের বৃন্দা চারশো বিরানব্বই
ফন্টে লেখা দুর্দান্ত গানের লিরিক –
কোথায় গেল খটকা?
আমাদের সোনার লঙ্কা।
পরিবর্তনের নাম মনুষ্যত্ব।
চৌত্রিশ বচ্ছর আমসত্ত্ব।
আমি হবো টুনটুনি
পেঁয়াজি ফুলুরি বেগুনী।
মাটি মানে কাঠা
ফোটাও এখান থেকে টাটা।
মা, আমার মা –
সা রে গা মা পা ধা।
সবাই করছে হুলুস্থুল
লঙ্কায় ফুটবে ফুল।
এই গানের লিরিকে সুর দেওয়ার জন্যে ইন্ডিয়া থেকে এ আর
রহমানকে ডেকে পাঠানো হলো। রহমান ‘মা,
আমার মা-’ বলে মাতৃবিয়োগান্তক সেই যে মড়াকান্নার টান ধরলো, ধরেই রইলো, পঙ্কজের উদাসের মতো চটাপট
চটাপট হাততালি সত্ত্বেও থামলো না। ফলে দেশে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হলো। যক্ষ রাক্ষসেরা এসে সারা দেশ দখল করে
নিল।
এর আগে রাবণ যখন সীতাকে হরণ করে লঙ্কায় নিয়ে যায়, সীতা তখন
এক এক করে গায়ের গয়নাগাঁটি খুলে খুলে ফেলে দিয়েছিল লঙ্কা যাওয়ার রাস্তায়। বাল্মীকি
সে খবর পেয়েই উইঢিবির পাশে বসে রামায়ণ লিখে সারা বিশ্বকে টেলিকাস্ট করে জানিয়ে
দিল। মাল্টি-বাহান্ন এপিসোডের সেই মেগাসিরিয়াল দেখে লক্ষ্মণ, জটায়ু, সুগ্রীব আর
তার চ্যালারা ফেলে দেওয়া গয়নার কিছু কিছু উদ্ধার করে রামকে ওয়াপস করেছিল। সেগুলো
একটা পোঁটলা পাকিয়ে হনুমানকে দিয়েছিল রাম। বলেছিল, এই হচ্ছে তোমার পাসওয়ার্ড, সীতা
তোমাকে সন্দেহ করলে এইগুলো দেখিও। হনুমান অশোকবনে সীতাকে সেগুলো দেখাতেই সীতা চিনে
গেল হনুমানকে। হনুর হাত থেকে গয়নাগাঁটি নিয়ে কোমরে হাতে গলায় দিয়ে দেখল বেশ ফিট
হচ্ছে। মানে অশোকবনে সীতা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে করিনা কাপুর হয়ে যায়নি। তারপর চেড়িদের একজন সেদিকে আসতেই
আবার গা থেকে খুলে পোঁটলায় ভরে ফেললো।
কিন্তু সে গয়না তো আর পি সি চন্দ্র জুয়েলার্সের হালকাপুলকা
মাল না, কয়েক কেজি ওজন। হারের লকেটটা তো খাঁটি হীরের, আফ্রিকার হীরের খনি থেকে
পাওয়া একটা ক্রিকেটের বলের সাইজের, তারপর নাসিকের বাংলাদেশী শিল্পীরা কাটিং করে
তাতে হাজার সূর্যের চাকচিক্য এনেছে। এর নাম বৈদূর্যমণি, এর কাছে কোথায় লাগে ইয়ের
জন্যে ইউজ-করা কোহিনূর!
তো সেই বৈদূর্যমণি ক্যাঁতাস্টিচের শাড়ির আড়ালে বেশিদিন
লুকিয়ে রাখা গেল না। চেড়িদের
চোখে পড়তেই খপাত করে কেড়ে নিলো তারা, এ হাত ও হাত হয়ে তা চলে গেল মন্দোদরীর কাছে।
মন্দোদরী দু'দিন আরামসে পরে প্রাসাদের ছাদে ‘এক হাসিনা থী, এক দিবানা থা’ গানের সঙ্গে
কোরিওগ্রাফি করে নিলো। কিন্তু রামের হাতে রাবণ বধ হতেই বিধবা মন্দোদরী হাহাকার করে
হাতের শাঁখা-পলা ভেঙে সেই লকেট ছুঁড়ে ফেলে দিল রাজপ্রাসাদের জানালা দিয়ে নিচে। নিচে
লতাগুল্মের ঝোপঝাড়। কোথায় যে পড়লো, কেউ সেটা কুড়িয়ে পেল কিনা, সে খবর বাল্মীকিও
জানে না।
বিজয়সিংহ
হেলায় লঙ্কা জয় করেছিল বঙ্গের সিংহপুরের রাজা সিংহবাহু আর
রাণী সিংহশিবালীর ছেলে বিজয়সিংহ। ভূরিশ্রেষ্ঠ বংশের এই রাজাগজাদের নামের মধ্যে
সিংহের ছড়াছড়ি, কেননা সিংহের ঔরসে মানুষীর গর্ভে জন্মেছিল সিংহবাহু। বাংলার রাজার
সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল কলিঙ্গের রাজকুমারী সুপ্পাদেবীর। সুপ্পাদেবী এতই রূপসী ও
নিম্ফোম্যানিয়াক যে কোনো পুরুষমানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না সেই রূপসুধা পান করার।
তার ইচ্ছেয় গির অরণ্য থেকে ধরে আনা হলো এক
সিংহকে, রাণীর ইচ্ছে পশুশ্রেষ্ঠর সঙ্গে মিলিত হবার। সেই মিলনের ফল হচ্ছে সিংহবাহু আর
সিংহশিবালীর জন্ম। শুধু বাহুতে না, সর্বাঙ্গে সিংহবাহুর সিংহের তেজ। নিজের বোন
সিংহশিবালীকে বিয়ে করে ফেলল, জন্মালো টুইন, যার বড়টিই বিজয়সিংহ।
অমন ত্যাঁদড় বাচ্চা আর দু'টি হয় না। ছোটবেলা থেকেই
ইয়ারবন্ধু জুটিয়ে নেশাভাঙ করে বিজয়সিংহ
সকলের ত্রাস হয়ে উঠলো। স্বভাবে একেবারে সঞ্জয় গান্ধী। তার অত্যাচারে দেশে কুমারীর
আকাল হওয়ার উপক্রম। বোম্বে ডাইং-এর টাওয়েল পরে থাকলেও নিস্তার নেই। বাবা ছেলের
জন্যে বেশ কয়েকটা বৌমা জোগাড় করে দিয়েছে, প্রত্যেকের অনেকগুলো করে বাচ্চাও হয়েছে,
কিন্তু বিজয়সিংহ চেঙ্গিস খানের বিশ্বরেকর্ড না ভেঙে ছাড়বে না। নগরের মধ্যে তো
বটেই, দূরে গ্রামে এমনকি তপোবনে আশ্রমবালিকাদেরও রেহাই দেয় না। শকুন্তলাকেও নজর
দিয়েছিল, কিন্তু সে কণ্বমুনির পালিতা কন্যা, তার তেজই আলাদা। হাতের বিড়িপাতা কাটার
কাঁচি দেখিয়ে বলেছিল, কাছে আয়, সূর্পনখা বানিয়ে দেব। বিজয়সিংহ তখন তাকে ছেড়ে পাশের
আশ্রম থেকে দুটো টীনেজারকে তুলে নিয়ে যায়। তিতি বিরক্ত জনগণ শেষে বুড়ো রাজার কাছে দরবার করল। রাজার বয়স হয়েছে, কিন্তু হাজার হোক
সিংহের বাচ্চা, প্রজাদের গজর গজর সহ্য করতে না পেরে দূর করে দিলো বিজয়সিংহকে,
বৌ-বাচ্চা-ইয়ার-বন্ধু সমেত। সাকুল্যে তারা সাতশো জন।
বেহুলার মতো ভেলা নিয়ে ভেসে পড়ল বিজয়সিংহ। কতদিন কতরাত
হিসাব নেই, ভাসতে ভাসতে কলম্বাসের মতো
যেখানে গিয়ে ঠেকলো, সেই জায়গার নাম তাম্বপন্নি। তার মাটি তামার রঙের মতো লাল। সমুদ্রের মধ্যে
থেকে অবশ্য তামার মতো মনে হয় না, মনে হয়
সোনার মতো উজ্বল, তাই বাইরের লোক একে বলে স্বর্ণদ্বীপ। ইংরেজ বণিকরা সেই রঙে মজে সোনা লুঠতে এসে
গিয়েছিল এখানেও, ভাগ্যের জোরে এমন সুন্দর নারকেল-ছাওয়া জায়গায় পৌঁছে গেল বলে কপাল জোরে
পেয়ে যাওয়াকে তারা তাদের ভাষায় বলতে গেল স্বর্ণদ্বীপ, ইংরেজ মোটা জিভে আড়ষ্ট হয়ে
তা হয়ে গেল সেরেন্ডিপিটি।
যেদিন এসে হাজির হলো তারা, সেদিনই ভগবান বুদ্ধদেব দেহ
রেখেছেন। যাওয়ার আগে কাউকে বর দেওয়ার
ইচ্ছে হয়েছিল বোধহয়, বিজয়সিংহকেই দিয়ে গেছেন, তাকে রাক্ষস রাক্ষসীরা মারতে পারবে
না। তাম্বপন্নিতে সেই সাতশো লোকের ট্রুপটার অভ্যর্থনা করলো এক নেড়িকুত্তা।
বিজয়সিংহের শাগরেদরা বলল, কুত্তা আছে মানেই মানুষের বাস আছে, চল এর পিছে পিছে যাই।
ধম্মোপুত্তুর যুধিষ্ঠির কুত্তা ফলো করে স্বগগে গেছিল, এরা সেই নেড়ির পেছন পেছন এসে
হাজির হলো এক যক্ষিণী নারীর কাছে, তার নাম
কুভেনি। কুভেনি তো দেখামাত্র ছশো নিরানব্বই জনকে হিপনোটাইজ করে ভেড়া বানিয়ে ফেলল,
কিন্তু বিজয়সিংহ বুদ্ধের বর পেয়ে সলিড। কুভেনিকে বলল, আমার লোকগুলোকে শিগগির রিলীজ
করো, নইলে তোমার একদিন কী আমার একদিন! কুভেনি বাধ্য হয়ে তাদের ছেড়ে দিল,
অন্ন-বস্ত্র-আবাস দিল, আবার ‘ম্যায় ষোলা
বরস কী, তু সত্রা বরস কা’ স্টাইলে নেচেকুঁদে বিজয়সিংহকে সিডিউস করে ফেলল। এত কিছু
না করলেও চলত, বিজয়সিংহ তো এটাই চাইছিল।
কুভেনি বিজয়সিংহকে সেই রাজ্যের রাজা বানিয়ে দিল। পাছে তার
যক্ষরা রেগে গিয়ে ঝামেলা পাকায়, তাই তাদের সবাইকে কচাকচ কেটে বে অফ বেঙ্গলে ছুঁড়ে
ফেলে দিল। কুভেনির গর্ভে বিজয়সিংহের এক
ছেলে এক মেয়ে জন্মালো। তৈরি হলো শ্রীলঙ্কার ইতিহাস। পরে অবশ্য এই কাহিনীর পরিণতি
খুব করুণ। বিজয়সিংহের এক সময় হঠাৎ খেয়াল হলো, আরে, এই কুভেনি তো যক্ষকন্যা, রাবণের
বংশধর, জাতে রাক্ষস! এর চেয়ে বড়ঘরের কোনো
রূপসী মেয়েকে বিয়ে করলে জাতে ওঠা যেত। ব্যাস,
কুভেনিকে ধরে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে দিল সে। মাদুরাইয়ের পান্ড্যরাজা তার মেয়ের সাথে
বিজয়সিংহের বিয়ে দিল। প্লাস তার রাজ্য থেকে আরো প্রচুর ইয়াং মেয়েদের পাঠালো বিজয়ের
চ্যালাদের বৌ হিসাবে। তাদের অরিজিন্যাল বৌদের হতভাগারা ততদিনে মালদ্বীপে খেদিয়ে
দিয়েছে।
ভাবছ, গুল মারছি? আরে বাবা, এইসব আছে শ্রীলঙ্কার মহাবংশে।
গুগুল ঘেঁটে দেখো না! সে যাই হোক, লঙ্কায় বিজয়সিংহ আর তার চ্যালারা সাউথ ইন্ডিয়ান
বৌ নিয়ে জাঁকিয়ে বসে রাজত্ব করতে লাগলো। লঙ্কার প্রাসাদ ট্রাসাদ সব তাদের।
বিজয়সিংহ যদিও আর বঙ্গদেশে ফেরেনি, কিন্তু ওর দোস্তদের যে কেউ আর সিংহপুরে ফেরেনি,
তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
ছোটবড় নৌকা বা ট্রলার নিয়ে মাছ ধরতে বেরোয় সাউথ ইন্ডিয়ান
জেলেরা রামেশ্বরম থেকে। তারা রাস্তা হারিয়ে মাঝে সাঝে জাফনাতেও নোঙর ফেলে। বররুচি
তাদের ধরে ধরে লসাগু-গসাগুর মাধ্যমে মাছের দাম, লাভক্ষতি, সুদকষা এইসব শেখান।
একদিন সমুদ্রের ধারে বালিতে কেশব নাগের এক্সট্রা জ্যামিতির
থিওরেম সল্ভ করছিলেন বররুচি, হঠাৎ দেখলেন একটা জেলেনৌকা উপকূল ছেড়ে যাচ্ছে। তাতে
কয়েকটা সাউথ ইন্ডিয়ান জেলেদের মধ্যে একজন যেন রাজপুরুষ। তার পোশাক অন্যরকম। মখমলি
জোব্বার দুই পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে সে এমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, দেখেই সম্ভ্রম জাগে।
মাথায় শিরস্ত্রাণ, তাতে সিংহ আঁকা।
নৌকাটা ছেড়ে যাবার অনেকক্ষণ পরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে
বররুচির খেয়াল হলো, ওরা তো ঠিক রামেশ্বরমের দিকে গেল না। পথ ভুল করলো নাকি?
জয়ললিতা
ই এন টি রামারাও যখন চুটিয়ে রাজনীতি করছে, সিনেমা করছে আর
প্রেম করছে, তখন মান্না দের বিখ্যাত গান – 'ললিতা গো, ওকে আজ চলে যেতে বল না'
রিলীজ হয়। সাউথ ইন্ডিয়ানরা এমনিতেই
ধর্মভীরু, এই গান শুনে মজে গিয়ে রামারাও প্রেম করার সময় ঘনিষ্ট মুহূর্তে জয় ললিতা
বলে ফেললেন। ব্যাস, প্রেমিকার নাম ছিল কী একটা সাউথি খটোমটো, হয়ে গেল জয়ললিতা।
রামারাও তাকে পঞ্চাশটা শাড়ি, ম্যাচিং ব্লাউজ আর চিরকুমারী উপাধি দিলেন।
জয়ললিতার ছোটবেলা থেকেই মন্দিরে গিয়ে জুতো ঝাড়ার অভ্যাস।
খালি পায়ে নয় হাওয়াই চটি পরে মন্দিরে যায় আর অন্যের চামড়ার ভালো নতুন চটি পরে বাড়ি
ফেরে। অষ্টাদশী হবার আগেই ওর জুতোর সংখ্যা
দশ হাজার পেরিয়ে গেল। ইচ্ছা করলে বাটা কোম্পানীর মতো একটা কোম্পানী খুলে ফেলতে
পারত, কিন্তু ভেবে দেখলো, রিস্কি। বাটা
কোম্পানীর জুতোর তেমন বিক্রি নেই বলে ওরা এখন নান আর চিকেন বিক্রি করছে বাটার নান
আর বাটার চিকেন নামে। জয়ললিতা নিরামিষ খায়,
চিকেনে ইন্টারেস্ট নেই। বরং সিল্কের শাড়ি পছন্দের। স্ট্যাম্প জমানোর মতো শাড়িও জমাতে লাগলো সে। মাইসোর সিল্ক, কাঞ্জিভরম
এইসব বিভিন্ন শাড়ির সংখ্যা যখন জুতোকে ছাড়িয়ে গেল, তখন ভাবলো পলিটিক্স করা যাক।
রাজনীতি মানেই তো হয় মানুষকে শাড়ির ঘেরের আড়ালে রাখা, নয় জুতোর তলায়, তার কাছে
দুটোই আছে পোচুর পরিমাণে।
তবে সাউথ ইন্ডিয়ায় পলিটিক্স মানে ভগবান সেজে থাকা। লোকজন
দেখা করতে এলে আশীর্বাদ করতে হয়, মাঝে মাঝে কেউ পায়ে মাথা ঠেকালে লাথিও মারতে হয় মাথায়। যে পুজোর যা মন্তর। শ্রীলঙ্কায় অনেক সাউথ
ইন্ডিয়ান গেছে। বিজয়সিংহ আর তার চ্যালাদের বৌ যেমন সাপ্লাই গেছে মাদুরাই থেকে,
মুরলীথরণ অফস্পিন করে ভাঁটার মতো চোখ ঘুরিয়ে বৌ নিয়ে গেছে চেন্নাই থেকে। ডিম্যান্ড
সাপ্লাই ইকুয়েশন জয়ললিতা খারাপ বোঝে
না।
জহরলাল যখন মেয়ে ইন্দিরাকে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে
পাঠালেন, আর সেই খবর ফলাও করে ছাপা হলো সাউথে দ্য হিন্দু পত্রিকায়, জয়ললিতার বাবাও
মেয়েকে লেখাপড়া শেখানোর জন্যে একটা আশ্রম
খুঁজতে লাগলেন। শান্তিনিকেতন তখনো নতুন, বিশেষ নাম টাম হয়নি, সিনিয়ার দাদারা র্যাগিং-এর
নামে মেয়েদের অ্যাবিউজ করা শুরু করেনি, বলতে গেলে বিশেষ কেউ চেনেই না। একটা অপশন
ছিল দুন স্কুল, কিন্তু ওখানে খরচ বেশি। তাই খুঁজে পেতে মেয়েকে পাঠালেন কণ্বমুনির
আশ্রমে। সেখানে ছেলেদের ভর্তি হতে গেলে জয়েন্টে ভালো স্কোর করতে হয়, কিন্তু
মেয়েদের বেলায় ছাড়। তাই ওখানে তখন
শকুন্তলা, অনসূয়া, প্রিয়ংবদা, শর্মিষ্ঠা, দেবযানী, অহল্যা, ঊর্মিলা, শ্রুতকীর্তি,
গৌতমী – কত মেয়ের ভিড়! তাদের মধ্যে জয়ললিতা ঢুকে গিয়ে শশিকলার মতো বাড়তে লাগলো। পরে কচকে
বিয়ে করে দেবযানী পালিয়ে গেল। অহল্যা পাথর
হয়ে গেল। গৌতমীরও বিয়ে হয়ে বাচ্চা হয়ে গেল, তার নাম গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী।
শকুন্তলাও ঠিক আইবুড়ো নেই, এক রাজা এসে অঙ্গুরীয় দিয়ে কীসব করে টরে গেছে। তবে
জয়ললিতা সেসব ইস্যুতে যায়নি। সহজপাঠ আর সতেরোর ঘরের নামতা মুখস্থ হয়ে যেতেই
রামারাওয়ের সঙ্গে লটকে গেছে।
বছরে একবার করে অবশ্য আশ্রমে যাওয়া চাইই চাই। শকুন্তলার
সাথে হোয়াটস্যাপে খুব ছবি শেয়ার হয়। এই তো, গতবার সে যে আশ্রমে এসেছিল একটা মাছধরা
ট্রলারে করে, তাতে ঝলমলে ড্রেস পরা লোকটা তাকে সাইজ করার কত চেষ্টা করলেও সে
পাত্তা দেয়নি। লোকটার একটা ছবি কিন্তু সে মোবাইলে তুলে নিয়েছিল তার অজান্তেই,
পাঠিয়ে দিয়েছে শকুন্তলাকে। এই তো অ্যান্ড্রয়েড ফোনের গ্যালারিতে এখনও সেভ করা আছে।
পরনে জোব্বা, মাথায় সিঙ্গি-আঁকা পাগড়ি, বাঁহাত কোমরে, ডানহাত জোব্বার পকেটে। দেখলেই মনে হয় হিন্দী
সিনেমার অশোককুমার।
দেখাবে ছবিটা আবার শকুন্তলাকে? না থাক। বেচারি একমনে বিড়ি
বেঁধে যাচ্ছে। কাজে বাধা দিয়ে লাভ নেই।
ডারুইন
পুরনো পুঁথি জোগাড় করে চোখ বোলানো ডারুইনের শখ। ছোটবেলাতেই
সে চর্যাপদ, ত্রিপিটক, মহাবংশ, কৃত্তিবাসী রামায়ণ সব পড়েছে। তার জিভে একটু সমস্যা
আছে, উচ্চারণ ঠিকঠাক হয় না, তাতে তো আর জ্ঞান আটকে যায় না। বররুচির কাছে যখন
ট্রেনিং নিতে গেছিল, তখন লোকাল ভাষায় রামায়ণের কয়েক পাতার চটিবই পেয়েছিল একটা।
অনেক দিন পর পড়ার চেষ্টা করতে গিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ।
পরিষ্কার লেখা তাতে –
অশোকবনে আসি হনু নাচানাচি করে।
শরীর সূক্ষ্ম কেহ চিনিতে না পারে।।
সীতার নিকটে আসি হনু আচম্বিতে।
বলে, দ্যাখো গয়নাগাঁটি তোমারই মা সীতে।।
দেখাইলো হনুমান না করিয়া ছল।
হীরের লকেট যেন কোকাবুরা বল।।
দু'দিন লুকায়ে সীতা সায়ার আড়ালে।
অকস্মাৎ ধরা পড়ে চেড়িদের জালে।।
এ চেড়ি ও চেড়ি হয়ে হীরা অবশেষে।
ঠাঁই নিলো রাণীমার জমকালো ড্রেসে।।
সেই বৈদূর্যমণি পেয়ে মন্দোদরী।
ভাবে, আমি এটা দিয়ে কত কী যে করি।।
লকেট গলায় দিয়ে মন্দোদরী নাচে।
রাক্ষস উঁকি মারে আনাচে কানাচে।।
হায় তার ভাগ্য মন্দ হইলা বিধবা।
ভাবে, মণি দিয়ে গলে কার সাথে শোবা।।
শাঁখাপলা ভেঙে ফেলে মণি ফেলে ছুঁড়ে।
কোথা সে হাপিস হলো কোন আস্তাকুঁড়ে।।
এরপর আর কিছু লেখা নেই। ডারুইন অনেক ভেবেছে, কোথায় যেতে
পারে এই কোকাবুরা বলের সাইজের বৈদূর্যমণি? শ্রীলঙ্কায় থাকলে তার খোঁজ কেউ পাবে না,
তা কী করে সম্ভব? অথচ রাজারাজড়া কারো কাছে নেই। বররুচি অঙ্ক কষে বলেছেন, সেই মণি
সর্বসমক্ষে খোলা রাখলে সূর্যের আলোয় তা এমন জ্বলজ্বল করে জ্বলবে, তা থেকে চোখ
ফেরানো যাবে না। অথচ তার খবর কেউ জানে না!
শ্রীলঙ্কার ইতিহাস আদ্যোপান্ত মুখস্ত ডারুইনের। রাজা
সিংহবাহুর বিশাল প্রতিকৃতি দেখেছে রাজপ্রাসাদে। নিশ্চয় বিজয়সিংহ অর্ডার দিয়ে
বানিয়েছিলেন। রাজবংশের মানুষের সঙ্গে এদেশের স্থানীয় মানুষের তফাৎ সে সহজেই বুঝতে
পারে।
নালন্দা, তক্ষশীলার লাইব্রেরি তোলপাড় করে খুঁজেছে যদি সেই
বৈদূর্যমণির খবর কিছু পাওয়া যায়। যাবতীয় লাইব্রেরিতে এখন আলমারি বোঝাই হয়ে
কথাঞ্জলি আর শ্রেষ্ঠ কবিতা, হাম্বা হাম্বা বুম্বা। কাজের মাল কিস্যু নেই।
কিছুদিন আগে ডারুইন আবার বররুচিকে ফোন করেছিল, গুরুদেব, সেই
মণিটির ব্যাপারে কোনো খবর কি পেলেন? উচ্চারণের সমস্যায় খবর শোনালো যেন কভোর।
বররুচি বললেন, কীসের কবর? মণির? ডারুইন শশব্যস্ত হয়ে বলল, না না গুরুদেব, সেই
বৈদূর্যমণির কোনো সন্দেশ –
বররুচি বললেন, না হে। তবে আমার কেমন যেন সন্দেহ গত বছর কোনো
এক রাজপুরুষ এখান থেকে মূল্যবান কিছু একটা
নিয়ে ইন্ডিয়ার দিকে পালিয়ে গেছে। জেলেদের এক ট্রলারে আমি এক রাজপুরুষকে দেখেছিলাম,
তার আচরণ কেমন যেন সন্দেহজনক। সে
রামেশ্বরমের দিকে না গিয়ে চলে গেল উত্তর-পূর্বে। ওদিকে গেলে অবশ্য জয়ললিতার চোখ
এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। তুমি বরং তার কাছে খোঁজ নাও, এমন কাউকে যদি সে দেখে থাকে –
জয়ললিতা চেন্নাইয়ে নেই, গেছে কণ্বমুনির আশ্রমে। কণ্বমুনির
আশ্রম ডারুইন ভালোই চেনে। জয়েন্টে আর একটু ভালো স্কোর করতে পারলে সে এই আশ্রমেই
পড়াশোনা করতে পারত, আর পটাতে পারতো শকুন্তলাকে। অল্প কিছু মার্ক্সের জন্যে সেই
সুযোগ হাতছাড়া হয়ে বেচারি ভর্তি হলো
নিকটবর্তী আর্যভট্টর টোলে। কয়েকবার কণ্বাশ্রমে ঢুঁ মেরে গেছে অবিশ্যি, মেয়েদের সংখ্যা তো এখানেই
বেশি।
কণ্বমুনির আশ্রমে প্রবেশ করেই ডারুইন দেখল, শকুন্তলা তাকে
দেখে উঠে চলে গেল। বেচারী! ভেবেছে বুঝি তার কাছেই আসছে। কুটীরের কাছে এসে গুরুদেব,
গুরুদেব ডাক দিতেই বেরিয়ে এলো জয়ললিতা। মেঘ না চাইতেই জল!
জয়ললিতা ডারুইনকে অপছন্দ করে না। লোকটা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে
টুরে বেড়ায়, প্লাস জুতোর চয়েস ভালো। ছেলেদের জুতোর চয়েস ভা্লো মানেই শৌখিন। রবীন্দ্রনাথ কি সত্যজিত রায় কখনো হাওয়াই চটি ফটফট করে
বেড়াতেন? ডারুইনের প্রশ্নের জবাবে সে বলল, অফ কোর্স জানি। আমি ছিলাম তো সেই ট্রলারে।
দেখুন তো এই লোকটা?
কোন লোক, তা কী করে জানবে ডারুইন? কিন্তু জয়ললিতার মোবাইলে
তার ছবি দেখেই বুঝে গেল এই নিশ্চয় সেই রাজপুরুষ, যার কথা বররুচি বলেছিলেন। নিশ্চিত
হতে তক্ষুণি হোয়াটস্যাপে ছবি পাঠাতেই ওপার থেকে বররুচি বললেন, হ্যাঁ, এই সেই।
বররুচি জয়ললিতাকে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু লোকটা গেল কোথায়?
জয়ললিতা বলল, তা তো আমি জিজ্ঞেস করিনি। তবে চলে গেল আরও
নর্থ-ইস্টে, কোস্টলাইন ধরে। নিজেদের মধ্যে যখন কথা বলাবলি করছিল, তখন সিংহপুর বলে
একটা জায়গার নাম বলছিল।
ইয়েস, সিংহপুরই তো রাজা
সিংহবাহুর রাজধানী। সেখানেই তো যাবে যদি বিজয়সিংহের লোক হয়। সেটাই তো ওদের স্বদেশ।
কিন্তু সিংহপুরটা কোথায়? ডারুইন শুধু জানে ওটা বঙ্গদেশে। কিন্তু বঙ্গদেশ তো আর
একটুখানি জায়গা নয়, বিশাল। কোথায় গিয়ে খুঁজবে? জয়ললিতা জানে না, শকুন্তলা কি
জানবে?
শকুন্তলাও জানে না, তবে সে জোর দিয়ে বলল, বাপি জানবে। বাপি
গুজরাট গেছে কী একটা মিটিঙে। ওখান থেকে ফিরবে রাতের ট্রেনে। বাপিকে জিজ্ঞেস করে
দেখতে পারো।
রাতে কণ্বমুনিকে ঘিরে ওদের জটলা। মহর্ষি কণ্ব বললেন, তুমি
সিংহপুর কোথায় জানো না? যাও ভালো করে আনন্দবাজার পড়। পড়তে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়, এই
যেমন তুমি পিছিয়ে পড়েছ। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, বর্তমান পড়লেও হবে, তারা তো ভগবান
ছাড়া কাউকেই ভয় পায় না। সিংহপুর এক অতি বিখ্যাত জায়গা। যদিও কালের নিয়মে তার নাম
এখন পালটে গেছে, সেই নামে এখন তাকে সারা জগত চেনে। ইতিহাসপ্রসিদ্ধ সে এখন।
কী বলুন তো? কলকাতা? মুর্শিদাবাদ? গৌড়? সপ্তগ্রাম?
তাম্রলিপ্ত? ডারুইনের প্রশ্ন।
কণ্বমুনি বললেন, না। সিংহপুরের বর্তমান নাম হচ্ছে সিঙ্গুর।
এখানেই রাজত্ব ছিল মহাপরাক্রমশালী রাজা সিংহবাহুর, যার পুত্র বিজয়সিংহ শ্রীলঙ্কার
রাজবংশ পত্তন করেন। টলেমির ম্যাপে এই সিঙ্গুরই রাঢ়, সংস্কৃতে লাটদেশ, আল বিরুণীর
বইতে লার্দেশ। কিন্তু কেসটা কী? তুমি হঠাৎ সিংহপুর নিয়ে মেতে উঠলে কেন?
ডারুইন সিংহলী রামায়ণের ছেঁড়া পাতা থেকে আনুপূর্বিক বলে
গেল। সীতার হারানো বৈদূর্যমণির সন্ধান করছে সে। খুঁজে পেলে আর সুইশ ব্যাঙ্ক
অ্যাকাউন্ট নিয়ে সরকারকে মাথা ঘামাতে হবে না। ওই মণির যা ভ্যালু, পাঁচটা
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হয়ে যাবে ওর টাকায়।
কণ্বমুনি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সকালটা তাঁর গুজরাটের
আনন্দে টাটা ন্যানো ফ্যাক্টরিতে রতন টাটার
সঙ্গে মিটিঙে কেটে গেছে। রতন তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় উটপাখির ডিমের সাইজের একটা বড়সড় খুব চকচকে পাথর
হাতে নাচাচ্ছিলেন। পেপারওয়েট হিসাবে রাখা ছিল তাঁর টেবিলে। নিজে থেকেই বলেছিলেন,
জানেন মহর্ষি, সিঙ্গুরের ফ্যাক্টরির
বিল্ডিংটা তো বানানোই হয়ে গেছিল, আমার অফিসও রেডি ছিল। তারপর একদিন কী হলো কে
জানে, নির্ঘাৎ রাজনৈতিক মদতে লোক খ্যাপানো, গিয়ে দেখি সব ভাংচুর। পাঁচিল ভেঙে দিয়েছে, ফ্যাক্টরির
চালে ঢিল মেরেছে। আমার অফিসের কাচের জানালা ভেঙেছে এই এইটে দিয়ে। বলে সেই পাথরটা নাচাতে
লাগলেন। আমি এসে দেখি, কাচের জানালা ছত্রাকার, আর এই পাথরটা মেঝেতে পড়ে আছে। বেশ
সুন্দর চকচকে পাথর। সুন্দর পেপারওয়েট হবে বলে সঙ্গে নিয়ে এসেছি। সিঙ্গুরের একমাত্র
স্মৃতি। বাকিটুকু মুছে ফেলতে চাই।
থাক, ওখানেই থাক। মনে
মনে বললেন মহর্ষি কণ্ব। ডারুইনকে বললেন, তুমি যে কোনো ট্রেন ধরে হাওড়া চলে যাও।
বর্ধমান কর্ড লাইনে কামারকুন্ডু স্টেশনে নেমে যাকে বলবে, সিঙ্গুর দেখিয়ে
দেবে।
বেশ মজাদার
উত্তরমুছুনএই লেখাটাকে কী বলব ? Absurd Writing বলা যাবে ? প্রশংসাসূচক অর্থে ? পড়তে পড়তে,চরিত্রগুলোকে নিয়ে টাইম মেসিনের একটা গ্রাফ তৈরির চেষ্টা করছিলাম, ঘেঁটে পুরো ঘ হয়ে ঘায়েল হয়ে পড়ে আছি ।
উত্তরমুছুন