কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪

১৪) সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়


দিয়েত্রিচ

(দুই)

লন্ডন যেন এক ধূসর কুয়াশার মোহময়ী
যে নিজের অলঙ্কারের পিছনে
হৃদয়ের প্রহেলিকা খোলসা করতে চায় না
আর সেজন্য তার আকর্ষণ বাড়তে থাকে
লন্ডন ব্রিজের ওপর একাকী দাঁড়িয়ে থাকা
সোনালি চুলের নিচে নীল চোখ দুটোতে
যে যার তো বয়ে চলে আপন খেয়ালে
কেউ কাউকে চেনে না, চিনতেও চায় না;
নিজের উদার গোঁফ আর ছুঁচালো সোনালি দাড়িতে
হাত বুলিয়ে দিয়েত্রিচ ফেরার কথা ভাবে
কোথায় সে নিজেও জানে না;
যে পুরস্কারের জন্য সে মনোনীত হয়েছিল
তালিকা পরিবর্তনের পর
এক ইংরেজ কবির জিম্মায় চলে গেছে,
এক সস্তা সরাইখানায় ছিল বেশ কিছুদিন
কিন্তু সেখান থেকে
এখন সে পথেঘাটে ঘুরেই দিন পার করে,
এমন নয় যে বাবার টাকার হুন্ডি
শেষ হওয়ার পথে তবুও সময় নিয়ে
ছিনিমিনি খেলে অচেনা মুখের ভিড়ে-
বন্ডস্ট্রীট, শার্লটস্ট্রীট থেকে ছন্নছাড়ার
তো লন্ডন টাওয়ার-বিগবেন-পিকাডিলি হয়ে
আবার নীরব ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে-তে ফিরে আসা,
এইভাবেই একদিন বরো অব রিচমন্ডের সামনে
এক যুবতী এসে হামলে পড়লো দিয়েত্রিচের ওপর,
পরনে পার্পল রঙের স্ট্রাইপ্ড হাইকলারওয়ালা শার্টওয়েস্ট
আর দুচোখে অসীম উন্মাদনা-
দিয়েত্রিচকে লন্ডনে কারোর চেনার কথা নয়,
তার কবিতা-স্কেচ বেশ কিছু
ছোট স্টলে বিক্রি হলেও কে এই যুবতী?
মেরী ওয়াটসন, ঠিকানা ডোভার স্ট্রীট,
পুরস্কার ঘোষণার পর থেকে
সে দিয়েত্রিচের কবিতার কবিকে খুঁজে বেড়াচ্ছে,
শেষমেষ সরাইখানার মালিকের ছেলের সাহায্যে...
দিয়েত্রিচ যারপরনাই অবাক লো
মেরীর নর্তকীসুলভ শরীরে পরিণতির ছাপ
অথচ তার ব্যবহারে শিশুসুলভ স্বতঃস্ফূর্তি
এরকম হওয়ার কথা ছিল না
তবুও মেরী দিয়েত্রিচকে ধরে নিয়ে গেল
তার পৈতৃক ভিটে হার্টফোর্ডশায়ারে,
দিয়েত্রিচের চোখে অসীম সৌন্দর্যের আনাগোনা
মুক্ত পশুচারণভূমিতে সে নিঃশ্বাস নিল প্রাণখুলে
মেরী কবিতা শোনানোর আবদার করল,
দিয়েত্রিচ শুনিয়ে গেল একের পর এক
আর মেরী যেন দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়লো
গভীরভাবে জীবন বাজি রেখে সে তার
হাতের দস্তানা আর স্প্রিং হ্যাট খুলে
নীরবে এগিয়ে এলো আনমনা দিয়েত্রিচের দিকে
দুচোখে চাপা জল চেপে সে তার
তৃষিত ঠোঁট রাখলো দিয়েত্রিচের উদাস ঠোঁটে;
বেদনার শব্দেরা চুরমার হয়ে গেল
পড়ন্ত বিকেলে দুই শরীর একের পর
রাতে কনকনে শীতে ফার্নেসের পাশের
খাটে দিয়েত্রিচ নিঃশ্বাস ঘোরের ধোঁয়ায়
মেরীর শুভ্র শরীরের ওপর,
তার বাঁকানো কোমরের ওপর অনাবৃত রক্তিম বুকে
লেখনী চালিয়ে মিলনের কবিতা লিখলো
মধুর মেরীর মদিরতা মাখিয়ে!
অসহায় কালো রাত শেষে দুজনের
জীবনেই সোনালি সকাল নেমে এলো
নরম পশমের হাত ধরে লন্ডনে ফিরে
টেমসের জীবনভরা বুক পেরিয়ে তারা
চার্চের করতালিতে আবদ্ধ লো বিবাহবন্ধনে,
অনাথ মেরী আলম্বন পেয়েছিল দিয়েত্রিচের
নিখাদ বাহুপাশের উষ্ণ ভরসায়
আর দিয়েত্রিচ মেরীর প্রেমে মানুষ হয়েছিল,
তবে সময়ের সাথেই বাঁধন শিথিল হতে লাগলো,
ভবঘুরে দিয়েত্রিচ ধীরে ধীরে বুঝলো
তার রক্ত থেমে থাকার নয়,
মেরীর থেকে বেশি মেরীর শরীর তাকে টানে
আর মেরীও তার থেকে তার কবিতাকে...
তাই টেনিসনের কবিতা, হার্ডির উপন্যাস,
দিয়েত্রিচের ছড়ানো-ছেটানো কোট-ট্রাউজারের
পাশে ডোভার স্ট্রীটের ছোট্ট কামরায়
যেমন এক ফুটফুটে দেবদূত এলো
তেমনই ঝগড়া গোলমালের আওয়াজে
তার কান্নার জল গালেই শুকিয়ে যেত,
শেষমেষ একদিন তুমুল ঝগড়ার পর
রাতের আঁধারে দিয়েত্রিচ ঘর ছাড়লো
সন্তানের মুখে হাজারো চুম্বন এঁকে,
মেরী বেশ কিছুদিন স্বস্তির শ্বাস নিয়েছিল
থিতিয়ে আসা রাগের ফোঁসফোঁসানির সাথে,
তারপর পাগলের তো লন্ডন জুড়ে খুঁজে
বেড়িয়েছিল দিয়েত্রিচকে অসহায়ভাবে,
নিরুপায় হতাশ হয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল
দিয়েত্রিচের লেখা আধখামচা কবিতায়
আর ডানপিটে শৈশবের দুষ্টুমিতে;
কিছু ইংরেজের সাথে আলাপ জমিয়ে
দিয়েত্রিচ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজের
ডকে কাজ করতে করতেই পরিচয় লুকিয়ে
একদিন পাড়ি দিল সুদূর ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে
যেখানে নিয়তি হয়তো সাজিয়ে রেখেছিল বহু কিছু,
বন্দর থেকে রওনা হওয়ার সময়
জাহাজের ডেকের ওপর দেখা গেল
দুটো শান্ত নীল চোখ আর গভীর নীল জলরাশি...





0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন