আম কিসস্যা
‘Magnifera India’ বললে
অনেকেই বুঝে যাবেন আমের কথা বলছি। আমেরও ইতিহাস আছে। ভারতের জাতীয় ফল এই আমের প্রথম
উল্লেখ পাওয়া যায় উপনিষদে খ্রীস্টপূর্ব ২০০০ সালে। পাণিনি আবার ভারতীয় নগরপালদের ‘আম্রপাল’ বলে
চিহ্নিত করেছিলেন। মহাভারতেও উল্লেখ পাওয়া যায় আমের। প্রথমবার, মহারাজ
বৃহদ্রথের পুত্র জয়দ্রথের ওপর ভালোবাসাকে আমের সুগন্ধের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে আর
একবার, দ্রৌপদী কৃষ্ণের ওপর যে চোরা টান অনুভব করতেন, সেটাও তুলনা করা হয়েছে আমের সাথে। পুরাণে এবং কালিদাসের অভিজ্ঞ্যানম শকুন্তলমে আমগাছকে
পুরুষ কল্পনা করা হয়েছে আর
তার পাতা আর ফল হয়ে উঠেছে নারী। ভারতচন্দ্র তাঁর ‘বিদ্যাসুন্দর’এ দেবরাজ ইন্দ্রের আম
প্রীতির কথা উল্লেখ করেছেন। সোমরস তৈরি করতে আমের রস কাজে লাগত। মুঘল সম্রাট শাহাজাহানের
সময় বিদেশী পরিব্রাজক মানুচ্চির মুখে আলফানসো আমের ভূয়সী প্রশংসা শোনা
গেছে। পরবর্তী কালে আকবর তাঁর আমবাগানে এক লাখ আম গাছ লাগিয়েছিলেন। এখন যেমন
কার্বাইড, ট্রাডিশন কিন্তু অন্য কথা বলে আম পাকানোর পদ্ধতির। প্রতিটি আমকে তুলোয় মুড়ে পাতার বিছানায়
শুইয়ে রাখা হতো অতি যত্নে। এবং সময়ে সময়ে তাদের এপাশ
থেকে ওপাশে ফিরিয়ে দেওয়া হতো। আম কাটার জন্য একমাত্র রুপোর ছুরি
ব্যবহার করা যেত, পরে অবশ্য বাঁশের ছুরিকেও মান্যতা দেওয়া হয়েছিল। আম আর যাই হোক হেলা ফেলার বস্তু যে নয়, এ থেকেই বোঝা যায়।
গরমকালটাকে সহ্য করা যায় কেবল আমের মুখের দিকে তাকিয়ে। বসন্তকাল থেকে যখন আমের
গুটি ধরে গাছে গাছে, সেই তখন থেকে চলে অপেক্ষা। প্রথমে আসে কচি কচি আম, সেই আমের টক-চাটনি-ডাল-আচার খেতে খেতে গরম
সামলাই কিছুটা। এরপর আঁটি শক্ত হয়ে আসে, পাকতে শুরু করে আম। বাজারে চলে আসে
কার্বাইডে পাকানো আম। সে আম না মিষ্টি, না টক! এক বিতিকিচ্ছিরি
অবস্থা তার! না খাওয়া যায়, না ফেলা যায়। এবার অপেক্ষার শুরু কখন আসবে সবুজ-হলদে
গাছপাকা হিমসাগর। যেহেতু হুগলী জেলায় থাকি, তাই হিমসাগরের বাগান দেখেছি নিজের
চোখে। খুব নিচু নিচু গাছেও ফল উপছে
পড়তে দেখা যায়। মাটি থেকেই আম পাড়া যায় তেমন গাছও আছে অনেক। এই আমের দাম নির্ভর করে
তার সাইজের ওপর। একেকটা আম ২৫০ থেকে ৩০০
গ্রামের ওপরও হয়ে থাকে। সেই হলো আসল হিমসাগর। বোঁটা কেটে জলে ভিজিয়ে রেখে খাও, হাত বেয়ে রস
গড়িয়ে নামবে কনুই পর্যন্ত। সোনা-হলুদ রঙের আঁশহীন
এই আমের স্বাদ গন্ধের তুলনা নেই। লোকের মুখে মুখে
আবার এর নাম হয়ে গেছে ‘সাগর’। এখন মুশকিল একটাই, অতিরিক্ত
রসালো নরম এই আম বেশিদিন রাখা যায় না। বাজারে আসার কিছুদিনের মধ্যেই
শেষ হয়ে যায়। জুনের মাঝামাঝি থেকে জুনের শেষ পর্যন্ত এই
আমের থাকাথাকি। তাই বিদেশে রপ্তানীর সুযোগও কম। এমনিতেই বিদেশের মাটিতে
নরম আমের কদর নেই। তাই আলফান্সোর এত কদর, এত দাম। পশ্চিমবঙ্গের মতো এত অঢেল হিমসাগরের
চাষ আর কোনো রাজ্যেই হয় না। বাংলাদেশের রাজশাহীতেও অবশ্য প্রচুর হিমসাগরের চাষ হয়।
হিমসাগরের কোনো বিকল্প নেই, প্রতিদ্বন্দ্বী
নেই, যতই লোকে ল্যাংড়ার নাম নিয়ে গুণ গেয়ে যাক্ না কেন! কোথায় সেই রঙ, কোথায়
সেই স্বাদ, আর কোথায় সেই রসে টইটম্বুর
ভরসা! হ্যাঁ,
এটা অবশ্য মানতে হবে যে, ল্যাংড়ার গন্ধের কাছে
হার মেনেছে হিমসাগর। তবে গন্ধে আর কী যায় আসে! তাহলে
তো ধূপ জ্বেলে রাখলেই হয়, কিম্বা ডিওডোরেন্ট! এই গন্ধের প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ল, একবার বেলগন্ধী আম
খেয়েছিলাম। জানি না, কী সেই আমের প্রজাতির নাম
বা তার ইতিহাস। একটু গোল ধরনের দেখতে, ভেতরটাও
বেশ রসালো, কিন্তু আম মনে করে যেই মুখে দিলাম, মনে হলো পাকা বেল খাচ্ছি। এ যেন মুখোশধারী আম! আম জগতের
কলঙ্ক! এর চেয়ে ল্যাংড়া ঢের ঢের গুণে ভালো। খুব ছোট ছোট ফুলি আমও মন্দ নয়। বোম্বাই আম বা ল্যাংড়ার পরে যারা আসে, যেমন চৌষা বা দশহরি, এরাও বেশ মিষ্টি। তবে খেলে মনে হয়, চিনির ডেলা খেলাম, এক গ্লাস
জল খাই। আর বিশাল সাইজের ফজলির কথা কী আর বলি! মালদার
ফজলি খুবই বিখ্যাত, শুনেছি। তা তিনি যতই বিখ্যাত হোন না কেন, আমি
তাকে একটুও পাত্তা দিই না । আমার মন পড়ে থাকে, নোলা পড়ে থাকে সেই ‘সাগরের’
মুখ চেয়ে। আবার এক বছরের অপেক্ষাই সই!
শোনা যায় ৫০০ থেকে ১০০০ রকম আমের প্রজাতি আছে এই ভারতে। যদিও মাত্র ২০ রকম প্রজাতি
জনপ্রিয় হয়েছে, চাষআবাদ করা হচ্ছে তাদের। এর মধ্যে রূপে গুণে খ্যাতির শীর্ষে
আলফানসো, যার ডাকনাম হাপু। মহারাষ্ট্র, গুজরাট
ও কর্ণাটকে এই আমের চাষ হয়। আঁশ নের, গাঢ় হলুদ রঙের
মিষ্টি এই আমের বেশিরভাগই বিদেশে রপ্তানী হয়ে যায়। দুর্মূল্য এই আমের স্বাদ জানে না
সাধারণ মানুষ। সৌভাগ্যক্রমে এই আম খাওয়ার সুযোগ
পেয়েছিলাম একবার। মোটের ওপর ভালোই খেতে, হিমসাগরের
মতো অতটা রসালো ও নরম না হওয়ায় রপ্তানীর ক্ষেত্রে
সুবিধে হয়। তবে কেমন যেন একটা বুনো গন্ধ পেলাম। জানি না, এ আমার নাকের দোষ
কিনা! এবছর কোনো কারণে আলফানসো রপ্তানী
বন্ধ হয়েছিল। তাই বাক্সবন্দী আলফানসোর উপদ্রব বেড়েছিল
নিউমার্কেট চত্বরে। আর দাম? হ্যাঁ, বেশ সস্তাই ছিল এবার। মাত্র দুশো টাকা কেজি।
গরমের সময় কেউ যদি ট্রেনে করে দক্ষিণভারতে যান, রেললাইনের
দু’ধারে প্রচুর ছোট ছোট আমগাছের চাষ দেখবেন, আর তাতে লাল লাল
সিঁদুরে আম ভর্তি। বেশ লাগে দেখতে। এছাড়া অন্ধ্রপ্রদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় আম হলো বঙ্গনাপল্লি। একটু গোলচে ধরনের এই আমের
ফলন হয় প্রচুর। বিহারের গোলাপগন্ধী গুলাবখাস আর গুজরাটের
খুশবুদার কেশর আমের কথা না বললে আমকাহিনী পূর্ণ হয় না। বিহারের কিষেনভোগ, গোয়ার মানকুরাদ, হায়দ্রাবাদের নীলম – এদের অতিরিক্ত
ফলনের জন্য পরিচিতি পেয়েছে। সবশেষে একটু টক আমের কথা বলি।
সবুজ রঙের, টিয়ার মতো ছুঁচোলো ঠোঁটওয়ালা আমের নাম তোতাপুরী হওয়াই তো
স্বাভাবিক। এই আম কেন কে জানে, মিষ্টি কথা বলেনি
কোনোদিন। এর টক স্বাদ নুন-লঙ্কা দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাও আর নয়তো চাটনি কিম্বা আচার
বানাও।
ছোটবেলায় আমের আঁটি খাওয়ার জন্য মারামারি করেছি, বেশ মনে
আছে। এখন ভাবলে হাসি পায়, কত বোকামোই না করেছি! যারা বুদ্ধিমান তারা শাঁস খেয়ে চলে
গেল আর আমি আঁটি চুষছি তো চুষছিই। চুষতে চুষতে একঘন্টা কেটে গেল, আঁটি সাদা হয়ে
গেল, জিভ খসখস করছে ছাল উঠে, তবু ছাড়ান নেই। এখন ভাবি, এই আঁটি যদি না থাকত,
ছোটবেলা কি আর ছোটবেলা থাকত! যদিও এটাও ঠিক যে, আমের চল্লিশ ভাগ
জুড়ে থাকে এই আঁটি। আচ্ছা সত্যিই যদি আঁটি না থাকত, তবে কেমন হতো তুমি বল তো!
বৈজ্ঞানিকরা বলেছেন, মানে হাতেকলমে করে দেখিয়েছেন, তাও সম্ভব, আটিঁবিহীন আম সম্ভব। আমাদের পাশের বাড়ি বিহারে এই বছরই মাত্র সাত মিলিমিটার সাইজের আঁটি নিয়ে ফলেছে আম। এই আমের নাম দেওয়া হয়েছে – সিন্ধু। আশা করা যাচ্ছে, এই বাংলায় এবং সারা
ভারতে ও ভারতের বাইরেও এই সিন্ধুর চাষ বাড়বে, জনপ্রিয়তা বাড়বে।
সবশেষে আবার সেই পুরনো কথায়
ফিরে আসতেই হচ্ছে আমায়। জয় হো, হিমসাগর। আমি তোমাতে সঁপেছি প্রাণ! আমার আর অন্য
প্রেম নেই। অন্যদিকে তাকাই বটে ঠারেঠোরে, কিন্তু প্রেম সেই একই – আমার
হিমসাগর! তোমার আঁটি থাক, তাকে আমি মাথায় করে রাখব, নয়তো ছোটবেলায় ফিরে যাব
আঁটি চুষতে। তুমি এমনই থাক চিরমধুর, সরস ও সহজাত প্রতিভায় ভরা।
খুব খেটে লেখা। দুর্দান্ত।
উত্তরমুছুনআর জানিয়ে রাখি আমারও সবচেয়ে প্রিয় আম হিমসাগর। হ্যাঁ, আলফানসোর থেকেও।
ধন্যবাদ তুষ্টি এই চমৎকার আমকাহিনীর জন্যে।
ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন