দেবাঞ্জন ও মার্কোপোলো : কবিতার গ্রাম
-- গ্রামটা আসলে কবিতার।
-- কবিতার গ্রাম?
-- হ্যাঁ। প্রত্যেকটা মানুষের জীবদ্দশায়, তার কিছু কবিতা থাকে। মানুষটা মারা গেলে সেই কবিতাগুলো একা হয়ে পড়ে। তাদের আর দেখার কেউ থাকে না। কবিতারা তো আমাদের মতো টক ক’রে ম’রে যেতে পারে না। ফলে এ’
কোণে ও কোণে না খেয়ে না ঘুমিয়ে চোখের কোলে কালি প’ড়ে যায়। রোগা, দূর্বল... ভারি খারাপ কাটে। তারপর শহরের ধূলো ধোঁয়ায় কষ্ট পেতে পেতে একসময় ক্ষয়ে যায়। আমরা তাই সেই সব কবিতাদের পুনর্বাসনের জন্য এখানে শহর থেকে
অনেক দূরে নির্জন ড্যামের ধারে একটা গ্রাম বানালাম। এখানের জলটাও খুব ভালো,
বুঝলেন? যেই খবর পাই কোথাও কোনও কবিতা একা হয়েছে, গিয়ে নিয়ে আসি। আমার নাম বাবলু ভট্টাচার্য, আর ও হলো রমেশ দত্ত। আমরাও এক সময় লিখতাম। কাজের চাপে ছেড়ে দিই। তবে ভালোবাসাটা থেকেই গেছিল। উশখুশ করতাম। তারপর
একদিন কাজকর্ম সব ছেড়ে এই কাজে ঝাঁপিয়ে প’ড়ি। শুরুতে
নানা অসুবিধা হয়েছিল বটে...
পায়ের কাছে একটা সুটকেস রাখা ছিল। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। বাবলুর কথা শেষ হওয়ার আগেই রমেশ সুটকেস হাতড়িয়ে “এই তো এই দেখুন না...”
ব’লে একটা কাঠের ফ্রেম বার করে। যে ফ্রেমে ছবি টাঙানো হয়, সেরকমই। শুধু কাচ বা ওই বোর্ডটা নেই, ফাঁকা।
-- এইটা নিয়ে বেনারসে যাচ্ছিলাম,
একটা কবিতাকেই আনতে।
আমি: ফ্রেম
নিয়ে? কেন?
রমেশ: ও মা!
প্রত্যেকটা কবিতার একটা নির্দিষ্ট সাইজ আর শেপ থাকে তো... ফ্রেম নইলে আনবো কী ক’রে?
বাবলু: বেনারসের পুরো গল্পটা শুনলে তো আর
সামলাতে পারবেন না। মন্নু
নাম ছিল লোকটার, বুঝলেন? খুব বড় মাপের গুন্ডা। লোক-টোক খুন ক’রে বেড়াত। প্রথমে
শুরুটা করেছিল তেরো বছর বয়েসে। তখন
অবশ্য ছোটখাটো পকেটমার, ধরা প’ড়ে
পাবলিকের পেটানি আর জেল। জেল
থেকে বেরিয়ে আরও বড় গুন্ডা। এভাবে
প্রত্যেকবার জেল ঘুরে ঘুরে তার প্রোমোশন হতে থাকল। কম্মের মধ্যে কম্ম, এইসময়
একটা বড়লোক মেয়ের সাথে প্রেম ক’রে বসে, খুব সিরিয়াস প্রেম, প্রেমিকাটিও। কিন্তু জানতে পেরে প্রেমিকার বাড়ি থেকে বাগড়া দেয়। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় আমেরিকা প্রবাসী এক ভারতীয়র সাথে। তো মন্নু বেচারা কী করে,
আমেরিকা গিয়ে তো আর মেরে আসতে পারে না। এখানেই আরও বেশি বেশি ক’রে খুন করতে থাকে। থাকার মধ্যে ওর কাছে ছিল 0.32” একটা পিস্তল। পাতি।
দেবা: চা
খাবেন?
বাবলু: নাহ। চলুন বেরোই। আবার ফিরেও আসতে হবে তাড়াতাড়ি।
আমি: হুম। যাওয়াই যায়। Interesting লাগছে। ব্যাগগুলো নিয়ে আসা যাক কী বলিস?
বাবলু: গল্পটা শুনে নিন। তো হলো কী, তিন বছর পর
সেই প্রেমিকা বেনারসে ফিরলো। বর
বাচ্চা সমেত। কিন্তু
একবারের জন্য দেখা করল মন্নুর সাথে। বরের
সঙ্গেই এলো। ভালোবাসার
টান, বুঝতেই পারছেন। বরকে
বাইরে রেখে মন্নুর হাতে তুলে দিল খাঁটি বিলিতি মাল, Browning-এর HiPower Standard 9mm 4.62"। বলল, “ইয়ে
লে মন্নু তেরে লিয়ে... অর কুছ তো তেরে কো দে
ন্যই প্যয়ি”! মন্নুর সে যে কী অবস্থা! সেই পিস্তলটাকেই জড়িয়ে ধ’রে ঘুমোতো। মদ খেয়ে পিস্তল ধ’রে কাঁদত। গা
মুছিয়ে দিত, ঘুম পেয়েছে কি না জানতে চাইত।
আমি: মরলো
কীভাবে? Encounter-এ?
-- আরে না না। মরলোও তো ও’ ভাবেই। একদিন
প্রচুর মদ খেয়ে পিস্তল জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। আচমকা
চাপ টাপ প’ড়ে দড়াম ফট। কিন্তু ওরও যে একটা কবিতা আছে, সেটা বোঝা গেল ও মরার পরে। কবে কখন যে সেটা তৈরি হয়েছিল, কেউ
জানে না। হয়তো মন্নু নিজেও
জানতো না।
আমি: Sad...
দেবা: হুম চল ব্যাগগুলো নিয়ে আসি।
ব্যাগ
আনতে আনতে দেবাকে বলি, “এই জায়গাটার নাম কী জানিস?”
--
কোডারমা তো!
-- হ্যাঁ। কোডারমা জেলা। আর শহরটার নাম ঝুমরি তিলাইয়া...
“দুধের পাহাড় কুলের বন
পেরিয়ে গিরি গোবর্ধন
নাইতে
ঝুমরি তিলাইয়ার কাছে
যে নদীটি থমকে আছে
তাইতে”
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন