গোপন রোদনের যমুনায় জোয়ার এবং কল্পনায় সবুজ কমল
মাঝ রাতে আচমকা ঘুম ভাঙিয়ে, সে আমার হাত ধরে নিয়ে চলল। কপালে, নাকের অগ্রভাগে, বুকের মাঝখানে বিন্দু বিন্দু ঘামের স্পষ্ট আভাসে কুম্ভকর্ণ আমি হতবাক হয়ে ভাবলাম, আজ মাইনাস নাইন!
সে আমার কানে কানে বলল, ভয় কিসের! হাত ধরো। আমি বললাম, এই রাত দুপুরে? সে বলল, হ্যাঁ, হাত ধরো...
কত সহজেই পৌঁছে গেলাম প্রিয় শহর সেন্ট ক্যাথারিনে, নায়াগ্রার বুকে কান পেতে থাকি এক মনে কিছুক্ষণ... কী গভীর ধ্যানমগ্ন জলরাশি কঠিনের বুক চিরে বেরিয়ে এসে ছটফটে যন্ত্রণায় ঝরে ঝরে বলেই চলেছে তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, মান-অভিমানের অজস্র কাহিনী... আমাকে নিমগ্নতার বারান্দায় ঝুঁকতে দেখে সে গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে, ওরা আর কতটা বলবে।
এসো, দ্যাখো, শোন, বোঝো এরা কী বলে চলেছে সেই কবে থেকে...
ছাব্বিশ নম্বর বাড়ির, ছাব্বিশ নম্বর ফ্ল্যাটের সামনে আমায় নিয়ে সে দাঁড়ালো।
চোখের ডাক্তার এই তো সেদিনই বলেছেন, দু’মাসও পেরোয়নি, আমার চোখে কোনো সমস্যা নেই। ভুল দেখছি কিনা বুঝে ওঠার আগেই সে বলে ওঠে, চিনতে পারো?
কেউ কি গলা টিপে ধরে আছে! কোনো শব্দ আসে না কেন কে জানে! প্রাণপণ চেষ্টা ব্যর্থ হয় বার বার।
তার বুঝি মায়া জাগে। আমাকে ভাবতে দেখে। বেশ জোর গলায় বলে ওঠে, এটা আমার একার। শুধু আমার। শুধুই আমার। সুতরাং তোমাকে ভাবনার সাগর পাড়ি দেবার দুঃসাহস দেখাতে হবে না।
আমার ঘুমে ভেজা চোখ দ্যাখে, আমার স্বপ্নে মোড়ানো আমি দ্যাখে, আমার মগজের পরতে পরতে বসে থাকা, লুকোনো সেই সে দ্যাখে; দরজার মাঝখানে জ্বলে আছে সোনার হরফে হীরের দ্যুতিতে একটা নাম।
কিন্তু, এটা তো আমার নাম!
হতে পারে। ছিল কোনোদিন। তোমার বাবা অথবা মা খুব যত্নে রেখেছিলেন।
মানে কী এসবের? আমি জানতে চাই, অস্ফুট স্বর ভেজা কান্নায় কোঁকায়।
আমাকে উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে হলো না তার। খুব যত্নে দরজা খুলে ভেতরে নিয়ে গেল আমায়।
আজ পুরো ছাব্বিশ বছর। আজকের দিনটাতে ঐ নাম ধারণ করার অধিকার হারিয়েছিলে তুমি। কেউ কেউ বা অনেকেই তোমায় ডাকে, ক্রমাগত ঐ নামে ডাকে। তুমি সাড়া দাও। হাসো। বয়ে যাও ঝর্ণার মতো।
আমি দেখি। নিরালায়। একা। গহীনে।
দম কি বন্ধ হয়ে আসে? মাথার ভেতরে কেউ কি আলপিন ফোটায়? হৃদয় অলিন্দ উত্তাপ কেন হারায়! হাতের তালুতে মসৃণ জলের ধারা। পায়ের দু’পাশ দিয়ে গলগলিয়ে বয়ে যাওয়া স্রোত বলে দেয়, আমি ঘামছি। ঘামের লুকোনো বহমান ধারা আমাকে হিম হিম পরশ বোলায়। আমি ঠান্ডা পাথর হয়ে অনড় দাঁড়িয়ে থাকি। প্রাণপণ যুঝি নিজের ভেতরে নিজে। দু’হাতে কুয়াশার চাদর সরিয়ে তাকাই।
অনেক কষ্টে উচ্চারিত হয় কয়েকটি শব্দ, ভালোবাসা এত গভীর কেন... কোন্ গোপনে বাস তার!
সে আমার হাত ধরে নিয়ে যায় ঘর থেকে ঘরে, স্বপ্ন থেকে বাস্তবে। বাস্তব থেকে প্রকাশ্যে।
এ্যালবামের পাতা ওলটানোর মতো করে আমায় সে দেখাতে থাকে জমে থাকা স্মৃতি রক্তবিন্দু দিয়ে অপার মমতায় বানানো ফ্ল্যাটের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।
স্মৃতির বাগান এত সবুজে ঘেরা থাকে!
থাকে, যার বাগানের নামটাই সবুজে মিশে থাকে তার স্মৃতির বাগান শত জন্মেও বিবর্ণতায় ছায় না। ম্লান হয় না।
বিস্ময়ের জানালা তার সবটা হুট করে খুলে দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলো প্রবল প্রচণ্ড উত্তাল দমকা বাতাসের তোড়ে, যখন আমায় সে নিয়ে গেল ধীর পায়ে শান্ত মনে তার শয়ন কক্ষে...
দেওয়ালটা কি রঙের ছিল? জানালা নেই কেন? শয্যা ছাড়া আর কোনো আসবাব!
দেওয়ালটায় কি রঙ ছিল, সেটা জানা জরুরী নয়। এখন দেওয়াল জুড়ে সবুজ। ছাব্বিশ বছর ধরে সবুজ। আজীবন থাকবে সবুজ। এই সবুজের প্রাণশক্তি যার জানা নেই, সেই জানালা খুঁজবে। আমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সবটুকু ঐ সবুজেই বিলীন। জানালা দিয়ে কি করবো আমি! শয্যাটাও আছে ঐ সবুজ দু’চোখ ভরে দেখতে দেখতে তাকে নিয়েই সবুজ প্রাঙ্গণে ঘুমিয়ে পড়তে, নইলে তারও প্রয়োজন ছিল না তেমন। আসবাব দিয়ে কী হবে! যার জীবনের প্রতিটি ঘর ভা্লোবাসার সবুজ আসবাবে সাজানো, তার কি আসবাব লাগে? বোকা ছিলে। বোকাই রয়ে গেলে... থাকবেও...
কান্নার রঙ কি সাদা? খয়েরী? নাকি সবুজ? মগজের ভাঁজে ভাঁজে কি জোনাক জ্বলে? মননের পর্দায় কালো রঙের প্রাবল্যতা। স্মৃতির পাখায় মসৃণ কারুকাজ সবুজ আলপনায় আঁকা।
ছাব্বিশে জানুয়ারি আমার জন্মদিন। সব বাচ্চা জন্মেই কান্নার সুরে পৃথিবীকে তার আগমনী সংবাদ দেয়। কিন্তু আম্মার কাছে শুনেছি, আমি কাঁদিনি, আমি জন্মেই হেসেছিলাম। তাই দেখে নার্স আম্মাকে বলেছিল, আপনার মেয়ে হেসেই সবাইকে জয় করবে।
আমার নামটার মানে চীরসবুজ। সেই চীরসবুজ আমার চোখে এই গভীর রাতে বহু দূর নির্জন এক শয়ন কক্ষের বিশাল দেওয়ালের পুরোটা জুড়ে নিজের হাসিমাখা মুখের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কুয়াশার ঘন আস্তরণ ছেয়ে যেতে দেখে অস্থির হই।
তারপর, খুব আস্তে আস্তে... চুপিচুপি... কেউ যেন না জানে... কেউ যেন কুয়াশার এক বিন্দুও না দেখতে পায়... খুব সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে কুয়াশা ভেজা চোখের তারায় ঘুমকে ডেকে এনে বলি, সবুজে মিলিয়ে যাও...
মাঝ রাতে আচমকা ঘুম ভাঙিয়ে, সে আমার হাত ধরে নিয়ে চলল। কপালে, নাকের অগ্রভাগে, বুকের মাঝখানে বিন্দু বিন্দু ঘামের স্পষ্ট আভাসে কুম্ভকর্ণ আমি হতবাক হয়ে ভাবলাম, আজ মাইনাস নাইন!
সে আমার কানে কানে বলল, ভয় কিসের! হাত ধরো। আমি বললাম, এই রাত দুপুরে? সে বলল, হ্যাঁ, হাত ধরো...
কত সহজেই পৌঁছে গেলাম প্রিয় শহর সেন্ট ক্যাথারিনে, নায়াগ্রার বুকে কান পেতে থাকি এক মনে কিছুক্ষণ... কী গভীর ধ্যানমগ্ন জলরাশি কঠিনের বুক চিরে বেরিয়ে এসে ছটফটে যন্ত্রণায় ঝরে ঝরে বলেই চলেছে তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, মান-অভিমানের অজস্র কাহিনী... আমাকে নিমগ্নতার বারান্দায় ঝুঁকতে দেখে সে গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে, ওরা আর কতটা বলবে।
এসো, দ্যাখো, শোন, বোঝো এরা কী বলে চলেছে সেই কবে থেকে...
ছাব্বিশ নম্বর বাড়ির, ছাব্বিশ নম্বর ফ্ল্যাটের সামনে আমায় নিয়ে সে দাঁড়ালো।
চোখের ডাক্তার এই তো সেদিনই বলেছেন, দু’মাসও পেরোয়নি, আমার চোখে কোনো সমস্যা নেই। ভুল দেখছি কিনা বুঝে ওঠার আগেই সে বলে ওঠে, চিনতে পারো?
কেউ কি গলা টিপে ধরে আছে! কোনো শব্দ আসে না কেন কে জানে! প্রাণপণ চেষ্টা ব্যর্থ হয় বার বার।
তার বুঝি মায়া জাগে। আমাকে ভাবতে দেখে। বেশ জোর গলায় বলে ওঠে, এটা আমার একার। শুধু আমার। শুধুই আমার। সুতরাং তোমাকে ভাবনার সাগর পাড়ি দেবার দুঃসাহস দেখাতে হবে না।
আমার ঘুমে ভেজা চোখ দ্যাখে, আমার স্বপ্নে মোড়ানো আমি দ্যাখে, আমার মগজের পরতে পরতে বসে থাকা, লুকোনো সেই সে দ্যাখে; দরজার মাঝখানে জ্বলে আছে সোনার হরফে হীরের দ্যুতিতে একটা নাম।
কিন্তু, এটা তো আমার নাম!
হতে পারে। ছিল কোনোদিন। তোমার বাবা অথবা মা খুব যত্নে রেখেছিলেন।
মানে কী এসবের? আমি জানতে চাই, অস্ফুট স্বর ভেজা কান্নায় কোঁকায়।
আমাকে উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে হলো না তার। খুব যত্নে দরজা খুলে ভেতরে নিয়ে গেল আমায়।
আজ পুরো ছাব্বিশ বছর। আজকের দিনটাতে ঐ নাম ধারণ করার অধিকার হারিয়েছিলে তুমি। কেউ কেউ বা অনেকেই তোমায় ডাকে, ক্রমাগত ঐ নামে ডাকে। তুমি সাড়া দাও। হাসো। বয়ে যাও ঝর্ণার মতো।
আমি দেখি। নিরালায়। একা। গহীনে।
দম কি বন্ধ হয়ে আসে? মাথার ভেতরে কেউ কি আলপিন ফোটায়? হৃদয় অলিন্দ উত্তাপ কেন হারায়! হাতের তালুতে মসৃণ জলের ধারা। পায়ের দু’পাশ দিয়ে গলগলিয়ে বয়ে যাওয়া স্রোত বলে দেয়, আমি ঘামছি। ঘামের লুকোনো বহমান ধারা আমাকে হিম হিম পরশ বোলায়। আমি ঠান্ডা পাথর হয়ে অনড় দাঁড়িয়ে থাকি। প্রাণপণ যুঝি নিজের ভেতরে নিজে। দু’হাতে কুয়াশার চাদর সরিয়ে তাকাই।
অনেক কষ্টে উচ্চারিত হয় কয়েকটি শব্দ, ভালোবাসা এত গভীর কেন... কোন্ গোপনে বাস তার!
সে আমার হাত ধরে নিয়ে যায় ঘর থেকে ঘরে, স্বপ্ন থেকে বাস্তবে। বাস্তব থেকে প্রকাশ্যে।
এ্যালবামের পাতা ওলটানোর মতো করে আমায় সে দেখাতে থাকে জমে থাকা স্মৃতি রক্তবিন্দু দিয়ে অপার মমতায় বানানো ফ্ল্যাটের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।
স্মৃতির বাগান এত সবুজে ঘেরা থাকে!
থাকে, যার বাগানের নামটাই সবুজে মিশে থাকে তার স্মৃতির বাগান শত জন্মেও বিবর্ণতায় ছায় না। ম্লান হয় না।
বিস্ময়ের জানালা তার সবটা হুট করে খুলে দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলো প্রবল প্রচণ্ড উত্তাল দমকা বাতাসের তোড়ে, যখন আমায় সে নিয়ে গেল ধীর পায়ে শান্ত মনে তার শয়ন কক্ষে...
দেওয়ালটা কি রঙের ছিল? জানালা নেই কেন? শয্যা ছাড়া আর কোনো আসবাব!
দেওয়ালটায় কি রঙ ছিল, সেটা জানা জরুরী নয়। এখন দেওয়াল জুড়ে সবুজ। ছাব্বিশ বছর ধরে সবুজ। আজীবন থাকবে সবুজ। এই সবুজের প্রাণশক্তি যার জানা নেই, সেই জানালা খুঁজবে। আমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সবটুকু ঐ সবুজেই বিলীন। জানালা দিয়ে কি করবো আমি! শয্যাটাও আছে ঐ সবুজ দু’চোখ ভরে দেখতে দেখতে তাকে নিয়েই সবুজ প্রাঙ্গণে ঘুমিয়ে পড়তে, নইলে তারও প্রয়োজন ছিল না তেমন। আসবাব দিয়ে কী হবে! যার জীবনের প্রতিটি ঘর ভা্লোবাসার সবুজ আসবাবে সাজানো, তার কি আসবাব লাগে? বোকা ছিলে। বোকাই রয়ে গেলে... থাকবেও...
কান্নার রঙ কি সাদা? খয়েরী? নাকি সবুজ? মগজের ভাঁজে ভাঁজে কি জোনাক জ্বলে? মননের পর্দায় কালো রঙের প্রাবল্যতা। স্মৃতির পাখায় মসৃণ কারুকাজ সবুজ আলপনায় আঁকা।
ছাব্বিশে জানুয়ারি আমার জন্মদিন। সব বাচ্চা জন্মেই কান্নার সুরে পৃথিবীকে তার আগমনী সংবাদ দেয়। কিন্তু আম্মার কাছে শুনেছি, আমি কাঁদিনি, আমি জন্মেই হেসেছিলাম। তাই দেখে নার্স আম্মাকে বলেছিল, আপনার মেয়ে হেসেই সবাইকে জয় করবে।
আমার নামটার মানে চীরসবুজ। সেই চীরসবুজ আমার চোখে এই গভীর রাতে বহু দূর নির্জন এক শয়ন কক্ষের বিশাল দেওয়ালের পুরোটা জুড়ে নিজের হাসিমাখা মুখের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কুয়াশার ঘন আস্তরণ ছেয়ে যেতে দেখে অস্থির হই।
তারপর, খুব আস্তে আস্তে... চুপিচুপি... কেউ যেন না জানে... কেউ যেন কুয়াশার এক বিন্দুও না দেখতে পায়... খুব সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে কুয়াশা ভেজা চোখের তারায় ঘুমকে ডেকে এনে বলি, সবুজে মিলিয়ে যাও...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন