কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০১৪

০১) অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

কবিতার বিপদভূমি : পারহাম শাহরজের্দি
অনুবাদ : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়


[পারহাম শাহরজের্দি (জ. ১৯৮০, তেহরান), প্রাবন্ধিক, সমালোচক ও অনুবাদক। বর্তমানে প্যারিসে থাকেন। সমসাময়িক ফার্সি কবিতার বহু সংকলন সম্পাদনা করেছেন। অনুবাদ করেছেন। ফার্সি ‘নতুন কবিতা’ নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে হাতে আসে ওঁর একটি দুরন্ত লেখা। পারহাম নিজে কবি নন, বা কবিতা লেখেন না বলেই হয়তো এরকম সপাটে বলে ফেলতে পেরেছেন কথাগুলো। যা ফার্সি কবিতার প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ‘কবিতা’ বিষয়ে ওঁর যে চিন্তা সোজা-সাপটা উঠে এসেছে এখানে, তা’ বিশ্বকবিতার পরীক্ষামূলক মুক্তধারারই প্রতিনিধিত্ব করে। পৃথিবীর যে কোনো মানচিত্রে ব’সে এ লেখা পড়তে পারেন কবিতার একজন আবিষ্কারক। অথবা কবিতার একজন বিপ্লবী। অবশ্যই যদি তিনি ‘নতুন জিভের মতো অল্প লালা ভাষাটা’ চান। আজকের ইরানে, যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই, কবি-সাহিত্যিকরা রাজনৈতিক ব্যাপারে যেখানে প্রত্যক্ষ সমালোচনা করতে পারেন না; ১৯৭৯-এর ইসলামিক রেভোলিউশনের পর একনায়কতান্ত্রিক শাসকের ক্ষমতা দখল; সাহিত্যে শিল্পে সরকারের নিয়ন্ত্রণ; প্রকাশনা ব্যবস্থা, কবিতা, সাহিত্য, শিল্প, ফিল্ম, রেডিও, টিভি, গ্যালারি এক্সিবিশন, মিউজিয়াম, ইন্টারনেট সর্বত্র অত্যাধিক মাত্রায় সেন্সরশিপ, রাষ্ট্র যেখানে প্রত্যেকটা মুহূর্তে তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, না পারলে তোমার বিরুদ্ধে যাবে, যেখানে দাঁড়িয়ে স্বাধীনভাবে লেখালিখি করা, শিল্প চর্চা করাটাই বিরাট ঝুঁকির প্রশ্ন — সেই রিস্কডমে দাঁড়িয়ে, বিপদনগরের কথা, কবিতার বিপদের কথা বলেছে এই গদ্য। কবিতার মুক্তির কথাও।

প্রবন্ধটি ‘Sens Public Revue électronique internationale’-এ ২০০৯-এ প্রকাশিত। চোদ্দ অনুচ্ছেদের প্রবন্ধটির সাতটি অনুচ্ছেদের (১-৬ এবং ৮) অনুবাদ করেছি আমি, বাংলায়। যে অংশটুকু করিনি, সেখানে মূলত আবদোলরেজায়েই-এর (ফার্সি কবি, ১৯৮৮-’৮৯ সাল নাগাদ ফার্সি কবিতায় যে ‘নিউ পোয়েট্রি’ মুভমেন্ট হয়েছিল, তার অন্যতম একজন) কবিতা নিয়ে কথা বলেছেন পারহাম। প্রসঙ্গত, ‘I live in Riskdom’ এই নামে আলি আবদোলরেজায়েই-এর একটি কবিতার বই আছে (মূল বইটি ফার্সিতে লেখা, ইংরেজি অনুবাদ আবোল ফ্রাওশান-এর), পারহাম ওঁর এই নিবন্ধে আবদোলরেজায়েই-এর কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েই কবিতা, কবিতার ভাষা, সমসাময়িক ইরানি সাহিত্য ইত্যাদি আরো নানান অনুষঙ্গ ছুঁয়ে গেছেন। লেখাটিতে যে কবিতাগুলো পারহাম উদ্ধৃত করেছেন সেগুলো সবকটিই আবদোলরেজায়েই-এর কবিতা। বাংলায় রূপান্তর আমার।

‘রিস্ক অফ পোয়েট্রি’ এমন এক গদ্য যা একই বিষয়ের ওপর ফরাসী, ইংরেজি এবং ফার্সি — এই তিনটি ভাষায় লেখা তিনটি আলাদা টেক্সট। ফরাসী টেক্সটটির নাম ছিল ‘Risquer la Poésie’, ইংরেজি টেক্সট ‘Risk of Poetry’। মজার বিষয় হলো, এখানে প্রতিটি ভাষা (ফরাসী, ইংরেজি, ফার্সি) তার নিজের ভাষাটির সন্ধান করেছে, একটি ভাষা আরেকটি ভাষাকে হুবহু অনুবাদের চেষ্টাই করেনি। একটি টেক্সট আরেকটি টেক্সটের ভাষায় কথা বলেনি। যদিও Sens Public পত্রিকা এই তিনটি টেক্সটের মধ্যে বেশ কিছু trace-কে retain করেছে, ফলে তিনটি টেক্সটের মধ্যে সম্পূর্ণ না হলেও অনেকটাই অনুরূপতা পাওয়া যায়। তবুও এই ট্রিলজিতে একটা টেক্সটের সাথে আরেকটা টেক্সটে বেশ কিছু জায়গায় এখনও অনেক মিউটিলেশন ঘটে রয়েছে। আর এখানেই এই ট্রিলজি ঝুঁকিপ্রবণ হয়ে ওঠে, এবং ঝুঁকি সে নেয়ও। এবং বিপদে ফেলে। আমি এখানে যে অংশের অনুবাদ করেছি, ফরাসী এবং ইংরেজি টেক্সট দুটির সাথে মিলিয়ে সেখানে চেষ্টা করেছি বাংলা অনুবাদে সামঞ্জস্য রাখতে। ফরাসী টেক্সটে যে অংশটি ছিল, কিন্তু ইংরেজিতে সেটা না থাকলে বাংলায় তাকে রেখেছি। আবার উলটো দিক থেকেও একই। অতি সামান্য কিছু জায়গায় কয়েকটি পার্সোনাল রেফারেন্স যা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে, রাখিনি। —অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়]

কবিতার বিপদভূমি



অবলিটারেচার — অথবা সেলিব্রিটির মৃত্যু


সাহিত্য? অক্ষর? সাক্ষর, অক্ষর-মানুষ? চলুন সাহিত্য ভোলা যাক এবারে, এগোনো যাক অসাহিত্যের দিকে, সাহিত্যমৃত্যুর (অবলিটারেচার) দিকে, পুরনোটাকে সরিয়ে নতুন ক’রে গ’ড়ে তোলা যাক একে নতুন সাহিত্যের পক্ষে। কারণ এই সাহিত্য ভীষণ শিষ্ট, মার্জিত এবং সূক্ষ্ম ও অলিখিত একটা আচরণবিধি দিয়ে সাহিত্যকে বিশুদ্ধ আর গোছানো পরিপাটি সুবিন্যস্ত ক’রে রেখে দেয়। যা ভীষণ প্রতিক্রিয়াশীল। স্থবির একটা বিনোদন দিয়ে যাচ্ছে। আমরা কি ভাববো সেই স্থবির বিনোদন নিয়ে? নিশ্চল সাহিত্য নিয়ে? স্রোতহীন জলে সাহিত্যের পরিতৃপ্তি নিয়ে কি ভাববো আমরা? না। এই সাহিত্য শেষ হয়ে গেছে। শেষ ক’রে দিচ্ছে এই সাহিত্য সবকিছুকে।

ইরানি সাহিত্যের এই পরিপাটি ও সুবিন্যস্ত লেখকগণ একটা প্রচলিত ব্যবস্থার আদেশ (নীতি-নৈতিকতার আদেশ, ধর্মীয় আদেশ, রাজনৈতিক আদেশ) পালনে সুপারদর্শী। যাতে তাদের ফার্সি সাহিত্য আরো পশ্চাদমুখী হয়, আরো আরো পেছনে পিছিয়ে যায়।

ইরানি সাহিত্যের প্রচল ধারা এর পেছনে ধাওয়া করতে করতে নিজেই এখন একটা প্রোটেক্টেড জোন হয়ে উঠেছে — লিটেরারি প্রোটেক্টরেট। আর এই সাহিত্যের সেই লেখকেরা এ ব্যবস্থার সাথে সহাবস্থান করতে করতে, এটাকে মেনে নিতে নিতে হয়ে উঠেছে আইন বলবৎকারী। একজন কেউ নেই যে এই রক্ষণশীলতাকে আঘাত করবে, যে এই সুপরিপাটি ছিমছাম সুবিন্যস্ত সীমার বাইরে ভাষাটাকে নিয়ে যাবে। তার মানে তুমি যদি লাইনটা অতিক্রম না করো — থেমে যাচ্ছো তুমি।

আদেশ এবং ভয় একটা বিন্দুতে এসে মেলে : তুমি সীমা লঙ্ঘনে ভয় পাছো, তুমি ভয় পাচ্ছো অপরিপাটি বিশৃঙ্খল হতে, তুমি এই প্রচল ব্যবস্থার আদেশনামার ধ্বংসস্তূপ মেরামতে ভয় পাচ্ছো, ভয় পাচ্ছো ভীষণ আলাদা হয়ে যেতে, পরিবর্তনকে ভয় পাচ্ছো, অচেনা অজানাকে ভয় তোমার, ঝুঁকি নিতে আর ঝুঁকিকে বিপজ্জনক করে তুলতে ভয়, ভয়কেই তোমার ভয়।

যেন এখানে বিধিবদ্ধ প্রবন্ধ, বইয়ের পৃষ্ঠার সংখ্যাঙ্কিতকরণ আর চিত্তবিভ্রম ছাড়া ‘সাহিত্য’ ব’লে আগে কক্ষনো কিছু ছিলই না। এই ঘোরলাগাটাকে ভাঙতেই হবে, ভাঙতেই হবে।


পৃথিবীর ভাষা, কবিতার ভাষা, ঝুঁকির ভাষা

লেখা হয় দুনিয়ার ভিত্তিপ্রস্তরটাকে নাড়া দেবার জন্যে। ভাষা এই পৃথিবীর ভিতটাকে নির্মাণ করেছে এবং করছে। এই ভিতটাকে এক হাত নিতে, সমস্ত পরিস্থিতি ও কার্যক্রমের সাজানো বিন্যাসটাকে হারাতে, এই সাজানো বিন্যাসের ধারাটাকে ভাঙতে, আমরা দুনিয়ার ভিত্তিপ্রস্তরেই হাত দেব।

বিপদ শুরু হয় তখনই যখন কবি উঠে দাঁড়ায়, দৈনন্দিন ভাষার বিরুদ্ধে, যোগাযোগের ভাষা ও কথোপকথনের ভাষার বিরুদ্ধে, ভাষার সাধারণ ব্যবহারের বিরুদ্ধে, যখন সে অবিচলিত দৃঢ় উঠে দাঁড়ায় চলতি দুনিয়ার বিরুদ্ধে। কবিতার ভাষা রোজকার অভ্যেসের ভাষা নয়, সংবাদ পরিবেশন নয়, রিপোর্ট লেখার মতো জনগণের জ্ঞাতার্থে প্রতিবেদন বা বিবরণ লেখা নয়, জ্ঞানগর্ভ কোনো কিছু নয়, শিক্ষাদানও করে না, পুনরাবৃত্তি নয়, বারবার একই জিনিস ঘটে যাওয়াও নয়।

প্রচল ধারা সবসময় তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চায়, সবসময় সে থেকে যেতে চায়, সেজন্যেই সে জনপ্রিয়তার রাস্তা অনুসরণ করে, আমরা কি হাঁটব জনপ্রিয় রাস্তায়?

ব্যাকরণ, ফার্সিতে একে বলা হয় ‘Dasture zabaan’, যার আক্ষরিক অর্থ ‘the order of tongue’. অর্ডার? এমন একটা জিভ যে হাতকে আদেশ করছে? কে দিচ্ছে আদেশ? কিসের আদেশ? ব্যাকরণ তো একটা মরাল কনস্ট্রাক্ট একটা নৈতিক কাঠামো, কি করা যাবে আর কি করা যাবে না— আগে থেকে ঠিক ক’রে দেওয়া এরকম একটা তালিকা থেকে যা ভবিষ্যতের ভাষাকে নির্ধারণ করে। কিন্তু কবিতা আর কবি থাকেন সেই আদেশ ও আদেশের ভাষাকে বিচ্ছিন্ন করতে, তাকে দুনিয়া থেকেই সরাতে, ভাষার একটা নতুন বাঁক সৃষ্টির জন্য। তবুও, বিপজ্জনক কবির জন্য ভাষা শুধু একটা উপায় বা কোনো মাধ্যমমাত্র নয়, ভাষা তার কাছে পুরোটা, এবং তার কাজের মূল লক্ষ্যবস্তু।


সাহিত্যে শূচিতা— পবিত্র বা শুদ্ধ সাহিত্য


শূচিতা এবং পবিত্রতা এমন একটা জিনিস যে, সে যখন হাত তোলে তখন সারা দুনিয়াকেই তার হাতের নিচে নিয়ে আসে। শব্দকে নিয়ে আসে তার আদেশের নিচে। কখনো কখনো হয়তো একটা প্রশ্নের আড়ালে লুকিয়ে থাকে এই পূত পবিত্রতা। ...কিন্তু তার অসীম পবিত্রতার ফলে সে কখনোই প্রশ্নের সামনে আসে না। অর্থাৎ এর’ম জিনিস রয়েছে যা নিয়ে কখনোই প্রশ্ন তোলা হয় না। কবিতা কিন্তু যা কিছুকে ইন্টিমেট করে, ইনক্লুড করে — ব্যতিক্রমহীনভাবে তাকে কবিতার প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয়। এখান থেকেই শুরু হয় কবিতার ঝুঁকির জায়গা, রিস্ক অফ পোয়েট্রি।

সামাজিক প্রতিষ্ঠান কবিতার সংজ্ঞা নিরূপণ করতে চায়, কিম্বা সে এমন কবিতা চায় যার সংজ্ঞা নিরূপিত করা আছে। কিন্তু কবিতা কোনো জ্ঞানগর্ভ কিছু নয়, এর কোনো নৈতিক মাপকাঠি নেই। যা দেখেছি তা’ লেখার জন্যে কবিতা লেখা হয় না। কি আছে তা বলার জন্য নয়, কি নেই তা বলার জন্য লেখা হয় কবিতা।

এবারে অল্প সময়ের জন্য একদলীয় শাসনতন্ত্রের বাস্তবে ফিরে আসা যাক, যে কোনো প্রশ্নই যেখানে ঝুঁকিপ্রবণ ব’লে বিবেচিত হতে পারে। ডেকে আনতে পারে জেল, অত্যাচার, বিচার এবং প্রাণদণ্ড দিয়ে যেখানে রাষ্ট্র নিজেই আততায়ী—‘‘এই লোকটা রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার পক্ষে একটা বিপজ্জনক লোক’’—‘‘ডেঞ্জেরাস এলিমেন্ট ফর ন্যাশনাল সিকিওরিটি।’’



‘আমি’ বিপদনগরে থাকি

কেউ একজন বললো : আমি বিপদনগরে থাকি, সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে বিপদের মুখেই ফেললো। কেউ একজন তার দেশের বিপদসঙ্কুল হয়ে ওঠার কথা লিখলো আর তৎক্ষণাৎ বিপদের প্রতিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিল আরেকটা বিপদকে। কি হলো এতে? (কি ঘটছে?) যখন আমরা বিপদের কথা বলি, কেউ একজন আমাদের সাথে, আমাদের মধ্যে, আমাদেরকে ছাড়াই কথা বলতে শুরু করে দেয়। একটা স্বর আসে কোত্থেকে : বিপদের জন্যেই লেখা, বিপজ্জনকভাবে বাঁচার জন্যে, লেখা থেকে লেখ্যান্তরে যাওয়ার জন্যে, এই বিপদভূমিতে ঘুরে বেড়াবার জন্যেই লেখা। একটা (লেখা) আরেকটাকে (লেখাকে) পাশে নিয়ে চলে। শমন, পরোয়ানা, ঝুঁকি, শমনের বিপদ; টান মেরে ছিঁড়ে ফেলা অংশে দাঁড়িয়ে আছে ওই সেই অপরজন।

খুব কাছ থেকে দেখলে — বিপদের মধ্যে বাঁচা, ঝুঁকির মধ্যে টিকে থাকা, ঝুঁকির কথা। আমি বিপদনগরে থাকি, পড়ুন : আমি শমনের মধ্যে থাকি। এইখানেই আমরা লেখার অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের সাথে মোকাবিলা করছি। ঝুঁকিটা হলো থাকা এবং না-থাকার। লেখালিখির ঝুঁকি, লেখালিখি থেমে যাবার, বন্ধ হয়ে যাবার ঝুঁকি। অন্যভাবে বলা যায়, ঝুঁকি হলো নিশ্চয়তার অভাব। বিপদ এই বিপদ ওই... তো? বিপদ এমন একটা অবস্থা যা deferral (or dropping) of obliteration, ধ্বংস স্থগিত রাখা একট মুহূর্ত। একটা pause, একটা বিরামচিহ্ন। বিপদের আগে অলিখিতকে অলেখাকে রাস্তা ক’রে দিতে হবে। পরোয়ানা আসার আগে ওকেই টেনে নিতে হবে পেছনে। বিপদনগরে থাকা মানে, শমন আসার আগের থেমে থাকা মুহূর্তটায় বাঁচা। যে মুহূর্তে তুমি লিখবে সেটাই ঝুঁকির মুহূর্ত। আমি বিপদনগরে থাকি, আর তারপর? হয় তুমি বিপদকে চেয়ার থেকে ফেলবে, অথবা সে তোমাকে হারাবে। তুমি হয় দীর্ঘায়িত করবে বিপদকে নয়তো শেষ করবে, অথবা সে এসে তোমাকে শেষ ক’রে দিয়ে যাবে। বিপদটাকে শেষ করলে পরোয়ানাও থাকবে না।

বিপদনগর : যখন পরোয়ানা, শমন তার মূল উৎসবিন্দুর কাছে পৌঁছে যায়। আই লিভ ইন রিস্ক্‌ডম্‌। এই একই অভিজ্ঞতার সামনাসামনি হচ্ছি আমরা। ...একটা বিচার চলছে, যা জীবনকে, লেখার জীবনকে, এবং কবির জীবনকে সংকটাপন্ন করে তুলছে। এই অভিজ্ঞতার, এই বিপদের, এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার আর কোনো বাহ্যরূপ নেই। ঝুঁকি, লেখালিখি নিয়ে বাঁচাটাই ঝুঁকি। টেক্সটের (লেখার) মুখোমুখি হওয়াটাও, রাস্তায় একটা অচেনা কারোর দিকে পা বাড়ানোটাই ঝুঁকির। কেউ একজন এমন একটা কিছু লিখেছে যা অন্য কেউ লেখেনি, অন্য কেউই লেখেনি, একজন একটা অজানা কিছু লিখেছে, আনরেকগ্‌নাইজ্‌ড্‌ কিছু, অনাহূত কোনো শব্দ, আগে লেখা হয়নি এমন একটা লাইন বা এমন জাক্সটাপোজিশন যা পূর্বে অপরীক্ষিত, আনফ্যাব্রিকেটেড কোনো ফর্ম বা কো্নো অদেখা ইমেজ, ব্যস্‌, কেউ লিখলো এটা তো ফেলে দাও তাকে ওদের গোলমালে, সংঘর্ষে, বিবাদে। সেই লোকটা কি আর ফিরে আসবে তারপরে? লিখবে কি সেই লোকটা আর? ওরা লিখতে দেবে একটা লোককে? বিপদ কি বিপদসীমার মধ্যেই সীমিত থাকবে?

আমি বিপদনগরে থাকি : ফিরে এসো আর এসে লেখো। তোমার টেক্সটকে তোমার অভিজ্ঞতাগুলো দাও। ফিরে এসে জীবনকে বিপদের প্রসঙ্গে এনে রাখো, লেখার লাইনের ওপর। বিপদ একবার এবং একটিমাত্রবারই আসতে পারে। যা পরোয়ানার পেছনে আছে, ছুঁয়ে আছে প্রান্তসীমা। তাই, লেখার আপতন বিন্দু এই সূক্ষ্ম টাচলাইন। শমন, পরোয়ানা লেখা হয় বিপদের এই টাচলাইনের ওপরেই।

এটা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয় যে একটা কবিতার শিরোনাম হলো ‘না ভয়’ (Fear Not), আর এর প্রথম লাইনটাই শুরু হয় একটা অপরিহার্য ক্রিয়াপদ দিয়ে। এইখান থেকেই শুরু হয় লিটারেচার।

‘‘আমি একটা দরজা খোলার চেষ্টা করছি
অন্য একটা কথা বলার জন্য
কোনো অন্য কাউকে
আগে কক্ষনো বলতে পারিনি যে কথাটা’’
একটা দরজা খোলা হয়, এবং কথা শুরু হয় তার থেকে। একটা দরজা, এই শব্দটা, এই শব্দটাই। একটা দরজা, কথা বলে এবং শব্দ (word) উচ্চারণ করে এবং অন্য একজন হয়ে ওঠে। অন্য একজনের সাথে কথা বলে। অন্য আরেকটা দরজা সেটা অন্য আরেকজন।

পরিবর্তন এবং ক্রমপরিবর্তন শুরু হয় এই টেক্সট থেকে। এইখান থেকে, একটা বিপ্লব আকৃতি পেতে থাকে, গ’ড়ে উঠতে থাকে এই টেক্সটে।

কবিতায় একটা নতুন বিপ্লবকে আসন দেওয়া এর মানে কী?



পোয়েট্রি অফ মাদার টাং


মা যদি জিভ হয় আর আমরা যদি তার মধ্যে থাকি তাহলে মা কোথায়? আমরাই বা কোথায়? কোথায় আমরা? মায়ের কোন্‌ জায়গায় আছি আমরা? কোথায়, আমাদের ভাষা? আমরা নির্বাসনে, বহু বহু দূরে, আমাদের ছেদবিন্দুটা কী? ‘মা’ হলো দূরত্ব, ব্যবধান। তাহলে ব্যবধান কী? কে এই দূরত্ব? ব্যবধান হলো অন্যের উপস্থিতি। এখানে এবং সেখানের দূরত্ব, আমি এখানে, ওখানে তুমি, আমাদের মাঝখানে ব্যবধান। দূরত্ব নিয়ে এই সেই সবথেকে ভালো লেখা লাইন—
‘‘পৃথিবীর এই দিকে তোমার যদি সন্তান থাকে
সে সন্তান পৃথিবীর ঐদিকেও’’
আত্মদমনের রাস্তা খুঁজতে থাকা কবিতার এই শুরুটা হঠাৎ গিয়ে পড়ে এরকম একটা শেষে—
‘‘পৃথিবীর এই দিকে যদি তোমার মা
সে মা পৃথিবীর ঐদিকেও’’
মা জিভ, মা শরীর, জিভ আর শরীর ব’লে কিছু নেই। মা-ও নেই। মায়ের জিভ মায়ের শরীর আলাদা। মায়ের শরীর থেকে পৃথক হওয়া দিয়ে শুরু আমাদের নির্বাসনের। জন্মের মুহূর্তেই মায়ের শরীর থেকে নেগেশন শেখে শিশু। সমস্ত হঠাৎ জন্ম থেকে, আমরা নির্বাসনে, ব্যবধানে, এখন কথক হয়েছি, অতীত দূরত্বের গল্প বলছি, হাত থেকে সব হারিয়েছি আর তাই লেখার শক্তির কাছে সাহায্য প্রার্থনা, হারিয়ে যাওয়াগুলোকে ডেকে আনতে, খুঁজে আনতে ওগুলোকে, এটাই আনন্দ। এবং মায়ের শরীরের জায়গায়, তার বিকল্পে মায়ের জেণ্ডার ও সেক্সুয়ালিটিকে আমরা বিনিময় করছি শব্দের (word) সাথে, শব্দের জেণ্ডার, সেক্সুয়ালিটি থেকে নন্‌-সেক্সুয়ালিটির দিকে, এবং অবশেষে, শব্দকে একটা জেণ্ডার দিই, শব্দ দিয়ে শব্দের মা বানাই একটা।


দ্রুত, দূরে, দেরি

কাউকে ডাকার জন্য দ্রুততম জায়গাটা কোথায়, যেখানে একটা ডাক (call) ক্ষিপ্রতম গতিতে পৌঁছে যাবে একজনের কাছে এবং ফিরেও আসবে তার কন্ঠস্বর?

দুজন মানুষের একটা নির্দিষ্ট সীমায়িত দূরত্বের মধ্যে ডাক শোনা যায়, দূরত্ব অসীম হয় যখন, শব্দ (word) এবং কথা (speech), অক্ষর (syllable) এবং ধ্বনি (sound) পৌঁছতে ভিন্ন ভিন্ন সময় নিয়ে নেয়, যখন কণ্ঠস্বর, ডাক, গলার আওয়াজ আর শোনা যায় না। তখন দূরত্বের মাঝখানের স্রোত ঢেউয়ে ভাসিয়ে দেয় কথা—

‘‘মা এটা ছিল আমার মুখের দ্রুততম উচ্চারিত শব্দ
আমি স্রোতে দূরে ভেসে যাওয়ায়
যা বিলম্বিত হয়েছে এখন’’
এখানে একটা স্মৃতি আছে, ভুলে যাওয়া আছে একটা, তারপর আবার মনে পড়া। দূরত্বের জন্যই দূরত্বের মাঝখানে ঢুকে যাওয়া আর সামনের কাউকে ডেকে ফেলা, তক্ষুনি। কখনো কখনো এটা হয়, যখন এই তাৎক্ষণিকতায়, সাহিত্য ভালো লাগার স্বাদ দেয়।


নর্মোপ্যাথি অথবা ডিজিজ অফ স্ট্যাণ্ডার্ড

‘‘আমি প্রথম যখন এলাম, চলে যাচ্ছিলাম
কিন্তু সহস্রতমটিও হারালো
সাইকেল একটা দেবার কথা ছিল বটে
বাবা মাতাল নদীতে আর কুড়ি নম্বরও সে পেল না পরীক্ষায়
সেই সাইকেল যেটা তিনি কখনোই কিনে দেননি
অনেক বছর বাদে ঝাড় খেলাম বিচ্ছিরি
দেখলাম আমার মা ঠাকুমা হয়ে যাচ্ছে
ছেলে তিনে পা দিল
গুনতে গুনতে চলেছে সে মায়ের প্রতিশ্রুতিগুলি
ঠাকুমা হেঁটে যাচ্ছেন তাঁর সদিচ্ছার পাশে পাশে
শেষবেষ কুড়ি সে পেল আর তখন গ্রীষ্মকাল তখন ছড়াচ্ছে সূর্যের আলো
সারাটা আকাশ যখন ঢেকে গেল কাক
ওয়াহ্‌, কী দুর্ধর্ষ সেই একশো কাকের কা কা কা কা কা কা কা—’’
অথবা,
‘‘ভবিষ্যতের অনুকূলে কিছু রাখব কিনা ভেবে
যখন নিশ্চিত নই
অপেক্ষাকৃতর চুলে রাখার জন্য কোনো হাত
প্রসন্ন ভঙ্গিতে ভাঁজ করিনি আমি’’
অথবা
‘‘যাত্রা করো সেই যাওয়ার দিকে যে দিকটায় আমি গেছিলাম ওটা না কিন্তু নইলে পেছনে প’ড়ে যাবে’’
স্থানচ্যুতি, বাক্যের নির্মাণ নিয়ে খেলা, বাক্যাংশের সোয়্যাপিং, ওয়ার্ড জাম্প, কবিতাগুলোতে এই ঘটনাগুলো স্পষ্ট। প্রথমদিকে পাঠকের মনে হবে কিছু একটা যেন নেই, কিছু একটা নেই জায়গা মতো, কি একটা এখানে থাকার কথা ছিল, কিন্তু নেই, কী সেটা? এখানে সিনট্যাক্‌স্‌, শব্দের স্বরমাত্রা (টোন) তার পুরনো কাঠামো থেকে সরে এসেছে। ক্লাসিক্যাল স্ট্রাকচার, সাধারণ কম্বিনেশন, প্রথানুগ ইমেজ পরিত্যাগ করা হয়েছে। পরিত্যাগ করার এই গুণ পাঠককে চালিত করে, যখন শব্দ চলতে থাকে, পাঠককেও নিয়ে যায় সাথে।

সমাজ সবসময় প্রমিতকরণ (standardization) করে, এবং পিঠে একটা এ্যাপ্রুভাল স্ট্যাম্প মেরে দেয়। পরিচিতি এবং স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য এটা চাওয়া হয়। সমাজ মূল্য নির্ধারণ করে দেয়; মিডিয়া, খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, টিভি— সেই প্রমিতকৃতটির বিজ্ঞাপন করে, একটা সাম্রাজ্য গ’ড়ে তোলে সেই মাপকাঠির এবং সবাই (সবাই?) কোনো ফলপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে বাঁচতে সচেষ্ট হয় — এটা হয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। এমন কি কবি-লেখকও সেই নির্দিষ্ট মানের সাথে সংগতিপূর্ণ ক’রে তোলেন নিজেদের। কেননা তাঁরা সমর্থন খোঁজেন, অনুমোদন চান। কেননা তাঁরা সমাজের পেছনে পেছনে দৌড়ন। কিন্তু একজন বিপজ্জনক কবি এই প্রমিতকরণ থেকে দূরে সরে থাকে। সমাজকে অনুসরণ করা তাঁর কাজ নয়। হয়তো সমাজকেই নিজের পেছনে নিয়ে আসাটা তাঁর কাজ।

তাই আমরা ব্যাকরণকে (ফার্সিতে যাকে বলে অর্ডার অফ টাং) ম্যানিপুলেট করছি। ভাষার অর্ডারকে ম্যানিপুলেট করছি পৃথিবীর অর্ডারকে ম্যানিপুলেট করব ব’লে। পৃথিবীর সত্যটাকে পাল্টাবার জন্যে, ঠিক যেভাবে পৃথিবীর বদলে একটা বাক্যকে স্থান দিই কবিতায়। চূড়ান্ত সত্য ব’লে আর কিচ্ছু নেই। একটাই সত্য আছে এখন পৃথিবীতে, কাব্যের সত্য, সেটাই তার স্বধর্ম।

‘‘সত্যিটাকে নিয়ে লোকটা এমন খেলাই খেললো
যখন মরলো
সেটাও মিথ্যে হয়ে গেল’’
প্রতিটি অবস্থার একটা অতীত আছে। শিল্প-কলার স্ট্যাণ্ডার্ডগুলো আসলে আর্ট মিউজিয়াম তৈরি করে। মিউজিয়াম এমন একটা জায়গা যেখানে আর্টিস্টিক ভ্যালুগুলো প্রদর্শিত হয়। দর্শকেরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকেন যে, তাঁরা এমন জিনিস দেখছেন যার পেছনে স্ট্যাম্প (স্ট্যাম্প অফ এ্যাপ্রুভাল) মারা আছে। কারণ সেই জিনিসগুলো সময়োত্তীর্ণ (টাইম অনারড্‌) এবং উৎকর্ষতার নিরিখেও উত্তীর্ণ, এবং সেজন্য ‘শৈল্পিক মূল্য’ ধারণের যোগ্যতা সম্পন্ন। কবিতাতেও মিউজিয়ামগুলো শুকিয়ে যাওয়া শব্দ দিয়ে তৈরি মৃত পশুর সংরক্ষিত শুকনো চামড়ার আকার ধারণ করে— জীবনের ছোঁয়া না থাকা ঐ চামড়ার মধ্যে পশুটা যেভাবে থাকে, সেইভাবে কবিতার জীবন থাকে সেখানে।

পোয়েট্রি অফ রিস্ক সমর্থন, অনুমোদন, স্বীকৃতির প্রতিশ্রুতিটাকেই মুছে ফ্যালে। পোয়েট্রি অফ রিস্ক ঠিক ‘এটাও চলে’ টাইপের নয়, আগে যেটা চলেছে বা কোন্‌টা চললে স্বীকৃতির স্ট্যাম্প পাবে — এসবের সাথে বিপদে ফেলার কবিতার, ঝুঁকি নেওয়ার কবিতার কোনো সাদৃশ্য নেই। পোয়েট্রি অফ রিস্ক, তার নিজের মতোই, বিপদে ফ্যালে।

‘‘আরে তুমিই যদি সেই প্রতিশ্রুতি তবে আমি স্থির আছি কেন?
ছুটেও যাব তো আমি যাব ছুটে দৌড়ে আবার হ্যাঁ আবার আমি কি
আগে থেকেই স্থির আমি কি আগেই কখন হয়েছি?’’
পোয়েট্রি অফ রিস্ক চেনা-চলার ছন্দ এবং রাস্তা এবং বহু ব্যবহৃত পথ থেকে দূরত্বে রাখে নিজেকে, পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত যে কোনো ধাঁচ থেকে ব্যবধানে রাখে।
‘‘যবে থেকে স্মরণ করতে পারি
আমার চলার পথে ওরা যে রাস্তা রেখেছে
আমি তা ভুলতে শিখেছি’’

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন