কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০১৪

০৭) স্বপন রায়

পাহাড়ি রায়ের চিয়া



নদী নয়, আড় ভাঙাবার কায়দা. আমি ঝুঁকে দেখছিলাম... রাজা বললো, দাদা জ্যাদা ঝুঁকিয়ে মত্‌ খাড়ি হ্যায়... আমি সরে আসি, নদীকে ভালোবাসলে চাকরির বিকল্প তৈরি হয়, রাজা জানে? আবার ভাবি জেনে কী হবে, কী হবে আমার যে আমি মেঘ-কুয়াশাকে ভাবছি ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের আবছা লভ্যাংশ, মানুষ সেই অসরন্ত কুয়াশাতুর মেঘে আমার লেন্সে ক্রমশ এক চরম আদরে গলে যাচ্ছে! আর একটা মানুষ ভাবছে, চা পেলে মন্দ হতো না! সেই মানুষটা আমি, পাহাড়ি!

অনেক পরে, একেবারে নদীর টাকরায় বসে সে আমাকে বললো, আপনাকে দেখে মনে হয় না যে, আপনি তুলতে পারেন!

-মানে?

-কী রোগা আপনি! তবু কী অনায়াসে তুললেন আমায়...

নদী আড় ভাঙাবার পরেই রাজার কথায় ফিরে আসছিলাম শেয়ার জিপের দিকে, বিকেলের টাচ আর সুচিত্রা সেনের “...টাচ করবে না”র রাগিনীভাঙা জেদ এই বাঁকটায় ছেঁকে দিচ্ছিল মেঘাদৃতা কুয়াশাকে। সে হাসলো। শেয়ার জীপের সহযাত্রিনী। শিলিগুড়ির সিকিম ন্যাশনালাইজড বাসস্ট্যান্ড থেকে আমার পাশে এই নাহাসিফুরনো মেয়েটি, নাম রাত্রি। জোড়থাং যাচ্ছে, তারপর সোমবারিয়া। আর আমি ভারসে। রাস্তা একই, সোমবারিয়াতে আমারো থাকার কথা এক, দুদিন। তো এ সবই মামুলি কথায় আমাদের সময় অবিরত এগোচ্ছিলো। জোড়থাং-এর কিছুটা আগে ধস নামায় এখন আমরা থেমে আছি...

সিকিমে এসে, বারবার এসে আমি কিছু শব্দসমষ্টি জাগাতে পেরেছি! ভাবিত সবুজ, বাঁকপ্রতি সুরেলা পাইন, পালকাঙ্গি, গ্রীবায়ন,মিছরিবিষাদ আলো... ভারসের মাথায় বসে এ সব ভাবছিলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘা কখনো দেখা দিচ্ছে, কখনো বা মেঘের আড়ালে। আপাততঃ এখানে কেউ নেই, আমি একা। দারুণ লাগছে, হাওয়াতে বেশুমার সান্দ্রতা। কাল বৃষ্টি হয়েছিলো, কালই আমি সোমবারিয়া থেকে বাসে হিলে আর হিলে থেকে চার কিলোমিটার ট্রেক করে ভারসের মাথায়। সারা রাস্তা জুড়ে ছিলো অপরিমেয় রডোডেন্ড্রনের উদার মুদারা, বৃষ্টি হঠাৎ করে এসে মাঝে মাঝে হরকতের চূড়ান্ত। আর আমি একাকী এক আজনবী তারানায় প্যাঁচ দিতে দিতে উঠে এসেছি, যেমন আমি করে থাকি পাহাড়ে। একা আসি, হাঁটি, দেখতে থাকি কী ভাবে সম্ভব হয় শীতের চাদরে রাখা এই ফুলেল রসায়ন! সারেগামায় জড়ানো শিখরপিপাসা আমায় ভাঙতে ভাঙতে গড়ে দেয়, আমার রুকস্যাকে লেপ্টে যায় আবার কারো ডেকে ওঠা, কোনো মুখের হাসিতে রাখা ঝুলবারান্দার চাউনি, আমি উঠতে থাকি তবু। আর রাত্রি গাঢ় হয়ে ওঠে সোমবারিয়ার শিহরটানা বাঁকে। আমি কী আর বলতাম, আমার তিরিশ বছরের শরীরে রাত্রি মুছে যাচ্ছে যখন?

আমি ভারসের এই ভোরে এ সব ভাবছি, হঠাতই আবার কাঞ্চনজঙ্ঘা উঁকি মারে! কিন্তু রাত্রি কোথায়, ও কি আসবে? সেদিন জীপ ধসের জন্য দাঁড়িয়ে পড়েছিল, হঠাতই আমি রাত্রিকে বলেছিলাম, নেমে আসুন! আমরা বসেছিলাম পাথরের ওপর, আর আমি রাত্রির শরীরে দেখলাম, আবার দেখতে পেলাম কিছুক্ষণ আগে দেখা সেই আড় ভাঙা নদীটিকে, নদীর ভেতরে যে সব জলস্বছতা থাকে পিচ্ছিল হয়ে, চিকণ শ্যাওলা হয়ে, আমি দেখলাম রাত্রির আনাচে কানাচে এ রকমই কিছু বহতা। যেন ওর অনেক সময় আছে সারাক্ষণ আকাশ বুকে নেওয়ার, বুকে! রাত্রি নড়ে বসলো, আমি তো সে ভাবে কিছু বলিনি, শুধু মুহূর্তের দেখা ওখানে পড়লেই কি এরকম হয়! সিক্সথ সেন্স! আমরা কথা বলতে থাকি, মেঘের স্পঞ্জে শুষে নেওয়া কথায় জড়িয়ে যায় আমার কাজের কথা, রাত্রির শান্তিনিকেতন, ওর মিশনারি স্কুলের চাকরি নিয়ে সোমবারিয়া যাওয়া, আমার পরিবার, ওর মায়ের মৃত্যু... সন্ধ্যা আব্জে ধরে আমাদের, কিন্তু তার আগে আমরা নেমে এসেছিলাম নদীর কাছে... ধসের জন্য আরো কিছুক্ষণ দেরী হতে পারে এটা জেনেই অবশ্য... সেই নদীর ধারে জল অব্দি যাওয়ার আগে ছিল পিচ্ছিল পাথরের অংশ... রাত্রি পড়ে যাচ্ছিল... আমি ওকে ধরে ফেলি... রাত্রি বলে, থাক, জল জলের জায়গায় থাক... আমি মৃদু হেসে ওকে বলি, ডু ইউ ট্রাস্ট মি? ওর মুখ তখনো পড়ন্ত অবস্থায় আমার বুকের কাছে... কিছু বলে না... আমি তুলে নিই ওকে... আর নদীর টাকরায় বসে সে আমাকে বলে, আপনাকে দেখে মনে হয় না যে আপনি এত অনায়াসে তুলতে পারেন!



ভারসের সকালে আমি রাত্রিকে নিয়ে জোড়থাং অব্দি হাঁটার কথা ভাবতে থাকি, সেদিন সন্ধ্যা আব্জে ধরার কারণেই আমরা প্রায় ছুটতে ছুটতে উঠে এসে দেখেছিলাম জীপ নেই। চলে গেছে। আমরা দু’জনে পরস্পরের দিকে তাকাই, হেসে ফেলি। হাঁটতে আরম্ভ করি দূরের জোড়থাং-এর দিকে, আলো জ্বলছে ওই তো!

আমি রাত্রির হাত ধরে নিই একসময়, আমাদের দু’জনেরই কিছু গান ছিল, কাজে লেগে যায়।

সেই রাতে আমি আর রাত্রি জোড়থাং-এ থেকে যাই, আলাদা ঘরে, আমাদের সত্যিই কোনো তাড়া ছিল না। কত সময় নিয়ে আমরা এক স্থানীয় রেস্তোঁরায় চীনে খাবার খেয়েছিলাম। হোটেলে এসে বিদায় নিয়েছিলাম গভীর চোখে তাকিয়ে, না চুমু খাইনি!

সোমবারিয়ায় কিছু একটা আছে, দুটো বাঁকে রাখা ছোট্ট জনপদ। এখানে সবাই গুনগুন করে, আজ সকালে দশটা নাগাদ এখানে পৌঁছেছি। রাত্রি স্থানীয় একটি মেয়ের কাছে ওর স্কুলের খোঁজ নিল নেমেই। আমি তখনো জীপের ভেতরে। একটু পরেই রাত্রি আমায় বললো, ভালো খবর আছে, স্কুলের পক্ষ থেকে এই মেয়েটির বাড়িতেই আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে... সেখানে আপনারও ঘরের ব্যবস্থা হয়ে যাবে...। আমি নেমে এলাম, লাগেজ নামতে হবে। সেই মেয়েটি গাড়ির ড্রাইভারকে বললো, আর একটু এগিয়ে যেতে... রাত্রি উঠে গেল... আমি আর সেই অনতি একুশ মেয়েটি হাঁটতে থাকলাম... মেরা নাম তিলমায়া... আপকা? বললাম... তিলমায়া হাসলো, আপ ক্যা বয়ফ্রেন্ড হ্যায় দিদিকা?... এবার আমি হাসলাম।

“দিল হি ছোটা সা, ছোটি সি আশা...”। আর একটি মেয়ে... মেরা বহেন লিলি... লিলি গুনগুনিয়েই হাসলো... তিলমায়া বললো, লিলি ঘর দিখা দেও দিদিকা... ইয়ে হমারে স্কুল কা নয়া ম্যাডামজী হ্যায়... আউর ইয়ে বলে হাসলো... লিলি কী বুঝলো কে জানে... গান বদলে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে, “প্যার হুয়া চুপকে সে...”

বিকেলে হঠাতই বৃষ্টি হয়ে গেল। থামার পরে আমরা বেরিয়ে এলাম, তিলমায়া দরজার কাছে ছিল। বললো, ক্যায়া দিদি ঘুমনে? রাত্রি হেসে মাথা নাড়লো, আমি ভেবেছিলাম তিলমায়াও গেয়ে উঠবে... গাইলো না, কিন্তু হাসিতে কী ভাবে যেন কিছু গান এরা রেখে দেয়... আমরা বেরিয়ে এসে হাঁটতে আরম্ভ করলাম বাজারের দিকে...

সেদিন রাতে তিলমায়া আর লিলিদের তিনতলা বাড়ির দোতলার ঝুলবারান্দায় আমি রাত্রিকে চুমু খাই। তার আগে বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে সেই শিহরটানা বাঁক এসেছিলো, কেউ ছিল না সেখানে, একটা বন্ধ দোকানঘরের চিলতে বারান্দা ছাড়া... বৃষ্টি আবার... আমরা দৌড়ে ওই বারান্দায় এসে দাঁড়াই... কথা বলতে থাকি... ঠাণ্ডা প্রবল হয়... কাঁপতে থাকা রাত্রিকে আমি আরো কাছে টেনে নিই... এবার শুধু নদী বা জলের আভাস নয়, আমি দেখি বৃষ্টি ওর শ্বাসাঘাতি শরীরে অকাতর হয়ে উঠছে, আমার ফেরারী প্রকৃতি যেন ঝরে পড়ার তাগিদেই এমন বৃষ্টিগন্ধা! রাত্রি আমার বুকের পাটা থেকে উঁকি মেরে বলে, তুমি আমি যা করছি এটাই তো ভালোবাসা... তোমার মধ্যে কী আছে জানি না... বাট আই এম ইন লভ উইথ ইউ...


আমি ওকে আরো কাছে টেনে নিই... রাত্রি অস্পষ্ট হয়ে বলে, আমি তোমায় ঠকাতে পারবো না... আমার লিউকোমিয়া আছে... বছরখানেক আগে আমার ভাইয়ের বোনম্যারো আমাকে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়েছে... আই ডোন্নো হোয়েদার আই এম গোইং টু সারভাইভ অর নট... বাইরে বৃষ্টি আরো ছড়িয়ে পড়ে... আমি ওকে বলি, আমরা এখন বেঁচে আছি... কিন্তু দাঁড়িয়ে আছি কেন? চলো, বৃষ্টি ডাকছে যে!

আর রাতে শুতে যাওয়ার আগে আমি ওর দিকে গভীরভাবে তাকাই... কাছে টানি... চুমু খাই... ও বলে, তুমি কাল ভারসে যাচ্ছো... আমি পরশু যাবো... রবিবার... একসাথে দেখবো কাঞ্চনজঙ্ঘা।

আজ রাত্রি আসবে... একা নয়, একজন গাইড ওকে পৌঁছে দেবে... আসতে আসতে দেড়টা দুটো। আমি আকাশের দিকে তাকাই, রোদ উঠেছে, হাসছে সব কিছু...

--দাদা চিয়া!

চমকে উঠি। চা নিয়ে এসেছে ওয়েট্রেস... ল্যাপটপে টাইপ করা অক্ষরগুলো ঝাপসা দেখাচ্ছে... আমি চা নিয়ে হাসি... সিকিমি মেয়েরা এত হাসতে হাসতে চা দেয় কেন? মনে পড়লো আজ বিকেলে মারাত্মক ভূমিকম্প হয়েছে সিকিমে... আমি ভারসে যাচ্ছিলাম... জোড়থাং-এ কাঁপুনি টের পেলাম ভালো মতোই... প্রথমে বুঝতে পারিনি... তারপর যা হয়... জীপ থেমে গেলো... দৌড়োদৌড়ি। ভাগ্যিস জোড়থাং পৌঁছে গিয়েছিলাম... এই হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে ভাবলাম লিখে ফেলি একটা গল্প, লেখার অনুরোধ আছে, ভালো পয়সাও দেবে... তো লিখছিলাম... এদের জেনারেটর থাকায় এবার টিভি চালিয়ে দিলাম খবর শোনার জন্য... এতো সাঙ্ঘাতিক... নর্থ সিকিম পুরো ধসে গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে... মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে... চারিদিকে হাহাকার... কান্না... শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়িও কাঁপছে... আমার অনেক পরিচিত প্রিয়জনেরা ওখানে থাকে, আর সিকিমের প্রত্যন্তে ছড়িয়ে রয়েছে আমার বন্ধুরা। মন খারাপ হয়ে গেলো... সিকিম আমার প্রিয় জায়গা... কতবার যে এসেছি...

--দাদা চিয়া’কা কাপ লে যাঁউ?

সেই মেয়েটি... ওর চোখ টিভির দিকে...

--ঘর কাহাঁ তুমহারা?

মেয়েটি চাপাস্বরে বললো, নর্থ সিক্কিম... তারপর চায়ের কাপ তুলে নিয়ে হাসার চেষ্টা করলো।

আমার তখনই মনে হলো, পৃথিবীতে কোনো গল্প নেই!

মনে হলো, গল্পের আগে ভাঙা টুকরো সব অপরিনতিগুলো পড়ে আছে, গল্পের উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই আর।

মেয়েটা এই অবস্থাতেও হাসার চেষ্টা করলো... আমি জানি না কী ভাবে... তবে আমি জানি ল্যাপটপের ডিলিট বাটন’টা কোথায়...

শোওয়ার আগে বাটন প্রেস করে ডিলিট করে দিলাম গল্পটা...

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন