কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ২৪ মার্চ, ২০১৪

০৩) অপরাহ্ণ সুসমিতো

ইলতুতমিশ, নবম শ্রেণী ও বসাকপাড়া লেন


বেশি খিদে পায় বলে আমি খেলাধুলা করি না। রাত জাগলেও খিদে পায় বলে রাত জাগি না। তাড়াতাড়ি কাঁথা মুড়ি দিই। আমাদের বাসায় খাবারের খুব অভাব। প্রতিদিন খাবারের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। একবেলা খাবারের পরই স্বপ্ন দেখি আবার কখন খাব।

আমার মা ও বড়বোন দুজনেই আড়ং-এর জন্য সারাদিন নকশীকাঁথা সেলাই করে। ভালো প্যান্ট সার্ট পরা একজন লোক, ইলতুতমিশ হোসেন নাম, একসময় বাসায় এসে নকশীকাঁথা নিয়ে যান, টাকা দেন। কাঁথা সেলাইয়ের জিনিষপত্র দেন। ইলতুতমিশ সাহেব বাসায় এলে মা বড়বোন হেসে হেসে কথা বলে। চা খেতে দেয়, বিস্কুট খেতে দেওয়া হয়, কখনো কখনো সেমাই। লোকটা অবহেলার সাথে খায়। ডায়াবেটিস ডায়াবেটিস বলেও সেমাইটুকু চুকচুক করে খায়। আমি লোভীর মতো তাকিয়ে থাকি লোকটার খাওয়ার দিকে।

লোকটা আমাকে ভ্রুক্ষেপ করে না।

সারাদিন কাঁথার উপর নুয়ে নুয়ে হাতে সেলাই করতে হয় বলে মাকে বোনকে দাঁড়ালেও কুঁজো দেখায়। আমি খিদের কথা বললে মা খ্যাঁক করে ওঠে। বলে, বিষ খা।

অভিমানে আমার গলা বুজে আসে, সত্যি সত্যি যদি বিষ পাওয়া যেত! মরে গিয়ে চোখ বুজে দেখতাম, আমার জন্য মা মাতম কান্না করে কী না!

সাদা কালো একটা বিড়াল আমার সঙ্গী। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে বিড়ালটা আমার কাঁথার উপর কুন্ডুলী করে ঘুমায়। বিড়ালটারও আমার মতো জনমের খিদে। মিউ মিউ করে। বলি –

: চাঁদ খাবি?
: মিউ
: খুব খিদে?
: মিউ
: বাংলাদেশ ব্যাঙ্ক খাবি?
: মিউ

আমার বিড়ালটার নাম নবম শ্রেণী। ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়াশোনা করে আমার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি বলে বিড়ালটার নাম রেখেছি নবম শ্রেণী। খুব প্রিয়। আকার ইঙ্গিত বেশ বোঝে ও।

যেদিন মাঝ রাতে খিদের তীরধনুক খুব তীব্র হয়, সেদিন আলোগোছে দরজা খুলে বাইরের রাস্তায় চলে আসি। জামালপুরে রাত গভীরের রাস্তা সুনসানই থাকে। রাস্তার পাশে একটা বড়সড় পাথর আছে কীভাবে যেন। ওখানটায় বসি। নবম শ্রেণী আমাকে ফলো করে।

কোনো কোনো রাতে চাঁদ মনে হয় কাজী নজরুলের ‘সংকল্প’ কবিতাটি পড়ে, “থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে... দেখব এবার জগতটাকে”, বলে বলে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে।
চিত্র নায়িকা শাবনুরের মতো সুন্দর লাগে গোলগাল চাঁদ। জামালপুরের দুধ-ভাসা চাঁদ। আমি গলা উঁচিয়ে তাকিয়ে থাকি।

আমাকে ছোট একটা প্লেটে ভাত খেতে দেয় মা। আমার একদমই পেট ভরে না। খাবার সময় একদানা ভাতও আমার বাইরে ছিটকে পড়ে না। ভাতের দানা বাইরে পড়লেই মা নবীজীর উদাহরণ দেয়। ভাত ফেললে না কী হাশরের দিন ভাত আমার সামনে থেকে সরে যাবে। আমি হাবিয়া দোজখ ভাত ভাত বলে কান্না করবো, সেই ভাতের দানা আমাকে আঙুল তুলে বলবে --

: তুই আমাকে সেদিন ছুঁড়ে ফেলেছিস কেন? আমি তোর কাছে আসব না।

ভাত খাওয়া শেষ হলে অনেক পানি খাই আমি, যাতে পেট ভরে টলটল করে। খাবার পর আমার নিজেকে ইলতুতমিশ হোসেনের মতো লাগে। পকেট ভর্তি মচমচে টাকা, হাতে অনেকগুলো আংটি, বাবা-জর্দা দিয়ে পান খাওয়া মুখ, সুখী জামালপুর সুখী জামালপুর।

পাথরটার উপর বসে থাকতে থাকতে ঝিম লাগে শরীরে। নবম শ্রেণীর চোখটা আধো আলো অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। চাঁদের প্রবালে ঠিকরে উঠতে উঠতে দেখি সঘন রাতের নির্জন তরাসে, বড় আপু খিলখিল করে হাসতে হাসতে ইলতুতমিশ হোসেনের সাথে হেঁটে হেঁটে বাসার দিকে যাচ্ছে। বড় আপুকে কী সুন্দর লাগছে, যেন বসাকপাড়া সড়কে আলো হেসে পড়েছে আবাবিল পাখির ডানায়।

দয়াময়ী মন্দিরের দেবীর মতো আমি ঠায় পাথরের উপর বসে আছি, নড়তে পারছি না। বড় আপু বাসায় ঢুকে গেল আলসে ঢঙে, ইলতুতমিশ পানের পিক পিচিক করে আমার প্রায় পাশেই ফেললেন। যেন চলে গেলেন চন্দ্রা দিঘির দিকে।

নবম শ্রেণী চাঁদের দিকে তাকাচ্ছে, আমিও।
: নবম?
: মিউ
: খিদে?
: ইলতুতমিশরে খাবি?
: মিউ

চোখ ভিজে যায় চাঁদের যৌবনে। কেন যেন খামোকা ডাকি –

: মা... মা রে...

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন