গ্রীক
মাইথোলজির ইকারুসের মতো মোমের ডানা নিয়ে আকাশ ছুঁতে
চেয়েছিলাম আমি। উড়তে উড়তে ভয়ঙ্কর তাপে সূর্যের
কাছাকাছি আসতেই আমার মোম-পালকের ডানা গলে যেতে থাকে। আমিও জলে
পড়েছিলাম, কিন্তু আমার মৃত্যু হয়নি ইকারুসের মতো। ওই এক কয়েক মুহূর্তের স্বাধীনতাই
আমার জীবনের চালক আজও। আমি ডিদেলাসের মতো রাজ্য থেকে,
বন্দীত্ব থেকে পালাতে চেয়েছিলাম। জীবনের অস্তিত্বের সন্ধানে এক নতুন
আবাসস্থলের খোঁজ আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে সারাক্ষণ। জীবন এমন এক
সমাজ উপহার দিয়েছিল আমায় যা আমায় শিখিয়েছিল কালো মেয়েদের পড়াশোনা করে চাকরি করে বাবাকে পণ-এর গুরুভার
থেকে রেহাই দেওয়াই প্রধান কথা। ভালো মেয়ে মানে
সাদা বর্ণের ‘সুইট’ মুখশ্রী। আর ভালো বিবাহ
মানেই আলাদিনের চিরাগ
হাতে পাওয়া অথবা পাত্রের একটি ভালো চাকরি, মানে সম্মান ও
অর্থের সমান সমান অনুপাত এবং ‘সারটেইনলি’ সে নিজের পিতা
মাতার চেয়ে বিবাহিত স্ত্রী
ও তার পরিবারকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করাটাকে জীবনের
মৌলিক ধর্মগুলির একটি মানতে অভ্যস্থ। সংসার মানে স্বামীর ভালোবাসার কথা প্রচার
করা। দরবারি ঐতিহাসিকদের মতো তাকে ‘গ্লোরিফাই’ করা এবং সে ও
তার পরিবারের নির্যাতনের কথা
বাইরে না বলে সংসারের দড়ি পাকড়ে ‘রেসের এন্ডিং পয়েন্ট’ পর্যন্ত মরে
থাকা। দেহ ও মনে পাথর নামের এক জগদ্দল ‘অবজেক্টে’র আকার নেওয়া।
আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, “আপনি নিজে সংসার, দাম্পত্য, প্রেমের ‘কোর্টে স্ম্যাশড’ খেয়েছেন, তাই কি এমনটা লেখেন?” তারপর জ্ঞানভান্ডার থেকে রত্ন তুলে আমার দিকে ছুঁড়তে থাকেন, “সমাজের সবটা বা সম্পর্কের সবটা ততটা খারাপ নয়”। হয়তো নয়! আমি এমনটা দাবীও করিনি, কিন্তু আমার কথা আমার, আর এই সমাজেই আমার বেড়ে ওঠা। অভিজ্ঞতার ফারাক হয়তো আছে। কিন্তু মৌলিক জায়গাটা সেই ধূসর থাকার কথা।
আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, “আপনি নিজে সংসার, দাম্পত্য, প্রেমের ‘কোর্টে স্ম্যাশড’ খেয়েছেন, তাই কি এমনটা লেখেন?” তারপর জ্ঞানভান্ডার থেকে রত্ন তুলে আমার দিকে ছুঁড়তে থাকেন, “সমাজের সবটা বা সম্পর্কের সবটা ততটা খারাপ নয়”। হয়তো নয়! আমি এমনটা দাবীও করিনি, কিন্তু আমার কথা আমার, আর এই সমাজেই আমার বেড়ে ওঠা। অভিজ্ঞতার ফারাক হয়তো আছে। কিন্তু মৌলিক জায়গাটা সেই ধূসর থাকার কথা।
জীবনে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস
করেছিলাম প্রেমের মানুষদের। তারাই সবচেয়ে বড় ঘাতক হয়ে আমাকে
তরবারির আঘাতে ফালা ফালা করেছে। রক্তাক্ত হয়েছি, কিন্তু কোনো
শিক্ষা নিইনি। গলি, রাজপথ যা সামনে
এসেছে সেই পথেই পা বাড়িয়েছি। আমার আর্থিক অবস্থান আমার প্রতারিত
হওয়ার ক্ষেত্রে ‘ক্যাটালিস্ট’এর ভুমিকা
নিয়েছে। প্রেমে ব্যার্থ হয়ে প্রবল হতাশা থেকে ‘বিলো
ষ্টান্ডার্ড’ পরিবারে বন্ধুত্ব হয়েছে। নানা ছলে আমি
সেখানে ব্যবহৃত হয়েছি। বন্ধু ‘অ্যাপ্লিকেশন’ লেখানোর নামে ‘স্ট্যাম্প
পেপারে সাইন’ করে নিয়েছে। বন্ধুর মা বলেছেন, মেয়েদের চাকরি করে দাও নইলে
তোমার বাবা খুন হবেন। অবুঝের মতো ছুটেছি এদের
পেছনে, যেন বাবাকে না মেরে ফেলে! কী নির্বুদ্ধিতা
আমার! বন্ধু আবার সেই ‘স্ট্যাম্প
পেপার’ নিয়ে বাবাকে দেখিয়ে ‘ব্ল্যাকমেল’ ও ‘কেস’ করার হুমকি
দিয়েছে। জীবনে ‘ক্লাশ কন্সাসনেস’ বা ‘স্ট্যাটাস’
শব্দের প্রতি অবমাননায় আমাকে মূল্য দিতে হয়েছে অনেক। প্রেমের মতো অবান্তর একটি বিষয় আমার জীবন জুড়ে কালবৈশাখী
নামিয়ে এনেছে। আমার প্রতিটি পদক্ষেপে আমায় টলিয়েছে, আমার বুদ্ধির
সব সূক্ষ্মতাকে স্থূল করেছে। সর্বশেষ ‘ক্রশিফাইড’ হই আমি যখন
আমার ২০ লক্ষ টাকার সম্পত্তি খোয়া যায় বিগত ৫ বছরে। সাথে সাথে আমার
চাকরি জীবনে অর্জিত ২০০ গ্রাম পছন্দের সোনার গয়না বাজারে ‘জাষ্ট’ বিক্রী করে
দেওয়া হয়। আমার বিশ্বাস আমায় এ ভাবেই জবাব দেয়। আমি হারতে
থাকি, হারাতে থাকি সব। ফেলে আসা
প্রেমিক, ছেড়ে আসা বন্ধু সবার কাছে উদ্ধারের আশায় হাত
বাড়াই। সকলে মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু এদের
বিপদে আমি প্রাণ দিয়ে লড়েছিলাম। আসলে রাখালের
হাতে রাজতরবারি চিরকাল আমি তুলে দিয়ে এসেছি। তার অপব্যবহারের
কথা আমি একবারের জন্যও ভাবিনি। সেই তরবারি
আমার আত্মা, অস্ত্বিত্ব ভেদ করেছে নিদারুণভাবে। আমাকে আমার
অবস্থান থেকে নামিয়ে এরা বেশ মজা পেত। বড়লোক বন্ধু আমি কেন রাখি? কেন নাচ-গান
করি? কেন ‘পার্লার’ যাই? কেন আমার
লেখালেখি? এ কি পুরুষের সঙ্গলাভের আকাঙ্ক্ষা? আমার গাড়ি চড়া কেন? আমার পোশাক কেন
দামী? এমন নানা বিজাতীয় প্রশ্নের বানে আমি বিদ্ধ হতে
থাকি। আমাকে বোকা বানিয়ে অর্থ ও সুযোগ নেওয়া খুব সহজ
অনেকেই এই ধারণার ভিত তৈরি করে আমার ‘আক্টিভিটিজ’ ও আমার জীবনে ঘটা ঘটনা, আর তা নিয়ে
অলীক সব গল্পের প্রচার। স্মৃতির চাদর নামিয়ে আনলে সব রোদ
সাদা হয়ে যায়। বন্ধুদের নিজের মেনেছি, তারা অনেকেই
মুসলমান বলে উপেক্ষা করেছে। নিজের গোত্রে ঠাই হয়নি। আরবী পড়তে জানি না, নামাজও শিখিনি। গরুর মাংস
জীবনে খাইনি। ভোরবেলা মাইকের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার জন্য
মুসলিম মহল্লা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি। মুসলিম জন্মসূত্রে হওয়ার জন্য যে ক’টি স্তম্ভকে
জীবনে মান্যতা দেওয়া আবশ্যক ছিল, তা মানা তো দূর, বিবাহ অমুসলিমকে
করেছি। সমাজ, পরিবার, বন্ধু, প্রেমিক কেউ
আমার কাছের হয়নি। নিজেকে মেশাতে পারিনি আমি কোনোভাবে।
আকাশ ছোঁয়া আমার হয়নি। শকুনি হায়নার দল ছিঁড়েখুঁড়ে নিয়ে গেছে প্রাণশক্তি। তবু উড়ান আমি ছাড়িনি। মানুষের বহুরূপের সামনে আমি নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে এগিয়েছে। নিচের শেষ সিঁড়িতে এসে আমি সেই ছড়িয়ে পড়া টুকরো ‘মিররে’ নিজেকে চেনার অপেক্ষায়। পেছনের পায়ের নিশান আমি মিটিয়ে ফেলেছি, তাই পেছন ফেরার পথ রুদ্ধ। সামনে, যত সামনে দৃষ্টি যায় আমি আমাতেই হারাতে থাকি। আমার পাশে আমার এই একার লম্বা সফরে সাথী আগুন সূর্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। সন্ধ্যেয় মাথার কাছে রাখা গা ভেজানো আলোভরা চোখে হঠাৎ করে আসা জল কেড়ে নেয় পাতায় পাতায়। জানালার ওপাড়ে তারাদের দল হাতছানি দেয়। জীবন হয়তো সত্যিই অনেক বড়, মহৎ। শুধু আমায় ফাঁকি দেবার অঙ্গীকার ছিল তার।
আকাশ ছোঁয়া আমার হয়নি। শকুনি হায়নার দল ছিঁড়েখুঁড়ে নিয়ে গেছে প্রাণশক্তি। তবু উড়ান আমি ছাড়িনি। মানুষের বহুরূপের সামনে আমি নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে এগিয়েছে। নিচের শেষ সিঁড়িতে এসে আমি সেই ছড়িয়ে পড়া টুকরো ‘মিররে’ নিজেকে চেনার অপেক্ষায়। পেছনের পায়ের নিশান আমি মিটিয়ে ফেলেছি, তাই পেছন ফেরার পথ রুদ্ধ। সামনে, যত সামনে দৃষ্টি যায় আমি আমাতেই হারাতে থাকি। আমার পাশে আমার এই একার লম্বা সফরে সাথী আগুন সূর্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। সন্ধ্যেয় মাথার কাছে রাখা গা ভেজানো আলোভরা চোখে হঠাৎ করে আসা জল কেড়ে নেয় পাতায় পাতায়। জানালার ওপাড়ে তারাদের দল হাতছানি দেয়। জীবন হয়তো সত্যিই অনেক বড়, মহৎ। শুধু আমায় ফাঁকি দেবার অঙ্গীকার ছিল তার।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন