ঢাকা-টরোন্টো
নদী বিষণ্ণ তিরতির বইছে। গাছের পাতা আলতো ছুঁয়ে যখন চুমু এঁকে দিচ্ছে ঢেউয়ের বুকে, আমি ভাবছি বাকলের গায়ে আটকে পড়া আলোর কথা। কারো ছায়া পড়েনি জলে অথচ কেউ এক আঁজলা জল তুলেছিল মুখ ডোবাতে। ওই মুখটুকুই সই, নইলে তলিয়ে যাওয়া। স্কুবাডাইভিং-এর খুব ইচ্ছে ছিল, মনে আছে? বলেছিলাম- ইটস ওয়ান ইন মাই বাকেট লিস্ট। বলিনি? কত কাটাকাটির
সংযোজন-বিয়োজন চলছে। বাদ পড়ে গেছে হয়তো।
আমরা তখন প্রচুর
লিখতাম। সারাটি ঘর বল হাউজের মতো। অসংখ্য সাদা তুষারবল কোমর সমান উঁচু হয়ে আছে। লংশট সরে গেলে দেখি তুষার নয়। দুমড়ে মুচড়ে ফেলা কাগজের বল। স্তুপ স্তুপ কাগজের গোলার মাঝখানে রাত্রি হাঁটুতে চিবুক ঠেকিয়ে আনমনা বসে।কত কী যে তার লেখার ছিল! ফ্র্যাক্টাল প্যাটার্নে কিছু লিখতে চেয়েছিল। সে লেখায় শৃঙ্খলা ছিল না সত্যি আর ছিল না প্রাণও। রিভিউ লুকিয়ে ফেলে বলেছিলে- বিচ্ছিরি আর বাজে সব। ওটা রাত্রি পড়তেই পেল না। ওর গাল থেকে যখন বিষাদ মুছে দিতে গেলে তুমি, বিজন আভাষে কিছু বুঝে নিচ্ছিলাম। রাত্রির খুব ইচ্ছে ছিল সূর্য দেখার। চৌহদ্দি জুড়ে কুয়াশা বিছিয়ে সে চলে গেল, তক্ষুনি এলো সূর্য।
আমিও তো সুর ধরতে চেয়েছিলাম লেখার সীমানা পেরিয়ে। সেই যে বলেছিলে শব্দগুলোকে ম্যাকারেনা নাচ নাচাতে। লিখতে জানলে অক্ষর আশাবরী গাইবে। হলো না। একবুক স্বরলিপি নিয়ে ভোর রাত্তিরে শুধু ধৈবতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ভালো লাগে না প্যারাসিটেমলের অনুশাসন। কেন পাশে বসলে না? তোমার রূপ-গন্ধ-বর্ণেই আমার সেরে ওঠার আশ্বাস। বইয়ের ভেতর রোদ্দুর পাঠিয়ে দিলে, আমি আজো খুলতে পারিনি। সোনালি আভা ছড়ানো সে বই নিয়ে যখন উপুর হয়ে শুয়ে, গলির মোড়ে নেমে আসা আকাশ আর দেখা হয় না। দু’হাতের পাতায় গাল চেপে শুধু ভাবছি- এ জীবন নিয়ে কী করতে হয়? শেখালে না।
তোমাকে যে গতবার
স্বার্থপর বলেছি, এবার তুমি প্রমাণ করেছ। যতবার ফোন বেজে ওঠে তাকিয়ে দেখি তোমার কোনো
বার্তা আছে কি’না। এভাবে শোধ নেওয়া? অতটা অফ? তবে জন্মের মতো আড়ি। আর অন হয়েই কী
হবে? শুনেছি বেলুচিস্তানে স্বাধীনতার আন্দোলন চলছে। পরাধীনতার সব কান্নাগুলো একই মনে হয়। স্বাধীনতার কতটুকু
অর্থপূর্ণ? আরেক দেশের বাণিজ্যিক রাস্তা চালু হয়ে যায় আমাদের ভেতর দিয়ে। রাত্রির মতো তুমি আর আমিও কি তবে নিজেদের দখল
হারিয়ে বিলুপ্তির পথেই হাঁটছি?
************************
************************
তা কেন? তুমি বেশ ঝাঁপ দিলে মেঘমুলুকে। প্যারাগ্লাইড করছ আকাশে আকাশে। হিমকুয়াশায় তবু কেন ঘেমে ওঠো, বুঝি না। শিরশিরে তোমার পায়ের নিচে শ্যামলসুন্দর ভ্যালী। সবুজের ঢেউ নামছে পাহাড় থেকে, বইছে নরম লেকের পাশাপাশি। আমি তখন কই? একা একা দেখলে মাউন্ট এভারেস্ট আর অন্নপূর্ণার
আলো ঠিকরানো স্নোয়ী পিক। পারলে? নেটওয়ার্কের
বাইরে গিয়ে থাকতে? এতগুলো দিন তার কতগুলো
ঘণ্টা? স্বার্থপর আমিই বটে!
আলো দেখছি আমিও, একটি মাত্র দরজা দিয়ে। সামান্য খোলা। গাছের বাকলে সেই যারা আটকে পড়েছিল, নীলচে ঘরে একটু সাদা হয়ে ঢুকছে। আলোর ক্ষীণরেখা মেখে মেঝের দিগন্ত উজ্জ্বল। অসময়ে মৃদু আলো কাঁপে হাওয়ায়। আমি বলেছিলাম- লাইট অফ হোপ। কী ভীষণ হেসেছিলে তুমি! বিষাদ আর আনন্দের সারি সারি স্ট্রীটলাইটের আলো এসে পৌঁছেছিল আমাদের বারান্দা অব্দি। দরজাটা সামান্য খুলেছিল, ভাগ্যিস! নইলে কি দেখতে পেতাম, দেড়খানা মানুষ সমান ল্যাম্পপোস্টের পাশে পার্কের একলা বেঞ্চিটিকে? বেঞ্চির ওপর কী আশ্চর্য ঝিকমিক বিন্দু বিন্দু তুষার চুপচাপ বসে। যেমন জমে থাকে নিরুক্ত কথা। ষ্ট্রীটল্যাম্পের আলোয় কে অমন কথাচূর্ণ ছিটিয়ে দিল, বলো?
এই যে মোবাইল
ফোনে তোমায় নিয়ে ঘুরছি, দিব্যি আছি। নইলে টরোন্টো বহুদূর আর আমি তো দূরেই রইলাম -
মাচ ফার ফ্রমমাইলাইফ। তোমার ক্লাস স্কেজুল, ফ্রায়েড রাইস, ক্যাপাচিনো, আড়ং-এর শাড়ি
থেকেও। এইচ ই সি প্যারিস ইউনিতে আমার পেপার একসেপ্টেড হয়েছে। বেস্ট ইন ইউরোপ। প্যারিস থেকে একটু দূরে। তোমার প্রিয় কবিতা
আর ছবির শহরে যাচ্ছি তুমিহীন। তবে খুব চাপ থাকবে সাত দিনের সেমিনারে। লন্ডন যাবার
ইচ্ছে আছে। আমি ছুটি না পেলে পাভেল ড্রাইভ করে চলে আসবে প্যারিসে। আমি অবশ্য তা চাইছি
না। রুমানার বেবি শাওয়ার হলো গত সপ্তায়। এ
সময় ওর কাছে পাভেলের থাকা দরকার। প্রেজেন্টেশানের আগের মাস পুরোটা জুড়ে ব্যস্ততা
থাকবে। এমনিতেও দিনে রাতে সময় কই? ক্লাস, ল্যাব, পেপার লেখা চলছেই। তবু হঠাৎ কেমন নিঃসঙ্গতা
আঁকড়ে ধরে। মধ্য অটাম এখন সরেনন্টোতে। মনোরম ম্যালাঙ্কোলিক বিকেলগুলোতে কী যেন মিস করি! স্টারবাক্সে
কফির মাগ হাতে নিলেই মনে হয় ধীর পায়ে হেঁটে আসছ
তুমি। এক্ষুনি সামনের চেয়ারটিতে বসবে। এত যে কফি ভালোবাস তুমি! চুমু!
যাক গে, অন্য কথা
বলি। জয় পড়ে পড়ে তো মাথাটি
গেছে। এবার এন্থনি ডোয়ার-এর ‘অল দ্যা লাইট উই কান্ট সি’ আর ক্যারোলিন ভ্যারমালের
‘জর্জ’স গ্র্যান্ড ট্যুর’ পাঠালাম। অসামান্য
দুটো উপন্যাস। কন্টেম্পোরারি। নাম শোনোনি নির্ঘাত। আর পাঠালাম, যা পাঠাবো
বলেছিলাম। দূর নিবাসে চলে যাবার আগে দিয়ে যাব বীজমন্ত্র। ধানের শীষ মুখ তুলে চাইতেই রোঁয়া বুনে দেব আর লুকিয়ে দেখব জল কাদায় কেমন ছপাছপ খেলছ তুমি এবং তোমরা। রোঁয়ার আরেক নাম কাশফুল, জানো তো? চলে এসো, প্লিজ। উপত্যকায় হাত রেখেছ কি আঙুলে পাবে হলুদ হেমন্তের স্পর্শ। সেই যে তোমার দুঃখগুলো,
ম্যাজেন্টা শনপাপড়ি হয়ে মিলিয়ে যাবে মুখে দিতেই। শুধু মিষ্টি আমেজ মন ভরাবে আর
জিভের মাঝখানে গোলাপি আভা কিছুক্ষণ। মাসালা চায়ে চুমুক দিই আপাতত। ডাকছে প্যারিস। তথাগত মোডে যাবার আগে, হাত ধরো, সরোদ কীভাবে ঝরে শেখাই...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন