উত্তরের
হাওয়া
ঝুম,
আবহাওয়া
পালটে গেছে, জানিস! প্রচণ্ড
গরম থেকে শীতল উত্তরে হাওয়া, সাথে প্রবল বৃষ্টি। বারো হাজার পাঁচশো কিলোমিটার দূরত্বে থাকা তোকে যদিও এ কথা জানানো
অর্থহীন।
আমাদের চাইতে ঢের ঢের বেশি শীতের
দেশে তোর বাস। গুগল বলছে- নভেম্বরে তোদের ওখানকার ওয়েদার চার্ট- Average
temperature is cool at 4.7 °C (40.46 °F).
Afternoons
can be a little cool with average high temperatures reaching 7.4 °C (45.3 °F). Overnight
temperatures are generally very cool with an average low of 1.9 °C. তবু তো আমরা কখনো শীতের অপেক্ষা করতাম। এই শীত এসে পড়া দু’জনেরই
খুব পছন্দের ছিল। শীতের পাখিদের মতো
তুই কেন উড়ে আসিস না বল তো! নতুন কাজ পেলি? আগেরবার লিখেছিলি,
জানি হার মেনে নেবার নাম জীবন নয়। কিন্তু হঠাৎ কাজ চলে গেলে এই দেশে কী যে কষ্ট,
কেমন নিরর্থ লাগে এই বেঁচে থাকা...
বাবাও বলতেন, ফাইট ফাইট! লড়ো
নইলে তুমি পিছিয়ে পড়বে। তখন বুঝতাম না। আজকাল মনে হয় এ লড়াই যে কত রকমের হতে পারে!
কাজকে ছুটি দিয়ে (না কি লড়াইকে?)
ক’দিনের জন্য বেরিয়ে পড়েছিলাম রিম্পিদের সাথে উত্তরের দিকে। আনিসের সময় হয়নি এবার।
চারটে দিন হু হু করে কেটে গেল। রিম্পি-মাসুদ আর আমি, কেমন অড নাম্বারিং বল! তবে
সেখানে পৌঁছাবার পর কিন্তু ইভেন হয়ে গেছি। রোজ আঠারো ঘন্টার জন্য আমাদের সাথে জুড়ে গেল মাসুদের বন্ধু শৌভিক। অত
ঢ্যাঙা একটা লোক দেখে প্রথমে কী অস্বস্তি! নতুন কারো সাথে শুরুতে মানিয়ে নিতে
অসুবিধে হয়, তুই জানিস। তবে সে মানুষটা যে একেবারেই অন্যরকম। কথা বলে কম। কিন্তু
যা বলে, খুব স্পষ্ট। সাঁওতাল পল্লীতে ঢুকেই রিম্পির মহুয়ার খোঁজ, এ
ঘর ও ঘর ছুটোছুটি। মাসুদও তাল দিচ্ছিল ওর পিছু পিছু। একপাল শুয়োরের ঘোঁৎ ঘোঁৎ, ভয়ে আমি পিছিয়ে পড়ছি। আর সেই শৌভিক
সেটা খেয়াল করে স্টেপ স্লো করল। বাকি পথ সাথে সাথে...
সাঁওতালদের কী যেন পরব ছিল। পূর্ণিমা। অচেনা বাঁশির সুর। মহুয়া
মাতাল নাচ। আকাশ থেকে তারা ঝরে পড়ছিল এক এক করে। কথা হচ্ছিল খুব কম। কিন্তু ভালো লাগার মোহন জাল ছড়িয়ে গেল। ভেতর ভেতর থরথর। চোখ দেখছিলাম। কী
শান্ত দুই চোখ... না আর কিছু নেই।! ফিরে এসেছি ভ্রমণোত্তর ফ্রেশনেস নয় বরং মুষড়ে পড়া
মনের অনতিক্রম্য দূরত্ব সাথে নিয়ে। মনে পড়ছে বারবার। অপরাধবোধ হচ্ছে। আমার তো আনিস
আছে, তবু কেন এই দোলাচল... এই যে পথ চলতি কাউকে দেখার পর থেকে তাকে ভুলতে না পারা, একে তুই কী বলবি...! ছবি
পাঠালাম উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের। দেখিস।
এই অবধি লিখে জি-মেল ড্রাফট থেকে বেরিয়ে এলো তিশা। বারান্দায় দাঁড়ালো। পাশাপাশি দুটো চেয়ার। ফিরে আসার পর থেকে ফাঁকাই আছে। ঝুমুকে আরো কিছু
লিখবে ভেবেছিল, কিন্তু
অশান্ত খুব। শেষ অবধি আর কিছু না লিখে মেল সেন্ড করে ফেললো। খুব অশান্ত। মনে পড়ছে, ফিরে আসার সময় প্লেনে ওঠার আগ অবধি
তার সেই প্রাঞ্জল
উপস্থিতি। ভাবছিল আনিসের কথাও। বন্ধু হিসেবে, সঙ্গী হিসেবে যে চমৎকার। তবু কেন এমন হচ্ছে... কেন ভুলতে পারছে না সে!
সব মানুষেরই নিজস্ব বিষাদ থাকে। খুব গভীরে ডুব
দিলে তা টের পাওয়া যায়। ফেসবুক বন্ধুত্বে তার আস্থা কম। হয়তো দোলাচলজনিত বিষাদ কাটাতেই আজ ফেসবুকে ঢুকল। ফেসবুক একটা সমুদ্র আসলে। ঝিনুক শামুক কাঁকড়া বা
সামুদ্রিক মাছের মতো এ ও ভুস করে ভেসে উঠছে নিউজফিডে। আর খাবারদাবার ভ্রমণের ছবি দিয়ে নিউজফিড ভরিয়ে ফেলছে। যেন পৃথিবীতে কোনো দুঃখ নেই। হাহাকার নেই।
মৃত্যু নেই। ঝুমের কথা মনে পড়ল আবার ওর। সার্চবক্সে টাইপ করল, ঝুমু খান। খুলে গেল ঝুমুর প্রোফাইল। ছবি ছাড়া এখানেও তেমন কিছু নেই।
ইতিউতি বেড়ানো, দেশে থাকাকালীন কিছু ছবি। স্ক্রল করতে করতে থমকে গেল একটা ছবিতে।
সৈয়দপুর এয়ারপোর্ট, ঝুম আর পাশে দাঁড়ানো এক ঢ্যাঙা পুরুষ। রৌদ্রজ্জ্বল এক সকালে
ঝুমুর হাতে ফুল, পুরুষের চোখে সানগ্লাস। দুজনের হাসিমুখ। মাউস দ্রুত নিচের দিকে
স্ক্রল করল। পেলো না তেমন কিছু। ঘুরে ওর ফটো এলবামে এলো। পুরনো এলবাম ঘাঁটতে
ঘাঁটতে পেয়ে গেল আরও কিছু ছবি, যার কোনোটায় ঝুম সেই পুরুষটাকে খাইয়ে দিচ্ছে বা কোনোটায় দু’জনের হাতের
আঙুল একসাথে করে হাঁর্টশেপের সেলফি। ছিটকে গেল ও...
ছুঁড়ে দেওয়া তীর কি আর ফেরানো যায়? তিশার চারদিকে
হঠাৎ নামছে অন্ধকার। জোর হাওয়া বইছে। কী করেছে ও! তিশার বহু আগেই ঝুম পৌঁছে গেছে যার কাছে তারই কথা সে... বুমেরাং। কোথায় পালাবে এবার... একবার জি-মেল, একবার গুগলিং করে যে মেলটা পাঠানো হয়ে গেছে, তাকে সে উদ্ধার করবে এবার কী করে!
সংযত হতে গিয়ে জল গড়িয়ে নামলো গাল বেয়ে।
অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দু’দিন গুম মেরে বসে আছে তিশা। দু’দিন দাঁতেও কাটেনি কিছু। দু’দিন ঘন্টায় ঘন্টায় মেল চেক, ফিরতি মেলে এই বুঝি ঝুম তর্জনী তুললো। দু’দিন পর রাত্তিরে সে সামান্য ধাতস্থ। ফেসবুক আর
খুলছে না সে। মেসেঞ্জারে ঢুকেছে। তেমন কোনো মেসেজ তো আসে না, অনিয়মিতকে ফেসবুকাররা
মনে রাখে না কী! কিন্তু অবাক হয়ে দেখলো, নিউ মেসেজ নোটিফিকেশন বলে একটা কিছু বোল্ড হয়ে তার অপেক্ষায় আছে। খুলবে? না থাক। কে না কে...!
বন্ধ করতে গিয়ে আবার ক্লিক করে ফেললো নিউ
মেসেজে। ঠিক চারদিন আগের মেসেজ।
‘কেউ কেউ চলে গেলে চারপাশ কেমন ফাঁকা হয়ে আসে।
খুঁজছিলাম। পেয়েও গেলাম। বলা হলো না, বহুদিন ধরে খুঁজে গেছি, আপনাকেই’।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন